এস এম সোহাগ
প্রায় ১৯০ বছর শাসনের পর ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয় ভারতীয় উপমহাদেশ, মুক্ত এই অঞ্চলে স্বাধীনচেতা নেতারা ধর্মের আদলে দুটি দেশ সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার কারনে পূর্ববঙ্গকে হতে হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান,যার ফলে যে দেশটিকে শাসিত হতে হয়েছিল আরও ২৪ বছর। স্বাধীন ভূখণ্ডে বাঙালিরাই ছিল পরাধীন, যাদের চিত্তে স্বাধীনতার চেতনা, রক্তে মুক্তির প্রত্যয়, তারা দমে থাকেনি। মুখের ভাষা কেড়ে নিতে দেয়নি, ভাষার যুদ্ধে জয়ের পরেও যেন পাকিস্তান শাসক শ্রেনীর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়।
স্বাধীন জীবনের জন্য মরিয়া এই জাতি উপমহাদেশের যেকোন জাতির চেয়ে অধিক শাসিত। তারা একসময় রুখে দাঁড়ায়। নিরস্ত্র, অসহায় মানুষগুলো সশস্ত্র শাসক শ্রেনীর সঙ্গে প্রায় ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে এনে সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়। আজ থেকে ৪৭ বছর আগের এই দিনে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের এই ভূখণ্ডটি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পেছনে বাঙালি ছাড়াও অনেক অবাঙালিদের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। মহান সেসব মানুষকে বাংলাদেশিরা কখনও ভুলতে পারবেনা, ভুলে গেলে জাতি হিসেবে বাঙালিদের অবস্থান বিশ্বে তলানিতে চলে যাবে। এমন একজন ব্যক্তি হলেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, ১৯৭১ সালের এক পাকিস্তানি সাংবাদিক। তিনি এমন এক সাংবাদিক যিনি সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, শাসকশ্রেনীর বিরুদ্ধে যার একটি সংবাদ সে সময়ের বিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরেছিল বিশ্ব দরবারে। নিজ দেশের সঙ্গে প্রতারণা করে, পেশাদারিত্বের তাড়না থেকে নিজেকে ও পরিবারকে হুমকির মুখে ফেলে মানবতার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন বাঙালিদের দুঃখকে প্রকাশ করতে। বাংলাদেশের সব মানুষ তার মতো সব মহাত্মাদের মনে রাখবে, একদিন হয়তো তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া হবে।
'বাংলাদেশের যুদ্ধ : যে প্রতিবেদন পালটে দিয়েছিল ইতিহাস' শিরোনামে ১৬ ই ডিসেম্বর ২০১১ সালে 'বিবিসি নিউজ' এর সাংবাদিক মার্ক ডুম্মেত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশের পরম বন্ধু পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে নিয়ে লেখা হয়েছিল এই প্রতিবেদন।
১৯৭১ সালের ১৩ ই জুন, এদিন যুক্তরাজ্যের 'সানডে টাইমস' পত্রিকায় 'জেনোসাইড' শিরোনামে আট কলামজুড়ে ছাপা হয় একটি প্রতিবেদন। লিখেছেন পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) মুক্তিকামী মানুষের ওপর বর্বর নির্যাতন-গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে। নিরাপত্তার কারণে বাধ্য হয়ে আত্মগোপণ করতে হয়েছিল ম্যাসকারেনহাসের পরিবারকে। যদিও ওই প্রতিবেদনই পাল্টে দিয়েছিল ইতিহাস।
'আব্দুল বারি, যার ভাগ্য তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল আরও সহস্রাধিক পূর্ব বঙ্গের নাগরিকদের মতোই। সে একটি ভুল করে ফেলেছে, একটি মারাত্মক ভুল, পাক বাহিনীর দৃষ্টির মধ্যে থেকে দৌড় দেয়ার মতো ভুল। পাক সেনারা মাত্র ২৪ বছর বয়সী কৃষকায় বালকটিকে ঘিরে রেখেছিল। সে কাঁপছিল, কারন সে জানে তাকে গুলি করা হবে যে কোনো সময়।'
পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের সচিত্র প্রমাণ। ছবি : সংগৃহীত
এবাবেই শুরু হয়েছিল বিগত দশকের শেষার্ধে দক্ষিণ এশীয় সাংবাদিকতার ইতহাসে অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদটির। পাকিস্তানি প্রতিবেদক মাসকারেনহাসের এই লেখাটি মুদ্রিত হয়েছিল ব্রিটিশ সংবাদপত্র 'সানডে টাইমস' এ। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে, বাংলাদেশের জনগণের ওপর কী নির্মম নির্যাতন চালায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। আদতে ঠিক কত মানুষ মারা গিয়েছিল তা জানেনা কেউ, কিন্তু নিঃসন্দেহে এক বিশাল অংকের মানুষ সেসময় প্রাণ হারিয়েছিল। স্বাধীন গবেষকরা মনে করছে এই সংখ্যাটা ৩ লাখ থেকে ৫ লাখের মধ্যে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই সংখ্যাটি ৩০ লাখের মতো।
এতে সন্দেহ নেই যে মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনটি যুদ্ধ শেষ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটা বৈশ্বিক মতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল এবং ভারতকে একটি নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করেছিল।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী 'সানডে টাইমসে'র সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন, মর্মস্পর্শী ওই প্রতিবেদন তাঁকে এতটাই ব্যথিত করেছে যে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার লক্ষ্যে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও মস্কোয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ম্যাসকারেনহাসের প্রতিবেদনও উদ্দেশ্যমূলক ছিল না। ম্যাসকারেনহাস সম্পর্কে সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স লিখেছেন, সততার সঙ্গে কাজ করা খুব ভালো একজন সাংবাদিক তিনি। ম্যাসকারেনহাস ছিলেন খুবই সাহসী। তখন পাকিস্তানের নেতৃত্বে ছিল সামরিক বাহিনী। ম্যাসকারেনহাস জানতেন, এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়া হতে পারে। তখনকার পরিস্থিতিতে এত বড় ঝুঁকি নেওয়া মোটেও সহজ ছিল না।
যে জাতি স্বাধীনচেতা সে ঘুরে দাঁড়াবেই, যা কিছু আছে তাই নিয়ে দেশ মাতৃকার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের সূর্যসন্তানেরা। ছবি : সংগৃহীত
১৯৮৬ সালের ৩ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাহসী সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস। প্রয়াত স্বামী সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী ভন্নে ম্যাসকারেনহাসের বক্তব্য এমন, 'ওর (মাসকারেনহাসের) মা সব সময় ওকে বলত, সদা সত্য কথা বলবে। ও আমাকে সব সময় বলত, আমার সামনে একটা পর্বত রাখো, আমি সেখানেই উঠব। ও কোনো কিছুতেই ভয় করত না।'
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে, মাসকারেনহাস দেশের প্রভাবশালী অভিজাতদের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কর্তৃত্বপূর্ণ প্রধান শহর করাচির একজন সম্মানিত সাংবাদিক ছিলেন। তিনি গোয়ান খ্রিস্টানদের ছোট সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন, এবং তার এবং ভন্নের ৫টি সন্তান ছিল।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছিল যখন পূর্ব পাকিস্তানি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল। এই দলটি ওই অঞ্চলে আরও বেশি সায়ত্বশাসন চেয়েছিল।
যখন ওই অঞ্চলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নতুন সরকার গঠন নিয়ে বিতর্ক চলছিল, তখন অনেক বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের লক্ষ্য ও আকাঙ্খাকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ এনেছিল।
আওয়ামী লীগ যখন আইন অমান্য নিয়ে একটি প্রচারণা সমাবেশ শুরু করল তখনই পরিস্থিতির অবনতি শুরু হল। দলটির সমর্থকরা অনেক অবাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করল, সহস্রাধিক সেনা পালিয়ে যায়।
মাসকারেনহাস তার দেশের সেনাবাহিনীর এই বর্বর নির্যাতনের এক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, যিনি নিজের পেশাদারিত্ব ও মানবিকতার তাগিদে বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের কথা বিশ্বে উপস্থাপন করেছিলেন। ছবি : সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় পাক সেনারা আওয়ামীলীগ এবং তাদের হৃদয়ঙ্গম প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায়। এদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী ও হিন্দু সম্প্রদায় মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যখন অঞ্চলটি সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ২০ শতাংশ ই হিন্দু ছিল।
জঘন্য এই যুদ্ধের একেবারে শুরুতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর হামলা চালায়, অধ্যাপক-শিক্ষার্থীদের সারিবদ্ধ করে হত্যা করে। এরপরেই তাদের নামমাত্র সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান গ্রামের দিকে চলে যায়, যেখানে স্থানীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে যারা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা শুরু করে।
প্রাথমিকভাবে, পরিকল্পনাটি কাজ করতে লাগল এবং সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় যে কিছু পাকিস্তানি সাংবাদিককে এই অঞ্চলে আমন্ত্রণ জানাবে। তারা কি সফলভাবে 'মুক্তিযোদ্ধাদের' সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল তা প্রচারের জন্য।
বিদেশি সাংবাদিকদের আগেই বহিষ্কার করা হয়েছিল, এবং পাকিস্তান অন্যদিকে সংঘটিত অত্যাচার প্রচারের জন্যও আগ্রহী ছিল। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছিল,যারা পাক সেনাদের অনুগত ছিল। যাদের দেশের স্বাধীনতার প্রতি ভালবাসা নিয়ে সন্দেহ ছিল, তাদের যুদ্ধাপরাধী বলে জানা হয়। এখনও অনেকে বাংলাদেশকে অস্বীকার করে।
মাসকারেনহাসসহ ৮ সাংবাদিককে প্রদেশটিতে ১০ দিনের সফরের জন্য আনা হয়েছিল। যখন তারা বাড়ি ফিরে যায়, তখন তাদের মধ্যে সাতজন যথাযথভাবে লিখেছিল ঠিক যা তাদেরকে বলা হয়েছিল লিখতে। কিন্তু, একজন ছিল যে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ছবি : সংগৃহীত
তার স্ত্রী ভন্নে মাসকারেনহাসে এখনও মনে আছে কি বিক্ষিপ্ত অবস্থা নিয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন। তিনি তাদের পশ্চিম লন্ডনের বাসভবনে বসে 'বিবিসি নিউজ'কে বললেন, 'আমি আমার স্বামীকে এমন অবস্থায় কোনদিন দেখিনি। সে ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত, হতভম্ব, পীড়াগ্রস্ত এবং মানসিকভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল।'
'তিনি আমাকে বললেন,তিনি যা দেখেছেন তা যদি লিখতে না পারেন তাহলে জীবদ্দশায় আর কোনদিন একটি শব্দ ও তিনি আর লিখতে পারবেন না।' বলে তিনি যুক্ত করলেন।
স্পষ্টতই এটা পাকিস্তানে বসে লেখা সম্ভব ছিলনা, কারণ প্রত্যেকটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পাক সামরিক বাহিনীর সেন্সর হয়ে আসতো। মাসকারেনহাস তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, যদি আমি এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের চেষ্টাও করি তাহলে নিশ্চিতভাবে তাকে গুলি খেতে হবে।
মাসকারেনহাস ভীষণ অসুস্থ বোনকে দেখার ভান করে লন্ডনে যান, যেখানে তিনি সরাসরি 'সানডে টাইমস' এর কার্যালয়ে যান এবং এর সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করেন। সম্পাদক ইভান্স তার কথা স্বরণ করলেন, সেই সাক্ষাৎ এর কথা। ' গোফওয়ালা, বর্গাকার আয়তনের বুকবিশিষ্ট সামরিক বাহিনীর মানুষের দেহের মতো সুঠামদেহী একজন মানুষ। কিন্তু তার চোখ ছিল আত্মিক এবং যেখানে গভীর মায়া ছিল, তা নিয়ে হাজির হল।'
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, তার স্ত্রী ভন্নি মাসকারেনহাস ও 'সানডে টাইমস' এর তৎকালীন সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স। ছবি : সংগৃহীত
'মার্চে বাঙালিদের ওপর বর্বর নির্যাতন দেখে তিনি হতভম্ব ছিলেন, পাক সামরিক বাহিনী যা করেছিল তা বৃহৎ পরিসরে একেবারেই জঘন্য একটা কাজ ছিল' বলে মাসকারেনহাসের অভিব্যক্তি নিয়ে ইভান্স লিখছিলেন।
মাসকারেনহাস তাকে বলেছিলেন যে, তিনি একটি বিশাল, নিয়মানুগ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং সেনা কর্মকর্তারা হত্যার বর্ণনাকে 'চূড়ান্ত সমাধান' হিসাবে বর্ণনা করতে বলেছিলেন।
ইভান্স এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তার স্ত্রী ভন্নে এবং সন্তানদের করাচি থেকে পালানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
যে টেলিগ্রাম পালটে দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে
মাসকারেনহাস তার স্ত্রীর নিকট 'আনের (তার বোন) অপারেশন সফল হয়েছিল' এমন এক সাংকেতিক টেলিগ্রাম পাঠানোর বিষয়ে তারা একমত হয়ে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করল।
তার পরিবারের প্রস্থানের জন্য সন্দেহ এড়াতে মাসকারেনহাসকে পাকিস্তানে ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সেসময়ে একজন পাকিস্তানির বছরে সর্বোচ্চ একবার বৈদেশিক ফ্লাইটে যাবার অনুমোদন ছিল সেহেতু মাসকারেনহাসকে দেশ থেকে পালানোর জন্য নিজেরই একটি উপায় বের করতে হয়েছিল। তিনি স্থলপথে আফগান সীমান্ত পার হয়েছিল।
পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য বাংলাদেশিরা। ছবি : সংগৃহীত
তার পরিবার তাদের লন্ডনের বাড়িতে যেদিন একত্রিত হলো ঠিক তার পরেরদিন ই 'সানডে টাইমস' এ "জেনোসাইড' শিরোনামে তার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হল।
প্রতারণা
রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে এটা ছিল দুঃসাহসিক ও শক্তিশালী একটি অংশ কারণ মাসকারেনহাস পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের দ্বারা স্পষ্টভাবেই খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি তার অধিকাংশ সময় তাদের সঙ্গেই কাটিয়েছিলেন।
'আমি সেনা ইউনিটের দ্বারা নৃশংস 'হত্যা ও অগ্নিসংযোগ অভিযান'গুলোর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। বিদ্রোহীমুক্ত করার পরে একটা পর একটা গ্রাম ও শহরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন অভিযানকে দেখেছি।'
'আমি "শাস্তিমূলক পদক্ষেপ" এর অংশ হিসেবে পুরো গ্রামকে ধ্বংস করতে দেখেছি।'
এবং রাতে কর্মকর্তাদের মেসে আমি সংশয়াপন্ন হয়ে সাহসী ও সম্মানিত মানুষদের উল্লাস করতে শুনেছি। সারাদিন কতগুলো হত্যা করেছে তা নিয়ে তাদের গর্ব করে উল্লাস করতে দেখেছি।'
'"তুমি কতজনকে পেয়েছিলে?" উত্তরগুলো আমার স্মৃতিকে অসাড় করে দিয়েছিল।'
২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথম আঘাত হানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার প্রতিবেদনটি একটি বিশাল প্রতারণা ছিল। এমনকি তাকে শত্রুপক্ষের এজেন্ট বলেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এখনও তাদের বাহিনীকে এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে, যেভাবে মাসকারেনহাস বর্বর নির্যাতনের কথা বর্ননা করেছিলেন। উল্টো তারা একে ভারতের প্রোপ্যাগান্ডা বলে দোষারোপ করে।
যাই হোক, এরপরেও তিনি পাকিস্তানে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বজায় রাখতে পেরেছিলেন এবং ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের পারমানবিক অস্ত্রের উন্নয়ন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের পারমানবিক অস্ত্রের সম্পৃক্ততার কথা সাংবাদিক হিসেবে তিনিই প্রথম প্রকাশ করেছিলেন বিশ্ব দরবারে।
বাংলাদেশে, অবশ্যই তিনি অত্যধিক সমাধৃত হয়ে আছেন। বাংলাদেশিরা তার প্রতিবেদনটি তাদেরমুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রেখেছে। জাদুঘরের একজন তত্ত্বাবধায়ক মফিদুল হক বলেন, 'যুদ্ধ নিয়ে লেখা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেদন এটি। এটা এমন এক সময় বের হয়েছিল যখন আমাদের দেশের সঙ্গে সমস্ত বিশ্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। এখানে যা হচ্ছে কিংবা সাহায্যের জন্য বহির্বিশ্বের নিকট যখন কোন সংবাদ পৌঁছানো সম্ভব ই ছিলনা ঠিক তখন এটা প্রকাশ হলো।'
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের পরিবার বর্তমানে তুলনামূলক শীতল এক দেশে নতুন জীবনে স্থায়ী হয়েছে। ভন্নে মাসকারেনহাস বলেন, লন্ডনের মানুষ খুব গম্ভীর ছিল এবং আমাদের সঙ্গে কেউ কথা বলতো না।'
ভন্নে মনে করে বললেন, 'আমরা খুব খুশি থাকতে চেয়েছিলাম, মুখে সর্বদা হাসি রাখার চেষ্টা করতাম। করাচী থেকে লন্ডন আমাদের জন্য সামান্য একটা পরিবর্তন ছিল যা নিয়ে আমরা কখনই পরিতাপ করিনি।'
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক মফিদুল হক। ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের ৪৭ বছর পূর্ণ হল আজ। এই বিজয় বিশ্বে শক্তিশালী শাসকশ্রেনীর হাত থেকে নিরস্ত্র দুর্বল শাসিতদের বিজয়। বিশ্ব দরবারে সমস্ত শাসিত, শোষিত মানুষের নিকট এই বিজয় এক অনুপ্রেরণা। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় এক জাতির ওপর বর্বর অত্যাচার, গণহত্যা, ধর্ষণ, জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোর পরেও সেই জাতি ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে এনেছিল।
এই দৃষ্টান্ত স্থাপনের ক্ষেত্রে এসব মানুষের ভূমিকাকে যথাযথ শ্রদ্ধা করা না গেলে জাতি হিসেবে আমরা কখনই নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারবনা। শোষিত মানুষের পক্ষে যেসব সাংবাদিক বিশ্বের আনাচে কানাচে সংগ্রাম করছে, সবকিছু ঝুঁকিতে ফেলে কাজ করে এই পেশাকে মহিমান্বিত করেছে তাদেরকে এই বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়ে স্বরণ করা উচিৎ প্রতিটি বাঙ্গালির।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড