• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অ্যাম্বুলেন্সেই বোনকে তওবা পড়িয়েছে নুসরাতের ভাই

  এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী প্রতিনিধি

১০ মে ২০১৯, ১৪:৪৯
নুসরাত জাহান রাফি
নিহত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি (ফাইল ছবি)

‘ভাই আমরা ছোট চাকুরী করি, আমাদের ক্ষতি হলে কাটিয়ে উঠতে পারবো না। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার হিসেবে চাকুরী করছি। হাজার হাজার রোগীকে বহন করেছি, তবে নুসরাতের মত এই রকম আগুনে পোড়া কোন রোগী বহন করি নাই। গাড়ির মধ্যে তার আর্তচিৎকার আজও আমার কানে বাজে। তার চিৎকারের দৃশ্য মনে পড়লে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুমাতে পারি না।’ কথাগুলো বলেছেন অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে বহনকারী সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক নুর করিম।

নুর করিম বলেন, ‘আমারও মেয়ে আছে, নুসরাতের সেই দৃশ্য দেখলে আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তার জীবন বাঁচাতে কত যে দ্রুত গতিতে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছি তা বলতে পারবো না। আমার মনে হয়, আমি এত দ্রুত গতিতে এ্যাম্বুল্যান্স চালিয়েছি আমার চাকুরী জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেনি।’

ছোট চাকুরী করেন হিসেবে গণমাধ্যমে কোন বক্তব্য দিয়ে বিপদে পড়তে চান না করিম। আবার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। নিজ কর্মের প্রতি আস্থার কারণে চাকুরীবিধি মেনে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হন তিনি। তারপরও এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই এটি স্পর্শকাতর বিষয়, ক্ষতি হলে কিছু লেইখেন না।’

ওই দিনের বর্ণনা দিয়ে নুর করিম বলেন, ‘সেদিন ছিল ৬ এপ্রিল আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টা। সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে কর্মরত মেডিকেল এসিসট্যান্ট মো. ইসমাইল স্যার আমাকে মোবাইলে কল দিয়ে বলেন করিম সাহেব আপনি কোথায়? এক মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে জরুরী বিভাগের সামনে আসেন। আমি তখন হাসপাতালের ভেতরে অ্যাম্বুলেন্সটি পার্কিং করছিলাম।’

‘পার্কিং না করে এক মিনিটের মধ্যে জরুরী বিভাগের সামনে হাজির হই। জরুরী আগুনে পোড়া একজন মাদ্রাসার ছাত্রীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন কর্তব্যরত ডা. আরমান স্যারসহ সহকারীরা। তার কান্না আর হাসপাতালে উপস্থিত তার ভাইয়ের অসহায়ত্ব দেখে নিজেই বিচলিত হয়ে যাই।’

অ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, ‘এদিকে ওই ছাত্রীকে উদ্ধারকারী কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য রাসেল ও মাদ্রাসার নাইট গার্ড মো. মোস্তফা তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন। তাদেরকেও চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। নুসরাতকে সবাই তাড়াহুড়ো করে ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলেন। আহত কনস্টেবল সামনের সীটে বসলেন। এ্যাম্বুলেন্সের পেছনে মেয়েটির সঙ্গে তার ভাই উঠলো। পুলিশের কনস্টেবল বলেন গাড়ি ঘুরিয়ে তাকে থানায় নিয়ে ওসি সাহেবকে দেখাতে বলেন। তার কথামত অ্যাম্বুলেন্স থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় ওসি তদন্ত মো. কামাল হোসেন এবং দারোগারা থানায় ছিলেন। মেয়েটির চিৎকার শুনে সবাই এগিয়ে এক নজর দেখে কেউ স্থির থাকতে পারেননি। সবার চোখে জল। বললেন এক মিনিট দেরী না করে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। তাদের কথামত ফেনীর দিকে ছুটে যাই।’

তিনি বলেন, ‘এদিকে খবর পেয়ে একনজর দেখার জন্য মেয়র সাহেব তার বাড়ির দরজায় অপেক্ষা করছেন। সোনাগাজী-ফেনী সড়কে তার বাড়ির সামনে তাকে এক নজর দেখিয়ে শুধু দোয়া চেয়ে অ্যাম্বুলেন্স টান মারি। ফেনীর দিকে যেতে যেতে তার ভাই তাকে প্রশ্ন করছে, কারা তোকে আগুন দিয়েছে? কেন দিয়েছে? তখন মেয়েটি বলতে থাকে একজন মেয়ে তাকে পরীক্ষার হলে বলে নিষাদরে ছাদের উপর মারিহালার। এই খবর শুনে আঁই ছাদের উপর গেলে বোরকা পরা চোখে চশমা ও হাত মোজা পরা ৪জন লোক আমারে বলে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছিস সেটা তুলতে হবে। একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে এগিয়ে দেয়। আমি বলি অধ্যক্ষ কেন ওস্তাদ হয়ে আমার সর্বনাশ করতে চেয়েছে? আমি কোন প্রকারেই মামলা তুলবো না। তখন তারা আঁর মুখ চেপে ধরে হাত পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দে।

‘ভাই আবার প্রশ্ন করে তুই হেগুনেরে চিনসনি, তখন মেয়েটি বলে কণ্ঠটি চেনা চেনা মনে হচ্ছে। রাখেন আমি মনে আনি। এই কথা বলেই একটি চিৎকার মারতে থাকে। আবার কিছুকক্ষণ চুপ থাকে। কেন যেন তার ভাইয়ের মনে জানা হয়ে গেছে বোন মনে হয় আর বাঁচবে না।’

‘তখন সে বোনকে বলতে থাকে, বোন তোমার অতীত ভুল ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। তওবা পড়। আরবী একটি সূরা পড়িয়ে বোনকে সে তওবা করাতে থাকে। আমি অ্যাম্বুলেন্স চালালেও আমার মনটি শুধু মেয়েটির বাঁচার আকুতির দিকে পড়ে আছে। এরই মাঝে এসে গেলাম ফেনী সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে। সবাই ধরাধরি করে মেয়েটিকে নামিয়ে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলো।’

‘দেখতে পেলাম সেখানে সোনাগাজী মডেল থানার ওসি তদন্ত কামাল স্যারও হাজির। চিকিৎসকেরা মেয়েটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যেতে বলেন। পকেটে টাকা না থাকা অসহায় ভাইয়ের কান্না দেখলাম। কিভাবে নেবে তাকে ঢাকা মেডিকেলে।

‘অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াও ছিল না তার পকেটে। ওসি তদন্ত কামাল স্যার একটি অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে। তার ভাই যখন কামাল স্যারকে জানালো তার পকেটে টাকা নাই। তখন তিনি তাকে বললেন টাকার ব্যপারে তুমি চিন্তা কইরো না। আমি দেখছি। তাদেরকে ঢাকার দিকে তড়িঘড়ি করে ঢাকার দিকে প্রেরণ করে আমাকে ২০০ টাকা বখশিষ দিয়ে বিদায় করেন। পরে আমি সোনাগাজী ফিরে আসি। সোনাগাজী এসে গণমাধ্যমের সুবাধে এবং ফেসবুকের মাধ্যমে মেয়েটির সব খবর শুনতে পাই। ৫দিন পরেতো মেয়েটি মারাই গেল। যাক আল্লাহ তার বেহেস্ত নসিব করুক।’

অ্যাম্বুলেন্স চালক নুর করিম বলেন, ‘পরে একদিন তদন্তে এসে পুলিশের ডিআইজি স্যার আমার বক্তব্য শুনেছেন। আমি উনাকে সেই দিনের দৃশ্যগুলো ওনাকে বলেছি। আর কোন তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ভাই আমি গরীব মানুষ। আমি কোন কথা বলতে চাই না। মাফ চাই, বিষয়টি যেহেতু জটিল, সেহেতু আমি কোন কথা না বলাই ভালো। তবে শেষ একটি কথা হলো নুসরাতের মত এ ধরণের কোন ঘটনা যেন কারো জীবনে না ঘটে। এটাই মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি।’

মুর্মূর্ষ রোগীদের জীবন বাঁচাতে সাইরেন বাজিয়ে মুহূূর্তের মাঝে হাজির হন করিম ড্রাইভার। অনেকটা নিজ বিবেকের তাড়নায় মানবিক লোকও বলা চলে তাকে। নিজের দায়িত্ববোধ থেকে অসুস্থ মানুষদের জীবন বাঁচাতে ছুটে চলেন নিরন্তর।

উল্লেখ্য, নিহত নুসরাত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে তিনি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়।

৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এসময় তাকে কৌশলে পাশের বহুতল ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখানে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। গত ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাত মারা যান। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাইয়ের দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই।

নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে গত ৮ এপ্রিল আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। ১০ এপ্রিল মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। পিবিআই ২২ জন আসামিকে গ্রেফতার করে। এরমধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

ওডি/এএস

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড