• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রম্য গল্প - পাত্রী বিভ্রাট

  শান্তনু চৌধুরী শান্তু

২০ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:০২
গল্প
ছবি : প্রতীকী

পাত্রী দেখার সু-মানসে যখন তীব্র গরম থেকে এসিওয়ালা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম মনে হলো স্বর্গে প্রবেশ করেছি। পরক্ষণে মনে হলো আচ্ছা স্বর্গের তাপমাত্রা কেমন হবে!

নাতিশীতিতোষ্ণ? নাকি এই রকম ঠাণ্ডা! নাকি শীতের দিনে লেপের নিচের উম সম? এই লাইনে আরেকটু ভাববো তার আগেই ওয়েটার জানতে চাইলো রিজারবেশন আছে কিনা। মাথা ঝাঁকালাম। জাকের আহমেদের নামে। আমার ছোট মামা। উনি আমার জন্য পাত্রী দেখানোর গুরু দায়িত্ব নিয়েছেন।

সেই উপলক্ষে এখানে আসা। পাত্রী সম্পর্কে আমি কেবল তিনটি তথ্য জানি। পাত্রী শহরের এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পড়ুয়া, তার নাম ইসরাত জাহান এবং দেখা করতে আসবে বান্ধবী সহ। দেখা করার আগে সামান্য কিউরিসিটির বশে রাতভর তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজেছি। বিশ্বাস করা কঠিন এই ছোট চট্টলা শহরে এত এত ইসরাত জাহান! যার মধ্যে ২১ জন ইসরাত জাহানের সর্ট লিস্ট করেছি যারা এই শহরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া! যার মধ্যে ৫টি প্রোফাইল লক।

টেবিলটা খুঁজে পেলাম। কথিত সামাজিক নিয়মানুসারে স্বাভাবিকভাবে পাত্রী আগে আসেনি। যাক বাঁচা গেলো। ঘামে লুতুপতু শরীরটা একটু শুকানো দরকার। বেশি না , আধা ঘণ্টার মধ্যে পাত্রী এসে হাজির। তবে বান্ধবীহীন। পাত্রী বিব্রত ও নার্ভাস। গরমে মেকাপ ও কাজল লেপটে গেছে। ওয়াস রুম থেকে আসতে আরো বেশ কিছুক্ষণ।

সামান্য কুশলাদী বিনিময় হলো। আমি এই, সে সেই। আমি ওটা করি , সে ওটা করে। আমার এটা পছন্দ, তার সেটা পছন্দ। আমার বাসায় এত জন , তার বাসায় ওত জন। ব্যাস কথার টিনের ডাব্বা খালি হয়ে গেলো। কি নিয়ে কথা বলবো বুঝছি না। নাকি বলবো 'দেশ ও সমাজের প্রতি আমাদের দায়, দায়িত্ব, ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পদচারণ সুদৃঢ় করতে করনীয় পদক্ষেপ কি হবে - এই নিয়ে আলোচনা করার কথা বলে ভরকে দিবো!

মাঝখানে খাবারের অর্ডার দেওয়া হলো। চিকেন কারী ও লাচ্চি। আচ্ছা প্রথমে চিকেন নিয়েই শুরু করি। - আচ্ছা আপনি কি জানেন মুরগি কিন্তু মানুষের চেয়ে বেশি সফল।

পাত্রী ইসরাত জাহান মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা থেকে ঢোক দিতে গিয়ে আটকে গেলো।

- কি রকম?

- বিবর্তন বলে যে প্রাণী নিজের জিন যত বেশি ছড়িয়ে দিতে পারে সে তত বেশি সফল। সে হিসেবে মুরগী ইতিহাসের সফলতম প্রাণী। সারা পৃথিবীতে মুরগীর সংখ্যা ২৩ বিলিয়ন!

ইসরাত জাহান মুখে কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের হাসি এনে বলল, ‘আরো বলেন শুনি।’

আমি জোরেশোরে শুরু করি, ‘তবে এই ইভোল্যুশনারী সাকসেসের জন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তাদের পারসোনাল লাইফ বলতে নেই!’

ইসরাত জাহান বিস্মিত হয়ে বলল, ‘মুরগীর আবার পারসোনাল লাইফ কি!’

- আরে পুরোটা শুনেন। একটা বন মুরগির গড় আয়ু সাত থেকে বারো বছর। এখন একটা মুরগির গড় আয়ু কয়েক সপ্তাহ, বড়জোর কয়েক মাস। যে মুরগি ডিম পাড়ে এদের হয়তো কিছু বেশিদিন বেঁচে থাকতে দেয়া হয়। কিন্তু কিসের বিনিময়ে? চরম অপমান আর অসম্মানের দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ১ ফুটে খাঁচায় বন্দী জীবনের বিনিময়ে। নিজেকে একটা সদ্য কিশোরী মুরগী জায়গায় করুন।

- মুরগীর জায়গায় আমি! - আরে পুরোটা তো শুনেন। মুরগীটারও ইচ্ছা হতে পারে ভালো দেখে একটা মোরগের সাথে প্রেম করার। হানিমুন করা নিজের মত নিজের ঘর বানিয়ে ডিম দেওয়া। ডিমে তা দেওয়ার। ডিম ফুটানো বাচ্চাকে আদর-যত্ন করে বড় করার। অথচ আমরা তার প্রতিটা অধিকার কেড়ে নিয়েছি।

আচ্ছা গবাদি পশুর কথায় আসি। যখনই পুরুষটির প্রয়োজন শেষ তখনই এদের খোঁজা করে ফেলি। সবচেয়ে মারমুখী পুরুষ ষাঁড়টিও ইঁদুর হয়ে যায়। তারও তো একটা সামাজিক জীবন ছিল, তারও তো যৌন চাহিদা চরিতার্থ করার সুযোগ ছিলো। সেই জীবন আমরা পুরাপুরি কেড়ে নিয়েছি। আচ্ছা গাভীদের কথাতেই আসি। গরু-ছাগলরা বাচ্চা হলেই দুধ দেয়। ফলে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বাচ্চা জন্ম নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলতো। যতটুকু দুধ দোয়ানো সম্ভব দুধ দুইয়ে নিত। তারপর মা বেচারিকে আবার প্রেগন্যান্ট করে ছাড়তো। তাও নিজের পছন্দের ষাঁড়ের সাথে ইলিশ-পিটিশ করিয়ে। একটা গরু হয়তো ১০ বছর বাঁচে। দেখা যায়, বাচ্চা জন্মের দুই কি চার মাসের মধ্যে তাকে আবার প্রেগন্যান্ট করে ফেলা হয়েছে। ভদ্রমহিলা তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই এভাবে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কাটিয়ে দিলেন। কেবল দুধের সর্বোচ্চ সাপ্লাই নিশ্চিত করার জন্য। প্রেম পিরিতি করা দূরের কথা।

অবশেষে ইসরাত জাহানের অস্থির বাঁধ ভেঙ্গে। উসখুস করছে। আমি আরো চেপে ধরলাম।

- মানুষের নিষ্ঠুরতার গল্প এখানেই শেষ নয়। একটা গোষ্ঠী আছে যারা ভেড়ার বাচ্চা মেরে তার মাংস খেয়ে চামড়াটা রেখে দিত। সেই চামড়া দিয়ে ভেড়ার একটা অবয়ব তৈরি করতো। ভেড়ার সেই অবয়ব মা ভেড়ার কাছে আনলে তার শরীরে দুধ আসতো। আরেকটা টেকনিক হচ্ছে বাছুরের মুখে শিং এর মত ধারালো কিছু দিয়ে ঢেকে রাখা। বাছুর তখন দুধ খেতে চাইলে মা নিজেই তাকে ব্যথায় সরিয়ে দিবে। সাহারা মরুভূমির লোকজন উটের বাচ্চার নাক আর উপরের ঠোঁট কেটে রাখতো। যেন বেশি দুধ খেতে না পারে। অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাস আসলে ভালবাসার ইতিহাস নয়। অন্যায়ের ইতিহাস। সবচেয়ে বড় অন্যায়টা এই গৃহপালিত পশুপাখিদের সাথে। পৃথিবীটা তাদের কাছে একটা জেলখানা বৈ আর কিছু নয়। - এই কথা আমার নয় ইউভ্যাল নোয়া হারারি - এ ব্রিফ হিষ্টোরী অফ হিউম্যান কাইন্ড থেকে নেওয়া ।

- অনেক লম্বা লেকচার দিলেন।

- ওয়েট আমি শেষ করিনি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এই অন্যায়ের জন্য আমাদের ভেতরে কোন অনুশোচনাও নেই। আমরা দিব্যি অন্যের টাকায় চিকেন কারী ও লাচ্চি খেয়ে ঢেঁকুর তুলছি।

ঠিক সে সময়েই চিকেন কারী আর লাচ্চি এলো। ইসরাত জাহান ইতস্তত করছে । মৃদু হাসলাম । মেয়েটাকে একটা সাজা খুব দরকার ছিলো। ‘আমি একটু ওয়াসরুম হয়ে আসছি’ - বলে কম্পিত পায়ে হেঁটে গেলো।

আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেলো। সে ফিরে আসেনি। আসবেও না জানি। আমি আমার ভাগের খানাটা তৃপ্তির সাথে খেয়ে ঢেঁকুর তুললাম। ইসরাত জাহানের খাবার অস্পর্শিত অবস্থায় পড়ে আছে। মেয়েটা প্রকৃত ইসরাত জাহান নয়। বরং তার বান্ধবী। ২১জন ইসরাত জাহানের একজনের প্রোফাইলে মেয়েটার সাথে জয়েন্ট ছবি আছে। খুব সম্ভবত ইসরাত জাহানও রাতভর আমার নামের কাউকে খুঁজতে গিয়ে আমাকে পেয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবে ভালো লাগনি। আফটার অল আমি তো প্রিন্স চামিং না। কিন্তু যেতে তো হবে । তাই তার বান্ধবীটিকে পাঠিয়েছে ফ্রিতে অন্যের অন্ন ধ্বংস করতে।

আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলাম। ভালো একটা বাঁশ দিয়েছি। ঢেঁকুর তুললাম। সামনে আরেকটা প্লেট বাকি। আশে পাশে তাকালাম। কেউ খেয়াল করছে না। ইউভ্যাল নোয়া হারাবিকে ধন্যবাদ। বেচারি মুরগী আর গরুদের জীবন তো বৃথা যেতে দেওয়া যায় না।

প্লেটটা আস্তে করে তুলে নিলাম।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড