একে আজাদ
খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত শিশুটির নাম রাখা হয় ক্ষুদিরাম। ১৬ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম পুলিশ স্টেশনের কাছে বোমা পুঁতে রাখেন এবং ইংরেজ কর্মকর্তাদের লক্ষ করেন। একের পর এক বোমা হামলার দায়ে ৩ বছর পর তাকে আটক করা হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর, বিহারে রাতে সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয় ২১ মে ১৯০৮ তারিখে যা আলিপুর বোমা মামলা নামে পরিচিত হয়। বিচারক ছিলেন জনৈক ব্রিটিশ মি. কর্নডফ এবং দুইজন ভারতীয়, লাথুনিপ্রসাদ ও জানকিপ্রসাদ। রায় শোনার পরে ক্ষুদিরামের মুখে হাসি দেখা যায়। তার বয়স খুব কম ছিল। বিচারক কর্নডফ তাকে প্রশ্ন করেন, তাকে যে ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কি না?
৩ ডিসেম্বর নীরবেই চলে গেল তার জন্মদিন। তার জন্মদিনেও বার বার ফিরে আসে ক্ষুদিরামের মৃত্যু কাহিনী। ফাঁসির মঞ্চে যথারীতি এক কথায় জল্লাদকেও অবাক করে দিয়েছিলেন আঠারোর বালক। তাঁর মৃত্যুবরণ দেখে হয়তো ভয় পেয়েছিলেন স্বয়ং যমরাজও। এমনই ছিলেন মেদিনীপুরের বিষ্ময় বালক ক্ষুদিরাম বসু।
জল্লাদকে কি এমন কথা বলেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু? তার ফাঁসির আগের মুহূর্তগুলোও অবাক করে দেওয়া। কথোপকথন এবং আচার ব্যবহারে একবারও মনে হয়নি ওকে মৃত্যু ভয় কোনো কথা রয়েছে। সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন ক্ষুদিরামের পক্ষে সওয়ালকারী তিন আইনজীবীর একজন। এ দিক সে দিক বহু কথার পর তিনি ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞাসা করেন “তুমি কি জানো রংপুর হইতে আমরা কয়েকজন উকিল তোমাকে বাঁচাইতে আসিয়াছি? তুমি তো নিজেই আপন কৃতকর্ম স্বীকার করিয়াছ।” ক্ষুদিরামের উত্তর ছিল “কেন স্বীকার করব না ?” এমনই ছিল তার শেষ প্রশ্নটিও।
১১ আগস্ট, জেলের ভিতরে ডানদিকে একটু দূরে প্রায় ১৫ ফুট উঁচুতে ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে দুই খুঁটি আর একটি মোটা লোহার রড যা আড়াআড়িভাবে যুক্ত তারই মাঝখানে বাঁধা মোটা একগাছি দড়ি ঝুলিয়া আছে। তাহার শেষ প্রান্তে একটি ফাঁস। এরপরেই ক্ষুদিরামকে নিয়ে আসে চারজন পুলিশ। তথ্য বলছে, ক্ষুদিরামই হাঁটছিলেন আগে। যেন তিনিই সেপাইদের টেনে আনছেন। এরপর সে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হাসে। এরপর ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত হলে তার হাত দুটি পিছন দিকে এনে বেঁধে দেওয়া হয়। জল্লাদ তখন শেষ মুহূর্তের কাজ করছিল। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্রই দামাল ছেলের প্রশ্ন “ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?” – এটাই তার শেষ কথা। চমকে দিয়েছিল জল্লাদকে।
এরপরের ঘটনা ইতিহাস। একটি সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে গলায় ফাঁস দেওয়া হয়। ক্ষুদিরাম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেন শেষ মুহূর্তটিকে তিনি প্রাণভরে উপভোগ করছেন। এরপর উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখে একটি রুমাল উড়িয়ে দেন। জল্লাদ মঞ্চের অন্য প্রান্তে হ্যান্ডেল টেনে দেয়। কেবল কয়েক সেকেন্ড ধরে উপরের দড়িটি নড়তে থাকে। তারপর সব স্থির। আধঘণ্টা পর দুজন বাঙালি ডাক্তার এসে খাটিয়া ও নতুন বস্ত্র নিয়ে যায়। নিয়ম অনুসারে ফাঁসির পর গ্রিবার পশ্চাৎদিক অস্ত্রপচার করে দেখা হয়, পড়বার পর মৃত্যু হয়েছে কি না। ডাক্তার সেই অস্ত্রপচার করা স্থান সেলাই করে, ঠেলে বাইরে চলে আসা জিভও চোখ যথাস্থানে বসিয়ে দেন। পরিয়ে দেন নতুন কাপড়। এরপর দেহ আসে জেলের বাইরে।
অন্তিম সময়ে ক্ষুদিরাম ম্যাৎসিনী, গ্যারিবল্ডি ও রবীন্দ্ররচনাবলী পড়তে চেয়েছিলেন। অন্তিম দিনে আইনজীবী কালিদাসবাবুকে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন , “রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহরব্রত উদযাপন করত , আমিও তেমন নির্ভয়ে প্রাণ দিব।”
১০ আগস্ট ক্ষুদিরাম বলেছিল, “আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই”
ফাঁসির আগে ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা ছিল – তিনি বোমা বানাতে পারেন, অনুমতি পেলে ওটা সবাইকে শিখিয়ে যেতে চান!
ক্ষুদিরাম বসু ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের কাছাকাছি কেশপুর থানার অন্তর্গত মোহবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ত্রৈলক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোল প্রদেশের শহরে আয় এজেন্ট। তার মা লক্ষীপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তার মায়ের চতুর্থ সন্তান। তার দুই পুত্র আগেই মৃত্যুবরণ করেন। অপর পুত্রের মৃত্যুর আশঙ্কায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তার পুত্রকে তার বড় বোনের কাছে তিন মুঠি খুদের (শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত শিশুটির নাম পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম রাখা হয়। ক্ষুদিরাম বসু পরবর্তী সময়ে তার বড় বোনের কাছেই বড় হন।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকের সর্বকনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী এক বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। ফাঁসির সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড