• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শাবনূরকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন সালমান

  মনিরুল ইসলাম মনি

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:১১
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার
সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেন পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার (ছবি : দৈনিক অধিকার)

স্ত্রী সামিরাকে তালাক না দিয়েই চিত্রনায়িকা শাবনূরকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ। তবে সামিরা বিষয়টি জেনে তালাক চেয়েছিলেন।

সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতাসহ পাঁচ কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন ৯০ দশকের জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ। আমাদের দীর্ঘ তদন্ত বলছে সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছেন। এছাড়াও আত্মহত্যার বাকি চার কারণ হলো— স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ, সালমান শাহ’র মাত্রারিক্ত আবেগপ্রবণতা এবং একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়া বা আত্মহত্যার চেষ্টা করা, মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা, জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রূপ নেওয়া এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনের অপূর্ণতা।’

পিবিআইয়ের প্রধান বলেন, পিবিআই চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র অপমৃত্যু মামলার তদন্ত শেষ করেছে। তদন্তে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সালমান শাহ’র বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন— ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসায় দেখা করতে যান তিনি। ওই সময় সালমান শাহ ঘুমাচ্ছিলেন শুনে সেখান থেকে ফিরে আসেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই চলচ্চিত্র প্রোডাকশন ম্যানেজার সেলিম সাহেব তাকে ফোন করে জানান সালমান শাহ’র কী যেন হয়েছে এবং তাকে দ্রুত সালমানের বাসায় যেতে বলেন। তখন তিনি তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে দ্রুত সালমান শাহ’র বাসায় যান। গিয়ে দেখেন সালমান মরার মতো তার রুমে শুয়ে আছেন। তখন তিনি উপস্থিত লোকদের সহায়তায় সালমানকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যান। তার অভিযোগ, হাসপাতালে যাওয়ার পথে তারা সালমানের গলায় দড়ির দাগ এবং মুখ ও হাত-পা নীলাভ বর্ণের দেখেন। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে গেলে কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক সালমান শাহকে মৃত ঘোষণা করেন।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বলেন, সালমান শাহ’র বাবার লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে রমনা মডেল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়। ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এসআই মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য পাঠান এবং সংশ্লিষ্ট সব আলামত জব্দ করেন। ডা. তেজেন্দ্র চন্দ্র দাস সালমানের লাশের ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। তিনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তার মতামত দেন যে, ‘ফাঁসের কারণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু সম্পন্ন হয়েছে, যা মৃত্যুপূর্ব ও আত্মহত্যাজনিত’। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার তখন ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়।

বনজ কুমার আরও বলেন, ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. হুমায়ুন কবীর মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। তার তদন্তকালে ১৯৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সালমান শাহ’র লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে পুনরায় সুরতহাল ও ময়না তদন্ত করা হয়। তিনি আলামত জব্দ করেন। পুনঃময়না তদন্তের রিপোর্ট প্রস্তুত করেন ডা. নার্গিস আরা চৌধুরী। মামলার তদন্ত সমাপ্ত করে সালমান শাহ’র মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আত্মহত্যা ব্যতীত কোনো সন্দেহ না থাকায় অর্থাৎ সালমান শাহ’র মৃত্যুটি ‘আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু’ বলে প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৯৭ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়।

তিনি আরও বলেন, বাদীর না-রাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত অপমৃত্যু মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মজিবুর রহমান মামলাটির পুনঃতদন্তভার গ্রহণ করেন। তার তদন্তের সময় ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই মো. রেজভী আহমদ ওরফে ফরহাদ (২০) সালমান শাহ’র বাবার বাসায় গিয়ে লেলিন পরিচয় দিলে তার বিরুদ্ধে ক্যান্টনমেন্ট থানায় ৩৭(০৭)৯৭ নম্বরের একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। তিনি আদালতে সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে বলে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারা মতে জবানবন্দি দেন।

বনজ কুমার বলেন, ওই অবস্থায় বাদী আদালতে অপমৃত্যু মামলাটি পেনাল কোড ৩০২/৩৪ ধারা মতে হত্যা মামলা হিসেবে নিয়ে তদন্তভার সিআইডিকে দেওয়ার আবেদন করেন। অপমৃত্যু মামলাটি তদন্তাধীন থাকায় আবেদনটিসহ রেজভী আহমদ ফরহাদের ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারার জবানবন্দির বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালত আইজিপিকে নির্দেশ দেন।

পিবিআই প্রধান বলেন, সিআইডি সিটি জোন ঢাকার সহকারী পুলিশ সুপার মো. খালেক উজ-জামান অপমৃত্যু মামলাটিসহ হত্যা মামলার আবেদন ও মো. রেজভী আহমদ ফরহাদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দির বিষয়ে তদন্তভার গ্রহণ করেন। তার তদন্তের সময় রেজভী আহমেদ ফরহাদকে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধায়নে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, সালমানের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না এবং তিনি সালমানের একজন ভক্ত হিসেবে তার ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় ও ছবি সংগ্রহের জন্য বাসায় গিয়েছিলেন। ক্যান্টনমেন্ট থানায় ও পরবর্তীকালে আদালতে যে জবানবন্দি লেখা হয়েছে এটা তার নিজের কোনো বক্তব্য নয়। ওই সময় তাকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মারপিট করা হয়। সালমানের মা-বাবা, ওসি ও দুজন এসআই তাকে সালমানের হত্যার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। তদন্তকালে অপমৃত্যু মামলার পুনঃতদন্ত সমাপ্ত করে সালমান শাহ’র মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আত্মহত্যা ব্যতীত অন্য কোনো সন্দেহ বা অন্য কোনো কারণ পাওয়া যায়নি।

চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে অতিরিক্ত সখ্যতাকে সালমানের আত্মহত্যার একটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সালমান শাহ’র সঙ্গে চিত্রনায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা থাকায় স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। সৃষ্ট এ দাম্পত্য কলহের কারণেই সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন এবং সালমান শাহ’র মৃত্যু পরিকল্পিত কোনো হত্যাকাণ্ড নয়।

রেজভী আহমেদ ফরহাদের জবানবন্দি সাজানো উল্লেখ করে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সালমান শাহ’র মৃত্যুটি ‘আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু’ প্রমাণ হওয়ায় তিনি গত ১৯৯৭ সালের ২ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। ওই মামলায় বাদী না-রাজি আবেদন করলে আদালত না-রাজি আবেদনটি নামঞ্জুর করেন। এর প্রেক্ষিতে বাদী গত ১৯৯৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নামঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মেট্রো ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা করেন। এই প্রেক্ষিতে অপমৃত্যু মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ হয়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে পাওয়া সাক্ষ্য-প্রমাণ ও সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনায় অভিযোগকারীর অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক ২০১৪ সালের ৯ জুলাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

পিবিআই প্রধান বলেন, সালমান শাহ’র মা নিলুফার চৌধুরী নীলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে না-রাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি র‌্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে ফৌজদারি রিভিশন মামলা করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত র‌্যাবকে তদন্তের আদেশ দেন। পরে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম বাবুল মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। মামলার তদন্তভার গ্রহণের পর আমার নির্দেশে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তদন্তে সহায়তা করার জন্য পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা ও পুলিশ পরিদর্শক মো. হুমায়ূন কবির মোল্লার সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করি। আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও সার্বিক নির্দেশনায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করি। পিবিআই তদন্তকালে ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনা সংশ্লিষ্ট ৪৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করে। এ ছাড়া ১০ সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট সব আলামত জব্দ করা হয়।

যেসব বিষয় নিয়ে তদন্ত এগিয়ে নেয় পিবিআই—প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল রিপোর্ট, প্রমথ ও দ্বিতীয় ভিসারা রিপোর্ট, কেমিকেল রিপোর্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় ময়না তদন্ত রিপোর্ট, বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ডের মতামত, হস্তলিপি বিশারদের মতামত, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বিল্ডিংয়ে প্রবেশ ও বাহির সংক্রান্তে বিশেষজ্ঞের মতামত, রিজভী আহমেদ ফরহাদ ও জরিনা বেগমের অডিও রেকর্ড, সাক্ষীদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি, ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রেকর্ড করা ১৬১ ধারায় জবানবন্দি, জব্দ করা আলামত পর্যালোচনা, আগের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা, বিভিন্ন লিখিত সাক্ষ্য, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য, কাগজপত্র এবং অন্য সাক্ষ্য পর্যালোচনা।

পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসে সালমান শাহ খুন হননি এবং সালমান শাহ’র মৃত্যুর ঘটনা একটি আত্মহত্যা।

আত্মহত্যার কারণ- জনপ্রিয় এ নায়কের আত্মহত্যায় পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে পিবিআই। প্রথমত. সালমান শাহ ও চিত্রনায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা। দ্বিতীয়ত. স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ। তৃতীয়ত. মাত্রাধিক আবেগ প্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টা। চতুর্থ. মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা, জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রুপ নেওয়া। পঞ্চম. সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ। ওই সময় সালমান শাহ’র হাতের লেখা একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে পুলিশ। সেখানে যা লেখা ছিল—‘আমি চৌ. মো. শাহরিয়ার। পিতা কমরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। ১৪৬/৫, গ্রীন রোড ঢাকা-১২১৫ ওরফে সালমান শাহ। এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে-আজ অথবা আজকের পরে যে কোনো দিন আমার মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি।’

ওডি/এমআই/এমআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড