নিজস্ব প্রতিবেদক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ‘বাংলাদেশি সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন’ বলে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়েছে।
রবিবার (২১ জুলাই) ঢাকা মহানগর হাকিম জিয়াউর রহমানের আদালতে প্রথমে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। পেনাল কোডের ১২৩ (এ), ১২৪ (এ) ও ৫০০ ধারায় মামলাটি আমলে নেওয়ার জন্য ব্যারিস্টার সুমন আদালতে আবেদন করেন।
অন্য দিকে একই অভিযোগে ঢাকা বারের কার্যনির্বাহী সদস্য ইব্রাহীম খলিল তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সুফিয়ান নোমানের আদালতে দণ্ডবিধি ১২৪ (ক) ধারায় তিনি মামলাটি করেন।
এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যাচার করার অভিযোগে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার ঘোষণা দিয়ে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন জানান, মামলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। রবিবার প্রথম প্রহরেই মামলা করা হবে।
শুক্রবার রাতে ফেসবুক পেজে দেওয়া ভিডিও বার্তায় ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘ট্রাম্পের নিকট প্রিয়া সাহা যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটি পুরোপুরি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। উনি বলেছেন, প্রায় তিন কোটি ৭০ লাখ মাইনরিটি মানুষকে বাংলাদেশে গুম করে দেওয়া হয়েছে। বাকি যারা আছে তারাও নাকি গুম হওয়ার পথে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের একজন নাগরিক হয়ে আমেরিকার মতো জায়গায় গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য উনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, আমি মনে করি এটা শুধু ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না; এটা রাষ্ট্রদ্রোহের এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এজন্য আমি ব্যারিস্টার হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি রবিবার কোর্ট খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে মামলা করবো।’
দুদকের একজন কর্মকর্তার স্ত্রী হয়ে কীভাবে বললেন, উনার সব জায়গা জমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রশ্ন তুলে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা একটা চক্রান্ত ও পুরো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং এই রকম ষড়যন্ত্রে আমরা বসে থাকতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি উদাহরণ। যেখানে আমাদের মাইনরিটি ভাইদের বিপদ হলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। মুসলমানদের নামাজে হিন্দু ভাইয়েরা পাহারা দেন। যেখানে হিন্দু ভাইদের বাসায় গিয়ে আমরা দাওয়াত খাই। তারপরেও আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। আমি মনে করি এটা ষড়যন্ত্র।’
এজন্য প্রিয়া সাহাকে বাংলাদেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করা ফরজ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ব্যারিস্টার সুমন। তিনি জানান, মামলা করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ জুলাই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ২৭ ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে ১৬টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহাও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই।
এরপর তিনি বলেন, এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর হারিয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।
ভিডিওতে দেখা গেছে, এক পর্যায়ে ট্রাম্প নিজেই সহানুভূতিশীল হয়ে ওই নারীর সঙ্গে হাত মেলান। কারা এমন নিপীড়ন চালাচ্ছে? ট্রাম্পের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘দেশটির মৌলবাদীরা এসব করছে। তারা সবসময় রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে।’
প্রিয়া সাহার দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির বহু উদাহরণ সোশ্যাল মিডিয়া তুলে ধরছেন নেটিজেনরা।
৭১ এর চেতনায় গঠিত যে দেশে সব ধর্মের নাগরিক সমান অধিকারে সহাবস্থান করে বিশ্বে অসাম্প্রদায়িকতার মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে সেই দেশ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে প্রিয়া সাহার এমন বক্তব্য কখনোই মেনে নেওয়ার মতো নয় বলেও অভিমত দিচ্ছেন সচেতনরা।
প্রিয়া সাহার বক্তব্যে রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া
সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার নালিশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
শনিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের উদ্দেশ্যেই প্রিয়া সাহা এই ধরনের বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ করেছেন।”
শনিবার আওয়ামী লীগের এক সভা শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের বিরুদ্ধে অসত্য, দেশদ্রোহীমূলক বক্তব্য দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেন, “এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, প্রক্রিয়া চলছে।”
একই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে করা অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে শুক্রবার বিকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশি নারী সংখ্যালঘুদের নিয়ে যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তা সঠিক নয়।
একই দিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে প্রিয়া সাহা কেন এমন বিতর্কিত মন্তব্য করলেন তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রিয়ার এই বক্তব্য শুনে শাহরিয়ার আলম ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, আমি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থায় একাধিকবার ভরা হাউসে পৃথিবীর সব দেশের এবং বাংলাদেশ ও বাইরের দেশের এনজিওদের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। যেখানে শ্রদ্ধেয় রানা দাশ গুপ্তর মতো মানুষেরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দেওয়া প্রিয়া সাহার অভিযোগের মতো কোনো অভিযোগ বা প্রশ্ন কাউকে করতে দেখিনি।
প্রিয়ার বক্তব্যে তার এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগের পেছনে প্রিয়া সাহার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ অর্জনের চেষ্টা রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার নিজ বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামের স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের দাবি, প্রিয়া সাহার বক্তব্য সঠিক নয়। জায়গা জমি নিয়ে বিরোধের ঘটনাকে সংখ্যালঘু নির্যাতন বলে অপপ্রচার করেছেন তিনি।
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামের স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে সীমানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে দুপক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। দুই পক্ষের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের। চলতি বছরের শুরুতে চরবানিয়ারীতে প্রিয়া সাহার ভাই জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাসের একটি অব্যবহৃত ঘরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
তার আগের দিন অপর পক্ষের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ দুটি পক্ষের একটিতে রয়েছে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান শামীম ও অপর পক্ষে রয়েছেন প্রিয়া সাহার পরিবার। এলাকায় এ দুই পক্ষের মধ্যে রয়েছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য।
স্থানীয়দের দাবি, প্রিয়া সাহার ভাইয়ের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি সাজানো। মূলত অপর পক্ষের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে কাউন্টার মামলা দেবার জন্য জগদীশ সাহার ঘরে আগুনের ঘটনা সাজানো হয়।
স্থানীয়রা আরও জানায়, এ বিরোধ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জায়গা জমি নিয়ে। এখানে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই। প্রিয়া সাহা দেশের বাইরে গিয়ে যে মিথ্যাচার করেছে তা অন্যায়।
মূলত ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য রাষ্ট্রবিরোধী এমন অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন এমনটিই মনে করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও পিরোজপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। মন্ত্রী বলেন, প্রিয়া বালার বক্তব্য অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নষ্টের উষ্কানিমূলক অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওডি/এআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড