• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : শেষ থেকে শুরু

  অ্যান্থনি সজীব

১৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:১৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

বিকেলে দক্ষিণের ব্যালকুনিতে দাঁড়ালে শরতের সাদা মেঘ আর পেছনের নীল আকাশ-পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের মিষ্টি কুসুমরাঙা আলো কাশফুলের মত সাদা মেঘের উপরে এসে পড়লে একটা উজ্জ্বল শুভ্র ঝলকানির সৃষ্টি করে। ছুটির দিনের অলস দুপুরের হালকা আলসেমিকে লায় দেওয়া ঘুমের আড়মোড়া ভেঙে ধোয়া উঠা চায়ে দুএকটা চুমুক পড়তেই মনটা সকল কালের বাঁধন ছিড়ে হুল্লোর আর লুটোপুটি করা কৈশরের দিনগুলোতে চলে যায়।

ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সদ্য গ্রিল বেয়ে বেড়ে উঠা অপরাজিতার গাছটার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ থেকেই নিজের শৈশব কৈশর বেলার স্মৃতির অ্যালবাম নেড়েচেড়ে যাচ্ছিলো অরূপ। নীলা এসে পেছন থেকে একটা ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- কিগো, কি হলো? চা যে চিনি ছাড়া এইটাও কি এতক্ষণে বুঝতে পারলেনা? এই যে স্যার, কোন ধ্যানে আছেন আপনি শুনি? আমি যদি চিনি দিতে ভুলেও যাই তাহলেও উনি সেইটাই খাবেন, অদ্ভুত পাগল তো আপনি। বলতে বলতে পেছন থেকেই অরূপের কাধে মাথা রাখলো নীলা। কিন্তু অরূপের চিন্তায় কোন বাঁধা পড়ে না। চিনি ছাড়া চা’ই চুমুকের পর চুমুক পান করতে দেখে নীলা এবারে একটু বিভ্রান্তের মত প্রশ্ন করে- আচ্ছা , তোমার শরীর টরির খারাপ করলো না তো আবার? কি হয়েছে বল দেখি? কথাটা বলেই কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা চালায় নীলা। এবারে অরূপ চায়ের কাপটা গ্রিলের পাশে রেখে নীলার দিকে তাকিয়ে বললো- নীলা তোমাকে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা একটা জিনিস যদি দেখাতে চাই, তুমি দেখবে? নীলা অরূপের কথায় অবাক হয়ে বলে- তোমার জীবনের সাথে যখন জীবন মেলাতে পেরেছি তখন জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা সব তো আমায় দেখতেই হবে। অবশ্যই দেখবো। দেখাও আমাকে। একটা অত্যন্ত জিজ্ঞাসাতুর হাসি হেসে নীলা আবার বলে- কি হয়েছে তোমার বলতো? আজ দুই বছর হলো আমরা সংসার করছি। এমন কি আছে তোমার জীবনে যা এখনো আমাকে দেখাওনি? অরূপ উড়ে যাওয়া মেঘের অনন্ত অসীম যাত্রাপানে দৃষ্টি মেলে দিয়ে বলে- তোমাকে এবারে অতীত দেখাবো। কখনো অতীত দেখেছো নীলা? জীবনের ফেলে আসা অতীত? নীলা মুখে কিছুই বলে না। শুধু অরূপের কাঁধে মাথা রেখে চায়ের কাপটা গ্রিলের পাশ হতে নিয়ে আবার ওর হাতে তুলে দেয়।

পরদিন সকালে বেরিয়ে পরে দুইজন। নীলা রাতে অনেকবার জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছে কোথায় যাচ্ছে তারা কিন্তু যখনই প্রশ্নটা গলা পর্যন্ত চলে এসেছে কি জানি এক অদ্ভুত আশংকামিশ্রিত দ্বিধা প্রশ্নটাকে থামিয়ে দিয়েছে সেখানেই। তাই জিজ্ঞাসা করি করি করেও আর করা হয়ে উঠেনি। গাড়ি শহর ছেড়ে উত্তর দিকে বেশ কয়েকঘন্টা চলার পর সবুজে ছাওয়া একটা গ্রামের দিকে ঢুকতে লাগলে অরূপকে কেমন একটু উচ্ছ্বসিত দেখালো। খানিক পরে অরূপ বলে উঠলো- এই যে বিল টা দেখছো এটাকে এ অঞ্চলের মানুষ ‘ইটাকরের’ বিল বলে চিনে। নীলা নামটা শুনে একটু হাসলো, ভ্রু একটু কুচকে প্রশ্ন করলো- কি নাম বললে? ইটাকরের বিল? হা হা হা, এটা আবার কেমন নাম? কি মানে এই নামের? অরূপ ডানে বামে মাথা ঝাকিয়ে বললো- কিজানি কি মানে। কখনো তো ভেবে দেখিনি। মানে কখনো তো এই প্রশ্নই জাগেনি মনে। তবে এই বিলটা পার করে ঐ যে একসাড়ি গাছ দেখছ ঐ দিকটায় আমার এক আত্মীয় থাকে। নীলা অরূপের দেখানো গাছের সাড়ির দিকে তাকালে অরূপ বললো- আচ্ছা তোমাকে যদি প্রশ্ন করি আত্মীয় বলতে কি বুঝ, কি উত্তর হবে তোমার? নীলা জানালা দিয়ে অরূপের দেখানো গাছের সাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। অরূপের প্রশ্ন শুনে পাশ ফিরে তাকালো। হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুত ভাবে কি উত্তর করবে বুঝতে না পেরে নীলা বললো- আত্মীয় শব্দের এত গভীর অর্থ তো বুঝিনা। তবে আমার কাছে আত্মীয় হলো আপনজন। আপনজন বলতে ধর আমার পরিবারের সদস্যরা আমার সবচেয়ে আপনজন। তাহলে তারাই আমার আত্মীয়। অরূপ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। জানালা গলিয়ে দৃষ্টি তখন দূরের কোন অতীতে। একটু অন্যমনষ্কভাবেই অরূপ উত্তর দিল- কিন্তু আমার কাছে আত্মীয় মানে আলাদা কিছু। - কেমন আলাদা? - আত্মীয় কথাটাতেই এর উত্তর আছে। - আহ, হেয়ালি না করে বুঝিয়ে বললেই হয়। - হেয়ালি নয় মোটেও। আমার উত্তর শুনলে তুমিও বলবে আমার উত্তরটাই সঠিক। হঠাৎ কেমন অসহায়ের মত নীলার ডান হাতটাকে শক্ত করে ধরে অরূপ বলে উঠলো- নীলা আজ যদি আমি আমার জীবনের অনেক কষ্টের কিছু গল্প তোমায় শুনাই, তুমি শুনবে না? নীলা ভ্রু একটু কুঁচকে অরূপের দিকে তাকিয়ে বললো- এভাবে কেন বলছ? আমি কি তোমার কোন কথায় কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেছি বা কখনো আমার কোন কথায় কি তোমার এমন মনে হয়েছে অরূপ? অরূপ আশ্বস্ত হয়ে বললো – না, তা কখনো মনে হয়নি বা তুমি কখনো বিরক্তও হওনি। হ্যাঁ, আজ আমি তোমাকে সব বলবো। আজকের এই ব্যারিস্টার অরূপের ব্যারিস্টার হয়ে উঠার গল্প। কিভাবে এই ধূলোমাটির গ্রাম ছেড়ে বাপ-মা মরা এতিম অরূপ মিত্র আজকে তোমার ‘অরূ’ হয়ে উঠেছে সব বলব। সব-। নীলা একটু বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো- - এই ধূলোমাটির গ্রাম ছেড়ে মানে? তুমি তো বলেছিলে তুমি কখনো গ্রামে থাকনি। তুমি কখনো গ্রামের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারো না। এমনকি গ্রামে তোমার কোন আত্মীয় স্বজনও নেই? - মিথ্যা বলেছিলাম তোমাকে। - আমাকে মিথ্যা বলেছিলে? কিন্তু কেন? - ভয়ে। - ভয়? কিসের ভয় অরূ? আমার কাছে তোমার কিসের ভয়? - ভয় তোমার প্রতি ছিল না, ছিল তোমার বাবার প্রতি। সত্যটা জানার পরে যদি তিনি আমার সাথে তোমার বিয়ে না দেন। তাই সত্যটা আমি লুকিয়েছিলাম। তোমাকে আমি হারাতে চাইনি নীলা। - আচ্ছা বুঝলাম, এখন তো আর সেই ভয় নেই, তাইনা? এখন তো বল সত্যিটা। - হ্যাঁ, আজ আমি সব বলবো। শুধু বলবোই না, আজ আমি অনেক কিছু তোমাকে দেখাবোও। আমার শিকড়টা তোমাকে তো এখনো দেখানো বাকি আছে। - আচ্ছা, তুমি কি এখন দয়া করে আমাকে বলবে আসলে আমাকে ঠিক কি বলতে চাও? আমি কি তোমার মত ব্যরিস্টারি পড়েছি যে এত কঠিন কঠিন ভাষা সহজেই বুঝে যাবো? একটু সহজ করে বললেই পার। অরূপ নীলার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দূর দিগন্তরেখায় মেলে দিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুরু করলো- আমার নাম অরূপ মিত্র নয়। না আমার বংশ মিত্র বংশ। আমি হলাম ডোম। আমার চৌদ্দ পুরুষ ছিল ডোম। সব জাতের হিন্দুরা কেবল মারা গেলেই আসতো আমাদের কাছে। মরদেহ দাহ করার কাজ করে এসেছে আমার পূর্ব পুরুষেরা। অরূপ মিত্র হবার আগে আমার নাম কি ছিল আমি জানি না। আমি কখনো জানার চেষ্টাও করিনি। কারণ আমি যখন অনাহারে রাস্তায় অসহায়ের মত ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছিলাম তখনোও আমার সম্প্রদায় আমাকে বাঁচানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। তাই আমিও আমার সম্প্রদায়কে আর বহন করতে চাইনি। আর জানতো রক্তে কখনো সম্প্রদায়ের নাম লেখা থাকেনা, ধর্মের নাম লেখা থাকে না তাই আমি পরবর্তী জীবনে আর কখনো কোন টানে আমার নিজের মানুষদের কাছে ফিরে যাইনি। যে প্রয়োজন তাদের ছাড়া মেটানো যায় না তা আমি অপূর্ণ রেখেই জীবনে সুখ খুঁজেছি। নীলা মনযোগ দিয়ে শুনছিলো। এইটুকু বলার পরে অরূপ একটু থামতেই নীলা বলে উঠলো- তাহলে? তুমি কিভাবে-? মানে বাবা-মা ছাড়া এতিম একটা ছেলে, নিজের সম্প্রদায়ের স্বজনদের সাহায্য ছাড়া- নাহ, ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না ব্যাপারটা। বরং আরোও বেশি জটিল হচ্ছে। অরূপ একটা বড় নিশ্বাস ভেতরে টেনে বললো- আমি মানুষ হয়েছি মাদ্রাসার হুজুরের ছত্রছায়ায়। - কী! মাদ্রাসার হুজুরের কাছে? এটা কিভাবে সম্ভব? নীলা যেন আকাশ থেকে পরলো। - হ্যাঁ, এটাই সত্যি নীলা। আমি আজকে এতদূর পথ পাড়ি দিয়েছি কেবল একজনেরই দোয়া আশির্বাদ আর সহায়তায়। তিনি হলেন আমাদের পাশের গ্রামের হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল শকুর মিয়া। অথচ তিনি কোনদিন আমাকে ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য করেননি বা আমার ধর্ম পালনে আমাকে কোনদিন বাধা দেননি। - কিন্তু মাদ্রাসার একজন মুসলিম হুজুর তোমাকে- মানে একজন হিন্দু ছেলের দেখভাল করেছে! ব্যাপারটা তো বেশ অদ্ভুত লাগছে অরূ। আবার ইন্টারেস্টিংও। - আজকে তোমার কাছে ব্যাপারটা যতটুকু রোমাঞ্চকর লাগছে ঘটনাটা আমার কাছে ছিল তারচেয়েও অনেক বেশি কষ্টের। একটা সমাজ, জাত ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসিত ছেলের জীবন সংগ্রামের গল্প। কথাটা বলেই অরূপের দৃষ্টি কেমন যেন তীক্ষ্ম হয়ে উঠলো। অনেক দূরের কোন আবছা জিনিস দেখার জন্য মানুষ চোখদুটোকে যেমন একটু ছোট করে তাকায় ঠিক সেইভাবে নীলার দিকে তাকিয়ে অরূপ বললো, - হুজুর অত্যন্ত অসুস্থ। আজ প্রায় ছয় বছর হয় আমি তার সাথে কোন যোগাযোগ করিনি। দেশের বাইরে ব্যারিস্টারি পড়তে গেলাম। যাবার আগে একবার দেখা করেছিলাম ঠিক। কিন্তু সেখানে থাকা কালিন আর কোন-। দেশে এসে স্থায়ী হয়েছি, বিয়ে করেছি আজ প্রায় দুবছর। এই মানুষটার একটা খোঁজও আমি নেইনি। আমি কত পাপ করছি বলতে পার নীলা? এ মুখে আমি ভগবান তুল্য মানুষটার সামনে দাঁড়াব কিভাবে!

নীলা শান্ত গলায় উত্তর দিল- আমি জানিনা এখানে আমার কি বলা উচিত। কিন্তু একটা কথা ভুলে যেও না, আজকে তুমি যখন হুজুরের সামনে যাচ্ছ তখন উনি অসুস্থ-বিপদ্গ্রস্থ। আর প্রকৃত আত্মীয় তো সেই যে বিপদে পাশে দাঁড়ায়। তুমিও তাই করছ। আর ভগবান তুল্যই যখন বলেছ, ভুলে যাচ্ছ কেন যে ভগবান কখনো ক্ষমা দানে কমতি রাখেন না। অরূপ একটু আশ্বস্ত হয়।

গাড়ি তখন বড় রাস্তা ছেড়ে ইটাকরের বিলের বুক চিড়ে আঁকাবাঁকা লম¦া বিস্তৃত রাস্তায় ঢুকে পরেছে। পানির সময়ে বিলগুলো নতুন যৌবন ফিরে পায়। গত কয়েকদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে বিলে বেশ পানি। দুএকটা নৌকাও চোখে পড়ছিল, সম্ভবত স্থানীয় জেলেদের ছোট ছোট নৌকা। মানুষগুলো অনেক সাধারণ গোছের। আসলে গ্রামের মানুষ মাত্রই এমন সাধারণ ভাব ধারার হয়। বিলের মাঝবরাবর মাটির রাস্তাদিয়ে একটু এসেই দুটো বড় বড় বটগাছের মোড়ে কয়েকটি টিনের ঘর, দোকান। কিছু মাঝ বয়সী পুরুষেরা বসে বসে গল্প করছে। গাড়ি মোড়ের কাছে আসতেই তাদের বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল। এত দূরের নিভৃত পল্লীতে শহর জীবনের বিলাসী কালো চকচকে গাড়ি যে অত্যন্ত বেমানান সেটার বর্হিপ্রকাশ তাদের অমনভাবে তাকিয়ে থাকা। গাড়ি কাঁদা মাটির রাস্তাদিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটা অত্যন্ত পুরাতন, রোদ-বৃষ্টিতে মরিচা ধরে লাল মলিন হয়ে যাওয়া টিনের ঘরের সামনে দাঁড়ালো। ছোট্ট উঠানে গাড়ি দাড়াতেই ঘর থেকে একজন পৌঢ়াকে বের হতে দেখা গেল। অরূপ গাড়ি থেকে নেমে ছলছল চোখে ধীর পায়ে হেটে তার সামনে গিয়ে বললো- কেমন আছেন চাচী? পৌঢ়া চশমার গ্লাস গলিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর চিনতে পেরে আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে জোড়ে বলে উঠলো- ওগো, এই দেহ তোমার অরূপ আইছে গো। কথাটা বলেই উনি দৌঁড়ে গেলেন ঘরের ভেতরে। কান্না আটকাতে পারলো না অরূপ। পাশে দাঁড়ানো নীলার চোখও তখন প্রায় ভিজে এসেছে। একটু পরে চাচী বাইরে বেরিয়ে আসলে নীলাও এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো অরূপের মত। চাচী নীলার দিকে ভাল করে তাকাতেই অরূপ বললো- ওর নাম নীলা, আমরা দুবছর হয় বিয়ে করেছি। চাচীর মুখে একখন্ড হাসি ফুঁটে উঠলো। নীলার চিবুকের ¯পর্শ নিয়ে চুমু খেলেন। তারপর নীলার হাত ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আব্দুল শকুর মিয়ার শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন- দেহ দেহ আমাগো অরূ কেমন সুন্দর হুরি একটা বিয়া কইরেছে। পেছনে অরূপ এসে দাঁড়ালে অব্দুর শকুর মিয়া একবার মাথাটা অরূপের দিকে ঘুরালেন। অরূপ পায়ের কাছে বসে সালাম করে বললো- কেমন আছেন চাচা? শকুর মিয়া চুপ। শুধু চোখের কোণা দিয়ে জল গড়াচ্ছিলো বাঁধভাঙা। অরূপ বললো- আমাকে ক্ষমা করে দিন চাচা, কতগুলো বছর অকৃতজ্ঞের মত আমি আপনাদের কোন খোঁজ খবর রাখিনি। কিন্তু এখন আমি এসে গেছি, কোন চিন্তা করবেন না। আপনাকে আমি কালই ঢাকায় নিয়ে যাবো। ভাল ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আপনি আবার ভাল হয়ে উঠবেন।

অরূপ জানে চাচা আর উঠবেন না। এই পক্ষাঘাত একবার মানুষের চলাচলে শেকল পড়িয়ে দিলে তা আর ছাড়ানো যায় না। অরূপ হাতে হাত রাখতেই শকুর মিয়া আরও শক্ত করে ধরে হাতটা। শকুর মিয়া নিঃসন্তান ছিলেন। তাই শেষ সময়ে আর কাউকে পাশে পাননি। বছরখানেক হয় প্যারালাইসিস এ আক্রান্ত। মুখদিয়েও কোন কথা বের হয় না। চলাচলের শক্তির সাথে সাথে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে গেছে। শুধু রয়েছে চোখের জল ফেলবার অক্ষয় শক্তি। সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষকে আঘাতের সামনে দাঁড় করান তখন সেই আঘাত প্রশমিত করার উপকরণ ও দিয়ে দেন পর্যাপ্ত পরিমানে। অরূপের কথায় চাচী মনে মনে অভয় পান। আশার সঞ্চার হয়।

রাতে অরূপ চেনা পরিচিত বেশ কিছু ডাক্তারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে। শকুর মিয়ার অচলবস্থা ডাক্তার বন্ধুদের জানালে সকলেই এই রোগ নিরাময় যোগ্য নয় বলে জানায়। তবুও এত সহজে আশা ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হয় না অরূপের। তাই লন্ডনে একসাথে পড়ালেখা করা পরিচিত এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে চাচাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলে রাতেই। চৌচালা দুটি টিনের ঘরের একটিতে অরূপ আর নীলার রাত কাটাবার ব্যাবস্থা করে দেন চাচী। অরূপের ভয় হচ্ছিলো পাছে নীলা এই গ্রাম্য সাধারণ পরিবেশে থাকতে গিয়ে আবার কোন অভিযোগ করে বসে। কিন্তু নীলা বেশ নমনীয় আর মানিয়ে নেওয়া মেয়ে। বড়লোকের মেয়ে মাত্রই যে অহংকারী হয় না তা ওকে দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। কুপি বাতির মিটমিট করা আলো আর বিদ্যুৎ হীন ভ্যাপ্সা গরম উঠা রাতেও নীলা কোনরকম অভিযোগ ছাড়াই কাটিয়ে দেয়।

অরূপের পরিকল্পনা মত সবকিছু ঘটলে গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো। শকুর মিয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হতো, হয়ত তাকে সুস্থও করা যেত। কিন্তু মনুষ্য পরিকল্পনার সাথে ভগবানের পরিকল্পনা খুবই কম সময়ে মিলে। কিন্তু যা ঘটে সবটাই তাঁর ইচ্ছামতই ঘটে। সেদিন রাতেই নিভৃত পল্লীর হাফিজিয়া মাদ্রাসায় দীর্ঘ ৩২ বছর শিক্ষকতা করে আসা মাওলানা আব্দুর শকুর মিয়া ইহলোক ত্যাগ করেন। সকালে উঠে অরূপ দেখে চাচী নিরবে মাথায় হাত দিয়ে উঠানে বসে আছে। চাচির মুখের দিকে তাকিয়েই অরূপ আন্দাজ করতে পারে ব্যাপারটা। দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে দেখে চাচার দৃষ্টি একদিকে স্থির। কোন নিশ্বাসের উঠানামা নেই। হাত-পা কাঁপতে থাকে ওর। বিছানার কোণায় থাকা মশারির স্ট্যান্ড টা শক্ত করে ধরে দাঁড়ায় অরূপ। নীলা অল্প সময় পরে ঘরে ঢুকে নিশ্বাস পরীক্ষা করে। প্রায় শক্ত আর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হাতটা তুলে শিরা পরীক্ষা করে অসহায়ের মত তাকিয়ে ডানে বামে মাথা ঝাকায়। অনেকদিন থেকে ধীরে ধীরে একটা বাঁধ নির্মাণ হচ্ছিলো যেন বান এলে ফসলী জমি না ভাসে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এক রাতে এমন একটা ঝড় আর বৃষ্টি একসাথে পাঠালেন যে ঝড়ে বাঁধ ভাঙলো আর বানের জলে ঘর ভাসল। সকালে সেই বানের জলে বাঁধ দেওয়া কি ভয়ানক দুঃসাধ্য কাজ! অরূপের কান্নার বাঁধ ভাঙ্গে। এর ঘন্টাখানেকের মধ্যে পাড়ার লোকে উঠান ভরে গেল।

বেলা পড়ে এলে জানাজা শেষ করে মাদ্রাসার দক্ষিণ পাশের গোরস্তানে সমাজের মুরব্বিরা শকুর মিয়াকে শেষ নিদ্রায় শুইয়ে দেয়। অরূপ সবার পেছন থেকে ধীরে ধিরে এসে একমুঠো মাটি ফেলে দেয় সাদা কফিনে ঢাকা পরম আত্মীয় উপরে। হটাৎ বুকটা কেমন যেন হুহু করে উঠে। বার বার মনে হতে থাকে চাচা অনেক অভিমান নিয়ে চলে গেল। সেই প্রানবন্ত উচ্ছ্বল পিতৃসমতুল্য মানুষটা খুব করে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছিল। সে নিজেও সেই আশা দেখিয়েছিল। চাচা সুস্থ হয়ে উঠবে এই কথায় চাচীর পৌঢ় মুখের সেইযে এক টুকরো হাসি ফুঁটে উঠেছিল সেই হাসিটা ফিরে ফিরে ভেসে উঠছিল অরূপের মনের মধ্যে। দাফন হয়ে গেলে একজন দুজন করে সকলে চলে গেলেও অরূপ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। দুজন তামাটে রঙের শক্ত সামর্থ্য যুবক কোদাল দিয়ে লাগাতার মাটি ভরাট করে চলছিল কবরে মধ্যে। এক ধ্যানে তাকিয়ে দেখছিল অরূপ। হটাৎ দূর থেকে কাউকে দৌঁড়ে গোরস্তানের দিকে আসতে দেখা গেল। ছোট্ট দশ-বার বছরের একটি ছেলে এসে অরূপের জামার কাপড় ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো- ভাইজান, ভাইজান, তাড়াতাড়ি আহেন- শহরের ভাবিজান কেমন জানি করতাছে। মাথা ঘুরানদিয়া পইরা গেছিল। দাদীজান মাথায় পানি ঢালতেচে। তাড়াতাড়ি আহেন। অরূপ ছেলেটার পেছন পেছন দৌঁড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখে নীলা বিছানায় শোয়া। কি করবে বুঝতে না পেরে চাচীর দিকে তাকালো। চাচী সারাদিন কেঁদেছে। চশমার গ্লাসের আড়ালে কালি পরে আসা চোখদুটির দিকে তাকালে ভেতরটা হুহু করে উঠে। চাচী অরূপের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর অথচ ভরাট গলায় বলল- আসলামের মায়রে আইতে কইছি। আইলে বুঝা যাইবো। এইখান থেকে আট দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন হাসপাতাল নেই। তার উপর রাস্তাঘাট ভালো না। গাড়ি কাদার রাস্তায় একবার আটকে গেলে আরেকটা বিপত্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। এদিকে সূর্য পশ্চিমের সীমানা ছুঁয়েছে। অন্ধকার নামতে দেরি নেই। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় অরূপ। চাচী নীলার পাশে বসে থাকে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই বয়সের ভারে প্রায় কুঁজো হয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধাকে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল।

মাওলানা আব্দুর শকুর মিয়ার এই উঠানে দাঁড়িয়ে জীবন প্রারম্ভবেলার কত শত স্মৃতি একের পর এক ভেসে আসতে থাকে। এখনো রঙিন এখন ঠিক আগের মতই জীবন্ত। টিউবওয়েলের পাড়ের বকুল ফুলের গাছটা কোন একটা বর্ষার দিনে ভিজে ভিজে সে আর চাচাজান লাগিয়েছিল। না হলেও ষোল-সতের বছর আগের কোন একটা বাদলের দিনে। আধো আলো আধো অন্ধকারে গাছের মেটে রঙের মোটা গোড়ালিটা শুধু বুঝা যায়। হঠাৎ আসলামের মা দরজা ঠেলে পেছনে এসে দাঁড়ালো। অরূপ পেছনে তাকাতেই বৃদ্ধা শুকনা একটা হাসি দিয়ে খবরটা জানালো। মানুষের সবচেয়ে প্রিয় খবরগুলোর মধ্যে যেটা অন্যতম। সৃষ্টির খবর। নতুন মানুষের আগমনের খবর। অরূপ হাসলো না। শুধু দরজার পাশে গিয়ে উঁকি দিয়ে নীলাকে দেখলো। কুপি বাতির হালকা মিহি লাল আলোয় ঘুমন্ত নীলাকে কি সুন্দর লাগছিল। পাশে চাচী নিশ্চুপ বসে। দুপ্রান্তের দুই মাঝি এক নৌকায়। একজন নতুনকে বরণ করবে অন্যজন জীবন প্রান্তে দাঁড়িয়ে আপনকে সদ্য বিদায় জানালো।

রান্নার খুপড়িটার পাশে কুকুরটা মুখ উঁচুয়ে একটানে অদ্ভুত এক করুণ সুর করে ডেকে চলেছে। চাচা বলতো মানুষ যা দেখতে পায় না অবলা প্রাণীরা তা দেখতে পায়। মানুষের মরণ আসলে কুকুর বিড়ালের ডাক এইরকম হয়ে যায়। হঠাৎ যেন কানে ভেসে এলো, চাচা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলছে- ওই লালু, গেলি এইহান থাইক্যা? অমন কইরা ডাকিস না। জানস না আমাগো অরূপ বাপজান হইবো। আর আমি হমু গিয়া দাদাজান।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড