• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ঘরে আগুন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু নিপীড়নের নাটক! 

  নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ জুলাই ২০১৯, ১৭:০৭
প্রিয়া সাহা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রিয়া সাহা (ছবি : সংগৃহীত)

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও হিন্দু বাড়িতে আগুন দিচ্ছে মুসলিম মৌলবাদীরা বলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার দেওয়া অভিযোগকে মিথ্যা অপপ্রচার বলে দাবি জানিয়েছেন তার এলাকার স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামের স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে সীমানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে দুপক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। দুই পক্ষের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের। চলতি বছরের শুরুতে চরবানিয়ারীতে প্রিয়া সাহার ভাই জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাসের একটি অব্যবহৃত ঘরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

তার আগের দিন অপর পক্ষের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ দুটি পক্ষের একটিতে রয়েছে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান শামীম ও অপর পক্ষে রয়েছেন প্রিয়া সাহার পরিবার। এলাকায় এ দুই পক্ষের মধ্যে রয়েছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য।

প্রিয়া সাহার এলাকার স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি, প্রিয়া সাহার ভাইয়ের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি সাজানো। মূলত অপর পক্ষের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে কাউন্টার মামলা দেবার জন্য জগদীশ সাহার ঘরে আগুনের ঘটনা সাজানো হয়।

স্থানীয়রা আরও জানান, এ বিরোধ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জায়গা জমি নিয়ে। এখানে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই। প্রিয়া সাহা দেশের বাইরে গিয়ে যে মিথ্যাচার করেছে তা অন্যায়।

ফেসবুকে প্রিয়া সাহার ঘরে আগুন লাগার সাম্প্রদায়িক উস্কানি

এদিকে প্রিয়া সাহার ঘরে আগুন লাগার ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে অনেকেই অপপ্রচার চালিয়েছেন। বসু চাকমা জুম্মা নামে ফেসবুকের এক পেইজ থেকে এ ধরনের ছবি পোস্ট করে অপপ্রচার চালানো হয়। এরপরই ছবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পরে এবং অনেকেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্ট করেন।

মূলত ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য রাষ্ট্রবিরোধী এমন অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন এমনটিই মনে করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও পিরোজপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। মন্ত্রী বলেন, প্রিয়া বালার বক্তব্য অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নষ্টের উষ্কানিমূলক অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রসঙ্গত, প্রিয়া সাহা ওরফে প্রিয় বালা বিশ্বাস (৫৪) পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের চরবানিয়ারী গ্রামের মৃত নগেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের মেয়ে। প্রিয় বালার স্বামী মলয় কুমার সাহা দুদকের সদর দপ্তরে সহকারী উপপরিচালক পদে কমর্রত রয়েছেন। তার দুই মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা সাহা ও ঐশ্বর্য সাহা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করেন। ‘শারি’ নামে বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায় নিয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক হলেন প্রিয়া সাহা ওরফে প্রিয় বালা বিশ্বাস। তিনি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দলিত কণ্ঠ’ নামক একটি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক।

প্রিয়া সাহার বক্তব্য ব্যক্তিগত অভিমত : রানা দাশগুপ্ত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে দেওয়া প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে তার ব্যক্তিগত অভিমত বলে দাবি জানিয়েছেন তার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, প্রিয়া সাহা যা বলেছেন এগুলো তার ব্যক্তিগত মত, সংগঠনের নয়।

তিনি বলেন,"যে 'ডিজঅ্যাপিয়ার' কথাটির সাথে তিন কোটি ৭০ লক্ষ যে সংখ্যা বলেছেন প্রিয়া সাহা - সেটা সত্য নয়। তবে দেশভাগের পর এখানে সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা ছিল ২৯.৭ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ সালে সেটা এসে দাঁড়ায় ৯.৭ শতাংশে।"

রানা দাশগুপ্ত বলেন, “এটাকে অর্থনীতিবিদেরা বলেন 'মিসিং পিপল' মানে হারিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী। কিন্তু 'ডিজঅ্যাপিয়ার্ড' মানে নিখোঁজ বা গুম। এখন এই শব্দ দিয়ে প্রিয়া কী বলতে চেয়েছেন, সেটা তিনিই জানেন।”

এদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের 'উধাও' হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সমালোচনা হলেও, বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দুদের একটি বড় অংশ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, সেটি একটি বাস্তবতা।

তারা বলছেন, ১৯৪৭ সালের পর ২০১১ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা যে ১৮ শতাংশ কমে গেছে বাংলাদেশে সেটি পরিসংখ্যানগত বাস্তবতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ঈশানী চক্রবর্তী বলছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষের দেশত্যাগ করা নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশত্যাগ বিভিন্ন সময় ঘটেছে, এটা মিথ্যা নয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সেরকম কোন গবেষণা নেই। কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নানা সময়ে দেশত্যাগ করেছেন সেটা তো বাস্তবতা।

তিনি আরও বলেন, মূলত দুটি কারণে এই দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। প্রথম কারণ অর্থনৈতিক, সেটা বুঝতে কোন পরিসংখ্যান লাগে না। আর দ্বিতীয় কারণ অনিশ্চয়তা, যেটা সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে সব সময়ই থাকে।

ঈশানী চক্রবর্তী বলেন, এই অনিশ্চয়তার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে দেশের এ পর্যন্ত কোন সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার হয়নি। সেক্ষেত্রে এ অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য সরকারের আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের উত্থান

বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ একটি অলাভজনক সংগঠন, যা বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনটি ১৯৭৫ সালে ঢাকায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল চিত্ত রঞ্জন দত্ত প্রতিষ্ঠা করেন। চিত্ত রঞ্জন দত্ত এটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯৮৮ সালে। ১৯৮৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনের মধ্য দিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করা হয়।

ঐদিনই ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়, যদিও ঘোষণা এসেছিল কিছু দিন পরে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ৯ জুনকে কালো দিবস হিসেবে পালন করেছিল। পরবর্তিতে ১৯৯০ সালে উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশি সংখ্যালঘুরা নিউ ইয়র্কে ঐক্য পরিষদের একটি বিভাগ খোলেন। ২০০৫ সালে টরন্টোতে কানাডিয়ান শাখা গঠন করা হয়েছিল। এটি ফ্রান্সের মত ইউরোপীয় দেশগুলিতেও এর শাখা রয়েছে। এই দাতব্য সংস্থার তহবিলের উৎস হচ্ছে সদস্যদের এবং সরকারের দান।

নাগরিকত্ব পেতে যুক্তরাষ্ট্রে মিথ্যাচার

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের নাটক সাজিয়েছেন প্রিয়া সাহা বলে অভিযোগ করেছেন সচেতন ছাত্র সমাজ।

শনিবার (২০ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে প্রিয়ার বাসার সামনে ‘সচেতন ছাত্র সমাজ’ ব্যানারে প্রথমে ২০ থেকে ২৫ জন মানববন্ধন করেন। পরে তার বাসায় তালা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেও তবে শেষ পর্যন্ত তালা দেননি।

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষানবীশ আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম বলেন, প্রিয়া সাহা সংখ্যালঘুদের কথা চিন্তা করে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন। তার দুই মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তাদের নাগরিকত্ব পেতেই ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছেন তিনি। মার্কিন অভিবাসন নীতি অনেক কঠিন। তাই মিথ্যাচার করে নিজের দুই মেয়ের নাগরিকত্ব নেওয়ার পথ পরিষ্কার করছেন এ নারী।

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ -খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এ প্রিয়া সাহা। তিনি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘শারি’-এর নির্বাহী পরিচালক। এটি বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দলিত কণ্ঠ’ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকও। তিনি পিরোজপুরের মেয়ে। তার স্বামী মলয় কুমার সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা। তাদের দুই মেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন।

ধানমন্ডিতে প্রিয়ার বাসার সামনে মানববন্ধনে অংশ নেন শুভ অধিকার। তিনি বলেন, আমাদের দেশ বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আমরা সকল ধর্মের লোক মিলেমিশে বসবাস করছি। প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে এদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু হত্যা ও গুমের নালিশ করেছেন। আমরা তা মানতে পারিনি। তাই আমাদের অবস্থান জানাতে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়েছি।

ওডি/এআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড