• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সাগর-রুনি হত্যার ৭ বছর 

ঝুলছে বিচার, ঘুরছে তদন্ত

  আয়াজ উর রাহমান

১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:১২
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা, হামলা মিলছে না বিচার (ছবি : সম্পাদিত)

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। তবে এখনও ঝুলছে এই নৃশংস হত্যার বিচার, ঘুরছে মামলার তদন্ত কাজ। সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে নেই বিচারের তেমন ইতিহাস। বেশির ভাগ ঘটনায় দুর্বল তদন্ত ও শক্তিশালী মহলের চাপে খালাস পেয়ে যায় আসামিরা। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা!

২০১২ সালের এই দিনেই নিজ বাসায় খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। দীর্ঘদিন ধরে বিচারের আশায় দিন গুনছেন স্বজন-সহকর্মীরা। তবে এখন পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের তদন্তও শেষ হয়নি।

হত্যার রহস্য উদঘাটন, খুনি ধরা থেকে বিচার-বিভিন্ন সময়ে আশার বাণী শুনলেও দীর্ঘ সময়ে শুধু তদন্ত সংস্থা আর তদন্ত কর্মকর্তাই বদল হয়েছে। রহস্য আর উদঘাটন হচ্ছে না।

থানা পুলিশ, ডিবি হয়ে আদালতের নির্দেশে র‌্যাব এখন মামলাটির তদন্ত করছে। এ পর্যন্ত ৬১ বার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন বদল হয়েছে। আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নির্ধারিত দিনেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে তদন্ত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে আদালতকে অবহিত করা হবে। এদিকে প্রতিবারের মতো এবারও ক্ষোভ আর হতাশা নিয়েই সোমবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দিনটি পালন করবেন এই সাংবাদিক দম্পতির স্বজন ও সহকর্মীরা। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছে। সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ডিআরইউ কার্যালয়ের সামনে এ প্রতিবাদ সমাবেশ হবে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে সাগর-রুনির ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাগর ছিলেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক। রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র সন্তান মিহির সরোয়ার মেঘ। ওই সময়ে তার বয়স ছিল সাড়ে চার বছর।

যেভাবে বেড়ে উঠছে নিহত দম্পতির সন্তান মেঘ

এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির ৫ বছরের শিশু সন্তান মেঘ-এর বয়স এখন মাত্র ১১ বছর।

এর আগে বিবিসি বাংলায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মামা নওশের রোমান বলেন, আর দশটি বাচ্চার মতই মেঘ স্কুলে যাচ্ছে, ক্রিকেট কোচিং করছে। আত্মীয়-বন্ধুদের মাঝে বেড়ে উঠছে। কিন্তু বাবা-মার আদর ছাড়া যেভাবে বেড়ে ওঠে একটি বাচ্চা সেভাবেই সে বেড়ে উঠছে।

বাবা-মার কথা সবসময় মনে করে সে। তবে মেঘ চায়না তার পরিবার টিভি বা মিডিয়ার সামনে কথা বলুক।

এ বিষয়ে আলম বিবিসিকে বলেন, "কদিন আগে সে বলছিল আমরা যেন মিডিয়ার সাথে কথা না বলি এবার মৃত্যুবার্ষিকীতে। তার প্রশ্ন-কথা বললে কি তার বাবা-মা কখনো ফিরে আসবে?যে কথা বললে তারা ফিরে আসবে না সে কথা বলে কি লাভ?"

নওশের রোমান জানান, মেঘ যত বড় হচ্ছে তার ছোট মনে এই ধরনের হালকা ক্ষোভ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে।

২০১৭ সাল থেকে গত ২১ বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২৮ জন সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ২৫ জন সাংবাদিক। দেশের সবচেয়ে আলোচিত ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলায় ৭ বছরে ৬১ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল।

সব মিলিয়ে বর্তমান আলোচনার শীর্ষে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন। দেশে সাংবাদিক নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং গণমাধ্যমের ওপর নানামুখী চাপের মুখে প্রশ্ন উঠেছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকারে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থান ভুটানের- ৯৪। নেপালের অবস্থান ১০৬, আফগানিস্তান ১১৮, শ্রীলংকা ১৩১, মিয়ানমার ১৩৭, ভারত ১৩৮, পাকিস্তান ১৩৯, থাইল্যান্ড ১৪০ এবং কম্বোডিয়ার অবস্থান ১৪২।

গণমাধ্যমের ও সাংবাদিকদের অধিকারে নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক ২০১৮’ -এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

২০১৭ সালে একই অবস্থানে থাকলেও স্কোরের দিক থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ২০১৮ সালে আরও খারাপ অবস্থানে পৌঁছেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের নেতিবাচক স্কোর ছিল ৪৮ দশমিক ৩৬। ২০১৮ তে তা বেড়ে হয়েছে ৪৮ দশমিক ৬২। আফ্রিকার দেশ উগান্ডা বাংলাদেশের চেয়ে ২৯ ধাপ এগিয়ে রয়েছে। ১৮০ দেশের সূচকে দেশটির অবস্থান ১১৭।

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত হামলা ও মামলার কারণে সেলফ সেন্সরশিপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অন্তত ২৫ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন, এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় কয়েকশ ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারী বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে।

সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) এর তথ্যমতে ২০১৭ সাল থেকে গত ২১ বছরে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৮টি। এর মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১টির। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক হত্যার বিচার এড়ানো দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম।

এছাড়া বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরের মধ্যে বাক স্বাধীনতায় সবচেয়ে বেশি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ২০১৭ সালে, সংখ্যায় যা ৩৩৭টি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইন্টিনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে উপলক্ষে নিজেদের ওয়েবসাইটে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আর্টিকেল নাইন্টিন।

এছাড়াও ২০১৭ সাল থেকে গত ২১ বছরে রাজধানীসহ সারাদেশে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৮টি। বিভিন্নভাবে ২৮ জন সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হয়নি। দুর্বল তদন্ত ও শক্তিশালী মহলের চাপের কারণে খালাস পেয়ে যাচ্ছে আসামিরা এমনই অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

২০০২ সালে খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চলের সিনিয়র রিপোর্টার হারুন উর রশিদ হত্যা এবং ২০০৪ সালে খুলনা প্রেসক্লাব সভাপতি দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ুন কবির বালু হত্যা মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছে।

অন্যান্য মামলাগুলো ঝুলে আছে। দুর্বল তদন্তের কারণেই আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সাংবাদিক নেতারা।

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় একদল হেলমেটধারীরা। তবে এ ঘটনায় ও নেই তেমন অগ্রগতি। ঝুলে আছে ঘটনার তদন্ত কাজ।

এছাড়া সাগর রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৭ বছর হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধী সনাক্তের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। পরে কত হাজার ৪৮ ঘণ্টা পার হল কিন্তু বিচার হল না। এ ধরণের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলেই ঘটে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আর তা না হলে অপরাধীরা একের পর এক এ ধরণের অপকর্ম চালিয়েই যাবে।

বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে দেশে রাজনৈতিক নেতারা মিডিয়ার বিরুদ্ধে তাদের সমর্থকদেরকে প্রকাশ্যে উস্কে দিচ্ছেন। একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলো নিজেদের মতো করে সাংবাদিকতাকে ব্যবহারের যেসব চেষ্টা করছে- যা গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি হয়ে উঠছে।

এদিকে বিবিসি’র বরাতে আরএসএফ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কারণ তিনটি হল-

১. তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় সাংবাদিকদের বিচারের আওতায় আনা,

২. সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ওপর অব্যাহত সহিংসতা,

৩. সাংবাদিকদের ওপর হামলার পেছনে দায়ী ব্যক্তিরা সহজে রেহাই পেয়ে যায়।

এ ব্যাপারে গণমাধ্যম বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক জানান, 'যখন কোনো দেশের সরকার কর্তৃত্বপরায়ণ হয় তখন সেখানকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। বাংলাদেশে একের পর আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ না ফেরা পর্যন্ত এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবেনা।'

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড