• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (১০ম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

২৪ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:০৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ডিম লাইটের আবছায়া আলোয় সায়েমের মুখটা দেখতে পাচ্ছে রাফা। একই বিছানার দুই প্রান্তে বসে আছে দু'জন। ঘরে আর কেউ নেই। দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো। আজ সায়েম আর রাফার বাসর রাত। হঠাৎ করেই ওদের বিয়েটা হয়ে গেল। সায়েম এখন নিজের বাড়িতেই আছে। সায়েমের ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পারছে না ও। অবশ্য জোরজবরদস্তি-ও তেমন করছে না। ও বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। কেমন যেন নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে। মানুষ সাধারণত নেশা করলেই মাতাল হয়। কিন্তু সায়েম তো নেশা করেনি। তবুও ওর নিজেকে মাতাল মাতল লাগছে৷ অসহায়ের দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকালো সায়েম। ওর এক কাজিন একপ্রকার রাগ করেই দরজাটা আটকে দিয়ে গেছে। দরজা আটকানোর আগে মেয়েটার চোখে জল দেখেছিল সায়েম। মেয়েটা ওকে অনেক পছন্দ করতো। একবার সরাসরি প্রপোজ করেছিল সায়েমকে৷ কিন্তু সায়েম ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে আর সাহস পায়নি সায়েমকে ভালোবাসার কথা বলতে। এমনকি সায়েমের সামনেও আসেনি সেদিনের পর থেকে। পারিবারিক ঘটনাক্রমে দুই একবার চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি। তবে আজ মেয়েটা সায়েমের সাথে একটু কথা বলার জন্য এসেছিল এই ঘরে। হয়তো সেদিনের জন্য ক্ষমা চাইতে। কিন্তু সায়েমের মা, মিসেস অন্তরা বেগম ওকে চোখ রাঙিয়ে বলে গেলেন, ‘বাসর তো ওদের হবে। তুই ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? থেকে দরজাটা আটকে দিয়ে চলে আয়।’

মেয়েটা কথাটাও বলতে পারল না। চোখে জল থাকলেও রাগ দেখিয়ে দরজা আটকে চলে গেছে। সায়েম তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। এবং ওর কাজিন তখন স্কুলে পড়তো। খুবই ছোট একটা মেয়ে ছিল। এইরকম অনেক মেয়েই সায়েমকে প্রপোজ করেছে। কিন্তু সায়েম সবসময় ওদের ধমক দিয়েছে। সায়েম কিছুতেই ভেবে পায় না, সবসময় ছোট ছোট মেয়েরাই কেন ওকে পছন্দ করে। ওর মধ্যে কী এমন আছে, যার জন্য ছোট ছোট মেয়েরা ওর প্রেমে পড়ে যায়। ওইতো মুখের সাদা চামড়ায় কালো কুচকুচে খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি। এলোমেলো চুলগুলো আর অদ্ভুত লাইফ স্টাইল। অবশ্য সায়েম জানে, ওর এই অদ্ভুত লাইফ স্টাইল-ই অনেককেই আকর্ষণ করে৷ কিন্তু ওর তো খারাপ দিকও ছিল। সিগারেট খেতো, মারামারি করতো। সারাক্ষণ আড্ডা দিতো। এগুলো অনেকেই জানতো। তবুও ওর প্রেমে পড়ল। এখন আর আগের সেই খারাপ অভ্যাসগুলো ওর মাঝে নেই। দায়িত্ববোধ ওকে সঠিক পথে পৌঁছে দিয়েছে। কয়েক বছর আগের সেই ঘটনাগুলো মনে পড়লে সায়েমের শুধু হাসি পায়। তবে আজ সায়েমের ঠোঁটের কোণে হাসি নেই। নিজের অসহায়তার জন্য কান্না পাচ্ছে ওর। সায়েম ভাবছে, ‘ইতিকে একটু জানানো প্রয়োজন। মেয়েটা একা একা ওই বাড়িতে আছে। এত রাত হয়ে যাওয়ার পর-ও আমি বাড়িতে ফিরছি না বলে হয়তো চিন্তা করছে খুব। কান্না-ও করে দিতে পারে। ওর দ্বারা কান্নাকাটি করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ফোনটাও তো আমার কাছে নেই। রাফার ফোনটা কী চাইবো?’

সায়েম আড়চোখে একবার রাফার দিকে তাকালো। রাফা বেশ আনন্দেই আছে। বেনারসি পরে বসে আছে বিছানায়। ওকে দেখে বুঝার উপায় নেই ও ছোট্ট একটা মেয়ে। যার হাইট সায়েমের কাধ নয়, সায়েম বুক পর্যন্ত। যার বয়স সায়েমের থেকে অনেকটাই কম।

সায়েম রাফার দিকে তাকাতেই রাফা মুচকি হাসি দিয়ে বলতে শুরু করল, ধরো কাল তোমার পরীক্ষা। রাত জেগে পড়ার টেবিলে বসে আছ। ঘুম আসছে না তোমার। হঠাৎ করে ভয়ার্ত কন্ঠে ওঠে আমি বললাম- ভালোবাসো? তুমি কি রাগ করবে? নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো ক্লান্ত তুমি অফিস থেকে সবে ফিরেছ। ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত,পীড়িত খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ঘর্মাক্ত আমি তোমার হাত ধরে যদি বলি-ভালোবাসো? তুমি কি বিরক্ত হবে? নাকি আমার হাতে আরেকটু চাপ দিয়ে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি। সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি। দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম। শতব্যস্ত হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-ভালোবাসো? তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে? নাকি হেসে ওঠে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দুজনে। মাথার উপর তপ্ত রোদ। বাহন পাওয়া যাচ্ছে না, এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে যদি বলি- ভালোবাসো? তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে? নাকি রাস্তার সবার দিকে তাকিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো শেভ করছ তুমি। গাল কেটে রক্ত পড়ছে। এমন সময় তোমার এক ফোঁটা রক্ত হাতে নিয়ে যদি বলি- ভালোবাসো? তুমি কি বকা দেবে? নাকি জড়িয়ে তোমার গালের রক্ত আমার গালে লাগিয়ে দিয়ে খুশিয়াল গলায় বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো খুব অসুস্থ তুমি। জ্বরে কপাল পুড়েযায়। মুখে নেই রুচি। নেই কথা বলার অনুভুতি। এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালোবাসো? তুমি কি চুপ করে থাকবে? নাকি তোমার গরম শ্বাস আমার শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি..

ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে। প্রচন্ড যুদ্ধে তুমিও অংশীদার। শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর। এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায় জিজ্ঞেস করলাম- ভালোবাসো? ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে, যাও। নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস দেবে। বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি…….

ধরো দূরে কোথাও যাচ্ছ তুমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেরুতে যাবে, হঠাৎ বাধা দিয়ে বললাম- ভালোবাসো? কটাক্ষ করবে? নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি

ধরো প্রচন্ড ঝড়, উড়ে গেছে ঘরবাড়ি, আশ্রয় নেই। বিধাতার দান এই পৃথিবীতে বাস করছি দুজনে। চিন্তিত তুমি এমন সময় তোমার বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালোবাসো? তুমি কি সরিয়ে দেবে? নাকি আমার মাথায় হাত রেখে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি..

ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দুরে। আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ হতভম্ব আমি যদি চিৎকার করে বলি- ভালবাসো? চুপ করে থাকবে? নাকি সেখান থেকেই আমাকে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

যেখানেই যাও, যেভাবেই থাক, না থাকলেও দূর থেকে ধ্বনি তুলো, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি..

দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর, বুঝব তুমি আছ, তুমি আছ ভালোবাসি,ভালোবাসি।"

সায়েম অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’

- এটা একটা কবিতা। যার নাম, ভালোবাসি, ভালোবাসি।

- কার কবিতা? তোমার!

- উঁহু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর লিখা কবিতা এটা।

সায়েম অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ওহ্।’

রাফা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আমি যে কবিতার মধ্যে দিয়ে তোমাকে প্রশ্ন করলাম, সেই খবর কী তুমি রাখো?’

সায়েম হকচকিয়ে ওঠে বলল, ‘প্রশ্ন! কীসের প্রশ্ন?’

- এই যে বললাম, ধরো কাল তোমার পরীক্ষা। রাত জেগে পড়ার টেবিলে বসে আছ। ঘুম আসছে না তোমার। হঠাৎ করে ভয়ার্ত কন্ঠে ওঠে আমি বললাম- ভালো বাসো? তুমি কি রাগ করবে? নাকি ওঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি।

সায়েম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘প্রথমত কাল আমার পরিক্ষা না। আর আমি কখনোই রাগ জেগে পড়াশোনা করি না। পড়ার কথা মনে হলে তো আমার চোখে এমনিতেই ঘুম এসে যায়।’

- আহ্। আমি তো বলছি না কাল তোমার পরিক্ষা। আমি শুধু কবিতার মধ্যে দিয়েই নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করছি। আর তোমার থেকে উত্তর পাওয়ার জন্য এইরকম প্রশ্ন করছি।

- সে যাই হোক। যদিও আমার কাল পরিক্ষা না। তবুও আমি ধরে নিচ্ছি এইরকম কোনো মুহূর্ত এলো। যখন তুমি ভয়ার্ত কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করবে ভালোবাসো? তখন তো আমি ভয়ে মরে যাবো। কারণ তোমার কণ্ঠের ভালোবাসি শব্দটা ভূত-প্রেতের কণ্ঠের থেকেও ভয়ঙ্কর।

রাফা ঠোঁট বাঁকা করে তাকালো সায়েমের দিকে। সায়েম আবার বলল, ‘এরপর কী যেন বললে? ওহ্ হ্যাঁ। এরপর বলেছিলে, ধরো ক্লান্ত তুমি। অফিস থেকে সবে ফিরেছ। ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পীড়িত, খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ঘর্মাক্ত আমি তোমার হাত ধরে যদি বলি- ভালবাসো? তুমি কি বিরক্ত হবে? নাকি আমার হাতে আরেকটু চাপ দিয়ে বলবে, ভালোবাসি, ভালোবাসি। সত্যি বলছি রাফা, তখন এক হাত দিয়ে তোমার হাতদুটো চেপে ধরব। যাতে নড়াচড়া করতে না পারো। আরেক হাত দিয়ে তোমার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বলব, এইসব নেকামি বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি রান্না কর গিয়ে।’

রাফা গাল ফুলিয়ে সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো তোমার বউ। নিজের বউ এর সাথে এত নিষ্ঠুরতা করবে তুমি?’

সায়েম রাগী কণ্ঠে বলল, ‘আরে রাখ তোমার বউ। তোমাকে আমি বউ বলে মানিই না। তুমি তো আমাকে জোর করে বিয়ে করেছ। নানন রকম ছলনা করে আমাকে বিয়ে করেছ তুমি।’

রাফা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘জোর করে?’

- অবশ্যই জোর করে। ১০০ বার জোর করে। শুধু ১০০ না, হাজারবার জোর করে।

- আচ্ছা আমি কি তোমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছি আমাকে বিয়ে কর, অন্যথায় তোমাকে গুলি করব।

- না।

- আমি কি তোমার গলায় চাকু ধরে বলেছি আমাকে বিয়ে কর, অন্যথায় মাথাটা আলাদা করে ফেলব?

- না।

- আমি তো তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করেও বিয়ে করিনি। তাহলে কোন ভিত্তিতে বলছ আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি।

- ডিরেক্টলি না হলেও ইনডিরেক্টলি আমাকে জোর করে বিয়ে করেছ তুমি। ছলনা করেছ আমার সাথে। জানি না আমার বাবা-মাকে কী করেছ তুমি। তারাও তোমার মিথ্যে কথা বিশ্বাস করে আমার সাথে ছলনা করেছে।

- তোমার বাবা-মা কোনো ছলনা করেনি। আমি শুধু তাদের বলেছি তুমি ইতির কথা রাখতে গিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ফিরিয়ে দিচ্ছ। তোমার বাবা-মা এটা মেনে নিচ্ছিল না৷ তাই একটু নাটক করেছে তোমার সাথে। একটা ফাঁদ পেতেছিল, যেখানে তুমি সহজেই পা দিয়েছ।

সায়েম অবাক হয়ে বলল, ‘ইতির কথা রাখতে গিয়ে মানে?’

- সেটা সকালে নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকেই নাহয় জেনে নিও।

সায়েম মনে মনে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, ‘এত কিছুর কী আর সময় আছে? আমাকে এখনো চিনতে পারোনি তোমরা। আমার মাথায় যে কত অদ্ভুত সব শয়তানি বুদ্ধি ঘুরাঘুরি করছে, তা কল্পনা-ও করতে পারছ না তোমরা। আমাকে যেমন বোকা বানিয়ে বিয়ে করেছ, তেমনি তোমাদের সবাইকে বোকা বানিয়ে আমি কেটে পড়ব এখান থেকে।’

সায়েমকে চুপ থাকতে দেখে রাফা এগিয়ে এসে সায়েমের পাশে বসল। সায়েমের একটা হাত ধরতেই হ্যাঁচকা টানে সায়েম রাফাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘বেশি সাহস দেখিও না রাফা। এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।’

রাফা অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ আমাকে মেনে নাও সায়েম। আমি তোমার বিয়ে করা স্ত্রী।’

- তোমার সাহস দেখে আমি হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি রাফা। তুমি কী জানো, তোমার কলেজের ইংরেজি স্যার আমার জুনিয়র । ও আমাকে আপনি করে এবং ভাই বলে সম্মোধন করে ডাকতো। সেখানে তুমি ওর স্টুডেন্ট হয়ে আমাকে নাম ধরে ডাকছ। তুমি কী জানো না বাবা-মায়ের পরে শিক্ষকের স্থান। আর শিক্ষকেও বাবার-কাকার মতো সম্মান করতে হয়। সেক্ষেত্রে তুমি আমাকে কাকা বলেই ডাকতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড।

- হোয়াট? তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে? মানসিক কোনো সমস্যা। নাহলে বরকে কেউ কাকা ডাকতে বলে।

- কেউ বলে না বুঝি? ভালোই তো। আমি তাহলে বিশ্বের এরমাত্র ব্যক্তি, যে বাসর রাতে বউকে বলছি, আমাকে কাকা বলে ডাকো। যদিও তোমাকে বউ বলে ভাবি না আমি। তুমি তো আমার বোনের মতো। সরি সরি, আমার ভাতিজির মতো।

রাফা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সায়েমের সাথে এই নিয়ে তর্ক করা মানে বাসর রাতে বরের সাথে রোমান্স করার থেকে কয়েক মিনিট ব্যয় করা। একটা মানুষ কতটা অদ্ভুত হলে বাসর রাতে বউকে ভাতিজী বানিয়ে দেয় রাফার জানা ছিল না। তবে আজ সায়েমকে দেখে জেনে গেছে ও। " মানুষ মজা করে হয়তো বরকে ভাই বলে ফেলে। তাই বলে কাকা বলে ডাকতে বলছে। ছি:!

কথাটা ভাবতেই রাফা কেমন যেন করে ওঠে। তবে এটা ভেবে রাফা অবাক হচ্ছে যে, সায়েম খুব বেশি রিয়াক্ট করছে না। হয়তো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রাফা এইসব ভাবছে, আর সায়েম ভাবছে কালকে কি কি হবে। তবে ও আগেই সবকিছু ঠিক করে রেখেছে৷ এখন শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা।

রাফা চুপ করে আছে দেখে সায়েম বলল, ‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।’

- বাসর রাতে কী মানুষ ঘুমায়?

সায়েম রাগী কণ্ঠে বলল, ‘আমি তো কোনো মানুষ না। আমি তো এলিয়েন। তাই বাসর রাতে মানুষ না ঘুমালেও এই এলিয়েন ঠিকই ঘুমাবে।’

রাফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সায়েম বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল। সায়েমের শোয়া দেখে অবাক না হয়ে পাড়ল না রাফা। পুরো একটা বিছানা দখল করে নিয়েছে সায়েম একাই। রাফা এক কোণায় বসে বসে ওর কর্মকাণ্ড দেখছে। সায়েম আড়চোখে দেখছে বিছানার কোথায় কোথায় ফাঁকা আছে। হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে ফাঁকা জায়গা টুকুও ভরে দিলো সায়েম। বিছানার মাঝে একটা শরীর। আর চারিদিকে চারটা হাত-পা দিয়ে রেখেছে। বসার জন্য একটুমাত্র জায়গা পেয়েছে রাফা। কিন্তু সায়েমের নড়াচড়ায় সেটুকুও হারাতে হলো। রাফা বিছানা থেকে নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। সায়েম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তা দেখে রাফা সায়েমের উপরেই শুয়ে পড়ল। রাফা জানে, ওর ছোট্ট শরীরটা সায়েমের উপরে সারারাত পড়ে থাকলেও সায়েমের কষ্ট হবে না। কিন্তু বিষয়টি সায়েম ভালোভাবে নিবে না। ঠিক তাই হলো। রাফাকে ধমক দিয়ে নামিয়ে দিলো। বিছানা থেকে নেমে রাফা গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সায়েম বলল, ‘আলমারিতে দেখ কাঁথা আছে কি-না। থাকলে সেটা সাথে নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়।’

রাফা কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, ‘নতুন বউকে ফ্লোরে শুতে বলছ। এত নিষ্ঠুর তুমি।’

- আমার সাথে শুনে পারবে না এটাই শেষ কথা। এখন ফ্লোরে শুতে না চাইলে দাঁড়িয়েই থাকো সারারাত। আমি তোমার দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে কিচ্ছু বলব না।

- তা বলবে কেন? তুমি তো এটাই চাও, আমি যেন কষ্ট পেতে পেতে তোমাকে ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু মি: সায়েম, রাফা যে ওইরকম মেয়ে না। নিজের অধিকার আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা রাফার আছে। কথাটা মনে মনে বলল রাফা। সায়েম হঠাৎ নাকডাকা শুরু করে দিলো।

রাফা কিছুটা বিরক্ত হলেও এইটুকু সহ্য করে বলল, ‘তাহলে তুমি নিচে ঘুমাও। আমি বিছানায় ঘুমাবো। আসলে আমার অভ্যেস নেই ফ্লোরে ঘুমানোর। তাছাড়া নতুন বউ ফ্লোরে ঘুমাবে, বিষয়টি কেমন যেন দেখায়, তাই না? শত হলেও ঘরের চারিদিকে চারটা দেয়াল আছে। আর জানেন তো, অনেকেই বলে দেয়ালের-ও নাকি কান আছে। যদিও দেখার জন্য চোখের প্রয়োজন হয়। তবে কান যখন আছে, তাহলে অবশ্যই চোখ-ও আছে।’

সায়েম বিরক্তির স্বরে বলল, ‘এত কথা বলছ কেন তুমি? চুপচাপ শুয়ে পড়। ফ্লোরে ঘুমালে আমার জ্বর এসে যায়। কালকে অনেককিছু করা বাকি আছে। জ্বর এসে গেলে সেটা আর সম্ভব হবে না।’

- কী কাজ আছে তোমার?

- তুমি চুপ করবে নাকি থাপ্পড় খাবে।

রাফা হঠাৎ ধুক্ করে উঠল সায়েমের কথা শুনে। মনে পড়ে গেল আগের দিনের ঘটনাটা। গতকালকে সায়েম অসভ্যের মতো দু'টো থাপ্পড় মেরেছিল রাফাকে। এখনো কেমন ব্যথা ব্যথা করছে গালে। আসলে ব্যথাটা এতক্ষণ করছিল না। হঠাৎ থাপ্পড়ের কথা মনে পড়তেই ব্যথা করতে শুরু করল।

রাফা আর কোনো শব্দ না করে সায়েমের পাশ থেকে একটা বালিশ নিলো। এরপর আলমারি থেকে কাঁথা নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ল।

সায়েম আবার বলল, ‘ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাও। আমার আবার রাতে বাথরুমে যাওয়ার অভ্যাস আছে। অন্ধকারে তোমার মতো একটা পিঁপড়া আমার নজরে পড়বে না কোনোভাবেই। আর আমার তখন মনেও থাকবে না ফ্লোরে কেউ শুয়ে আছে। সো বুঝতেই পারছ তখন কী এক অবস্থা হবে। কাল সকালের হেডলাইন হবে, ‘বাসর রাতে বউকে পিঁপড়া মনে করে পা দিয়ে পিষিয়ে মেরে ফেলল বর।’

সায়েমের কথা শুনে মুখ চেপে ফিক করে হেসে দিলো রাফা। কিন্তু ও তো আলোয় ঘুমাতে পারে না। তাই বলল, ‘অন্ধকার থাক প্লিজ। নাহলে আমি ঘুমাতে পারব না।’

- তাহলে বারান্দায় গিয়ে ঘুমাও। ওখানে প্রকৃতির আলো ছাড়া অন্য কোনো যান্ত্রিক আলো পাবে না। প্রকৃতি নিশ্চয়ই তোমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাবে না।

রাফা কিছু না বলে লাইট অন করে শুয়ে পড়ল। রাফা মনে মনে গালাগাল দিতে লাগল সায়েমকে। রাফাকে শায়েস্তা করতে পেরে পৈশাচিক হাসি দিলো সায়েম। সকালের পরিকল্পনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

আযানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সায়েমের। ঘরের লাইট জ্বালানোই আছে এখনো। হাতের উপর ভারী কিছু অনুভব করল। পাশে তাকাতেই চমকে উঠল ও। ওর হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে রাফা। ঘটনাটা বুঝতে কয়েক মিনিট সময় লাগল সায়েমের। যখন বুঝতে পারল, তখন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আস্তে আস্তে রাফার মাথাটা বালিশে রেখে ওঠে দাঁড়াল। রাফা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকা মানুষটাই ভোর সকালে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এই কথাটা খুব ভালো করেই জানে সায়েম। অধিকাংশ মানুষই যান্ত্রিক আলোয় সহজে ঘুমাতে পারে না। সেজন্য অনুমান করে সায়েম বলেছিল ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে। যাতে করে রাফার ঘুমাতে অনেকটা সময় লাগে। আর ভোরবেলায় সহজে যেন ঘুম না ভাঙে। কারণ রাতে অনেকটা সময় জেগে থাকার পর ভোরবেলায় তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না৷ আর রাফার মতো মেয়ের দ্বারা তো একেবারেই অসম্ভব।

সায়েম আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গেল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই বিছানার দিকে নজর দিলো। ছোট্ট একটা মেয়ে শাড়ি পরে শুয়ে আছে বিছানায়। পরনে এখনো সেই বেনারসি শাড়ি। সায়েম লক্ষ্য করল রাফার পেটের শাড়িটুকু সরে গেছে। আর কাঁথাটাও শরীরে নেই। যার কারণে পেটটা উন্মুক্ত হয়ে আছে। সায়েম সেখানে দাঁড়িয়ে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে রাফার মেদহীন ফরসা পেটে ছোট্ট তিলটার দিকে। তিলটা অদ্ভুতভাবে আকৃষ্ট করছে সায়েমকে। ফরসা পেটে তিলটা যেন চকচক করছে। সেই সাথে সায়েমকে বারবার কাছে টানতে চাইছে। সায়েম বারবার করে কেঁপে উঠছে রাফার উন্মুক্ত পেটের তিলটার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ একটু একটু করে রাফার কাছে যেতে লাগল সায়েম। বিছানায় ওঠে রাফার ঠিক পাশে গিয়ে বসল। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তিলটার দিকে৷ সায়েমের খুব ইচ্ছে করছে রাফার পেটটা স্পর্শ করতে। - উঁহু, পেট নয়। পেটের তিলটাই আমাকে খুব করে কাছে টানছে। একেবারে আষ্টেপৃষ্টে।" মনে মনে কথাটা বলে ভুলটা শুধরে নিলো সায়েম। নিজের অজান্তেই হাতটা রাফার পেটের দিকে নিতে লাগল। সায়েম যেন লোভ সামলাতে পারছে না। একজন যুবক ছেলে চোখের সামনে এভাবে উন্মুক্ত পেট দেখলে মাথা কী আর ঠিক থাকে। তার উপর এই তিলটা। সায়েমকে পাগল বানানোর জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। হঠাৎ সারার কথা মনে পড়ল সায়েমের। আর মুহূর্তের মধ্যেই থেমে গেল।

- সারাকে ঠকানোর কোনো মানেই হয় না। মনে মনে কথাটা বলল সায়েম। কাঁথা দিয়ে রাফার পেটটা ঢেকে দিলো৷ এরপর রাফার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক।’

বিছানা থেকে নেমে এলো সায়েম। মানিব্যাগটা পকেটে ঢুকিয়ে রাফার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সংসার করার খুব শখ জেগেছিল, তাই না? এবার বর ছাড়াই সংসার কর।’

সায়েম রাফার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বারান্দায় এলো। দরজাটা বাইরে থেকে এখনো লাগানো আছে। তাই বারান্দায় থেকে গাছ বেয়ে নিচে নামতে হবে। রাতেই সব পরিকল্পনা করা ছিল। তাই কোনো অসুবিধা হলো না। নিচে নেমে রাস্তায় চলে এলো সায়েম। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে অলরেডি। রাস্তায় কোনো রিকশা দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্ট্যাণ্ডে যেতে লাগল। বেশ অনেকটা সময় লাগল স্ট্যাণ্ডে পৌঁছাতে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই বাস এসে গেল। কোনো পিছুটান না রেখে গাড়িতে ওঠে পড়ল সায়েম। বাস দ্রুত চলছে। সায়েমের চোখের সামনে ভেসে ওঠছে রাফার সেই উন্মুক্ত পেটটা। সায়েম মনে মনে ভাবছে, ‘এক রাতের মধ্যে কী এমন হলো, যে রাফাকে অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করলাম আমি।’

দীর্ঘক্ষণ পর ওর গন্তব্যে গিয়ে বাস থামলো। সায়েম বাস থেকে নেমে তাড়াতাড়ি করে বাড়িতে যেতে লাগল। ইতি হয়তো সারারাত কেঁদেছে। এখনো হয়তো কাঁদছে। বাড়িতে পৌঁছে কলিংবেল বাজালো। কিছুক্ষণ পরই দরজাটা খুলে গেল সামনে থেকে। কিন্তু ভিতরের মানুষটাকে দেখে সায়েমের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। ও যেন আকাশ থেকে পড়ল সামনের মানুষটাকে দেখে। - " সব পরিকল্পনা শেষ।" মনে মনে কথাটা বলল সায়েম।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ৯ম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড