রাকিবুল হাসান তামিম, ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন! একটি স্বাধীন দেশে সড়কে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্দোলন করতে হয় এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৮ এর ২৯ জুলাই। জাবালে নূর নামক বেপরোয়া বাসের চাপায় রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের নিহত দুই শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাকায় নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। এর মধ্যে অন্যতম দাবিগুলো ছিল-
১. নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা
২.সড়ক-নিরাপত্তায় কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ
৩. এবং ট্রাফিক আইনভঙ্গকারী চালকদের শাস্তি
পরবর্তীতে ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রীসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।
বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ, রাজধানী ঢাকার বাস সার্ভিসগুলোতে যা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ এর জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২৫ হাজার মানুষ এবং আহত প্রায় ৬২ হাজার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে, ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং বাকি ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে। (অনলাইন থেকে প্রাপ্ত তথ্য)
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে ২০১৮ সালে দেশে চলমান বৈধ গাড়ির সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ ৪২ হাজার, কিন্তু বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ২৬ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ প্রায় ৯ লাখ গাড়ি লাইসেন্সবিহীন চালক দ্বারা চালিত হয়। উপরন্তু দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়তে থাকে। আন্দোলনের পূর্ববর্তী কয়েক মাসে দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব, বাসের হেলপার কর্তৃক নদীতে ফেলে দেওয়া পায়েল, বাসচাপায় আহত সৈয়দ মাসুদ রানা ও বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী এবং সর্বশেষ বিইউপির ছাত্র আবরারসহ প্রমুখের মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে সমালোচনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় সরব হয় প্রশাসন। ব্যবস্থা নেওয়া হয় নানাভাবে। পালন করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। কর্তৃপক্ষ গতবছর ৫-১৪ আগস্ট ১০ দিনব্যাপী সড়ক-নিরাপত্তামূলক ‘ট্রাফিক সপ্তাহ’ ঘোষণা করে এবং এ সময়ে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার অপরাধে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা এবং ৭ কোটি ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ডিএমপি সেপ্টেম্বর মাসকে ট্রাফিক সচেতনতা মাস ঘোষণা করে সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তাতেও খুব একটা সফলতা আসেনি। এ বছর আবার নানা কর্মসূচির পর গেল ১৭ মার্চ থেকে আবার ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হয়। আর শুরুতেই সুপ্রভাত বাসের চাপায় মারা যায় আরও একটি তাজা প্রাণ।
তারই প্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক কী এর প্রয়োজনীয়তা কী, সড়ককে কেন নিরাপদ করা যাচ্ছে না, কেন একের পর এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে সড়কে অঝোরে প্রাণ ঝরছে, কেন মৃত্যুর মিছিল থামছে না ? এই সমস্যার কারণ ও প্রতিকার কী এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার নানা বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দুইজন কর্মইকর্তার সঙ্গে কথা হয়। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ দুটি জায়গা শাহবাগ এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিটের টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) ছারোয়ার-ই-দ্বীন এবং হেলাল উদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন দৈনিক অধিকারের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি রাকিবুল হাসান তামিম।
সারোয়ার-ই-দ্বীন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর, শাহবাগ বিট, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ট্রাফিক বিভাগ)
নিরাপদ সড়কের প্রয়োজনীয়তা বা নিরাপদ সড়কের গুরুত্বের ব্যাপারে নতুন করে বলার কিছু নেই। নিরাপদ সড়ক বলতে যেখানে সবাই নিরাপদে চলাচল করতে পারবে তাই বুঝায়। বর্তমান সমাজে ঘর থেকে বের হলেই প্রত্যেকটা মানুষকে সড়ক দুর্ঘটনা নামক আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। যার ক্ষয়ক্ষতি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
জনসচেতনতা এবং প্রয়োজনীয় সরকারি বেসরকারি পদক্ষেপই এই মহামারীকে রুখে দিতে পারে। আমি মনে করি সবার আগে আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা অধিকাংশই যোগাযোগের জন্য সড়ক পথের ওপর নির্ভরশীল। তাই এই পথের গুরুত্ব অনেক বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবার সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টার পাশাপাশি আরও কিছু ব্যাপারে পরিবহন চালক, মালিক এবং সর্বোপরি সবাইকে সচেতন হতে হবে।
যেমন-
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন নিয়ে রাস্তায় না নামা
২. অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে গাড়ি না দেওয়া
৩. সড়কের ওপর অবৈধ হাটবাজার বন্ধ করা
৪. সঠিক জায়গায় ফুট ওভার ব্রীজ নির্মাণ করা
৫. বিকল্প রাস্তার ব্যবহার না করে এক লেনে চলার চেষ্টা করা
৬. যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুড়ি না করে ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা
৭. রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার যথাস্থানে নির্মাণ করা
৮. ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা
৯. রাস্তার সংখ্যা বাড়ানো ও প্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার তৈরি করতে হবে
১০. এছাড়া রিকশার জন্য আলাদা লেন তৈরি এবং রাস্তাগুলো সংস্কার ও মেরামত কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে
১১. দূরপাল্লার গাড়ির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি না চালিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা
সর্বোপরি নিরাপদ সড়কের জন্যে যত পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক না কেন যতক্ষণ না আমরা সাধারণ মানুষজন সচেতন না হব ততদিন নিরাপদ সড়ক কেবল মিছে এক স্বপ্নের মতোই থাকবে।
মো. হেলাল উদ্দীন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি বিট, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ট্রাফিক বিভাগ)
নিরাপদ সড়ক শুধু কথার কথা নয়, বরং সকলেরই অন্যতম একটি চাওয়া। নিরাপদ সড়কের গুরুত্বের ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই। কারণ প্রতিটি দুর্ঘটনাই অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রতিদিন সংবাদপত্রে আমাদের দেশে যে খবরটি অনিবার্য তা হলো সড়ক দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যানবাহনগুলোর মুখোমুখি সংঘর্ষে, গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, এমন কি পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হওয়ার সময়ও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
এই সকল দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সবার সতর্ক হতে হবে। এক্ষেত্রে যাত্রী, পরিবহন চালক,পরিবহন কর্মচারী, পরিবহন মালিক সবাইকেই সতর্ক হতে হবে।অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিংয়ের ঘৃণ্য মনোভাব দূর করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে গাড়িগুলোর অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিং। আবার আইন অমান্য করার ফলেও ঘটে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এক জরিপে দেখা যায়, ৯১ শতাংশ চালক জেব্রা ক্রসিংয়ে অবস্থানরত পথচারীদের আমলই নেয় না। পাশাপাশি ৮৫ ভাগ পথচারী নিয়ম ভেঙ্গে রাস্তা পার হয়।
সুতরাং নিরাপদ সড়ক গড়তে সবারই সচেতনতামূলক মনোভাব তৈরি করতে হবে। তবেই দুর্ঘটনার হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
ওডি/আরএআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড