• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের দুর্বলতা আরাকানে! 

  আয়াজ উর রাহমান

২৪ জুন ২০১৯, ১২:১৪
চীন-বাংলাদেশ
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন-বাংলাদেশ (ছবি : সম্পাদিত)

দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভুগছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের বিপুল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্যে সন্ত্রাসবাদের মতো বড় হুমকি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখছে ঢাকা। এই আঞ্চলিক বাণিজ্যে অন্যতম স্বার্থ রয়েছে এশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র চীনের। আর এই বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই পাঁচ দিনের সফরে চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মুসলিম বিশ্বের কাছ থেকে ইতোমধ্যেই সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে আঞ্চলিক সংকট নিরসনে বাংলাদেশের একমাত্র ভরসা প্রতিবেশী ভারত এবং চীন। এই দুই রাষ্ট্রের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। তবে আঞ্চলিক বাণিজ্যের স্বার্থে মিয়ানমার ভারত এবং চীন দুই দেশের কাছেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি রাখাইন বা আরাকান রাজ্য খনিজ সম্পদের ঘাঁটি বলে এই জায়গায় চীনের বিশাল বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রতিবেশী ভারতের জোরালো ভূমিকার অপেক্ষায় বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক সহযোগী রাষ্ট্র চীনের কাছ থেকেও মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ চাচ্ছে ঢাকা। তবে এখন পর্যন্ত চীনের কাছ থেকে মৌখিক আশা পেলেও তেমন কোনো সবুজ সঙ্কেত পাওয়া যায়নি।

রোহিঙ্গা ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী পহেলা জুলাই পাঁচ দিনের সফরে চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইতিবাচক সংকেত মিলবে চীনের কাছ থেকে এমন প্রত্যাশাই করছে বাংলাদেশ।

রবিবার (২৩ জুন) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ দিনের অবস্থানের ফলে এ অঞ্চলে ‘মৌলবাদ ও অনিশ্চয়তা’ সৃষ্টির জন্য নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে বেইজিংকে জানাতে চায় বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গা ইস্যুকে ঘিরে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যদি রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘদিন ধরে সমাধানহীন অবস্থায় থেকে যায়, তাহলে এ অঞ্চলে মৌলবাদের উত্থান হতে পারে। যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়, পুরো অঞ্চলে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।’

এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের মতো সংকট তৈরি হলে নিজেদের প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনে চীন সমস্যায় পড়তে পারে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন।

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় প্রাধান্য পাবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘চীন মিয়ানমারে অনেক বিনিয়োগ করছে। তারা বাংলাদেশেও বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এ অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা না থাকলে বিনিয়োগ কোনো কাজে আসবে না। আমরা চীনকে এটা বোঝাব।’

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের ভালোর জন্য এ অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পুনরায় সক্রিয় করার ব্যাপারে বেইজিং মিয়ানমারকে চাপ দেবে। এদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরানোর ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ এবারের বেইজিং সফরে নিজেদের ‘কৌশলগত অংশদারিকে’ নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ ও চীন।

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিংপিংয়ের ঢাকা সফরে চীনের নেওয়া উদ্যোগ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়। এই বিআরআই কাঠামোর মাধ্যমে চীন নিজেদের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায় এবং সেই সঙ্গে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে চায়।

তবে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কে আঘাত আসার মতো কোনো পদক্ষেপে চীন যাবেনা এমনটাও আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া রাখাইনে চীনের বাণিজ্যিক স্বার্থও রয়েছে। সেক্ষেত্রে চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কতটা সহযোগী হবে এটাও জানার বিষয়।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যেখানে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি রয়েছে সেখানে চীনের বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে বলে ইতোমধ্যেই খবর প্রকাশ হয়েছে। যার ফলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার কারণে বিশ্বব্যাপী দেশটি যখন সমালোচনার মুখে, তখন ইয়াঙ্গুনকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে প্রতিবেশী দেশ চীন। মিয়ানমারের প্রতি বেইজিংয়ের এ নিরঙ্কুশ সমর্থনের নেপথ্যে রয়েছে সহিংসতাকবলিত রাখাইন রাজ্যে চীনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।

রাখাইনের তেল, গ্যাস ও বন্দর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। এএফপি জানায়, সংঘাতকবলিত রাখাইন রাজ্য চীনের বিনিয়োগের জন্য যেন এক চুম্বকক্ষেত্র। গত ৫০ বছর ধরে সেনাশাসনের কারণে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর বেশ কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যার বেশিরভাগই ২০১৫ সালে একটি নির্বাচনের পর তুলে নেয়া হয়।

তবে মিয়ানমারের সঙ্গে সবসময়ই বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছে চীন। এমনকি ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সামরিক জান্তা সরকারের অধীনে দেশটিতে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে।

সিনহুয়া নিউজ জানিয়েছে, এ বিনিয়োগের প্রধান অংশই দেশটির তেল-গ্যাসের খনি ও জ্বালানি খাতে। এ সময় ধরে সেনা সরকার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অস্ত্রশস্ত্রও সরবরাহ করেছে চীন। জাতিসংঘ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৭ লাখ শরণার্থীকে খাদ্য সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন অব্যাহত থাকলেও তারা প্রায় ৭ লাখ শরণার্থীর খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।

বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির উপ-প্রধান দ্বীপায়ন ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে বলেন, জাতিসংঘের সব সংস্থা একত্রে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, মানবিক সহযোগিতা কর্মসূচি থেকে কেউ বাদ যাবে না।

এসব বিষয়ে মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চীনের দুটি স্বার্থের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এর একটি হলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার পক্ষে তাদের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি - যার পাশাপাশি চীন চায় যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অন্য কোন দেশ হস্তক্ষেপ না করুক।

"আর অপরটি হচ্ছে, তাদের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থ - যার মূল কথা: তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আরেকটি স্থলপথকে অক্ষুণ্ণ রাখা।"

চীনের এই নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে ড. আলি বলেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা ২০১৭ সাল থেকেই বলে আসছে যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সরকারকেই আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান করতে হবে - বাইরের কোন শক্তির হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না, কারণ তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, চীনের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। তিব্বত বা শিনজিয়াং - এই দুই প্রদেশের অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোক বাস করে এবং তাদের সাথে বহু দশক ধরে চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান সম্প্রদায়ের সংঘাত চলছে। চীন সরকার এই অঞ্চলগুলোকে শান্ত করার জন্য বেশ কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

এ নীতি দেখিয়েই তারা চাইছে, অন্য দেশগুলো চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক। এটা হচ্ছে একটি দিক। অন্য আরেকটি বিষয় ভুললে চলবে না যে বহু দশক ধরে মিয়ানমার চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। এর অনেক কারণ - তবে একটির কথা আমি বলতে চাই।"

সৈয়দ মাহমুদ আলির কথায়, "গত দু দশক ধরে চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হচ্ছে। সেই বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সাথে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট।"

"এখন বাণিজ্য পথ খোলা রাখার জন্য চীন যদি সেখানে নৌবাহিনী পাঠায় - তাহলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে - যাকে বলে চীনের মালাক্কা ডাইলেমা।"

"সেই মালাক্কা সংকটের কথা মাথায় রেখেই চীন স্থলপথে বিভিন্ন পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এবং গ্যাস যাতে চীনে পৌছাতে পারে- তার ব্যবস্থা করেছে। এরকম দুটি পাইপলাইন আরাকান রাজ্যের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছেছে।

ভারতেরও এ ধরণের বিনিয়োগ রয়েছে কালাদান এবং সিটওয়ে বন্দরে - কিন্তু চীনের অর্থনীতির জন্য এ দুটি পাইপলাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই চীন চাইছে না যে মিয়ানমার সরকার যেন আরাকানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়, বা আরাকানকে কেন্দ্র করে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক খারাপ হোক।

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার চীনের যে নীতি - তার সূচনা কিভাবে হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে ড. আলি বলেন, তিব্বতে ১৯৫৪ সালে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল - যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত তখন তিব্বতী যোদ্ধাদের সমর্থন দিচ্ছিল। সেই যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্য নিয়ে চীন এবং ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাঁচটি আদর্শের কথা বলা হয়েছিল। তার প্রথমটি ছিল - কোন দেশই অন্য কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। জাতিসংঘের সনদেও এমনটা লেখা আছে।

"১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং-এ আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশগুলোর এক সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়। সেখানেও বলা হয়েছিল, এই আদর্শগুলোকে অনুসরণ করেই জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোকে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। চীন আনুষ্ঠানিকভাবে এই পাঁচটি নীতিমালা এখনো বজায় রেখেছে, সেকারণেই তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে চাইছে না। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।"

তাহলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আসল চাবিকাঠি কার হাতে এমন প্রশ্নের জবাবে জবাবে সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, লক্ষ্য করার বিষয় যে অন্য ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও রোহিঙ্গা বা মিয়ানমার বিষয়ে তাদের নীতি মোটামুটি একই রকম।

তিনি বলেন, "বাংলাদেশ যদি আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে এ সংকটের সমাধানে আগ্রহী হয় - তাহলে আমার মনে হয় বাংলাদেশের দুটি বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও চীন - এই দুই রাষ্ট্রের সহযোগিতার মাধ্যমেই মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করা সম্ভব।” কিন্তু ভারত এবং চীনকে বাদ দিয়ে এ সংকটের সমাধান সম্ভব বলে আমার মনে হয় না - বলেন তিনি।

চীন-বাংলাদেশ স্বার্থ

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যে বর্তমানে বড় ঘাটতি রয়েছে। চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে প্রায় ৫০০ পণ্যের ওপর বিনা শুল্কে রপ্তানির সুবিধা প্রদান করেছে। এর ফলে রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হার কয়েকগুণ বাড়লেও অঙ্কের হিসাবে তা একেবারেই কম। বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে তাতে তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি।

চীন বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। কেউ কেউ অবশ্য চীনকে আমেরিকার আগে স্থান দিয়ে থাকেন। সমগ্র বিশ্বে চীনা পণ্যের আগ্রাসন সর্বজনবিদিত। আর তাই বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থা চালু হলে আরও বেশি চীনা পণ্যের বাংলাদেশে প্রবেশের ভয় অমূলক নয়। আর বাংলাদেশের পণ্যের ঝুড়িতে পণ্যের বাহার খুব কম বলে তা রফতানি করে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে, এমন ভাবা যায় না।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্যের বিষয়টি বিবেচনা করার আগে আমাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আগামী গতি-প্রকৃতি, চীনা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি ছাড়াও আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়াবলি মাথায় রাখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে চীনের অর্থনীতির তুলনা করা অবান্তর। তবে চীনের বিশাল বাজার তথা প্রায় ১৪০ কোটি লোকের দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সন্ধান করাটা অবান্তর নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্যের বিষয়টির সঙ্গে বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোকের এবং চীনের ১৪০ কোটি লোকের বাজার তত্ত্বটি বিবেচনায় আনা যায়।

চীনের যেমন বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাজারের দিকে দৃষ্টি রয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি বাংলাদেশকেও চীনের প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটা বিশাল বাজারের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান আমদানির এক-চতুর্থাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে চীনের। দেশটি বাংলাদেশের আমদানির সর্ববৃহৎ উৎস।

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ২০০৩ সাল থেকে চীনের বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার শুরু হয়। চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক সম্প্রসারণের প্রচেষ্টার পাশাপাশি এতদঞ্চলে বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও শুরু করে। এক হিসাব অনুযায়ী ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সালে চীনের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশসহ মালদ্বীপ, ভুটান ও শ্রীলংকার বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ছয়গুণ বৃদ্ধি পায়।

একই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪ গুণ। অর্থাৎ এই অঞ্চলে চীন বিশেষ দৃষ্টি দেয় যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এই ৫টি দেশের চীনের পণ্যের ওপর নির্ভরতা ২০০৩ সালে যেখানে ছিল ১৫ শতাংশ সেটি ৮ বছর পর তথা ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ শতাংশে।

চীন প্রথমদিকে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে মৈত্রীসুলভ সহযোগিতা করলেও তা পরবর্তী সময়ে লাভজনক বিনিয়োগের দিকে মোড় নেয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র ও ৭টি মৈত্রী সেতু নির্মাণের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে চীনের বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ পাচ্ছে।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাবে যে, ১৯৯৭-৯৮ ও ২০১২-২০১৩-এর মাঝে বাংলাদেশে চীনের রফতানি বেড়েছে প্রায় দশ গুণ। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশে চীনের রফতানি ছিল ৫৯২.৪৬ মিলিয়ন ডলার কিন্তু ২০১২-১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬৩০০ মিলিয়ন ডলারে। আবার বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি বেড়েছে ১০.৫৯ গুণ।

১৯৯৭-৯৮ সালে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার। ২০১২-১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮ মিলিয়ন ডলার। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের আমদানি-রফতানি অনুপাত হচ্ছে প্রায় ১:১৪। ২০০৮-৯-এ কিন্তু এই অনুপাত ছিল ১:৩৫, যা সর্বোচ্চ। আবার ভিত্তি বছর তথা ১৯৯৭-৯৮ সালে এট ছিল ১:১২। বাংলাদেশে চীনের রফতানি ৫৯২ থেকে ৬৩০০ মিলিয়নে উন্নীত হলেও একই সময়ে চীনের আমদানি বেড়েছে ৪৯ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪৫৮ মিলিয়ন ডলারে।

সাধারণভাবে এটা ধরা যায় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি স্বল্পমেয়াদে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কেননা বাংলাদেশে চীনা পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যদি শুল্কমুক্ত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীন থেকে আরও বেশি পণ্য আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়বে, ফলে স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশ থেকে চীনে পণ্য রফতানির চেয়ে চীন থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।

বাংলাদেশ তার আমদানির এক-চতুর্থাংশ চীন থেকে সম্পাদন করে বলে আমদানি শুল্ক থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ে কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তা অবশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়। কেননা চীন থেকে আমদানিকৃত অনেক পণ্যে বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি অনুযায়ী শূন্য শুল্প বিদ্যমান। বিশেষ করে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল বন্ডেড ওয়্যার হাউসের মাধ্যমে শূন্য শুল্কে আমদানিকৃত হয়ে থাকে।

তবে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে অন্যরকম ফল আশা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে মজুরির হার কম বলে পণ্য উৎপাদন খরচ কম এবং পণ্যমূল্য কম থাকার কারণে চীনে এ দেশের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে, তাছাড়া চীনা উদ্যোক্তারা বিনা শুল্কে প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করে তা প্রক্রিয়াজাত করে চীনে কিংবা অন্য কোনো দেশে রফতানি করার সুযোগ পাবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভিয়েতনাম বছরে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে থাকে, যার বেশিরভাগই উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য এবং এই প্রযুক্তির বিকাশে চীন ভিয়েতনামকে সহযোগিতা করেছিল। এই উচ্চ প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হলে চীনের উদ্যোক্তারা তাদের উচ্চ প্রযুক্তি বাংলাদেশে স্থানান্তর করে আবার চীনে রফতানি করতে উৎসাহিত হবে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এই খাতে একটি দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়তা করবে।

তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও চীনের বাজারে প্রবেশ করার বিষয়ে দ্রুত সক্ষমতা অর্জন করবে এবং সেখানে তাদের উপস্থিতি শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

চীনে বাংলাদেশের পোশাকের বাজারের সম্ভাবনা ব্যাপক। চীনের বস্ত্র ও পোশাকের বাজারকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাজার হিসেবে মনে করা হয়। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ২০০০ সালে চীনে যেখানে জনপ্রতি বস্ত্রের ব্যবহার ছিল ৪.১ কেজি সেখানে ২০০৮ সালে তা ২০.৩ কেজিতে পৌঁছে। ২০০১ সালে চীনে যেখানে জনপ্রতি পোশাক ক্রয়ে ব্যয় ছিল শহরাঞ্চলে আরএমবি ৫৩৩.৬৬ এবং গ্রামাঞ্চলে আরএমবি ৯৮.৬৮; কিন্তু ২০০৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাম দাঁড়ায় যথাক্রমে আরএমবি ১২৮৪.২ এবং ২৩২.৫-এ।

মজার বিষয় হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশসমূহ থেকে চীন ২০০৯ সালে মোট প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের বস্ত্র ও পোশাক আমদানি করেছিল, যার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল সর্ববৃহৎ রফতানিকারক। বাংলাদেশ থেকে চীন একই সময়ে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারের বস্ত্র ও পেশাক আমদানি করে। যদিও চীন বাংলাদেশ থেকে এর সিংহভাগই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আমদানি করেছিল। জারা এবং এইচ এন্ড এমের মতো বিশ্বখ্যাত ক্রেতাগণ এ সব পণ্য বাংলাদেশ থেকে ক্রয় করে চীনে চেইন স্টোরের মাধ্যমে বাজারজাত করেছিল।

চীনের বাজারে প্রবেশের জন্য বেশকিছু দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। আমাদের পোশাক রফতানিকারকরা চেষ্টা করলেই চীনের বাজারে প্রবেশ করার কৌশলসমূহ রপ্ত করতে পারেন। চীনের সদ্য বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নিকট যেমন নতুন নতুন ডিজাইন আর ফ্যাশনের চাহিদা রয়েছে, ঠিক তেমনি সে দেশের অনুন্নত অঞ্চলের ভোক্তাদের জন্য কম মূল্যের পোশাকের চাহিদাও রয়েছে।

আর এ জন্য বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের ডিজাইন ও ফ্যাশন খাতে গবেষণার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে চৈনিক ভোক্তাদের রুচি ও চাহিদা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যেতে পারে।

চীনের মতো দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আগে এর ঝুঁকি সম্পর্কে যেমনিভাবে বিশদ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন, ঠিক তেমনিভাবে দক্ষতার সঙ্গে এই চুক্তির আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি। তা ছাড়া ভবিষ্যতের বিষয় চিন্তা করে চীন ছাড়াও ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গেও মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

ওডি/এআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড