রিফাত হোসেন
আনিস উদ্দিন একটু বাঁকা হয়ে শুলেন। দরজার দিকে মুখটা একটু এলিয়ে দিয়ে ‘অন্তরা’ বলে ডাক দিলেন। সম্ভবত অন্তরা বেগম কাছাকাছি কোথাও ছিলেন, সেজন্য খুব তাড়াতাড়ি চলে এলেন ঘরে। স্বামীর পাশে বসে বললেন, ‘তোমার শরীর ঠিক আছে তো? কেমন লাগছে এখন?’
- আমি ভালোই আছি। কাশেম কী এসেছে আজ?
- হ্যাঁ। উপরের ঘরগুলো পরিষ্কার করছে।
আনিস উদ্দিন মুখটা বাঁকা করে বললেন, ‘ওগুলো পরিষ্কার করা মানেই সময় নষ্ট করা। এর থেকে ভালো গেইটের বাইরের রাস্তাটা পরিষ্কার করতে বলো। সময়টাও বিফলে যাবে না, আর মানুষের উপকার-ও হবে।’
অন্তরা বেগম চোখ ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘এভাবে বলছ কেন? ওগুলো তো তোমারই ছেলে-মেয়েদের ঘর।’
- ছিল, এখন আর নেই। ভাবছি বাড়িটাকে ভেঙে ফেলব। এরপর ছোট্ট করে একটা টিনের চালের ঘর বানাবো। পুরো ঘরে একটা শক্ত কাঠের তৈরি বিছানা থাকবে। আসবাবপত্র বলতে শুধুমাত্র খাবার রান্নার জন্য একটা পাতিল, একটা উনুন, আর খাওয়াদাওয়ার আসবাব হিসেবে দু'টো থালা থাকবে। প্রতিদিন সকালে হেঁটে হেঁটে বাজারে গিয়ে একদিনের জন্য চাল আর আলু নিয়ে আসবো। ছোট্ট ঘরের কাঠের তৈরি বিছানায় বসে ভাত আর আলুসিদ্ধ খাবো। এভাবেই বাকি জীবনটা দিব্বি কেটে যাবে।
অন্তরা বেগম অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার মাথা ঠিক আছে তো! এইসব কী বলছ আবোলতাবোল? এতবড় বাড়ি ভেঙে তুমি ছোট্ট টিনের বাড়ি বানাবে। ভাত আর আলুসিদ্ধ খেয়ে জীবন পাড় করবে! এইসব কী বলছ?’
- আমি ঠিকই বলছি অন্তরা। শুধু শুধু এতবড় বাড়ি রেখে কী লাভ বলো তো? মাত্র তো একটা ঘরই কাজে লাগে। শুধু শুধু এতবড় বাড়িতে থেকে বিলাসিতা করার কোনো মানেই হয় না। এতে আরো রিস্ক আছে। চোর-ডাকাতের নজর পড়তে পারে।
- তোমার ছেলে-মেয়েরা কোথায় থাকবে তাহলে?
- এখন যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে ওরা। বাড়ি থেকে তো চলেই গেছে, আর আসবে কেন?
- তুমি কী ওদের উপর রাগ থেকেই এইসব কথা বলছ? নাকি এমনিতেই আমার সাথে মজা করছ।
- আমি সত্যি সত্যি বলছি। অসুস্থ শরীর নিয়ে তোমার সাথে মজা করা বা বেয়াদব দু’টো ছেলে-মেয়ের উপর রাগ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাছাড়া তোমার বয়স হয়েছে, তোমার সাথে মজা করে আমার কোনো লাভ হবে না। আর তোমার ছেলে-মেয়েকে আমি খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছি। রোজ যেমন বাজার করার জন্য টাকা খরচ করি, ধরে নাও তেমনি গোপন কোনো কাজের জন্য ওদের খরচ করে ফেলেছি।
- তাহলে এতদিন ধরে ছেলে-মেয়ের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলে কেন? আমি তো কাশেমের কাছ থেকে সব শুনেছি। তুমি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছ, তাই বাইরে যাও না কাশেমের সাথে কথা বলতে। সেজন্য বাধ্য হয়ে কাশেমের দ্বারা ছেলে-মেয়েদের খোঁজ-খবর নেওয়ার কথাটা আমাকে বলেছ। নাহলে তো আমি জানতেই পারতাম না।
আনিস উদ্দিন বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, ‘উফ্, যাও তো এখানে থেকে। তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না আমার। তুমি এখন আমার সামনে থেকে যা-ও, আর দু'তলায় গিয়ে কাশেমকে পাঠিয়ে দাও এখানে।’
- আচ্ছা যাচ্ছি। তোমাদের পুরুষ মানুষদের মতলব আমি বুঝি না বাপু। কখন যে কী কর, আর কী বল, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
অন্তরা বেগম রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন ঘর থেকে। আনিস উদ্দিন হেসে দিয়ে বললেন, ‘মেয়েরা নাকি পুরুষ মানুষের মতলব বুঝে না! অথচ কালকে সকালে দেখলাম বাচ্চু মিয়ার বড় ছোকরাটা ফোনে কাকে যেন জোরে জোরে বলছে, "তোমাদের মেয়ে মানুষদের ভাবসাব আমি বুঝতে পারি না। তোমরা একেক সময় একেক রূপ ধারণ করো।" কী এক অবস্থা, আমাদের সময়ের মেয়েরা পুরুষদের ভাবসাব বুঝতে পারে না, আর এখনকার সময়ের পুরুষরাই নাকি মেয়েদের ভাবসাব বুঝতে পারে না। আচ্ছা, এটা কী বয়সের দোষ, নাকি পুরুষদের পিছিয়ে যাওয়ার দোষ?’
- কাকা আসবো?’ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাশেম কথাটা বলল। আনিস উদ্দিন সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ কাশেম আয়।’
কাশেম ভিতরে আসতে আসতে বলল, ‘সিড়ি দিয়ে নামতেছিলাম, তখন কাকি বলল আপনি ডাকছেন।’
- হ্যাঁ। চেয়ারটা টেনে বস এখানে। এখন তোর বিচার হবে।
- কাকা, আমি জানি আপনি কী কইবেন। কিন্তু আগে আমার কথাটা শোনেন। আপনার ছেলে-মেয়ের খোঁজ নিয়ে আসছি আমি। সকালেই কাকি ফোন করে বলেছে আপা আর ভাইয়ের খোঁজ-খবর আনতে।
- সে এনেছিস ভালো কথা। আগে বল তোর কাকি জানল কীভাবে আমি নিয়মিত ছেলে-মেয়ের খোঁজ নেই?
- মাফ করেন কাকা। আসলে আমিই একদিন হুট করে বলে দিয়েছিলাম। এরপর কাকি আমাকে জেরা করতে থাকে, আর আমি সব বলতে থাকলাম।
- মাথায় তো কোনো বুদ্ধি নেই। সবইটাই গোবর। যাই হোক, এখন বল এই কয়দিন ওদের খোঁজ দিস নাই কেন?
- এতদিন আপনি তো বলেন নাই তাদের খোঁজ নিতে।
- সে তো আমি অসুস্থ ছিলাম বলে তোকে ডেকে কিছু বলতে পারছিলাম না। তাই বলে তুই আসবি না আমার ঘরে। যাই হোক, এখন ওদের খবরটা বল।
- খবর খুবই অদ্ভুত কাকা। আপনাকে কইছিলাম না আপনার ছেলে একটা সুন্দরী মেয়ের পিছন পিছন ঘুরে বেশ কিছুদিন ধরে।
- হ্যাঁ বলেছিলি কয়েকবার। ওই তো ওদের উপরের তলায় ভাড়া থাকে মেয়েটা। ওর অফিসেই তো চাকরি করে। কেন কী হইছে মেয়েটার?
- মেয়েটার কিছু হয়নি কাকা, তবে গেইটের দারোয়ান এর কাছ থিকা শুনলাম, আজকে নাকি আপনার ছেলে আর ওই মেয়েটা একসাথে অফিসে গেছে।
আনিস উদ্দিন উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘বলিস কিরে! পিছন পিছন হাঁটা বাদ দিয়ে এখন পাশাপাশি হাঁটা শুরু করছে। বাহ্ বাহ্, ছেলেটা দিনদিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে দেখছি। আগে যেই ছেলে সারাদিন আড্ডা মারতো, আর বাপের টাকা নষ্ট করতো, সেই ছেলে এখন চাকরি করে বোনের দায়িত্ব নিয়েছে। নিজে চলছে। আবার একটা মেয়ের সাথে লাইন ও মারছে। যাই হোক, এতদিন জানতাম কোনো কাজ ছাড়াই মেয়েটার পিছনে ঘুরঘুর করছে। এখন বুঝতে পারলাম আসল কাহিনী। আচ্ছা, মেয়েটার খবর কী? এ জীবনে কী আর পড়াশোনা শেষ হবে না ওর?’
- দারোয়ান বলল সকালে নাকি ফাইলপত্র নিয়ে রিকশা দিয়ে কোথাও গেছে। মনে হয় চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছে।
- হুহ্, ওই তো একটুখানি একটা মেয়ে, সে আবার গেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। ওর চেহারা দেখলেই অফিসের লোক বলবে, বাচ্চা মেয়ের চাকরি আমাদের এখানে হবে না।
- আপনি তো সেই বাচ্চা মেয়েটারেই বিয়ে দিতে চাইছিলেন। তখন মনে হয়নি, মেয়েটা অনেক ছোট। এখনি বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আনিস উদ্দিন রেগে গিয়ে বললেন, ‘ধুর’হ হারামজাদা।’
- আরে কাকা রেগে যাচ্ছেন কেন? আচ্ছা আর কমু না। কিছুটা পিছনে গিয়ে কথাটা বলল কাশেম। আনিস উদ্দিন কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা শোন, তোর চাকরিটা পার্মানেন্ট করে দিলাম আজ থেকে। বেতন পাবি ডাবল। তবে কাজটা বেড়ে গেছে এখন। আগে যেমন দারোয়ান এর কাছ থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে আসতি। এখন আর সেটা করবি না, কারণ এখন থেকে তুই নিজেই ওদের উপর নজর রাখবি। কে কখন কোথায় যায়, সব। আর ওই উপরের তলার মেয়েটার সম্পর্কেও খোঁজ নিবি। মেয়েটার গ্রামের বাড়ি কোথায়? ওর বাবা-মা কে, বা কী করেন তারা? আরো যা যা দরকার সব খোঁজ-খবর নিবি। ছেলেটার বয়স তো আর কমছে না, দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। এরপর তো বুড়োদের খাতায় নাম লিখাতে হবে।
আনিস উদ্দিন কে থামিয়ে দিয়ে কাশেম বলল, ‘আপনি শুধু শুধু ভাইয়ের নামে উল্টো পাল্টা বলছেন। কোনোভাবেই বুড়ো হওয়ার মতো বয়স হয়নি ভাইয়ের।’
আনিস উদ্দিন রাগী কণ্ঠে বলল, ‘তোকে কথা বলতে বলেছি আমি? দিনদিন তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তোর চাকরি নট করে দিবো।’
- চাকরি পার্মানেন্ট হয়ে গেছে কাকা। চাকরি নট করতে চাইলে ১০ লাখ টাকা লাগবো। আগে ১০ লাখ টাকা দেন, তারপর চাকরি নট কইরেন।
- আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি কাশেম।
- টাকার কথা বললেই তো আপনার রাগ হয়। যাই হোক, ১০ লাখ লাগবো না, নতুন চাকরির বেতন ঠিকমতো দিলেই হইবো। এখন তাইলে যাই আমি কাকা।
- আচ্ছা যা। আর একটা কাজ করবি, আড়ালে থেকে ওদের ছবি তুলে আনবি।
- ওদের বলতে?
- তোর আপা আর তোর ভাইয়ের। সাথে উপরের তলার মেয়েটার-ও।
- আচ্ছা কাকা।
কাশেম চলে এলো ঘর থেকে। আনিস উদ্দিন উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী যুগ আসল! যেখানে ছেলে-মেয়েদের উচিত বাবা-মায়ের খোঁজ-খবর নেওয়া, সেখানে এই বুড়ো বয়সে আমাকে ওদের খোঁজ-খবর নিতে হচ্ছে। মানুষের বিবেক বলে কিচ্ছু নাই। মানছি আমি রাগারাগি করেছি, সবার সামনে অপমান করেছি। এটাও মেনে নিচ্ছি যে আমি তোদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি। আরে বাবা, সেজন্য কী এই বুড়ো বাবা-মায়ের খোঁজ-খবর নিবি না একটু? গোপনে-গোপনেও তো খোঁজ নেওয়া যায়, তাই না? যেমনটা আমি করে আসছি এতদিন ধরে।’
ইন্টারভিউ রুম থেকে বের হলো ইতি। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির আবেশ লেগে আছে। বসের রুমের বাইরে থাকা চেয়ারে বসে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল। এরপর পাওয়ার বাটন অন করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর স্ক্রিনে থাকা ছবিটায় চুমু দিয়ে বলল, ‘এই যে মি:, এভাবে তাকিয়ে থাকলে হবে! একটু তো হাসো। জানো, ইন্টারভিউ দিয়ে আমি সিলেক্ট হয়েছি। দুই একদিনের মধ্যেই আমার জয়েনিং লেটার চলে আসবে। নিজের যোগ্যতা আর মেধা দিয়ে চাকরিটা পেয়েছি আমি। একে একে আমার সব স্বপ্নগুলো পূরণ হচ্ছে। ভাইয়ার পরে একমাত্র তুমিই ছিলে, যে আমাকে প্রতিটি পদক্ষেপে সাহস জুগিয়েছ। আমার পাশে থেকে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছ। আমার সারাজীবনের সঙ্গি হিসেবে তুমিই বেস্ট, কারণ তোমার মধ্যে আছে মনুষ্যত্ববোধ আর বিবেকবোধ। একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি। এই খুশির খবরটা দিয়ে তোমাকে চমকে দিবো আমি।’
(চলবে...)
আরো পড়ুন ৩য় পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড