• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (১১তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

২৬ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:০৫
প্রচ্ছদ
ছবি : প্রতীকী

সায়েম স্তব্ধ হয়ে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারা। সারাকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়েছে সায়েম। তবে ওর চোখেমুখে এখন বিস্ময় নয়, বরং ভয় কাজ করছে। ইতিকে না হয় কোনোভাবে মিথ্যে বলে পাড় পেয়ে যেতো। কিন্তু সারাকে মিথ্যে বলবে কীভাবে ও? সারার কাছে যে সে অপরাধী। সায়েম সারার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। একটা ভয় কাজ করছে ওর মনের ভিতর। আর একটা শঙ্কা, যা একটু একটু করে কুড়ে-কুড়ে খাচ্ছে।

সায়েমকে চুপ থাকতে দেখে সারা নিজেই প্রথমে বলল, ‘এই আপনার আসার সময় হলো। আপনার মাথায় কী কোনো বুদ্ধি নেই? ইতিকে তাও মিথ্যে বলে শান্ত করে রেখেছিলাম। কিন্তু ইতিকে যেটা বলেছি, সেটা তো সত্যিই না। আমার তো আপনার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল।’

সায়েম নিজের ভিতর দৃঢ়তা আনল। এরপর বলল, ‘ইতিকে কোন মিথ্যে বলেছেন আপনি?’

- এটাই বলেছি যে, আপনি অফিসের একটা কাজে একটু দূরে আছেন। অনেকটা সময় লাগবে এই কাজ শেষ করতে। আর খুব ব্যস্ততায় থাকবেন বলে ফোনটা সাথে নিয়ে জাননি। কিন্তু আমি তো জানি এটা সত্যি নয়। এটা ঠিক যে আপনি অফিসের একটা কাজেই বাইরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বসের কাছ থেকে এমনটাই শুনেছি আমি।

সায়েম মুখের ঘাম মুছতে লাগল শার্টের হাতের অংশটুকু দিয়ে। সারা আবার বলল, ‘তো মি. সায়েম, এবার সত্যিটা বলুন। সারারাত কোথায় ছিলেন আপনি?’

সায়েম ভিতরে উঁকি দিলো। কিন্তু না, ইতি আশেপাশে কোথাও নেই। তাই বলল, ‘একটু কাজ ছিল আমার।’

- সে তো কালকে দুপুরে ছিল। কিন্তু রাতে কী করেছেন আপনি?

- তার আগে বলুন আপনি কালকে অফিসে না গিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন? দারোয়ান বলেছিল আপনি অনেকক্ষণ আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন৷ কিন্তু অফিস গিয়ে আমি আপনাকে পাইনি।

- বাবার সম্পর্কে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম কালকে। এছাড়াও কিছু রিপোর্ট ছিল, যা ডাক্তারকে দেখাতে হয়েছে।

আনিস উদ্দিনের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে সায়েমের। ওই লোকটা কালকে মিথ্যে বলেছিল ওকে। যার ফলস্বরূপ এতসব কাণ্ড হলো। সায়েম এইসব ভাবে বাদ দিয়ে সারাকে পাশ কাটিয়ে ইতির রুমের আসতে চাচ্ছিল। সারা তখন পিছন থেকে বলল, ‘দরজাটা আটকে দিন সায়েম। আমি উপরে যাচ্ছি। আসলে ইতি একা বলে রাতে আমি এখানেই ছিলাম। এখন যখন আপনি এসে গেছেন, তাই আমি উপরে যাচ্ছি। তাছাড়া অফিসেও যেতে হবে।’

সায়েম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। কারণ ও নিজেই চাচ্ছিল সারা যেন এখন চলে যায়। সারার সামনে কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না সায়েম। সারা চলে যাওয়ার পর দরজাটা আটকে দিয়ে ইতির ঘরে এলো সায়েম। ঘরে এসে দেখে ইতি কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে। হঠাৎ সায়েমের বুকটা কেমন ধুক্ দিয়ে উঠল। ইতি কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে দিয়ে সায়েমের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ভয়টা আরো বেড়ে গেল সায়েমের। নিজের মনে মনে বলল, ‘ইতি কী সবটা জেনে গেল?’

সায়েম মনে মনে এইসব ভাবলেও মুখে কিছু বলছে না। তা দেখে ইতি কিছুটা চেঁচিয়েই বলল, ‘এইসব কী শুনছি ভাইয়া? তুমি এইরকম একটা কাজ করতে পারলে। ছি. ভাইয়া।’

সায়েমের হাত-পা কাঁপছে। ও প্ল্যান করেছিল ইতিকে সত্যিটা না বলে এখান থেকে চলে যাবে। আর চাকরিটাও ছেড়ে দিবে। কারোর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ না রেখে দূরে কোথাও চলে যাবে ওরা। কিন্তু সেসব বোধহয় আর সম্ভব হবে না। ইতি সবটা জেনে গেলে কিছুতেই এ অন্যায় মেনে নিবে না।

সায়েমকে চুপ থাকতে দেখে ইতি আরো চেঁচিয়ে বলল, ‘কী হলো চুপ করে আছ কেন? বল এইরকম অন্যায় একটা কাজ কেন করলে তুমি? সারা আপুকে কেন ঠকালে?’

সায়েম কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ওর হাত পায়ের সাথে সাথে কণ্ঠস্বরও কাঁপছে। যার কারণে স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারছে না। কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকলে ইতি ওকে আরো ভুল বুঝবে।

সায়েম নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘আমার কথাটা শোন ইতি। আমি একটা ফাঁদে পড়েছিলাম। আর সেজন্যই এতসব হয়ে গেল। আমার জন্য ফাঁদ পেতেছিল আমার নিজের বাবা-মা। ভাবতে পারছিস কতটা অসহায়তার মধ্যে দিয়ে এই একটা রাত পাড় করেছি আমি। কিন্তু তোকে এইসবকে বলল?’

- রাফা নিজেই আমাকে ফোন করে এইসব বলল। তুই নাকি ওকে বিয়ে করেছিস। আর সকালে পালিয়ে এসেছিস।

- আমি বিয়ে করতে চাইনি বোন। ও আমাকে জোর করে বিয়ে করেছে।

ইতি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তুমি কী বাচ্চা ছেলে নাকি? যে তোমাকে জোর করে বিয়ে করিয়ে দিবে, আর তুমি কিচ্ছু বলতে পারবে না। আমাকে মিথ্যে বলে পাড় পাবে না ভাইয়া।’

সায়েম দমে গেল এবার। কথাটা ওভাবে বলা উচিত হয়নি। জোর করে বিয়ে করায়নি, কারণ সায়েম নিজে থেকেই হাসিমুখে কবুল বলেছে, সাইন করেছে। কিন্তু ওর সাথে ছলনা করা হয়েছে।

- না, না। জোর করে না। তবে আমাকে ঠকানো হয়েছে। সায়েমের দৃঢ় কণ্ঠ শুনে ইতি ঠোঁট বাকিয়ে অবিশ্বাসের স্বরে বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি না।’

- বিশ্বাস না করলে আমার আর কিছু বলার নেই ইতি। কারণ আমি খুব ভালো করেই জানি, আমি কাউকেই ঠকাইনি। কালকের ঘটনাটা জাস্ট একটা দূর্ঘটনামাত্র।

- ইহ্। ইতি এবারও বিশ্বাস করল না সায়েমের কথাটা।

- সত্যি বলছি ওটা একটা দূর্ঘটনা। ভুল করে রাফার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

- একটু বুঝিয়ে বল তো। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

- কাল অফিসে যাওয়ার পর দেখলাম সারা নিজের ডেস্কে নেই৷ একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, সারা অফিসেই আসেনি। অথচ সারা আমার অনেকক্ষণ আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। বসের রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে আমার কথাটা এড়িয়ে গেল। উল্টে আমাকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে দিলো। কাজটা বাইরের ছিল। অন্য একটা কোম্পনির সাথে ডিলের ব্যপারে কথা বলার জন্য কিছুটা দূরে যেতে হয়েছিল। এর মধ্যে সারাকে ফোন করে খোঁজখবর নেওয়ার সময়ই পাইনি। তো ভেবেছিলাম মিটিং শেষ করে সারাকে ফোন দিবো। কিন্তু মিটিংসহ আরো নানান কাজ শেষ করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তবুও ভেবেছিলাম সারাকে ফোন দিই। কিন্তু হঠাৎ বাবা ফোন দিলো।

- আমার বাবা!

- হ্যাঁ তোরই বাবা।

- না, মানে আমি সেটা বলিনি। বললাম যে আমাদের বাবা ফোন করেছিল কী? আসলে মাঝে এতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও কখনো ফোন দেয়নি তো, সেজন্য একটু অবাক হলাম।

- ফোন দিতো না কখনোই। নেহাৎ খুব বড় একটা উদ্দেশ্য ছিল, তাই ফোন দিয়েছে। অবশ্য তার উদ্দেশ্যটা আমার জন্য ভালো ছিল না।

- তো ওই লোকটা ফোন করে কী বলল তোমাকে?

- বাবা ফোন দিয়ে বলল বাড়িতে নাকি ঝামেলা হইছে। আমি যেন তাড়াতাড়ি ওখানে যাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? সে বলল, আগে বাড়িতে আয়, খুব জরুরি। আর তাড়াতাড়ি আয়। আমি এটাও বলেছি যে, তোকে যেন ফোন দেয়। বাবা বলল তুই নাকি ওখানেই আছিস এবং আমাকেও যেতে হবে ওখানে।

- আমি ওই বাড়িতে আবার কখন গেলাম। আমি তো সারাদিন এই বাড়িতেই ছিলাম। সায়েমকে আবারও থামিয়ে দিয়ে ইতি কথাটা বলল। সায়েম বিরক্তির স্বরে বলল, ‘মাঝে পথে কথা বলিস না। আমাকে আগে সবটা বলতে দে। আসলে বাবা কথাটা মিথ্যে বলেছিল। যেন আমি কোনোরকম দ্বিধা না করে ওখানে চলে যাই। ঠিক তাই হলো। আমি ভাবলাম তুইও যখন ওই বাড়িতে আছিস, তার মানে কোনো গণ্ডগোল হয়েছেই। এবং সিরিয়াস কিছু। তাই আমি আর কিছু না ভেবেই তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে লাগলাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল তখন। বাড়ির অবস্থা দেখে তো আমি ‘হা’ হয়ে গিয়েছিলাম। যতই ভিতরে যাচ্ছি, ততই অবাক হচ্ছি। বাড়িতে লোকজনও অনেক ছিল। কয়েকজন আবার আমাদের আত্নীয়। কিছুক্ষণ পর মা আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম এইসব কী হচ্ছে? মা তখন হুট করেই বলল, তোর বিয়ের দাওয়াতেই সবাই এসেছে। আর এভাবে সাজানো হয়েছে বাড়ি। মায়ের কথা শুনে তো আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু মা পরক্ষণেই বলল, তুই যেই মেয়েটাকে ভালোবাসিস, সেই মেয়েটার সাথেই তোর বিয়ে হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?’

- এখন এতকিছু বলার সময় নেই বাবা। আগে বিয়েটা হোক, আত্নীয় স্বজন বিদেয় দেই। ফ্রি হয়ে সব বলব।

- আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মা। আমি কাকে ভালোবাসি না বাসি, সেটা তোমরা কীভাবে জানলে?

- কাশেমকে দিয়ে তোর বাবা সব খবরাখবর নিয়েছে।

- কাশেম ভাইকে দিয়ে খোঁজখবর নিয়েছে মানে?

- বললাম তো এত সময় নেই এখন। অনেক দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই।

- কিন্তু ইতি কোথায়? ওর সাথে কথা বলব আমি।

- ইতি মেয়েটার সাথেই পাশের ঘরে আছে। আর ইতি পালিয়ে যাচ্ছে না কোথাও। বিয়ে হোক, তারপর কথা বলিস।

- আমার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মা। এভাবে বিয়ে হচ্ছে আমার। তাছাড়া সারা তো আমাকে কিছুই বলল না। হুট করে ও বিয়েতে রাজি হয়ে গেল।

- আসলে সকালেও এখানে এসেছিল। আমাদের সামনে এসে বলল তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস। মেয়েটাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে, মেয়েটা চাকরি করে। এত কম বয়সেও মেয়েটা চাকরি করে তাবতেই অবাক লাগে।

- ওর চাকরি নিয়ে বাবা কোনো কথা বলেনি? বাবা তো মেয়েদের চাকরিবাকরি পছন্দ করে না।

- মেয়েটাকে খুব পছন্দ হয়েছে তার। আসলে আগেরদিন রাতে কাশেম তোর আর মেয়েটার বেশ কিছু ছবি দিয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে তুলেছে ছবিগুলো। তো সেগুলো দেখেই তোর বাবা মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেলেছে। আর সামনাসামনি দেখেও পছন্দ করে। তাই তখনই প্ল্যান করেছে যে, তোকে চমকে দিয়ে আজকেই বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। তখনই ইতিকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছে। তারপর আত্নীয়দের দাওয়াত দিয়েছে। বাড়ি সাজিয়েছে।

সায়েম একটু থামল। ইতি বলল, ‘মা এতবড় মিথ্যে কথা বলতে পারল? আর বাবা! ছি., এদের তো আমার বাবা-মা বলে ডাকতেই ঘৃণা করছে। আমাকে তো কেউই ফোন করেনি।’

- এরপর কী হয়েছে শোন। অন্যদের উপর বিশ্বাস না থাকলেও তোর উপর আমার বিশ্বাস ছিল। আর তুই তো জানিসই আমি সারাকে ভালোবাসি। সো আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, সারার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। যেহেতু সময় খুব কম ছিল। আর সবাই আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। তাই আমি আর সারার সাথে কথা বলার কোনো চেষ্টা না করেই অন্য একটা ঘরে ঢুকে গেলাম। এই চেষ্টা না করাটাই ছিল আমার জীবনের বড় একটা ভুল। কিছুক্ষণ পরই আমাদের কাজিনরা এলো। সাথে কাজী সাহেব এবং হজুর। বিয়ে পড়ানো হলো। সারা আমার পাশের ঘরেই ছিল। বিয়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই জোর করে আমি পাশের ঘরে গেলাম সারার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু পাশের ঘরে গিয়ে তো আমার চোখ কপালে ওঠে গেল। ওখানে সারার জায়গায় রাফা বসে আছে। আর তুই নেই ওখানে। আমি তো তখনই চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। মা হঠাৎ আমাকে টেনে অন্য ঘরে নিয়ে এলো। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এইসব কী হচ্ছে মা? সারার জায়গায় রাফা কেন? আর ইতি কোথায়?’

- তোর সাথে তো সারারই বিয়ে হয়েছে। আর ইতি নেই। আমি একটু মিথ্যে বলেছিলাম তোকে। মা ইতস্ততভাবে বলল কথাটা।

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সারার সাথে বিয়ে হয়েছে মানে? আমি তো ওই ঘরে দেখলাম রাফা বসে আছে বউ সেজে। তাহলে সারার সাথে কীভাবে বিয়ে হলো?’

- আরে ওর ডাক নাম হলো সারা। আর সার্টিফিকেট এ রাফা নাম আছে। ওইযে থাকে না, এক জনের কতগুলো নাম৷ ওইরকমই আরকি।

- এই মেয়েটা তোমাদের মিথ্যে বলেছে মা। ওর নাম সারা না। ওর নাম শুধুই রাফা। ফাহাদের বোন। আর আমি সারাকে ভালোবাসি। যে হয়তো এখন বাড়িতে আছে।

- এইসব কী বলছিস বাবা? আমরা তো মেয়েটার বাবা মায়ের সাথে কথা বললাম। ওর বাবা-মা তো গ্রামের গাড়িতে আছেন বলে আজকে আসতে পারেনি। তবে তারা রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। আর বিয়ে পড়ানোর অনুমতি-ও দিয়েছে। হয়তো কালকের মধ্যে চলে আসবে।

- তোমাদের ভুল বুঝানো হয়েছে মা। রাফার বাবা বেঁচে নেই৷ আর রাফার মা গ্রামে না৷ পাশের এলাকাতেই আছে। বললাম না, ও ফাহাদের ছোট বোন।

- কিন্তু বাবা কাশেম যে বলল তুই এই মেয়েটাই ভালোবাসিস। আমাদের তো ছবি-ও দেখিয়েছে।

- কীসের ছবি মা?

- দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি।

মা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ছবি আনতে।

ইতি বলল, ‘রাফা মেয়েটা এত সাংঘাতিক। ওরে আল্লাহ। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, বাবা-মা কী সব না জেনেই করেছে। নাকি তারাও এইসব জানতো।’

- তারা এইসব জানতো না।

- তাহলে এই মিথ্যেটা কেন বলল, যে আমি ওখানে আছি।

- কারণ রাফা বলেছিল, এই বিয়েতে তোর মত নেই। আর আমি নাকি তোর অমতে ওকে বিয়ে করতে চাইবো না। তাই মা বুদ্ধি করে বলেছে তুই ওখানেই আছিস। ফলে আমিও বুঝে যাবো এই বিয়েতে তোর মত আছে। আর আমিও বিয়েতে রাজি হয়ে যাবো।

- এরপর কী হলো? মা কীসের ছবি দেখালো তোমাকে?"

- পরশু হঠাৎ করে রাফা আমার অফিসে চলে গিয়েছিল। বসের রুম ফাঁকা পেয়ে হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আর তখনই কেউ ছবি তুলেছিল। সাথে একটা ছোট্ট ভিডিও। রাফা যতক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, ভিডিওটা-ও ততক্ষই করা হয়েছিল। এছাড়াও মাঝে মাঝে রাস্তাঘাটে রাফার সাথে আমার দেখা হতো। তখন দুই একটা কথা হতো। সেই মুহূর্তের ছবি-ও কেউ আড়াল থেকে তুলেছিল। যা ওই মোবাইলে ছিল।

- বলো কী! এতসব ছবি কে তুলল?

- ছবিগুলো নাকি কাশেমই বাবা-মাকে দেখিয়েছে। আর বলেছে এটাই আমার ভালোবাসার মানুষ। সুতরাং এতেই বুঝা যায় কাশেমই ছবিগুলো তুলেছে।

- সেটা কীভাবে সম্ভব? কাশেম ভাই তোমার অফিসে ঢুকবে কীভাবে?

- যেভাবে রাফা বসের রুমে ঢুকে গিয়েছিল, সেভাবেই ঢুকেছে। আমার মনে হয় এর পিছনে আরো বড় কারোর হাত আছে।

ইতি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ‘হারামজাদা কাশেকের বাচ্চাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে আমার।’

- আমারও তাই ইচ্ছে করেছিল তখন। কিন্তু কাশেম ভাই নাকি সকাল থেকে বাড়িতেই আসেনি।

- হয়তো পালিয়েছে। আচ্ছা, রাফার বাবা-মায়ের পরিচয়ে কে কথা বলেছিল। নম্বরটা নিশ্চয়ই আছে। সেটা কাজে লাগাতে পারব আমরা।

- গতকাল সকালে নাকি কাশেমের ফোন থেকে কল এসেছিল বাবার ফোনে। কাশেমই নাকি রাফার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাফার তো বাবা নেই। আর ওর মা এইরকম কিছুই করবে না। তাছাড়া ফাহাদ কখনোই আমার সাথে এইরকম কিছু করবে না। আর ওই বাড়িতে ফাহাদ বা, ওর মা, কাউকেই দেখিনি। আমার মনে হয় তারা কিছুই জানে না এইসব। সকল কূ-কর্ম কাশেম করেছে। আর ওকেও কেউ হেল্প করেছে। সাথে রাফা তো আছেই।

- কিন্তু কাশেম ভাই এইসব কেন করল?

- সেটা তখনই জানতে পারব, যখন কাশেমকে হাতের মুঠোয় পাবো।

- কিন্তু তুমি এতকিছু মেনে নিলে কেন? তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে৷ তুমি তখনই চলে আসতে সেখান থেকে।

- মাকে আমি সবটা খুলে বললাম। যে আমি রাফাকে নয়, সারা নামের একজনকে ভালোবাসি। আর রাফা তোমাদের মিথ্যে বলে আমাকে ঠকিয়েছে। ওর সঙ্গ দিয়েছে কাশেম। ছবিগুলো আমার অগোচরে তোলা হয়েছে। সবই ওদের প্রি-প্ল্যান। আর আমি এইসব কিছুতেই সহ্য করব না। আমি এক্ষুনি চলে যাবো এখান থেকে। মা তখন কেঁদে দিয়ে হাতজোড় করে বলল - "বাড়িতে অনেক আত্নীয়স্বজন আছে বাবা। আমি তোর পায়ে পড়ি, আপাতত চুপচাপ থাক। তোর বাবা অসুস্থ। এইসব শুনলে তিনি আরো অসুস্থ হবে৷ ফলে বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি, এর একটা বিহিত হবেই। কালকেই এই মেয়েটার মা আর ভাইকে ডেকে আনবো আমি। তারপর ব্যবস্থা করব। আপাতত একটু সহ্য কর। আত্নীয় স্বজন সব কালকের মধ্যেই চলে যাবে আশা করি। তখনই যা করার করিস।" কী আর করব বল? হাজার হলেও সে আমার নিজের মা। মা ছেলের পা ধরতে চাইছে৷ আর এভাবে আকুতি করছে। ছেলে হিসেবে কীভাবে সহ্য করব ওটা। তাই আর কিছু না বলে রাতটা সহ্য করলাম। আর ভোর হতেই গোপনে চলে এলাম।

- তুমি এত স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছ কীভাবে ভাইয়া? এই ঘটনার পরিনতির কথা ভাবতেই তো আমার শরীর কেঁপে উঠছে। ভাবতে পারছ, তুমি বিয়ে করে ফেলেছে। সারা আপু জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে ভাইয়া। সারাজীবনের জন্য তাকে হারিয়ে ফেলবে তুমি।

- আরে চুপ কর তো। কালকের ঘটনাটা নেহাৎই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। আমি মনে করব, কালকে রাতে নেশা করে ঘুমিয়েছিলাম। তারপর গভীর ঘুম থেকেই একটা স্বপ্ন দেখেছি৷ যা দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। সকাল হতেই সব স্বাভাবিক। তাছাড়া ভাবছি বাড়িটা চেঞ্জ করব। অফিস চেঞ্জ করার-ও পরিকল্পনা আছে আমার। যাতে করে কারোর মুখোমুখি হতে নাহয়।

- কিন্তু ভাইয়া, আসলে তো এটা কোনো দুঃস্বপ্ন না৷ এটা তো সত্যিই হয়েছে। আর তোমার বিয়ে হয়ে গেছে রাফার সাথে। রাফা তো খুব কান্নাকাটি করল আমাকে ফোন দিয়ে। মেয়েটার উপর একদিক দিয়ে খুব রাগ হচ্ছে, আবার খুব কষ্ট-ও হচ্ছে। শত হলেও নিজের বোনের মতো স্নেহ করতাম। তাছাড়া ওর জীবনটা অন্ধকারে চলে গেল। অবশ্য এর জন্য ও নিজেই দ্বায়ী।

- ওর জীবন কোথায় চলে গেল সেটা আমার দেখার বিষয় না। ও মরে যাক, এতেও আমার সমস্যা নেই। তাছাড়া বিয়েটা আমি ভেঙে দিয়েছি সকালেই।

ইতি অবাক হয়ে বলল, ‘মানে? কীভাবে?’

- ওর কানে কানে তিনবার তালাক বলেছি আমি।

- তিনবার তালাক বললেই বিয়ে ভেঙে যায় নাকি?

- যায় না? কে বলেছে যায় না? তিনবার কবুল বলাতে বিয়ে হয়ে যেতে পারলে তিনবার তালাক বলাতে বিয়ে ভেঙে যেতে পারে না কেন?

- তোমার সাথে তর্ক করে কোনো লাভ হবে না ভাইয়া। তুমি যাও, গিয়ে বিশ্রাম নাও। আজকের দিনটা অফিস থেকে ছুটি নাও। আমি ফাহাদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখি।

সায়েম ইতির ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো।

বেশ কিছুক্ষণ পর কলিংবেলের শব্দ শুনে সায়েম ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সাথে ইতিও। সায়েম এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে রাফাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সায়েমের বুকটা ধুকপুক করে উঠল। রাফা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে আছে সায়েমের দিকে। ড্রয়িংরুম থেকে ইতি বলল, ‘রাফা তুমি এখানে?’

রাফা বলল, ‘কী আর করব আপু? তোমার ভাই তো আমাকে ফেলেই পালিয়ে এসেছে।’

ইতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সায়েম রাগী কণ্ঠে বলল, ‘থাপ্পড় দিয়ে তোমার সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব মেয়ে। আর এখানে আসার সাহস কোত্থেকে পেলে তুমি? আমার ঠিকানাই বা কীভাবে পেলে? আমি তো কখনোই তোমাকে এখানকার ঠিকানা দিইনি।’

- ঠিকানা জোগাড় করা তো আমার বা হাতের কাজ। একটা ফোন করে শুধু তোমার ঠিকানা কেন, তোমার পুরো ডিটেইলস হাতের মুঠোয় আনার ক্ষমতা আছে আমার।

- চুপ কর তুমি। আগে বল তুমি এখানে কেন এসেছ?

- আমার বরের বাড়িতে আমি আসবো না তো কে আসবে শুনি?

- হুহ্! কে কার বর?

- তুমি আমার বর, আর আমি তোমার বউ।

সায়েম হেসে দিয়ে বলল, ‘হা হা হা! তিনবার তালাক বলে তোমাকে তালাক দিয়ে দিয়েছি আমি। সুতরাং তুমি এখন আর আমার বউ নও।’

- কারণ রাফা বলেছিল, এই বিয়েতে তোর মত নেই। আর আমি নাকি তোর অমতে ওকে বিয়ে করতে চাইবো না। তাই মা বুদ্ধি করে বলেছে তুই ওখানেই আছিস। ফলে আমিও বুঝে যাবো এই বিয়েতে তোর মত আছে। আর আমিও বিয়েতে রাজি হয়ে যাবো।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ১০ম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড