রিফাত হোসেন
- ম্যাডাম আপনার ফাইলটা। ইতির সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে কথাটা বলল। ইতি ফাইলটা হাতে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে আমি আসছি এবার।’
- ওকে ম্যাডাম। আর স্যার বলেছে দু'দিনের মধ্যেই আপনার ঠিকানায় জয়েনিং লেটার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
ইতি হেসে দিয়ে বলল, ‘অফিসের মালিক খুব মজার একটা মানুষ, তাই না? অদ্ভুতভাবে কথা বলছিল আমার সাথে। উনার সামনে বসে ইন্টারভিউ দেওয়াটাও ছিল আমার জন্য একটা অভিজ্ঞতার ব্যপার। এত মজার মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি। প্রথম ইন্টারভিউ ভেবে যে ভয়টা ছিল মনের ভিতর, উনার সাথে কথা বলার পর সেটা চলে গিয়েছিল। সেজন্যই তো স্বাভাবিকভাবে উনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি।’
- জ্বি ম্যাডাম। স্যার খুব ভালো মানুষ। উনার স্ত্রী-ও একই রকমের। দু'জনেই খুব হাসিখুশি মানুষ।
- হ্যাঁ। সেটাই দেখলাম। যাই হোক, আমি তাহলে চলি।
ইতি চলে এলো সেখান থেকে। ওর মনের ভিতর আজ অদ্ভুত এক ভালোলাগা আর উত্তেজনা কাজ করছে। মানুষ কত ইন্টারভিউ আর কত ঘুরাঘুরি করে চাকরি পায়। অনেকে আবার তাও পায় না। উদাহরণ হিসেবে ওর ভাইকেই বলা যায়। সায়েমও অনেক ঘুরেফিরে সাধারণ একটা চাকরি পেয়েছিল। পরে অবশ্য প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র হয়েছে। অথচ প্রথম ইন্টারভিউ দিয়েই চাকরি পেয়ে গেল ইতি। তাও আবার এত বড় অফিস আর এত ভালো মানুষদের সাথে। মৃদু হাসতে হাসতে বাস স্ট্যাণ্ডে এলো ইতি। ফোনটা ব্যাগে রেখে বাসে ওঠে পড়ল। বাস চলতে শুরু করল। ইতি মুচকি হাসতে হাসতে ভাবনার জগতে চলে গেল। - ইশ, আজ নতুন এক ইতি লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। নতুন এক পরিচয়ে। আচ্ছা, যখন লোকটার মারাত্মক আকর্ষণীয় চোখ দু'টোর দিকে তাকিয়ে বলব, এই যে মি:, আমি চাকরি পেয়ে গেছি, তখন লোকটার চোখে-মুখের অবস্থা কেমন হবে! হয়তো খুব অবাক হবে। ভাবতেই পারবে না হুট করে এইরকম একটা খুশির সংবাদ তাকে দিবো আমি। কারণ আমি তো এটাও আগে বলিনি যে, আজ আমার ইন্টারভিউ ছিল।
গাড়িতে বসে এইসব ভাবছিল ইতি। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো একবার। এরপর অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় বলল, ‘উফ্, আজ এত সময় লাগছে কেন? গাড়িটা কী আর একটু জোরে চালানো যায় না? ইচ্ছে করছে ড্রাইভারের গলায় একটা ছুরি ধরে বলি, এক মুহূর্তের মধ্যে যদি লোকটার অফিসের সামনে আমাকে নিয়ে যেতে না পারেন, তাহলে আপনার শরীর থেকে মাথাটাই আলাদা করে ফেলব।’
হর্নের শব্দে আবারও সম্মতি ফিরে পেলো ইতি। নিজের কল্পনায় ভাবা কথাগুলো মনে পড়তেই বোকার মতো হাসতে লাগল মুখ টিপে।
লাঞ্চের কিছুক্ষণ আগেই সায়েম আর সারার ডাক পড়ল অফিসের বসের রুমে। বস সকাল থেকেই মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিল। সেজন্যই এতক্ষণ পর ওদের ডাকলেন তিনি। সায়েম খুব ভালো করে জানে এই আহ্বান কীসের জন্য। আর এটাও জানে সেখানে গিয়ে বড় একটা ঝড়কে প্রতিরোধ করতে হবে কীভাবে। তাই মনে কোনোপ্রকার ভয় না রেখেই বসের রুমের দিকে যেতে শুরু করল। পিছনে পিছনে সারা যাচ্ছে। বসের রুমের সামনে গিয়েই সারা সায়েমের হাত ধরে থামিয়ে দিলো। সায়েম সারার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘এভাবে বারবার স্পর্শ করলে তো আমি নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলব। তখন আবার উল্টো পাল্টা কিছু করে বসব।’
সারা সায়েমের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘উফ্ চুপ করুন তো। আমি এদিকে ভয়ে মরে যাচ্ছি, আর আপনি উল্টো পাল্টা বকে যাচ্ছেন।’
- আরে এত ভয় কীসের?
- যদি চাকরিটা নড়বড়ে হয়ে যায়। কিংবা চাকরিটা যদি একেবারেই চলে যায়, তখন কী করব আমি? আরেকটা চাকরি খুঁজতে গেলে আমি মরে যাবো এবার।
- কিচ্ছু হবে না। আপনাকে আমি হবু স্ত্রী বলে পরিচয় দিবো। তখন দেখবেন আমার সাথে সাথে আপনিও বেঁচে গেছেন। সাথে দু’টো টোস্ট বিস্কুট আর চা ফ্রি।
সারা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘হবু স্ত্রী মানে কী, হুম?’
- আপনাকে বাঁচানোর জন্যই তো এটা বলব।
- ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিবো কিন্তু।
সায়েম কিছু না বলে হাসতে হাসতে দরজায় টোকা দিলো। সাথে সাথে ভিতর থেকে একজন বলল - ‘আসুন।’
সায়েম ভিতরে ঢুকলো। পিছনে সারা। বস দু'জনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অফিস টাইম শুরু হয়েছিল কয়টায়, আর আপনারা এসেছিলেন কয়টায়?’
সায়েম বিব্রত না হয়ে বলল, ‘জ্বি স্যার, অনেকটা দেরি হয়ে গেছে আজ।’
- আপনাদের ভাগ্য ভালো যে, এতক্ষণ পরে আসার পরও অফিসে ঢুকতে পেরেছিলেন। আর মি: সায়েম, দেরি হওয়াটা তো আপনার নিত্যকার অভ্যাস।
- আসলে স্যার, এই দেরি হওয়ার পিছনেও একটা কাহিনী আছে। প্রতিবারের মতো এবারের কাহিনীটা-ও মজাদার।
- বেশি সময় লাগলে কাহিনী শোনাতে হবে না। এই আপনার কাছ থেকে গল্প শুনতে গেলে এমনিতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। ফলে কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না।
- বেশি সময় লাগবে না স্যার। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যপার। কাহিনীটা হলো আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের।
- ইউনিভার্সিটি জীবনটা যে সত্যিই খুব মজার, তা আমি জানি। কিন্তু এর সাথে আপনার দেরি হওয়ার কোনো সম্পর্ক আমি দেখছি না। আপনি শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করতে চাইছেন।
- আপনি কাহিনীটা না শুনেই বলে যাচ্ছেন স্যার। আসলে অফিসে আসার পথে ইউনিভার্সিটির এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়।
বস সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এরপর সেই বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতে আপনার দেরি হয়ে গেছে, তাই তো? এইসব কাহিনী অনেক শুনেছি মি. সায়েম।’
সায়েম দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এই সায়েম কোনো গল্পকার নয় যে বসকে গল্প শোনাবে। আমি জাস্ট একটা সত্যি কাহিনী বলব আপনাকে। আর মোটেও সেটা আপনার ধারণার মতো কমন একটা কাহিনী নয়। এটা খুবই আনকমন একটা কাহিনী। এই বন্ধু আমার বা আপনার অন্যসব বন্ধুদের মতো নয়। এই বন্ধুর অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে, যা অন্য কারোর মধ্যে নেই। এ খুবই স্পেশাল বন্ধু আমার। তাই স্পেশাল বন্ধুর সাথে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা সময় দেরি হয়েছে বলে আপনি এখন আমাকে কথা শোনাচ্ছেন। কিন্তু এই বন্ধুর আসল কাহিনীটা শোনার পর আপনি বুঝতে পারবেন কেন আমার অফিসে আসতে দেরি হয়েছে।’
সামনের চেয়ার দু'টো দেখিয়ে সায়েম আর ইতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এখানে বসুন। আর এত কথা না বলে আসল কাহিনীটা বলুন। আমার কাজ আছে।’
- প্রথমেই ওর নাম আর ক্ষমতা সম্পর্কে বলে নিই। ওর নাম শামসুল। যদিও এটা ওর কাগজপত্রের নাম শুধুমাত্র। লোক মুখে ওর নামের অভাব নেই। এটাও ওর একটা ক্ষমতা। ওর যেখানেই যায়, সেখানেই নিজের নতুন একটা নাম দিয়ে পরিচয় গড়ে তুলে। ক্যাম্পাসের সবাই ওকে রুডি বলে ডাকে। এটা ওরই তৈরি করা নাম। এলাকার মানুষজন ওকে জ্যাক বলে ডাকে। এটাও ওরই দেওয়া নাম। আরো অনেক জায়গায়, অনেক নামে পরিচিত ও। অথচ বাড়ির সবাই ওর নাম রেখেছিল শামসুল। যা শুধুমাত্র ওর সার্টিফিকেট'এ আছে। ওর আরো ক্ষমতা আছে, তা হলো, যেখানে ঝামেলা বাধবে, সেখানে ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে ফেলে মুহূর্তের মধ্যেই। আর যেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকবে, বা কোনো ঝামেলা নেই, সবকিছু ঠিকঠাক আছে, সেখানে গিয়ে ও ঝামেলা বাধিয়ে বসে। সেজন্য ও পুরো ক্যাম্পাসের এবং এলাকার পরিচিত একজন ছিল। কোথাও ঝামেলা সমাধান করতে হলেও ওকে প্রয়োজন হতো। আবার কোথাও ঝামেলা লাগাতে হলে ওকেই প্রয়োজন হতো। মোটকথা, ও ঝামেলা লাগাতেও পারে, আবার ঝামেলা সমাধান ও করতে পারে।
- বেস্ট ইন্টারেস্টিং তো ব্যপারটি। তারপর বলুন। সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে কথাটা বলল বস। সায়েম আড়চোখে সারার দিকে তাকালো একবার। সারা ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। ও নিশ্চয়ই সায়েমের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না৷ কারণ অফিসে আসার সময় এইরকম কারোর সাথেই দেখা হয়নি সায়েমের। যা সারা নিজেই দেখেছে। সায়েম তো সকালে ঝগড়া করতে গিয়ে দেরি করেছে। সারা নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, ‘অসভ্য লোক একটা। মিথ্যে গল্প বানাতে একটুও সময় লাগে না।’
সারার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সায়েম মৃদু হাসি দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘শামসুল খুব বই প্রেমী ছিল। প্রাক্টিক্যালি প্রচুর মেধা ছিল বটে, তবে একাডেমিক বই পড়তো না খুব বেশি। ওই পাশ করার জন্য যেটুকু দরকার, সেটুকুই। তো আমাদের ক্যাম্পাসে বিশাল একটা লাইব্রেরি ছিল। শামসুল যেহেতু গল্প, উপন্যাস আর কবিতা প্রেমি, তাই ও অনেকটা সময় লাইব্রেরিতে কাটাতো। মাঝে মাঝে দুই একটা বই বাড়িতে নিয়ে যেতো। কখনো ফেরত দিতো, আবার কখনো দিতো না। এরপর আবার কয়েকদিন লাইব্রেরিতে যেতো না।।ফলে এই বই এর কথা স্যারের-ও মনে ছিল না। তবে খাতায় সব লিখা ছিল। তো ছোট ছোট দুই একটা বই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলেও বড় বড় সমগ্র উপন্যাসগুলো লাইব্রেরির বাইরে যেতে দিতো না স্যার। একজন স্যারই ছিল লাইব্রেরির দায়িত্ব। তো একদিন হঠাৎ শামসুল আমাদের এসে বলল, লাইব্রেরি থেকে নাকি বই চুরি করবে। যার জন্য আমাদের সাহায্য লাগবে ওর। যেহেতু ও আমাদের ভালো বন্ধু ছিল, পাশাপাশি আমাদের অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছে অনেকবার। তাই আমরা আর না করি। লাইব্রেরির জানালার পাশের ছিল আরেকটা বিল্ডিংয়ের ছাঁদ। আমরা ছাঁদে অপেক্ষা করছিলাম। অন্যান্য বাইয়ের আড়ালে লুকিয়ে ও জানালা দিয়ে চারটা সমগ্র উপন্যাস দিয়েছিল আমাদের হাতে। স্যার সমগ্রগুলো খুঁজেও দেখেননি কখনো। তাই ওটা আড়ালেই থেকে যায়। তো ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষার আগে অনুমতি পত্র নেওয়ার সময় সেই লাইব্রেরির স্যার ওকে আটকে দেয়, কারণ খাতায় স্পষ্ট লিখা আছে শামসুল বেশ কয়েকবার বই নিয়েছিল লাইব্রেরি থেকে। যার মধ্যে কয়েকটা বই ফেরত দেয়নি। তো অফিস থেকে লাইব্রেরি রুমে যেতে বলে ওকে। আমরা ওর সাথে যাই তখন। তো বাংলা সাহিত্যের সেই লাইব্রেরিয়ান স্যার ওকে খাতা দেখিয়ে বলে, এই বইগুলো আগে ফেরত দাও, তারপর আমি অনুমতি দিবো তোমাকে প্রবেশপত্র দেওয়ার।" শামসুল তখন হেসে দিয়ে বলল, চাকরি বাঁচাতে চাইলে মেইন অফিসে বলেন আমাকে প্রবেশপত্র দিতে। নাহলে আপনার চাকরি কীভাবে খেতে হয়, তা ভালো করেই জানি আমি।’
ওর কথা শুনে স্যারসহ আমরাও হতভম্ব হয়ে গেছিলাম তখন। ও আবার বলল, ‘আমার কাছে এই লাইব্রেরি চারটা উপন্যাস সমগ্র আছে স্যার। কিন্তু সেই হিসেব আপনার খাতায় নেই। এবার আমি প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে গিয়ে বলল লাইব্রেরিতে চারটা উপন্যাস সমগ্র নেই। প্রিন্সিপাল স্যার আপনার এখানে আসবে। হিসেব চাইবে আপনার কাছে। তখন কোত্থেকে দিবেন আপনি হিসেব? আপনার কাছে তো কোনো হিসেব নেই এর। তখন কী করবেন আপনি? আমার কথা বলবেন? কিন্তু কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে? তাছাড়া আপনি দায়িত্বে থাকার পরও বইগুলো বিনা অনুমতিতে আমার কাছে এলো কীভাবে? নিশ্চয়ই এই দায়িত্ব আপনি সঠিক মতো পালন করতে পারেন না। একবার ভেবে দেখুন স্যার, প্রবেশপত্র না পেলে আমি এমনিতেই পরিক্ষা দিতে পারব না। কিন্তু সেই সাথে আপনার চাকরি যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে যাবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, আর আপনার সরকারি চাকরি। বুঝতেই পারছেন বিষয়টা কতদূর যাবে।’
শামসুল যতক্ষণ কথা বলছিল, আমরা সবাই শুধু ‘হা’ করেই তাকিয়ে ছিলাম ততক্ষণ। হঠাৎ স্যার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘বেয়াদব ছেলে কোথাকার। তোমার এতবড় সাহস যে, তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছ। শুনে রাখ, আজ হয়তো তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি আমি। কিন্তু এর শোধ আমি নিবোই। আমি এই ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন আমার বিষয়ে পাস করতে পারবে না তুমি। আমি তোমাকে পাস করতে দিবো না। আর আজকের ঘটনাটা তো সারাজীবন মাথায় রাখবো।’
সেদিন স্যার ওকে অনুমতিপত্র দিয়েছিল। কিন্তু সত্যি সত্যিই স্যারের বিষয়ে ফেইল করেছিল শামসুল। স্যার শামসুলকে দেখলেই ক্ষেপে যেতো। তো এর অনেকদিন পর ক্লাস শেষে শামসুলকে শালাইব্রেরি রুমে ঢুকতে দিচ্ছিল না স্যার। সেই নিয়ে আরো ঝামেলা হয়ে যায় শামসুল আর স্যারের মাঝে। স্যার গিয়ে সরাসরি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে অভিযোগ করল। প্রিন্সিপাল স্যার ওকে শাসিয়ে যায় এবং ওকে তার রুমে ডেকে নিয়ে যায়। লাইব্রেরির স্যার তো মহা খুশি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন শামসুলকে এবার ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কার করবে। আমরাও তেমনটাই ভেবেছিলাম। সেদিন আর শামসুল এর দেখা পাইনি। ভেবেছিলাম হয়তো বহিষ্কৃত হয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে রাতের ট্রেনে। কিন্তু না, পরেরদিন ও আবার ক্যাম্পাসে হাজির। অদ্ভুতভাবে সেদিনের পর থেকে প্রিন্সিপাল স্যার শামসুল এর সঙ্গ দিতে শুরু করল। ক্লাসরুমে এসে শামসুল এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। শামসুল এর সব কথায় সম্মতি জানাতো সবসময়। আমরা সবাই তো অবাক। কী এমন করল শামসুল, যার জন্য ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কার হওয়ায় বদলে প্রিন্সিপাল স্যারের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠল। লাইব্রেরির স্যারও অবাক হয়ে দেখতো সব। আমরা শামসুল কে জিজ্ঞেস করেছিলাম আসল কাহিনী কী? কিন্তু ও বলেছিল, ‘সব জানলে আকর্ষণ কমে যাবে। তাই কিছু কিছু গোপন থাকা ভালো। কী আর বলব। এভাবেই দিন যেতে থাকল। আমরা পাস করে বেরিয়ে এলাম। আর শামসুল সেখানেই ফেইল করে পড়ে রইল। আজকেই হঠাৎ ওর সাথে দেখা। কথা বললাম ওর সাথে। ও বলল, আমরা ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসার কিছুদিন পরই লাইব্রেরির স্যার অন্য একটা ইউনিভার্সিটিতে ট্রান্সফার হয়ে যায়। এর পরের বছরই শামসুল পাস করে উপরে ইয়ারে ওঠে৷ এখন একটা চাকরি করছে ও। এবার আপনিই বলুন স্যার, এইরকম একটা বন্ধুর সাথে দেখা হলে কীভাবে কিছুক্ষণ আড্ডা না দিয়ে চলে আসি?’
বস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘হুম। ঠিকই করেছেন। এইরকম অদ্ভুত চরিত্রের লোকদের সাথে কথা বললে অভিজ্ঞতা বাড়ে। তবে অফিস টাইমটা-ও মাথায় রাখবেন। এখন তাহলে যান নিজেদের কাজে আপনারা। তবে পরবর্তীতে তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবেন।’
- ওকে স্যার।
সায়েম আর সারা বেরিয়ে এলো বসের রুম থেকে। সারা এতক্ষণ নিঃশব্দে থাকলেও রুমের বাইরে এসে বলল, ‘ওরে আল্লাহ। আপনার মতো মানুষ পুরো পৃথিবী খুঁজলেও আর পাওয়া যাবে না। বসের সামনে তো আমি নিশ্বাস ও নিতে পারছিলাম না, আর আপনি এতগুলো মিথ্যে কথা বলে ফেললেন কোনোরকম দ্বিধা না করে। আপনি সত্যিই জিনিয়াস।’
- মাত্র একটা মিথ্যে বলেছি। তা হলো শামসুল এর সাথে কথা বলতে গিয়েই দেরি হয়ে গেছে। বাকি সব সত্যি।
- তারমানে এই শামসুল, লাইব্রেরির স্যার, প্রিন্সিপাল স্যার, এইসব সত্যি।
- ইয়েস ম্যাডাম, এইসব নাম সত্যি। আর ঘটনাগুলোও সত্যি।
- ভাবাই যায় না যে, এইরকম অদ্ভুত মানুষও আছে পৃথিবীতে।
- শুধু তাই নয়, ও তো পরিক্ষার খাতাতেও মাঝে মাঝে নিজের বানানো গল্প লিখে দিতো। কবিটাটাই বেশি লিখতো।
- তার সাথে কখনো দেখা হলে আমাকে বলবেন। আমিও দেখা করব। আচ্ছা, আপনি এখন কাজ করুন।
সায়েম মৃদু হাসি দিয়ে নিজের ডেস্কে বসে পড়ল। সারা-ও তাই করল।
ফাহাদের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইতি। কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল। এরপর ফাহাদের নম্বরে ফোন দিলো। ফাহাদ নিজের কেবিনে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। তখনই ফোনটা বেজে ওঠায় স্ক্রিনের দিকে তাকালো। ইতির নামটা দেখে ফাহাদের বুকটা চিনচিন করে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফোনটা রিসিভ করল ফাহাদ। নিঃশব্দে সেভাবেই ফোনটা কানের কাছে রেখে বসে রইলো। ফোনের ওপাশের মানুষটার নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ফাহাদ। উত্তেজনায় বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ইতি। কিছুটা সময় এভাবে পেরিয়ে যাওয়ার পর ইতি বলল, ‘চুপ করে আছ কেন ফাহাদ ভাইয়া?’
ফাহাদ এবারও চুপ করেই রইল। ইতি রাগ দেখিয়ে বলল, ‘চুপ করে থাকলে কিন্তু আমি চলে যাবো। আর ফোনও দিবো না কোনোদিন।’
ফাহাদ মুচকি হাসি দিলো শুধু। কিছু বলল না। ইতি সবগুলো দাঁত এক করে বলল, ‘তোমাকে সামনে পেলে খুন করে ফেলতাম আমি। আমার সাথে মজা করছ তুমি। তোমাকে একবার দেখার জন্য অফিসের সামনে চলে এসেছি, আর তুমি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছ না। ওকে আর আসবো না তোমার সামনে। আর একটা খুশির সংবাদ-ও দিতে এসেছিলাম, কিন্তু তুমি যা করলে, এরপর আর কথাই বলব না তোমার সাথে।’
ইতির কথা শেষ হতেই ফাহাদ বলে উঠল, ‘আমার অফিসে এসেছ মানে? কোথায় তুমি?’
ইতি মুচকি হাসি দিলো নিঃশব্দে। ফাহাদ আবার বলল, ‘প্লিজ রাগ করো না। আমি আসলেই একটু মজা করছিলাম। তুমি কোথায় আছ সেটা আগে বলো, আমি এক্ষুনি আসছি?’
ইতি তবুও নিশ্চুপ। ফাহাদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে মেইন গেইটের দিকে তাকাতেই দেখল ইতি দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদ ফোনটা কানের কাছে ধরেই দৌড় দিলো। নিচে এসে দেখে ইতি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদকে দেখে ইতি ফোনটা নামিয়ে ব্যাগে রেখে দিলো। ফাহাদ ফোনটা পকেটে রেখে ইতির সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বল - আরে রাগ করছ কেন? আমাকে আগে বললেই হতো, যে তুমি এখানে এসেছ।
- এখানে আসা ছাড়া কী তোমার সাথে কথা বলা যাবে না, যে ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছ?
- আরে যাবে না কেন? আমি তো একটু মজা করছিলাম।
- হুম ঠিক আছে।
ফাহাদ ইতির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যপার, মিস ইতিকে আজ একটু অন্যরকম লাগছে।’
- আজ আমার জীবনের অনেক বড় একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। একটু অন্যরকম তো লাগবেই, তাই না?
- তাই নাকি, তা কোন স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে?
- আমি চাকরি পেয়ে গেছি ফাহাদ ভাইয়া।
ফাহাদ চোখ বড় বড় করে তাকালো ইতির দিকে। ইতি মুচকি হেসে দিয়ে বলল, ‘ঠিকই শুনেছ।’
ফাহাদ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ওয়াও। কংগ্রাচুলেশনস মাই ডেয়ার।’
- থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া।
ফাহাদ রাগী কণ্ঠে বলল, ‘আরে রাখো তোমার ভাইয়া। দিনরাত যাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখি, সে সারাদিন ভাইয়া ভাইয়া করে কথা বলে।’
ইতি হেসে দিয়ে বলল, ‘তুমি আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। আমার তো নয় যে তোমাকে নাম ধরে ডাকবো। তাই তোমাকে আমি ভাইয়া বলেই ডাকবো।’
ফাহাদ অবাক কণ্ঠে বলল, ‘কিছুদিন পর যখন আমাদের বিয়ে হবে, তখনও কী আমাকে ভাইয়া বলেই ডাকবে?’
ইতি আবারও হেসে দিয়ে বলল, ‘বিয়ের পর কী তুমি আমার ছোট হয়ে যাবে?’
- না।
- তাহলে তখনও ভাইয়া বলেই ডাকবো।
ফাহাদ অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘হায় আল্লাহ, এই মেয়ে বলে কী? স্বামীকে নাকি ভাইয়া বলে ডাকবে। সত্যি বলছি ইতি, তোমার মতো অদ্ভুত মেয়ে আমি এ জীবনে দু'টো দেখিনি।’
ইতি শব্দ করে হেসে উঠলো। ফাহাদ কিছু না বলে চুপ করেই রইল। কিছুক্ষণ পর ইতি বলল, ‘আমি এবার যাই ফাহাদ ভাইয়া।’
- আগে বল আজ তোমার ইন্টারভিউ, সেই কথাটা আমাকে আগে বলোনি কেন?
- ভেবেছিলাম চাকরিটা হবে না। যখন তুমি জিজ্ঞেস করবে চাকরির কথা, তখন কীভাবে না বলতাম? তাই লজ্জা পাবো বলে ইন্টারভিউ এর কথাটা বলিনি।
ফাহাদ মৃদু হেসে দিয়ে বলল, ‘হুম বুঝলাম। তা এত সেজেগুজে গিয়েছিলে কেন? অফিসের বস কী খুব স্মার্ট?’
- হ্যাঁ, মধ্যবয়সী হলেও খুবই স্মার্ট। আর আমি এমনিতেই একটু সেজেগুজে গিয়েছি। বস আমার বাবার বয়সী।
- তোমাকে এত খুব সুন্দর লাগছে যে, এবার সত্যি সত্যি তোমার ভার্জিনিটি নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করছে।
ইতি লাজুকলতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি চুপ করবে, নাকি আমি ভাইয়াকে বলে দিবো।’
ফাহাদ উচ্চস্বরে হেসে দিয়ে বলল, ‘সাবধানে যেও। লাঞ্চ শেষ করে আমাকে কাজ করতে হবে আবার। নাহলে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতাম।’
- ঠিক আছে।
ফাহাদ চলে গেল অফিসের ভিতর। ইতি সেখান থেকে আবারও বাসে করে বাড়িতে চলে এলো। বাড়িতে এসে নিজের ঘরের বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো ইতি। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। ইতি সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘লোকটার কাণ্ডজ্ঞান বলে কী কিছুই নেই? কীভাবে আমাকে বলল, এবার সত্যি সত্যি তোমার ভার্জিনিটি নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করছে! আগে তো সামনে এলো হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিতো। অথচ এখন কীসব বলে! সাহস দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে লোকটার। এবার কিছু একটা করতে হবে।’
রহস্যময় হাসি দিয়ে বালিশে মুখ গুজে চোখ বন্ধ করল ইতি।
(চলবে...)
আরো পড়ুন ৪র্থ পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড