• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

২ দফা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, যা পেল বাংলাদেশ

  আয়াজ উর রাহমান

২১ মার্চ ২০১৯, ১২:৫৬
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
২০১৮ ও ১৯ সালে সংঘটিত নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। (ছবি : সম্পাদিত)

গণপরিবহনের নৈরাজ্যের মুখে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দ্বিতীয়বারের মতো আন্দোলনে নেমেছে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তারা। ২০১৮ সালেও একই দাবিতে আন্দোলন করেন দেশের শিক্ষার্থীরা।

মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) রাজধানীর প্রগতি সরণীতে সুপ্রভাত পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে চাপা পড়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-এর শিক্ষার্থী আবরার আহম্মেদ চৌধুরীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলনে নামেন বিইউপির শিক্ষার্থীরা। পরে তারা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আহ্বান জানিয়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ডাক দেন।

এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের রেষারেষিতে প্রাণ যায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের আবদুল করিম ও দিয়া খানম নামের দুই শিক্ষার্থীর। এ ঘটনায় সারাদেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নামে স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের আন্দোলনে যোগ দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।

নিহত শিক্ষার্থী আবরার আহম্মেদ

দেশে সংঘটিত দুই দফা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে বিভিন্ন রকমের দাবি জানিয়েছেন ছাত্র সমাজ। এছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় নানা পরিকল্পনার বিষয়ও উত্থাপন করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের এসব দাবি ও পরিকল্পনা দৈনিক অধিকারের পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-

২০১৯ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ৮ দফা -

১। লাইসেন্স প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা করতে হবে। ২। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ড্রাইভারদের পুনরায় পরীক্ষা নিতে হবে এবং ড্রাইভারদের স্কুলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। ৩। স্কুলিং এর সময় মালিক পক্ষকে ড্রাইভারদের বেতন দিতে হবে। যেসকল ড্রাইভার পরীক্ষায় ফেল করে পুনরায় স্কুলিং এ অংশ নিলে তাদের বেতন ও মালিকপক্ষ দিবে। ৪। প্রাইভেট বাস কোম্পানিকে ট্যাক্স ব্রেক দিতে হবে। যাতে তারা ভাল গাড়ি, ড্রাইভার ও ফিটনেসে আরও ব্যয় করতে পারে। ৫। ট্রিপ ভিত্তিক পেইমেন্ট বন্ধ করে দৈনিক বা মাসিক বেতন নির্ধারণ করার মাধ্যমে উগ্র প্রতিযোগিতা থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করতে হবে। ৬। গুরুত্বপূর্ণ, ঝুকিপূর্ণ ও ব্যস্ত অংশে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডার পাস নির্মাণ করতে হবে। ৭। নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় পর্যবেক্ষণের জন্য একটি সিভিল কমিটি বা স্টুডেন্ট কমিটি থাকতে হবে। ৮। দুর্ঘটনা হলে বাস ড্রাইভারদের আক্রমণের প্রবণতা দেখা যায়, যা আমাদের বন্ধ করতে হবে।

এর আগে মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেন। তাদের দেওয়া আরও দাবি গুলোর মধ্যে রয়েছে-

১। পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং প্রতিমাসে বাস চালকের লাইসেন্সসহ সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে। ২। আটককৃত চালক এবং সম্পৃক্ত সকলকে দ্রুততম সময়ে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ৩। আজ থেকে ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুততম সময়ে অপসারণ করতে হবে। ৪। ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সকল স্থানে আন্ডারপাস, স্পিড ব্রেকার এবং ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। ৫। সড়কে হত্যার সাথে জড়িত সকলকে সর্বোচ্চ আইনের আওতায় আনতে হবে এবং চলমান আইনের পরিবর্তন করতে হবে। ৬। দায়িত্ব অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় আইন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৭। প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৮। শিক্ষার্থীদের হাফ পাশ বা আলাদা বাস সার্ভিস চালু করতে হবে।

এছাড়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সড়কে বিশৃঙ্খলার নানা বিষয় উঠে আসে। এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা রয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এমনকি চাপের মুখেই উদ্যোগ অন্যথায় গাফেলতি ও দুর্নীতির কারণে নীরব থাকেন কর্তৃপক্ষ বলে অভিযোগ করেন ছাত্র সমাজ। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে উঠে আসে, পাবলিক পরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস ভাড়া কেন কার্যকর নেই? এই বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ চাই। তারা বলেন, শিক্ষার্থী মরলে আমাদের আন্দোলনের মুখে সরকারের টনক নড়ে। কিন্তু আগে থেকে সতর্ক কেনো থাকা হয় না। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির বিষয়ে ও প্রশ্ন তুলেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি কীভাবে রাস্তায় নামে, এই সব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী দাবি জানিয়ে বলেন, নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী ছাউনি করতে হবে। সেখানেই পাবলিক বাস এসে থামবে। সেখান থেকেই যাত্রীরা উঠবে। এছাড়া যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো যাবে না।

এসময় জাবালে নূর পরিবহনের বাস পুনরায় কেনো সড়কে চলাচল করছে, এই নিয়েও প্রশ্ন তুলেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এই বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী দৈনিক অধিকারের কাছে বলেন, এয়ারপোর্ট এলাকায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ঘাতক জাবালে নূরকে সাময়িকভাবে সড়কে স্থগিত করলেও পরবর্তীতে জাবালে নূর কীভাবে রোড পারমিট পেল?

এসব নিয়ে দৈনিক অধিকারের সঙ্গে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি এবং বিইউপির ছাত্র আরিফুর রহমান শাকিল। তিনি বলেন, বিআরটিএ এর দুর্নীতির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ, সরকার কেনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। তাদের দুর্নীতির বিষয়টি কিন্তু সকলেরই অবগত। তারা লাইসেন্স এর বিষয়ে দুর্নীতি করে বলেই এবং এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের গাফেলতি থাকার কারণেই সার্বিক সমস্যা হচ্ছে।

২০১৯ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধ

ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের গাফেলতি রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাতারাতি আন্দোলনের চাপে তারা ফুটওভার ব্রিজের উদ্বোধন করে দিলো। তাহলে নির্দিষ্ট স্থান গুলোতে কেনো ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় না।

শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরিবহনে হাফ পাস ভাড়ার প্রসঙ্গে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এই বিষয়ে নিরাপত্তা সড়ক আইনে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের হাফ পাস ভাড়া নিয়ে বাসে হেরেজমেন্টে পড়তে হয়। শিক্ষার্থীদের হাফ পাস ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সব শেষে শাকিল বলেন, আমরা আশ্বাস চাই না। আমরা সুষ্ঠু সমাধান চাই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবির বিষয় গুলো নিজে দেখবেন। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সার্বিক সমাধান দেবেন।

এদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক শেষে আন্দোলন স্থগিতে সম্মত হয়ে এলেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একাংশ তা মানতে নারাজ। দাবি বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বে না বলে জানিয়েছেন। তবে বুধবারের (২০ মার্চ) মতো সড়ক অবরোধ তুলে নিয়েছেন তারা। আন্দোলনে অন্য পক্ষরা বলছেন, বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) সকাল ১০টায় ফের তারা সড়ক অবরোধ করবেন।

এর আগে ঢাকা উত্তর সিটির নগর ভবনে বিইউপি উপাচার্যের উপস্থিতিতে উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিইউপি শিক্ষার্থীর একটি প্রতিনিধি দল।

মেয়র বৈঠকে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে এগুলো বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দল আন্দোলন এক সপ্তাহের স্থগিতের ঘোষণা দেন।

বৈঠক শেষে মেয়র আতিকুল ইসলাম ও প্রতিনিধি দলের সদস্য শিক্ষার্থী ফয়সাল এনায়েত জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হলে শিক্ষার্থীরা ফের আন্দোলনে নামবেন। ২৮ মার্চ সকালে এসব পদক্ষেপের অগ্রগতি নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেই বৈঠকের আলোচনায় অগ্রগতি সন্তোষজনক না হলে নতুন করে রাজপথে নামবেন তারা।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা–

১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. নৌপরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ৩. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। ৪. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না। ৫. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৬. প্রত্যেক সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে। ৭. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৮. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে। ৯. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

নিরাপদ সড়ক চেয়েছিলেন নিহত আবরার আহম্মেদ

২০১৮ সালের সংঘটিত নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের একজন প্রতিবাদী শিক্ষার্থী ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহম্মেদ। তার ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে এ-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা গেট এলাকায় সু-প্রভাত পরিবহনের দুই বাসের সড়কে প্রতিযোগিতার মুখে রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে প্রাণ যায় আবরারের।

আবরারের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে দেখা যায়, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন চলাকালে তিনি আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে তার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করেন। ছবির নিচে লেখা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’। ২ আগস্ট ছবিটি পোস্ট দেন আবরার।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাজনৈতিক হামলা

২০১৮ সালের সংঘটিত নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি আন্দোলন হয়েছিল। তবে শিক্ষার্থীদের অহিংস এই আন্দোলনে রাজনৈতিক হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় অনেক শিক্ষার্থীরা আহত হন। এছাড়া হামলার ঘটনা ঘটে সাংবাদিকদের উপরেও। ওই হামলায় গুরুতর আহত হন প্রথম আলোর প্রতিবেদক আহম্মেদ দীপ্ত ও এসোসিয়েট প্রেস (এপি) এর ফটো জার্নালিস্ট এম এ আহাদ।

হামলার শিকার এপি'র ফটো সাংবাদিক এম এ আহাদ

এ ঘটনায় অভিযোগ উঠে এক দল হেলমেটধারীরা এই হামলা চালায়। ওই এলাকায় কর্তব্যরত সাংবাদিকরা জানান, পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, ক্যামেরা দেখলেই তেড়ে আসছিলেন তারা। মাথায় হেলমেট আর হাতে রামদা-কিরিচ। কারো হাতে লাঠিসোঁটা কিংবা রড। দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ওই এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল তারা।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামা শিক্ষার্থীদের ধরে ধরে পেটাচ্ছিলেন তারা। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সংবাদ কভারেজের বিষয়টি টের পেয়ে তারা সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়ে। এ সময় অন্তত পাঁচজন সাংবাদিককে মারধর করেছে তারা।

আহত অন্যান্য সাংবাদিকরা হলেন- দৈনিক বনিক বার্তার পলাশ শিকদার, বর্তমানে ইউএনবি এর কর্মরত ফটো সাংবাদিক আবু সুফিয়ান জুয়েল, দৈনিক জনকণ্ঠের জাওয়াদ ও প্রথম আলোর সিনিয়র ফটোগ্রাফার সাজিদ হোসেন।

এছাড়া ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের যৌথ হামলায় আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আহতরা হলেন রাহাত করীম, এনামুল হাসান, মারজুক হাসান, হাসান জুবায়ের ও এন কায়ের হাসিন উল্লেখযোগ্য।

সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপ

গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত আন্দোলন সারাদেশের গণবিক্ষোভে রূপ নেয়। ঢাকায় ২৯ জুলাই সংঘটিত এক সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।

আন্দোলনের তীব্র চাপের মুখে ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রীসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছিল। ৮ আগস্টের মধ্যে শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

এদিকে সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় রাজধানীতে গত রবিবার (১৭ মার্চ, ২০১৯) থেকে শুরু হয় পঞ্চমবারের মতো ট্রাফিক সপ্তাহ। এরই মধ্যে বাস চাপায় একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।

এছাড়া সড়ক ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে ইতোমধ্যেই একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। ১৫ সদস্যের এ কমিটির নেতৃত্বে থাকছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভায় এ কমিটি গঠন করা হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ কাউন্সিল সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, কমিটি ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এসব সুপারিশ একে একে বাস্তবায়ন করা হবে।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও আলোচনা-সমালোচনা

গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও উত্তেজনার মধ্যেই ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ -এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। ফিটনেসবিহীন ও বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালানোসহ সড়কে নিয়ম ফিরিয়ে আনতে ‘ট্রাফিক পুলিশ সপ্তাহ’ পালিত হয়।

কুর্মিটোলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে সান্তনা ও তাদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র অনুদান দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনটি নিয়ে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রস্তাবিত আইনে, বেপরোয়া গাড়িতে কারও মৃত্যু হলে চালকের পাঁচ বছর জেল হবে। কেউ গুরুতর আহত হলে একই সাজা ভোগ করতে হবে।

তবে পুলিশের তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় চালক উদ্দেশ্যমূলক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাহলে ৩০২ ধারায় মামলা হবে। এ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।

ফিটনেসবিহীন ও বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালানোসহ সড়কে অন্য নিয়ম ভঙ্গের সাজাও বেড়েছে নতুন আইনে। তবে মৃত্যু উপত্যকা সড়কে প্রাণহানি রোধে আরো কঠোর আইন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, আগের আইনে অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর সাজা ছিল তিন বছরের কারাদণ্ড। নতুন আইনে ৩০৪ (খ) ধারায় সাজা দুই বছর বাড়বে। এ ধারায় জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। তবে তদন্তে যদি তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয় উদ্দেশ্যমূলক হত্যা তাহলে ৩০২ ধারায় মামলা হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদন ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আদালত নির্ধারণ করবেন বিচার ৩০২ না ৩০৪ (খ) ধারায় হবে।

তবে খসড়ায় সাজা দুই বছর বাড়লেও একে যথেষ্ট মনে করছেন না নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।

তিনি বলেন, মালিক-শ্রমিকের স্বার্থই রক্ষা করা হয়েছে। নামের বিচারেই ‘সড়ক পরিবহন আইন’ যথার্থ হয়নি। এটি হওয়ার কথা ছিল ‘সড়ক পরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন’।

তিনি বলেন, আইনে বলা হয়েছে, হত্যা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সেটা হবে তদন্ত সাপেক্ষে ৩০২ ধারায়। এটা কি আমাদের দেশে আদৌ সম্ভব? ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো কেউ যদি মারা যায়, তাহলে ৩০২ ধারায় যাবে। সাধারণ মানুষ তো ওই জায়গায় যেতে পারবে না। রংপুরের একজন শ্রমিক মারা গেলে কেউ ৩০২ ধারায় নেবে?

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান বলেন, আসলে সুচিন্তিতভাবে মানুষকে ঠকানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে আইনে। লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৬ মাসের জেল, আর নকল লাইসেন্স ব্যবহার করলে ২ বছরের জেল। এটা কী ধরনের কথা? তাহলে কে নকল লাইসেন্স দেখাবে, সে তো ধরা পড়লে লাইসেন্স ছুড়ে ফেলে দেবে। আইনে থাকা বৈষম্যগুলো দূর করা জরুরি বলে মনে করেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

এদিকে সড়ক পরিবহন আইনে খুশি নন মালিক-শ্রমিক নেতারাও। তারা বলেছেন, সাজা অনেক বেশি কঠোর হয়ে গেছে। এত কঠিন সাজা মাথায় নিয়ে পরিবহন খাত চলতে পারবে না। সড়ক পরিবহন সংগঠনের নেতারা বলেছেন, চালকরা গলায় ফাঁসির দড়ি নিয়ে সড়কে যানবাহন চালাবেন না। তারা আইনটিকে স্বাগত জানাচ্ছেন না।

পাঠকদের সুবিধার্তে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর পিডিএফ দেওয়া হল-

পিডিএফ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড