• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কোজি কটেজ যেন মৃত্যুপুরী

  বিশেষ প্রতিবেদক

০২ মার্চ ২০২৪, ২০:৫০

সাদা কাফনে মোড়ানো একের পর এক নিথর দেহ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের মাঝে। প্রিয় মানুষটির খাটিয়া ধরে গগন বিদারী চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। গত বৃহস্পতিবার রাতে বিভিষিকাময় আগুনে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে।

ভয়াবহ আগুনে একই পরিবারের ৫ জনসহ ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে। আহত ও দগ্ধদের মধ্যে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহতদের মধ্যে ৪০ জনের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে। তাদের মরদেহ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর বেইলি রোডের আগুনে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো।

এত মানুষের মৃত্যুর পেছনে আগুনে পোড়া ছাড়াও বিষাক্ত কালো ধোঁয়াকেও কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। আগুন লাগার পর উত্তাপ আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গ্রিন কোজি কটেজের ওপরের তলাগুলো। গতকাল শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করে ৪৬ জনের মৃত্যুর তথ্য দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন।

তিনি বলেন, ‘যারা মারা গেছেন তারা কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ, একটা বদ্ধ ঘরে যখন বের হতে পারে না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালীতে চলে যায়। প্রত্যেকেরই তা হয়েছে।

যাদের বেশি হয়েছে, তারা মারা গেছেন। তবে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তারাও কেউ শঙ্কামুক্ত নয়।’

তিনি বলেন, ‘যারা আগুনে পুড়ে মারা যান, তাদের শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গের ভেতরে তাপে বা পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। আবার আগুনের ধোঁয়ার কারণে শ্বাস নিতে না পারায় কারো কারো মৃত্যু হয়।

শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া মানুষ এক দণ্ড বাঁচতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় অক্সিজেনের। আগুনের ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। এই কার্বন মনোক্সাইডের মধ্যে শ্বাস নিতে গেলে অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং সেক্ষেত্রে মানুষ মারা যায়।’ এত মানুষের মৃত্যুর পেছনে আগুনে পোড়া ছাড়াও বিষাক্ত কালো ধোঁয়াকেও কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

সামান্য লাভের আশায় নিরাপত্তার কথা না ভেবে আর নিয়ম নীতি না মেনেই গড়ে তোলা হচ্ছে ভবনগুলো। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা আর প্রাণহানি। দুর্ঘটনা ঘটার পরই শুরু হয় এ নিয়ে আলোচনা। রাজধানীর বেইলি রোডের এই ভবনটিতে ছিল কোনো ধরনের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটিকে তিনবার নোটিশ দেয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।

গতকাল বেইলি রোডের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। মাইন উদ্দিন বলেন, ‘এই ভবনকে পূর্বে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ভবনের মালিককে তিনবার নোটিশ পাঠানো হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ভবনে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। এ কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’ আগুন লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা নিচতলার সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে।’

তিনি আরও বলেন, ভবনটিতে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাত্র একটি সিঁড়ি ও ভবনের একটি ছাড়া প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে খাবারে দোকান থাকায় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে।

বেইলি রোডে যে ভবনটি আগুন লেগেছে সে ভবনের নির্মাণের সময় নিয়ম মানা হয়নি বলে জানিয়েছেন মেয়র তাপস। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির ব্যতয় হয়েছে যখন নির্মাণ করা হয়েছে তখন। পাঁচ তলার ঊর্ধ্বে কোনো ভবন হলে দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। এই ভবনে তা ছিল না। রাজধানীর বেইলি রোডে যে ভবনটি আগুন লেগে ৪৬ জনের প্রাণ গেছে সেই ভবনটি বাণিজ্যিক কাজের জন্য অনুমোদন নেয়ার পরও বিনা অনুমতিতে আবাসিক করা হয়েছে।

মেয়র বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির ব্যতয় হয়েছে যখন নির্মাণ করা হয়েছে তখন। পাঁচ তলার ঊর্ধ্বে কোনো ভবন হলে দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। এই ভবনে তা ছিল না। ‘সিঁড়ি প্রশস্ত থাকার কথা কিন্তু এই ভবনে একটি মাত্র সিঁড়ি তাও প্রশস্ত নয়। এ ছাড়া ভবনটি বাণিজ্যিক কাজের জন্য অনুমোদন নেয়ার পরও আবাসিক করা হয়েছে বিনা অনুমতিতে।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্নভাবে নকশা অনুমোদন করা হচ্ছে কিন্তু সেসব নকশায় ইমারত বিধিমালাকে পরিপালন করা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত অনেক ক্ষেত্রে নকশা ঠিক থাকলেও যখন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে তখন ব্যতয় করা হচ্ছে।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন ‘সাততলা ভবনের একটি মাত্র সিঁড়ি, কোনো ফায়ার এক্সিটও নেই। একমাত্র সিঁড়িটিও আবার গ্যাস সিলিন্ডারে পরিপূর্ণ ছিল। ভয়ঙ্কর ব্যাপার! এরকম একটা অবস্থায় আপনি কিভাবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা করবেন। এসব ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অবশ্যই দায় আছে। বিশেষ করে সেখানে ফাস্ট সেফটি নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব ছিল।’ গতকাল রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাøের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি এসব কথা বলেন।

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘গত বছরের ৪ জুন আমরা একটি জাতীয় সেমিনার করি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে। সেখানে আমরা নিমতলীর ঘটনা, চুরিহাট্টার ঘটনা, বঙ্গবাজারের ঘটনা, নিউমার্কেটের ঘটনাসহ সব বড় বড় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে পর্যালোচনা করি। সেখানে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করি। কিন্তু সেসব সুপারিশের আলোকে আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।’

জাতীয়ভাবেই আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা কেউ এ ধরনের অগ্নিকাø নিয়ে সচেতন হচ্ছি না। কর্তৃপক্ষকে এখন বাধ্য করতে হবে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করতে।’

কর্তৃপক্ষের অবহেলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কামাল উদ্দিন বলেন, ‘দেখুন, এখনও পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরেনি। কাদের দায়িত্ব এটা সরানোর? ফায়ার সার্ভিস সরানোর জন্য একের পর এক নোটিশ করবে আর এগুলো সরবে না- এটা তো হতে পারে না।’

চেনা যাচ্ছে না ৬ মরদেহ, হবে ডিএনএ পরীক্ষা :

রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ৪০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে এখনো ছয়জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ওই ছয়জন বেশি পুড়েছে। তাদেরকে চেনা যাচ্ছে না। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত হলে তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এদিকে রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভবনের নিচতলার চুমুক রেস্তোরার ২ জন ও কাচ্চি ভাইয়ের ম্যানেজারকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া ভবন মালিকসহ যাদের দায় আছে তাদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ: মহিদ উদ্দিন।

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সাত সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি আগামী ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে ভবনটির প্রয়োজনীয় নথিপত্র বিশ্লেষণ করে কমিটি জানতে পেরেছে, বেইলি রোডের ভবনটির অনুমোদন, নকশায় কোন ত্রুটি নেই। তবে ৭ তলা এই ভবনটির ৫ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন থাকলেও তারা উপরের বাকি দুই তলাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করেছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড