• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : শেষ বিকেল

  মুহাম্মদ বরকত আলী

০৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:০৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

দুই হাতে ভর দিয়ে ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সালেহা খাতুন। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই দম ফুরিয়ে এল। মুখ থেকে বের হচ্ছে এক ধরনের অদ্ভুত হু হু হু শব্দ। ঘামে সারা শরীর ভিজে একাকার। হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল। হাতে লেগে থাকা ধুলোর আস্তরণ আর মুখের ঘাম একত্রে সারা মুখে লেপ্টে গেল। যদিও শীতের মৌসুম তবুও সে সূর্যের তেজটা এখনো কমেনি। আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে পুরোপুরি শীত আসতে। দমটা আয়ত্তে এসেছে। মুখ থেকে বের হওয়া শব্দটাও কমে এসেছে। আবার সামনের দিকে যেতে শুরু করল। কিছুদূর এগিয়ে গেল। বোধ করি তার সামর্থ্য ফুরিয়ে এসেছে।

মানুষ পায়ে গেটে যেতে বিরক্ত হয়, কষ্ট হয়। সালেহা দুহাতে ভর দিয়ে আর কতক্ষণ? শেষমেশ কোনো মতে এসে পৌঁছল বাড়ির উঠানে। উঠানে ঠায় দাঁয়িয়ে থাকা কাঁঠাল গাছটার নিচে গিয়ে গাছটায় হেলান দিয়ে বসে হাত পা সামনের দিকে এলিয়ে দিল। হু হু হু শব্দটা অবিরাম বের হতে লাগল। কাঁঠাল গাছটা সালেহার শশুরের বাবার হাতের লাগানো। একবার বন্যার সময় মাঠের সমস্ত ফসল জলের নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। গ্রাম শহর সবখানেই আকাল শুরু হল। এক বেলা চুলো জ্বলে তো আরেক বেলা জ্বলে না। পেটের জ্বালায় উপান্তর না পেয়ে সালেহার স্বামী মকবুল হোসেন এই কাঁঠাল গাছটার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু শশুর মশায় ঘর থেকে বের হয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘খবরদার মকবুল এই গাছ কাটনের কথা কইবি না। না খাইয়া মইরা যামু তবুও এই গাছ কাটতে দিমু না। আমার বাজানের হাতের লাগানোর গাছ। বাজানের স্মৃতি।’ তারপর থেকে কেউ এই গাছটা কাটার কথা চিন্তাও করেনি। সালেহার শশুর গত হয়েছে। স্বামী গত হয়েছে। কাঁঠাল গাছটা তিন পুরুষের সংসারের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থেকে বের হওয়া হু হু হু শব্দ কমে এসেছে। গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে সালেহা।

পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যর আলোর ঝিলিক এসে পড়ে মুখে। কি যেন ভাবতে থাকে। পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো মনের জানালায় এসে উঁকি দেয়। একের পর এক সুখ দুঃখের স্মৃতি মনে পড়ে সালেহার। এইতো সেদিনের কথা। কাঁঠাল গাছটার ডালে স্বামী মকবুল দড়ির একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছিল তার জন্য। সেই দোলনায় চেপে বসে সকাল বিকেল দোল খেত সালেহা। স্বামী মাঠে যাওয়ার পথে দু একবার ধাক্কাও দিয়ে যেতে সেই দোলনায়। সালেহাকে ভুলিয়ে রাখার জন্যই এই আয়োজন। শশুর শাশুড়ি আর স্বামীর আদরে সোহাগে ভুলে গিয়েছিল মায়ের সংসার। এই বাড়িতে সালেহা খুব ছোট কালে বৌ হয়ে এসেছিল। লাল জরির শাড়ি পরে, কপালে লাল টিপ, হাতে লাল চুড়ি, পায়ে নূপুর, মাথায় লাল ওড়নার সাজে সেজে নতুন বৌ।

সেদিন সালেহার মনে হয়েছিল, এ যেন বৌ বৌ খেলা হচ্ছে। বান্ধবীদের সাথে এরকম বৌ বৌ খেলা সে কতই না খেলেছে। কলার পাতা দিয়ে শুকনো মরা পুকুরের ঢোলকলমির ভিতর বেঁধেছিল সেই ঘর। ঢোলকলমির ফুল দিয়ে মাইক বানিয়ে বিয়ে বাড়ির গান বাজিয়েছে কত। এইতো সেদিনের কথা। স্বামীর সোহাগে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে এটাই তার বেঁচে থাকার আশ্রয়। এটাই তার আসল বৌ বৌ খেলা নামের সংসার। তারপর ধীরে ধীরে সব কিছু বুঝতে শেখা। কোন জুড়ে আসে একমাত্র সন্তান সেলিম। শশুর মারা যায় সর্পদংশনে। পিছু পিছু শাশুড়িও। সংসারের হাল ধরে মকবুল। সালেহা দিন-রাত এক করে সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে। সংসারের ঘানি টানা আর ছেলের যত্ন নেওয়ায় কোনো কমতি পড়ে না। সংসারের একটু সচ্ছলতা আনতে পালন করে হাঁস, মুরগির, গরু, ছাগল। হাঁপিয়ে ওঠে সালেহা।

তবুও তাকে পারতেই হবে। ছেলেকে শিক্ষিত করতে হবে। ছেলে একদিন বড় চাকুরী পাবে। সালেহার দুঃখ দুর হবে। গুছিয়ে উঠতে না উঠতেই গঞ্জ থেকে ফেরার পথে লরি উলটে বিদায় নিয়ে চলে যায় মকবুল। সালেহার কাঁধে চেপে বসে সংসার। তবুও হার না মানা সৈনিকের মত রাত দিন এক করে খাটতে থাকে চরম অমানবিক খাটুনি। হাঁস মুরগির ডিম বিক্রি করে ছেলের স্কুলের বেতন পরিশোধ করলেও নিজের মুখে কখনো একটা ডিম তুলে দেয়নি সালেহা। রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে লোকের কাঁথা সেলায় করে টাকা জমিয়েছে শুধু মাত্র ছেলের লেখাপড়া করানোর জন্য। শেষ পর্যন্ত জমিয়ে রাখা বিয়ের গহনা গুলো বিক্রি করে ছেলেকে ভর্তি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়া শেষ করে একটা চাকুরীও জুটেছে সেলিমের। সেদিন সালেহার আনন্দ দেখে কে। তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। বছর যেতে না যেতেই ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে এনেছে বৌ মা। একটা হলদে রঙের কাঁঠাল পাতা উপর থেকে পড়ল সালেহার মুখে। ভেঙ্গে যায় সুখ দুঃখের স্বপ্নগুলো।

কল্পনার জগত থেকে ফিরে আস বাধ্য হয়। গলা শুকিয়ে এসেছে। নরম সুরে বলে, ‘ও বৌ এক গেলাস পানি দাও না, খুব তেষ্টা পেয়েছে।’ কোনো সাড়া শব্দ পায় না। আবারও বলে, ‘ও বৌ, এক গেলাস পানি দাও না, খুব চেষ্টা পেয়ে গো।’ বৌমা ঝংকার দিয়ে ওঠে। দপ-দপিয়ে পা ফেলে ঘর থেকে বের হয় একটা টিনের গ্লাস হাতে নিয়ে। টিউবওয়েলের নিকটে গিয়ে ঝনঝনিয়ে টিউবওয়েলের সারা শরীর ঝাঁকিয়ে এক গ্লাস পানি এনে ধরে সালেহার সামনে। ‘এই নাও। সারাদিন হুকুম ছাড়াতো কিছুই জানো না।’ সালেহা গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢক ঢক শব্দে এক নিঃশ্বাসে পানি পান করে। ছেলে বৌয়ের কথার কোনো প্রতিউত্তর দেয় না। মনে মনে ভাবতে থাকে, একদিন এই সংসারের সমস্ত কাজ এই সালেহা একাই করেছে। শশুর শাশুড়ির যত্ন করেছে নিজের বাবা মা মনে করে। আজ সে অক্ষম। পা দু’টোতে শক্তি পায় না। একটা পা শুকিয়ে পাঠ খড়ি হয়ে গেছে। আরেকটা একই পথের পথিক। এখন তাকে হাতের উপর ভর দিয়ে চলতে হয়। প্রচুর কাঁথা সেলায় করেছে রাত জেগে। এখন চোখ দু’টোও বেইমানি করছে। দৃষ্টিও কমে এসেছে। মনে পড়ে সালেহার সেই ছোটবেলার কথা। এই পা দু’টো দাপিয়ে কতই না খেলেছে সে।

মায়ের বানিয়ে দেওয়া নূপুর পরে সারা পাড়া ঘুরেছে। অথচ আজ সেই পা দু’টোই কিনা অচল। কল্পনায় ডুবে যেতে মন চায়। হঠাৎ বাইকের হর্নে আবারও ভেঙ্গে যায় কল্পনার জগত। ছেলেটা বাইকে চেপে বাড়িতে ঢুকল। বৌ দৌড়ে যেতেই একটা প্যাকেট হাতে তুলে দেয়। সালেহা জিজ্ঞেস করে, ‘বাজান, আমার ঔষধ নিয়া আইছো?’ সেলিম বলে, ‘ঔষধ খেয়ে লাভ নেই। ঐ ল্যাংড়া পা আর ভালো হবে না।’ সালেহা চুপ হয়ে যায়। চোখের জল মাটিতে পড়তে দেয় না। জোরে কাঁদতেও চায় না। ছেলের অসঙ্গ হবে। হু হু হু শব্দটা বেড়ে যায়। কান্না চেপে বলে, ‘বাজান, হাঁপানিটা বাইড়া গেছে। কাসেমের দোকান থেইকা দুইটা বড়ি আইনা দিবা?’ ছেলে খেঁকিয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘তুমি কি একটু শান্তিতে থাকতে দিবা না? এই মাত্র আসলাম অফিস শেষ করে আর শুরু হল তোমার নানান বায়না।’ কথা শেষ করে বাইকটা উঠানে রেখে চলে যায় ঘরের ভিতর। কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে ভেসে আসে দুজনের খিল খিল হাসির শব্দ। হু হু করে ওঠে সালেহার বুকের ভিতর।

কানের কাছে বাজতে থাকে সেলিম নামটা। সেলিমের কি এতটুকুও মনে নেই? সে যখন ছোট ছিল তখন মকবুল গঞ্জ থেকে ফেরার পথে হাতে করে নিয়ে আসতো জিলিপি, খুরমা, মিঠাই। সালেহা কোনো দিনও সখ করে নিজের মুখে চেকেও দেখতো না। সেলিম রোয়াকে বসে মজা করে খেতো। ঐ ঘরটা ছিলো তার সুখের ঠিকানা। এক সময় ঐ ঘর স্বামীর সোহাগ ভালোবাসায় গমগম করেছে। দিন বদলায়, পরিস্থিতি বদলায়, মানুষের ভাগ্যও বদলায়। কিন্তু সালেহার ভাবনার জগতে কখনো উঁকিও দেয়নি কোন এক সময় তার ভাগ্য এভাবে দুর্ভাগ্যে বয়ে আনবে। মাগরিবের আযান ভেসে আসে। সালেহাও অতীত থেকে বেরিয়ে আসে। দুহাতে ভর দিয়ে হু হু হু শব্দ করে এগিয়ে যায় গোয়াল ঘরের দিকে। গোয়াল ঘরটাতে এখন আর গরু থাকে না। সালেহার পায়ের সমস্যার পর থেকে আর গরু পালন করা হয় না।

স্বামীর হাতের তৈরি করা গোয়াল ঘরটা এখন সালেহার দখলে। চৌকিতে ওঠার ক্ষমতা নেই সালেহার। তাই গোয়াল ঘরের মেঝেতেই একটা বিছানা পেতে থাকতে হয়। ছেলের সুখের জন্য সারাটা জীবন কষ্ট করেছে। দুঃখের সাথে যার বসবাস তার আবার দুঃখ কি? দুঃখকে সে অনেক আগেই সুখ হিসেবে মেনে নিয়েছে। ছেলের খাওয়া পরা, লেখাপড়া, সব করিয়েছে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে। এত অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে নিজের যৌবন কুরবানি করে ছেলের জন্য সুখ কিনতে চেয়েছে। ইচ্ছে করলেই নতুন ভাবে অন্য কারো না কারো সাথে সংসার করতে পারতো। ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে দ্বিতীয় বিবাহ পর্যন্ত করেনি। রাত বাড়তে থাকে। কিছুক্ষণ আগে সেলিমের বৌ রাতের খাবার দিয়ে গেছে। থালায় পড়ে আছে কয়েক দলা ঠাণ্ডা ভাত। শীতের সময় রাতে ঠাণ্ডা ভাত খেলে হাঁপানিটা বেড়ে যায়।

দু’টো গরম রুটি হলে মন্দ হয় না। কিন্তু এত আদর করে দুবেলা দুটো রুটি বানিয়ে দেওয়ার মত কেউ নেই। তাই এক প্রকার বেচে থাকার তাগিদে ঠাণ্ডা ভাতই খেতে হয়। হাতে ভর দিয়ে চলতে গিয়ে দুহাতে ময়লার স্তর জমে আছে। গ্লাসটা হাতের ধাক্কায় পড়ে গেল। পানি নিয়ে আসার ক্ষমতা তার নেই। ময়লা হাতে খাওয়াও যায় না। ছেলে বৌকে ডাকার সাহস পায় না। অনুপায় হয়ে না খেয়ে বসে রইল। রাত বাড়ার সাথে সাথে হাঁপের বেগ বাড়তে থাকে। ছেলেকে ডাকার সামর্থ্যটুকুও হারিয়ে যায়। গলা দিয়ে হাঁক ডাক বের হয় না। সন্ধ্যের সময় বলেছিল হাঁপানির একটা বড়ি নিয়ে আসতে। এনে দেয়নি। রাত বাড়ার সাথে সাথে চারিদিক নীরব হয়ে আসে। সালেহার হাঁপানির শব্দ ছাড়া আর কোনো কিছুর শব্দ পাওয়া যায় না।

মাঝরাতে উঠানে কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ শব্দে মেতে উঠেছিল। এ যেন কুকুরে কুকুরে যুদ্ধ। তবুও কেউ একবারও উঁকি মারেনি।

সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে উঠানে পা দিতেই চিৎকার করে উঠল সেলিমের বৌ। বৌয়ের চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে এক লাফে উঠানে এলো সেলিম। উঠানের কাঁঠাল গাছটার নিচে রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর দেহে পড়ে আছে সালেহার ক্ষতবিক্ষত দেহ। মৃত দেহের পাশে দুটি কুকুর জিব বের করে হাঁপাচ্ছে। কুকুর দুটোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কুকুর সারারাত শেয়াল গুলোর সাথে লড়াই করে ক্লান্ত ওরা। ওদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছে সালেহাকে বাঁচাতে। বাঁচাতে না পারলেও অন্তত শেয়ালের সাথে লড়াই করে সালেহার মৃত দেহটা নিয়ে যেতে দেয়নি ওরা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড