• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : নিস্তব্ধতা (শেষ পর্ব)

  রিফাত হোসেন

০৭ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:৪১
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

রাত ১০.১৫ বাজে। ড্রয়িংরুমে বসে অধীর আগ্রহে নিবিড়ের জন্য অপেক্ষা করছে তিথি। কলিংবেল বেজে উঠায় সোফা থেকে ওঠে দরজা খুলে দিলো। নিবিড় ভিতরে এসেই দুই হাত দিয়ে তিথিকে কাছে টেনে নিলো। তিথির ঠোঁটে চুমু দিতে যাবে, তখনই তিথি ওকে বাধা দিয়ে বলল, ‘এখানে না। ঘরে চলো।’

নিবিড় হেসে দিয়ে বলল, ‘ওকে মাই ডেয়ার সুইটহার্ট। চলো তাহলে।’

নিবিড় তিথিকে জড়িয়ে ধরেই সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময়-ও নিবিড় তিথির ঘাড়ে নাম গুজে দিয়ে ঘ্রাণ নিতে লাগল৷ তিথি বলল, ‘গতকালকে সারারাত তোমাকে মিস করেছি নিবিড়। একটুও ঘুমাতে পারিনি।’

নিবিড় ঘাড় থেকে মুখ তুলে বলল, ‘আমিও তোমাকে মিস করেছি সুইটহার্ট। সারারাত ছটফট করেছি আমি। তুমি তো জানো, রাতেরবেলা তোমার এই আকর্ষণীয় শরীরের স্পর্শ না পেলে আমি দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না।’

- কী করব বলো, হঠাৎ করেই মায়ের ওখানে যেতে হয়েছে। মা একটু অসুস্থ। তবুও এক রাত থেকে আবারও ব্যাক করলাম তোমার কাছে।

নিবিড় তিথির ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘এইজন্যই তো তোমাকে এত ভালোবাসি।’

ঘরে চলে এসেছে ওরা দু'জন। তিথি দরজা আটকে দিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। নিবিড় তিথিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল বিছানায়। একে অপরের চোখের দিকে তাকালো। নিবিড় তিথির শরীর থেকে জামা খুলে দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। তিথি নিবিড়ের হাতটা ধরে বলল, ‘এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন বেবি? শারীরিক ভাবে রোমান্স করার জন্য আরো অনেকটা সময় বাকি আছে। আগে একটু মানসিক ভাবে রোমান্স করে নেই।’

তিথির ঠোঁটে হাত বুলাতে বুলাতে নিবিড় বলল, ‘মানসিক ভাবে রোমান্স করে কীভাবে আবার? জীবনের প্রথম শুনলাম এইরকম কথা।’

- আজ অনেক কিছুই শুনবে, যা জীবনে কখনো আশা-ও করোনি মাই ডেয়ার।

- তাই নাকি? তা বলো একটু শুনি। আর মানসিক ভাবেও রোমান্স করি একটু।

- অবশ্যই। সেজন্যই তো অপেক্ষা করে আছি।

শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়াল তিথি। সাথে নিবিড়ও। পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে একটা বোতল হাতে নিলো তিথি। এরপর নিবিড়ের কাছে এসে বলল, ‘এবার বুঝতে পেরেছ, কীভাবে মানসিক ভাবে রোমান্স করে?’

তিথির হাতে থাকা বোতলটাকে উদ্দেশ্য করে নিবিড় বলল, ‘এটা কী?’

- দেখে বুঝতে পারছ না?

- তুমি তো জানো, খুব স্পেশাল কোনো মুহূর্ত ছাড়া মদ খাই না আমি। তবুও নিয়ে এসেছ এটা।

তিথি রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, ‘আজকের এই মুহূর্তটাও খুব স্পেশাল মাই ডেয়ার। কারণ এখন তোমাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে যাচ্ছি। আর আমি বিশ্বাস করি, কথাটা শোনার পর তোমার জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল মুহূর্ত হবে এখন।’

- কী কথা?

- তোমার আর আমার সম্পর্কের কথাটা বাড়িতে বলেছি আমি। বাড়ির সবাই মেনেও নিয়েছে। মা বলেছে, খুব শীঘ্রই তোমার আর আমার বিয়ে দিবে। এটা কী এই মুহূর্তের স্পেশাল কথা নয়?

তিথির কথা শুনে ভীমড়ি খেল নিবিড়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ওয়াও। দারুণ একটা খুশির কথা শোনালে সুইটহার্ট। আর অবশ্যই এই মুহূর্তটা আমার জীবনের অন্যসব স্পেশাল মুহূর্তের থেকে বেস্ট।’

তিথি হেসে দিয়ে বোতলটা আর একটা গ্লাস এগিয়ে দিলো নিবিড়ের দিকে। নিবিড় বোতলটা হাতে নিয়ে মনে মনে বলল, ‘সত্যিই আজকের মুহূর্তটা স্পেশাল তিথি। তবে তোমার মুখে বিয়ের কথাটা শোনার জন্য নয়। একটু পরে যা হবে, সেটার জন্য।’

নিবিড় বোতলটা খুলে গ্লাসে ঢেলে নিলো। এরপর তিথিকে কিছুটা খাইয়ে দিয়ে নিজে খেতে লাগল। তিথি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। চোখের কোণে ছলছল করছে জল। কিন্তু ওকে এখন কাঁদলে চলবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো অনেককিছু ঘটবে। ওকে শক্ত হতে হবে। তিথি চোখের জল মুছে নিবিড়কে বলল, ‘তাহলে কবে যাবে আমাদের বাড়িতে?’

নিবিড় গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তোমাদের বাড়িতে কেন?’

- বিয়ের তারিখ ঠিক করতে।

নিবিড় হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো। তিথি বলল, ‘হাসছ কেন?’

নিবিড় পিছন থেকে পিস্তল বের করে তিথির মাথায় ধরে বলল, ‘তাহলে কী কাঁদতে বলছ? কিন্তু আমি তো কাঁদব না। আজ তো তুমি কাঁদবে।’

তিথি মনে মনে বলল, ‘এতটাও আশা করিনি বিখ্যাত প্লেবয় মি: নিবিড়। বাইরে সবার কাছে তুমি শুধুমাত্র রেসিং চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু কিছু কিছু মেয়েদের কাছে তুমি প্লেবয় চ্যাম্পিয়ন। এছাড়াও খুন করতে এক্সপার্ট তুমি। তবে এত সহজের নিজের নৃশংস রূপটা সামনে আনবে ভাবিনি আমি।’

তিথিকে চুপ থাকতে দেখে নিবিড় আবার বলতে শুরু করল, ‘সত্যি বলেছ তিথি। আজকের মুহূর্তটা খুবই স্পেশাল। তোমাকে খুন করেই আজকের স্পেশাল মুহূর্তটাকে আরো স্পেশাল করব আমি।’

- এইসব কী বলছ নিবিড়? আর তোমার হাতে পিস্তল কেন?

- এই মুহূর্তে তুমি কী আমার হাতে প্রটেকশন আশা করেছিলে?

- কাজটা ঠিক করছ না নিবিড়। ভুলে যেওনা তুমি আমাকে ভালোবাসো, এবং আমি তোমাকে। তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিয়ে করব।

- এখানেই তো ভুলটা করলে সুইটহার্ট। বেশ ভালোই তো ছিলে, শুধু শুধু বিয়ের স্বপ্ন দেখতে গেলে কেন? যখন ইচ্ছে, তখনই তো ইনজয় করতে পারছ।

- শুধুমাত্র যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য তোমাকে ভালোবাসিনি আমি। তোমার সাথে সংসার করতে চেয়েছিলাম আমি।

নিবিড় হেসে দিয়ে বলল, ‘যেখানে বিয়ে না করেই এতএত আকর্ষণীয় মেয়েদের ভোগ করতে পারছি, সেখানে বিয়ে করার প্রয়োজন কী?’

- মানে?

- কিছু মানুষ আছে, যারা সংসার করার জন্য ভালোবাসে। আর কিছু মানুষ আছে, যারা নিজের যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য ভালোবাসো। আমিও এদের দলেই। তোমার মতো কতো সুন্দরীর মেয়েদের কে ভোগ করেছি আমি, তার কোনো হিসেব আমার কাছে নেই। খুনও করেছি অনেককেই। দু'দিন আগেও একজনকে খুন করেছি। মেয়েটা ছিল বিবাহিতা। তবে বিবাহিতা হলেও শরীরটা ছিল তোমার শরীরের মতোই আকর্ষণীয়। সারাক্ষণ ইনজয় করলেও অনীহা জন্মাতো না। এর আগেও অনেক মেয়েকেই মেরেছি। তারা সবাই কিছুদিন আমার সাথে শোয়ার পর বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু এই মেয়েটা বিয়ের স্বপ্ন দেখেনি। ওর উদ্দেশ্যে ছিল সাংঘাতিক। অন্যদের মতোই বেশ ভালোই চলছিল আমাদের সম্পর্কটা। আমি জানতাম ও আমাকে বিয়ের করার স্বপ্ন দেখে না। ও শুধুমাত্র যৌন চাহিদা মেটানোর জন্যই আমার কাছে আসে। ওর স্বামী ছিল অনেক বয়স্ক। শুনেছি আমার বয়সী একটা ছেলের বাবা ওর স্বামী। তবে ওর ছেলেটাকে কখনো দেখিনি আমি। ও ছিল লোকটার দ্বিতীয় স্ত্রী। যাই হোক, যেহেতু আমাকে নিয়ে সংসার বাধার কোনো ইচ্ছে মেয়েটির মধ্যে ছিল না, তাই আমাদের সম্পর্কটার প্রায় কয়েক বছর হয়ে যায়। প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম। আমি বাড়িতে একা থাকি। তাই দিনের বেলাতেই নিয়ে যেতাম। আর রাতে কখনো তোমার সাথে, তো কখনো অন্য মেয়েদের সাথে। মেয়েটা সবই জানতো। তো একদিন হঠাৎ করে ও আমাকে জিজ্ঞেস করে,- " আচ্ছা ডার্লিং, এই পর্যন্ত কয়টা মেয়েটা ভোগ করার পর খুন করেছ তুমি?

আমাদের কারোর শরীরেই তখন জামা-কাপড় ছিল না। ও ছিল আমার বুকের উপর শোয়া ছিল। তো আমি বললাম, ‘কোনো হিসেব নেই।’

- লাস্ট কাকে এবং কীভাবে খুন করেছ সেটা একটু বলবে প্লিজ। খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

যেহেতু ও আমার সম্পর্কে সবকিছু আগে থেকে জানে, তাই আমি কোনো দ্বিধা না করে একটা মেয়েকে খুন করার বর্ননা দিয়ে দিলাম। আর সেটাই আমার জীবনের ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নিয়ে এলো। আমি আগে যখন বাথরুমে গিয়েছিলাম, তখন ও কোথাও একটা ছোট্ট ক্যামেরা রেখে দিয়েছিল। যা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। তো সেই মুহূর্তের ভিডিও সহ আমার মুখে খুনের স্বীকারোক্তি ও রেকর্ড হয়ে যায়। এরপর থেকে ও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। ও বলেছিল, ওর আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও প্রকাশ হলেও সমস্যা নেই। সম্মানহীনতার ভয় ওর নেই।

কিন্তু সমস্যাটা আমার ছিল। এতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছি আমি। এবং খুনের স্বীকারোক্তি ও দিয়েছি। আমার ফাঁসি নিশ্চিত হয়ে যেতো। ও আমার কাছে টাকা চাইতে শুরু করে। সামান্য কয়েক হাজার টাকা আমার সমস্যা ছিল না। ও একদিন কোটি টাকা চেয়ে বসে। যা ছিল আমার পক্ষে অসম্ভব। অত টাকা কোথায় পেতাম আমি। অনেক বুঝানোর পরেও যখন ও মানছিল না, তখনই সিদ্ধান্ত নেই ওকে মেরে ফেলব। প্ল্যান অনুযায়ী ওকে টাকা দিবো বলে আমার বাড়িতে ডাকি। আগেই ভিডিওটা চাই আমি। ও দেওয়ার জন্য রাজি-ও হয়েছিল। কিন্তু পুরো ব্যাগ খুঁজেও ভিডিওটা পেলো না ও। ও বলল, ভিডিওটা ওর স্বামীর কাছে আছে। ওর স্বামী ভিডিওটা দেখতে পেয়ে সরিয়ে ফেলেছে। আমার রক্ত তখন গরম হয়ে গিয়েছিল। দেরি না করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওর গলায় আঘাত করি। রাগে আর ক্ষোভে মাথাটাই আলাদা করে দেই। এরপর কাটা মাথাটা ওর স্বামীর বাড়িতে দিয়ে আসি। আর সাথে একটা কাগজ পাঠিয়ে দিই। যাতে ওর স্বামীকে ভিডিওটা দেওয়ার কথা লিখে দেই। এরপর তোমার এখানে চলে আসি স্পেশাল মুহূর্তটাকে আরো স্পেশাল করার জন্য। কিন্তু তোমার ব্যস্ততার জন্য সেটা হয়নি।

তিথি হঠাৎ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘সেজন্যই তুমি হঠাৎ করে বিকেলেই আমার বাড়িতে চলে এসেছিলে। যা আগে কখনো করোনি।’

- হ্যাঁ। আর আমার একটা লোক ওর দেহটা নদীর ঘাটে একটা নৌকায় ফেলে দিয়ে আসে রাতেরবেলা।

তিথি চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘কালকে রাতে তুমি আমার বাড়িতে এসেছিলে তাই না?’

- হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে?

- সকালে বাড়িতে এসে দেখি একটা ঘরে চেয়ারে দড়ি বাধা। আর আশেপাশের মেঝেতে রক্ত লেগেছিল। আমার বাড়ির চাবি আমি ব্যতীত শুধুমাত্র তোমার কাছেই ছিল। আর দরজার লকটা অক্ষত ছিল। সুতরাং ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি এসেছিলে।

নিবিড় হেসে দিয়ে বলল, ‘খুন করার আগে সবাইকেই আমার সম্পর্কে সবকিছুই বলে যাই। অন্যদের মতো তোমাকেএ বলব সব। কিচ্ছু লুকাবো না। ভিডিওটার জন্য মেয়েটার স্বামীকে তুলে এনেছিলাম আমি। কিন্তু হারামজাদা ভিডিওটার কথা অস্বীকার করল। উনি তো আর আমাকে চিনে না। আর এখানে আসার সময় উনি অজ্ঞান ছিল। সুতরাং আমি কে, বা উনাকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছিল, উনি কিছুই জানে না। তাই ভিডিওটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য উনাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছি। পরেরবার উনার ছেলেকে তুলে আনবো। যদিও উনার ছেলেকে আমি চিনি না। তবে খোঁজ-খবর নিয়ে নেবো।’

তিথি ডুকরে কেঁদে উঠল। নিবিড় হাসতে হাসতে বলল, ‘কেঁদে আর লাভ নেই তিথি। মরার জন্য প্রস্তুত হও।’

- সেই সুযোগ আর তুই পাবি না হারামজাদা। বাথরুমের দরজা খুলে ইউনিফর্ম পরা ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ ভিতরে এসে কথাটা বলল। নিবিড় বিছানা থেকে নেমে এলো। ইনস্পেক্টর এর দিকে তাকিয়ে উগ্র কণ্ঠে বলল, ‘এইসব কী হচ্ছে ইনস্পেক্টর? আপনি এখানে কী করছেন? আর আপনার সাহস হলো কীভাবে আমাকে গালি দেওয়ার?’

- হারামজাদা, কথা বলার জন্য যে তোর এই মুখটা এখনো অক্ষত আছে, সেটা তোর ভাগ্য। এতদিন প্রমাণ ছিল না বলে উড়ে বেরিয়েছিস। এবার শালা তোদের দিন শেষ। তোদের এবার দেখিয়ে দিবো, এই ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ কোন ব্রান্ডের জিনিস।

নিবিড় বিষয়টি বুঝতে পেরে মাসুদ আহমেদ এর দিকে পিস্তল তাক করে ধরল। হঠাৎ আলমারির দরজা খুলে, ভিতর থেকে ফারাবী বেরিয়ে এসে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিবিড়কে লাথি মারল। হাত থেকে ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পিস্তলটা পড়ল। নিবিড় নিজের ভারসাম্য সামলাতে না পেরে পরে যাচ্ছিল। ফারাফী নিবিড়ের কলার ধরে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করল। নিবিড় ফারাবীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এইসব কী ফ্রেন্ড? তুমি এখানে কীভাবে? আর আমাকে মারলে কেন?’

ফারাবী চিৎকার করে বলল, ‘তোকে তো খুন করতে ইচ্ছে করছে আমার। কিন্তু আমি তো আর তোর মতো পিচাশ নই, তাই একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে খুন করতে পারছি না।’

নিবিড় বিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি এইসব কী বলছ ফ্রেন্ড? এই ইনস্পেক্টর এর সাথে সাথে তুমিও দেখছি পাগল হয়ে গেলে?’

- চুপ কর হারামজাদা। তুই আমার মা’কে খুন করেছিস। তোর মতো জঘন্য একটা লোকের মুখে ফ্রেন্ড শব্দটা বেমানান।

- আমি তোমার মা'কে খুন করেছি মানে?

ফারাবী ইনস্পেক্টর কে ইশারা করে বললেন দরজাটা খুলে দিতে। নির্দেশ অনুযায়ী ইনস্পেক্টর ঘরের দরজা খুলে দিলেন। এরপর ভিতরে এলেন মিস্টার আহসান সাহেব, সাথে কয়েকজন কনস্টেবল। মিস্টার আহসান কে দেখে নিবিড়ের চোখ কপালে ওঠে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আপনি এখানে? মানে কীভাবে সম্ভব?’

মিস্টার আহসান ফারাবীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘ফারাবী আমার ছেলে।’

পূনরায় বিশাল একটা ধাক্কা খেলো নিবিড়। কিন্তু মনে মনে রাগ সৃষ্টি হতে লাগল ওর। ফারাবীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল ও। ফারাবী একটা হাত দিয়ে নিবিড়ের গলা চেপে ধরে ওকে দেয়ালের সাথে আষ্টেপৃষ্টে ধরল। হাটু দিয়ে পরপর কয়েকবার নিবিড়ের পেটে মারল ফারাবী। নিবিড় রাগী কণ্ঠে বলল, ‘কাজটা ঠিক করছ না কিন্তু। আমি একবার ছাড়া পেলে তোমাদের সব ক'টাকে রাস্তায় ফেলে মারব। তোমাদের এমন অবস্থা করব, যাতে পুরো পৃথিবী কেঁপে ওঠে।’

ইনস্পেক্টর বলল, ‘সেই সুযোগ তুই পাবি না। তোর বিরুদ্ধে সব প্রামণ আমাদের হাতে এখন।’

- মানে? কীসের প্রমাণ?

ইনস্পেক্টর শব্দ করে হেসে দিয়ে বলল, ‘একটু আগে যা যা বলেছিস, সবকিছুর রেকর্ড আছে আমাদের কাছে। পিছনে তাকিয়ে দেখ ক্যামেরা লাগানো। তুই নিজেই সব অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়েছিস।’

নিবিড় চেঁচিয়ে বলল, ‘এটা অন্যায়। আর তিথি, তুমি নিশ্চয়ই সব জানতে। সব জেনেও আমার সাথে এইরকম করলে তুমি। এটাই কী তোমার ভালোবাসার নমুনা?’

তিথি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভালোবাসা মানে বুঝ তুমি? আল্লাহর কাছে হাজারবার শুকরিয়া আদায় করি, কারণ তিনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আমার ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় আজ সকালেই ফারাবী ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে আমার।’

- ফারাবীর সাথে দেখা হয়েছিল মানে? ফারাবী তোমার ঠিকানা পেয়েছ কোথায়?

ফারাবী নিবিড়কে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আমি সবটা বলছি। তুই যখন বাবাকে অপহরণ করে এখানে নিয়ে এসেছিলি, তখন তার অজ্ঞান থাকা অবস্থায় তুই ফোনে কারোর সাথে কথা বলছিলি। ভাগ্যক্রমে তখনই বাবার জ্ঞান ফিরে যায়, আর তোর বলা শেষ কথাটা শুনতে পায়। তুই কাউকে বলছিলি, এই নিবিড় কাউকে ভয় পায় না। বাড়িতে এসে বাবা তোর নামটা আমাকে বলে। আমি তখন বুঝতে পারি, তুই'ই সেই নিবিড়। যে বাবাকে অপহরণ করেছিল, এবং আমার মা'কে খুন করেছিল। বাবাকে জিজ্ঞেস করি আমি, তার সাথে তোর সম্পর্ক কী? আর তোর সাথে মায়েরই'বা সম্পর্ক কী? বাবা তখন একান্তভাবে আমাকে বলে সবটা। মা ছিল, আমার আসল মায়ের খালাতো বোন। বাবা আগে থেকেই জানতেন মায়ের খালাতো বোন বেশি সুবিধার না। উনি প্রায়ই বাবার সাথে লেগে থাকতেন। তখন বাবার টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। মা মারা যাওয়ার পর থেকে, মায়ের বোন আরো বাবার দিকে ঝুকে পড়তে থাকে। সারাক্ষণ বাবার আশেপাশে থাকতো। একদিন হঠাৎ এমন কিছু করে বসে, যার জন্য বাবার মান-সম্মান সব শেষ হয়ে যায়। বাবা বাধ্য হয় মায়ের বোনকে বিয়ে করতে। আসল মায়ের জায়গায় সৎ মা এসে যায় আমার জীবনে। ছোট ছিলাম বলে এইসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আর সৎ মা আমাকে কখনো আবহেলা করত না। বাবার সাথে শুধু ঝামেলা হতো। যাই হোক, বিয়ের পর মায়ের উশৃংখলতা বেড়ে যায়। নিজের আগের স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু আর সম্মান হয়রানির জন্য বাবা ডিপ্রেশনে ভুগত্র থাকে। নিজের বিজনেসে মনোযোগ দিতে পারেন না। অফিসের লোকজনই সব দেখাশোনা করত তখন। আর সেই সুযোগ নেয় আমার সৎ মা। নিজে অফিসে যায়। ইচ্ছেমতো টাকা খরচ করতে থাকে। কোম্পানির নামে ধারদেনা করে পার্টিতে যায়, নেশা করে। আমি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত আমি। তাই বাবা-মায়ের ঝামেলার কারণ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না আমার। আমি যখন আইন নিয়ে পড়াশোনা করছি, ঠিক সেই সময় বাবা বুঝতে পারে, মা অবৈধ কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে। মা'কে ফলো করে বাবা। আর সেই ফলো করার মাধ্যমেই নিবিড়ের সন্ধান পায় বাবা। এরপর বাবা নিবিড়ের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়। নিবিড় কে, কী করে সব। একসময় মা নিজেই পরকীয়া সম্পর্কের কথা স্বীকার করে। এদিকে আমি আইনজীবী হওয়ার জন্য, ভালো সুযোগ সুবিধার জন্য, আর ইন্টার্নির জন্য এই শহরে চলে আসি। মাঝে মাঝে শুধু বাবা-মায়ের সাথে কথা হতো ফোনে। একদিন হঠাৎ মা'কে নিয়ে এই শহরে হাজির হয় বাবা। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজনেসে লস হওয়ার জন্য ওটা বিক্রি করে দিয়েছে। আসলে সত্যিটা ছিল, ব্যাবসায় যা আয় হতো, তা থেকে বেশি ব্যয় হতো তখন। তাই ব্যবসাটাই ধ্বংস হয়ে যায়। আর মায়ের করা ধারদেনা পরিশোধ করার জন্য প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িসহ বিক্রি করতে হয়েছিল। বাবার একটা বন্ধু, যে দেশের বাইরে থাকেন। তার এই শহরেই দু'টো বাড়ি আছে। একটা বিক্রি করা শেষ হলেও আরেকটা বিক্রি হয়নি তখনও। বাবা তার সাথে যোগাযোগ করে ওই বাড়িটা কেনার ব্যবস্থা করে। সাথে যা টাকা ছিল, তা দেয়। এবং বাকি টাকা আস্তেধীরে পরিশোধ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। তিনি রাজি হয়। এরপর থেকে আমরা তার বাড়িতে থাকতে শুরু করি। বাবা ভেবেছিল নিবিড়ের থেকে দূরে এসে মা হয়তো স্বাভাবিক হবে। পাপের পথে আর যাবে না। কিন্তু নিবিড় এখানেও চলে আসে। বাবা আবার একদিন নিবিড়কে ফলো করে। নিবিড় সারাদিন একটা বাড়িতে ছিল, যেটাকে সবাই রেদোয়ান রোহান এর বাড়ি বলে জানে। আর রাতে এই বাড়িতে আসতো। নিবিড় বা মা কিছুতেই টের পায়নি, বাবা ওদের ফলো করছে। বাবা-ও আর আগের মতো এই বিষয়ে ঝগড়া করতো না। আমার কথা ভেবে কিছু বলতোও না। কারণ মা আমাকে ভালোবাসতো এটাই সত্যি। হোক সেটা নিজের ছেলে হিসেবে, কিংবা বোনের ছেলে। বাবা শুধু মনে মনে ঘৃণা করতো মা'কে। এরপর হঠাৎ একদিন সকালে মা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা পেন ড্রাইভ ফেলে যায় বাড়িতে। মা তখন বুঝতে পারেনি। তাই তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর বাবা ওটা ওপেন করে একটা ভিডিও পায়। সেই ভিডিওতে নিবিড়ের স্বীকারোক্তি ছিল। কিন্তু বাবার আঘাত লেগেছিল আপত্তিকর অবস্থায় মা'কে আর নিবিড়কে দেখে। রাগে আর ক্ষোভে পেনড্রাইভ নষ্ট করে দেয় বাবা। ভিডিওটাও শেষ হয়ে যায় সাথে সাথে। এরপর বিকেলে মায়ের কাট মাথা বাড়িতে আসে। মাথার সাথে কাগজের লিখাটা দেখে বাবা বুঝতে পারে কাজটা কে করেছে, এবং কেন করেছে। কিন্তু আমাকে কিছু বুঝতে দেয় না বাবা। কারণ আমি তখন সবেমাত্র উকালতি শুরু করেছি। ভালো একটা ক্যারিয়ার আমার। শুধুশুধু এইরকম ঝামেলায় জড়াতে দিতে চায়নি তিনি। তারপর তো অপহরণ এর ব্যাপারটা হলো। বাবাকে অনুরোধ করায় সবটা আমাকে বলে। সাথে এটাও বলে তিথির ঠিকানা। কারণ রাতে নিবিড় এখানেই আসতো। আমাকে প্ল্যান-ও বুঝিয়ে দেয় তিনি। বাবা জানতেন, এই বাড়ি তিথি একা থাকে। আগেই খোঁজ-খবর নিয়েছিল তিনি। তো প্ল্যান অনুযায়ী সকালে এখানে আসি আমি। তিথির সাথে কথা বলি। উনাকে বুঝাই সবকিছু। উনি বুঝতে চাচ্ছিলেন না কিছুতেই। নিবিড় মাঝে মাঝেই আমাকে অনলাইনে বলতো, আজ এই মেয়ের সাথে রুমডেটে যাবো, কাল ওই মেয়ের সাথে রুমডেট যাবো। আরো কিছু গোপন কথাও মাঝে মাঝেই অনলাইনে বলতো আমাকে। তিথিকে সেগুলো দেখাই আমি। এরপর আস্তেধীরে ও বিষয়টা বুঝতে পারে। নিবিড়কে ধরতে আমাকে সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দেয়। এরপর আমি, বাবা, ইনস্পেক্টর আর তিথি মিলে এই প্ল্যান করি। প্ল্যান অনুযায়ী আগেই ক্যামেরা লাগানো ছিল। এবং পুরো বাড়িতে পুলিশের নজর ছিল। এরপর যা যা হয়েছে সব প্ল্যান অনুযায়ী।’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলার পর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো ফারারী। তিথি নিবিড়কে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করব আমি। তুমি ড্রয়িংরুমে একটা চুমু দিতে চেয়েছিলে, তাই না। আসো, আমিই তোমাকে চুমু দেই।’

নিবিড় মাথা নিচু করে ফেলল। মাসুদ আহমেদ, ফারাবী আরো উপস্থিত সবাই হা করে তাকালো তিথির দিকে। তিথি নিবিড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ ঠাসসস করে থাপ্পড় মেরে দিলো। "হা" বন্ধ করে মৃদু হাসি দিলো ফারাবী। ইনস্পেক্টর নিবিড় কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এবার তাহলে চল আমাদের সাথে। দেখি তোর কোন বাপে বাঁচায়। প্রমাণ পেলে তোমার বসকেও একদিন জেলে ঢুকাবো আমি। এই মাসুদ আহমেদ হাই লেভেল ব্রান্ডের প্রডাক্ট। অন্যায় রোধ করার চেষ্টায় থাকি সবসময়। তোর ফাঁসি না হলেও যাবৎ জীবন জেল নিশ্চিত।’

নিবিড় সম্মতি জানালো থানায় যাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে নিবিড়ের চোখের কোণে জল ছলছল করতে দেখল ফারাবী। নিজের মনে মনে বলল, ‘এটা কীসের জল? অপরাধবোধ, নাকি নিজের ভবিষ্যত করুণ পরিণতির কথা ভেবে।’

........সমাপ্ত........

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড