নাবিলা বুশরা
বাংলাদেশের পূর্ব উপকূলের ছোট গ্রামগুলো নিয়ে গবেষণা করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন সেখানে গর্ভপাতের হার সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে আরও বেশি গবেষণার ফলাফলে জানা যায়, এর জন্য মূলত দায়ী জলবায়ুর পরিবর্তন। সাংবাদিক সুসান্নাহ স্যাভেজ এই লোকালয়ে গিয়ে জেনেছেন আরও বেশ কিছু তথ্য।
৩০ বছর বয়সী আল-মুন্নাহার বলেন, 'ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো। ছেলেরা কথা শোনে না। অনেক জেদি হয়। মেয়েরা শান্ত হয়।'
পূর্ব উপকূলের ছোট্ট একটি গ্রামে তিন ছেলেকে নিয়ে আল-মুন্নাহারের বসবাস। ছেলে সন্তান থাকার পরেও একটি মেয়ের জননী হতে চেয়েছিল সে। এই ভাবনায় চতুর্থবারের মতো মা হওয়ার সময় গর্ভপাত হয় তার। গ্রামে এভাবে গর্ভপাত হয়েছে এমন অনেক নারীর মাঝে সে নিজেও একজন।
যখন গর্ভপাত কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না, তখনই বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলে গর্ভপাতের হারকে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় একটু বেশিই দেখতে পাচ্ছিলেন। আর এর কারণ হিসেবে তারা জলবায়ুর পরিবর্তনকেই খুঁজে পান। আল-মুন্নাহার গ্রাম ফইল্যা পাড়া ঘুরে জানা যায়, এই গ্রামে টিকে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য। গ্রীষ্মকালে জলাশয়গুলো একদম শুকনো থাকে আর বর্ষাকালে হয়ে যায় সমুদ্র।
'এখানে আর কোনো ফসল উৎপন্ন হয় না', বলছিল আল-মুন্নাহার। অথচ খুব বেশিদিন আগে নয়, ১৯৯০ সাল পর্যন্তও এ জলাশয়গুলোতে ধান চাষ হতো।
ধান উৎপাদনকে যদি খুব বেশি লাভজনক হিসেবে নাও ধরা হয়, তবু বলা যায় এটি একটা সহনীয় মাত্রায় ছিল। কিন্তু এখন তাও নেই। পানি বৃদ্ধি আর সে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ বাধ্য হয়েই চিংড়ি চাষ করছে অথবা লবণ সংরক্ষণ করছে। বর্তমানে খুব অল্প পরিমাণ ধান ক্ষেত রয়েছে।
বাংলাদেশের ডায়রিয়া গবেষনা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)'র গবেষক ড. মানজুর হানিফি বলেন, 'জলবায়ু ক্রমশ পরিবর্তন হচ্ছে। জমিতে এর প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু শরীরেরটা পাচ্ছি না।'
লবণাক্ততা এবং ঘুষ
আইসিডিডিআরবি গত ত্রিশ বছর ধরে কক্সবাজারের কাছাকাছি চকরিয়া জেলায় এবং আশেপাশে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক নজরদারি রেখেছে। যার কারণে সে সকল সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যের এমনকি ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলোও জানা সম্ভব।
বিগত কয়েক বছরে, অনেক পরিবার বন কর্মকর্তাদের প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে সমুদ্র আর সমভূমি ছেড়ে পাহাড়ি এলাকার দিকে চলে গেছে।
তিন বছর আগে স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে উপকূল থেকে পাহাড়ে চলে আসে কাজল রেখা। সে জানায়, 'এই ঘর বানানোর জন্য আমরা ২৩০,০০০ টাকা দিয়েছি। কারণ পানির জন্য আমার সন্তানদের প্রায় সময়ই জ্বর হতো বিশেষ করে বন্যার পর যখন আমাদের বাড়ি পুরো ভেজা থাকত। কিন্তু এখানে জীবন যাপন বেশ সহজ।'
প্রাকৃতিক এই অভিবাসন তুলনামূলকভাবে বেশ ভালোই। ফসল ফলছে, চাকরি পেতে বা স্কুলে যেতে যাতায়াতের পথ সুগম হচ্ছে। আগের যে জীবন তারা ফেলে এসেছে তার চেয়ে এই জীবনে তারা বেশ ভালো আছে। বলতে গেলে, এই এলাকার নারীদের গর্ভপাত বেশ কম। ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মাঝে, পাহাড়ি এলাকা আর উপকূল মিলে আইসিডিডিআরবি'র গবেষক দল ১২,৮৬৭ গর্ভবতী নারীর তালিকা করে।
গর্ভবতী হওয়ার পর সন্তান জন্মদান পর্যন্ত এদের সবার ওপর নজর রেখে দেখা যায়, উপকূলীয় এলাকায় সে সকল নারীরা উপকূলের ২০ কিলোমিটার এবং সমুদ্রতল থেকে ৭ মিটার দূরত্বে বাস করেন তাদের গর্ভপাত সমুদ্র থেকে দূরে থাকা নারীদের তুলনায় ১ দশমিক ৩ মাত্রায় বেশি হয়।
পার্থক্যটা এখন হয়তো খুব ছোট বলে মনে হচ্ছে কিন্তু উপকূলীয় এলাকায় এই গর্ভপাতের হার দিন দিন বাড়ছে বলে জানান ড. হানিফি।
এই অঞ্চলের সাথে সাথে আইসিডিডিআরবি উপকূল থেকে অনেক দূরের একটি এলাকা মতলবকেও পর্যবেক্ষণে রেখেছিল। এই দুইয়ের মাঝে গবেষক দল বেশ বড় একটি পার্থক্য খুঁজে পান। চকরিয়াতে যেখানে গর্ভপাতের হার ১১ শতাংশ, সেখানে মতলবে ৮ শতাংশ!
গবেষক দলের বিশ্বাস, এই পার্থক্য হওয়ার মূল কারণ পানিতে থাকা লবণ যা ওই এলাকার গর্ভবতী নারীরা পান করে। আর পানিতে লবণ বৃদ্ধির মূল কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন।
যে সকল পরিবারের আর কোনো উপায় ছিল না
আইসক্যাপ গলে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এর সাথে সাথে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাও বায়ুমণ্ডলীয় চাপকে প্রভাবিত করছে। এমনকি এই কারণে একটি ছোট পরিবর্তনও সমুদ্রের স্তরে বিপরীত প্রভাব সৃষ্টি করে।
বায়ুমণ্ডলীয় চাপ যদি এক মিলিবার কমে যায় তাহলে সামুদ্রিক মাত্রা বেড়ে যায় দশ মিলিমিটার। বায়ুমন্ডলের নিম্নচাপের প্রভাবে অগভীর সমুদ্রের অববাহিকায় পানির ক্রমশ বৃদ্ধি হতে পারে বলে জানান ড. হানিফি।
যখন সমুদ্রের মাত্রা বৃদ্ধি পায় তখন সমুদ্রের লবণাক্ত পানি নদীর পরিষ্কার পানিতে প্রবাহিত হয়ে যায়, এমনকি মাটিতেও। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, পানির নিচের স্তর অ্যাকুয়াফারস যেখানে পানি মজুদ থাকে সেখানে এই লবণাক্ত পানি পরিষ্কার পানির সাথে মিশে যায়। পানির নিচে জমে থাকা এই মিশ্রিত পানি তখন গ্রামের টিউবওয়েলের পানির সাথে উপরে উঠে আসে।
ফইল্যা পাড়ায় একটি পাম্প থেকে গ্রামবাসীরা পানি নেয়। সে পাম্প থেকে যে পানি আসে সে পানির রঙ কিছুটা লাল। আর প্রচুর পরিমাণে লবণাক্ত। কিন্তু এতেও সে পাম্প থেকে গ্রামবাসীর পানি পান করা বন্ধ হয়নি- এমনকি গোসল, কাপড় ধোয়া বা খাবার রান্না কোনো কিছুই নয়!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র পরামর্শ মতে, একজন মানুষের দিনে ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া যাবে না। চকরিয়ায়, উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারীরা দিনে ১৬ গ্রামের বেশি লবণ খান যার পরিমাণ পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীদের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
আমেরিকার মতো দেশও স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্যাম্পেইনে অতিরিক্ত লবণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছে অনেকদিন ধরে। এটির কারণে হাইপারটেনশন হয়, বৃদ্ধি পায় স্ট্রোক আর হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা। এমনকি গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত এবং প্রিক্ল্যাম্পসিয়ারের জন্যও দায়ী অতিরিক্ত লবণ।
বাংলাদেশের এই পরিবারগুলো জানে না তারা যে পানি পান করছে তার জন্য তাদের শরীর ঠিক কতটা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আসলে এই অসহায় পরিবারগুলোর আর কোনো সুযোগ না থাকায় তারা এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই পানি পান করছে।
'লবণ ফসলের জন্য ক্ষতিকর' বলছিল ৫০ বছর বয়সী জানাত আরা। সে এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছে আর কখনও এখান থেকে অন্য কোথাও যায়নি। যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে তার পরিবার ফইল্যা পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে কিনা তখন সে হেসে বলছিল, 'অবশ্যই না! আমি এখানে সারাজীবন থাকব। আর আমরা কোথায় যাব? আমরা গরিব।'
'জীবন এখানে অনেক কঠিন'
তার প্রতিবেশী ২৩ বছর বয়সী শারমিন এখান থেকে চলে যেতে চায়।
তার দুই সন্তানের জন্য ফইল্যা পাড়ায় কী ভবিষ্যৎ আছে সে বিষয়ে শারমিন অনিশ্চিত। সে বলে, 'জীবন এখানে অনেক কঠিন'। কিন্তু তারপরেও খুব শিগগিরই সে আবার মা হতে যাচ্ছে।
'এ মুহূর্তে, শারমিন আর আল-মুন্নাহারদের মতো নারী যাদের গর্ভপাত হয়েছে তাদের সংখ্যা কিছু পরিমান বেড়েছে। কিন্তু যদি এই জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে এ সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়তেই থাকবে'- বলেন ড. হানিফি।
নিম্ন ভূমির দেশ যেখানে ভূমি জুড়ে বন্যার পানি থাকে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে দেশটি ক্রমশ সুরক্ষা হাত থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু সমুদ্রের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য দেশও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে।
ভারত মহাসাগর জুড়ে, ২০০৫ সালে সুনামির কারণে যে ক্ষতি হয়েছিল তাতে কৃষি জমি আর পরিষ্কার খাওয়ার পানির উৎসগুলো সব লবণাক্ত পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, চকরিয়া স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এই সাইটটিই একমাত্র সাইট যেটি দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্যসহ সকল বিষয় নজরদারিতে রাখা হয়।
ড. হানিফি বলেন, 'প্রচুর পরিমান অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন খাতে খরচ করা হলেও, বলতে গেলে কোনো একটি গবেষণাও জনস্বাস্থ্যে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। সবাই শুধু প্রাকৃতিক ক্ষতির কথাই ভাবছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা কারও নেই।'
তথ্যসূত্র: বিবিসি ডট কম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড