• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : শরৎ মেঘের আলাপন

  তানজিদ শুভ্র

০৭ অক্টোবর ২০১৯, ১১:৪৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

গ্রামের বাড়ি এসেছি আজ এক সপ্তাহ হতে চলছে। এখনো বাড়ির বাইরে যাইনি। বাড়িতে তেমন কেউ নেই যাকে নিয়ে ঘুরে দেখব নিজের গ্রামকে। তিন বছর পর গ্রামে এসেছি। আমাদের পরিবার ঢাকায় আর জ্যাঠামশাই পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকেন প্রায় পনেরো বছর হতে চলছে। দু বছর পরপর ঠাম্মিকে দেখতে আসেন। গ্রামের বাড়িতে পুরনো ঘরগুলো আছে। ঠাম্মি, দুসম্পর্কের এক পিসি আর গুটি কয়েক কাজের লোক থাকে এই বাড়িতে। আমি এসে এক রুম দখল নিয়েছি। শোবার ঘরের চেয়ে পারিবারিক যে গ্রন্থাগার রয়েছে সেখানেই বেশীরভাগ সময় কাটাই। ঠাম্মি আজ জোড় করেই একা একা একটু হেঁটে আসতে বলল বাইরে থেকে। ক্যামেরা সাথে নিয়ে বিকেলে একটু বের হয়ে বাড়ির পাশের মাঠে এক কোণে বসে বসে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনছিলাম। এমন সময় পাঠশালা ছুটি হলে দল বেঁধে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরছিল। কিঞ্চিৎ পরিচিত কয়েকজন এসে আমায় ঘিরে ধরল। হাতে ক্যামেরা দেখে ছবি তোলার আবদার করে দু একটা ছেলেমেয়ে বলছিল, ‘মেঘ পিসি, আমাদের ছবি তোলে দাও না!’

আমি বেশ খুশি হয়েই রাজি হয়ে যাই এ প্রস্তাবে। হাতের ক্লিকে একেকটা হাসিমুখ ফ্রেমবন্ধি করছিলাম। ছবি তোলা শেষে আনন্দ চিত্তে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল সবাই। আমি একা একাই বসে রইলাম।

মৃদু বাতাসে আমার চুলগুলো উড়ছিল। নীলু, রানু, জাফি, টুকু - যাদের ছবি তুলেছি তা ক্যামেরার পর্দায় দেখে নিজের শৈশব স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম। কত দুরন্ত ছিলাম আমি। মাসতুতো, পিসতুতো সব ভাই বোনেরা মিলে দলবেঁধে কত হই হুল্লোড় করেছি! ভাবনার মোহনায় হারিয়ে যাওয়ার এই মুহূর্তে বাইসাইকেলের টুংটাং শব্দ পেলাম। তাকিয়ে দেখি আমার দিকেই আসছে। আমি ঠিক চিনতে পারছি না। সামনে এসে সাইকেল থেকে নেমে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে, মেঘ! কত দিন পর দেখা! কেমন আছ?’ - জি, ভালো আছি। - মনে হয়, আমাকে চিনতে পার নি। - হুম, ঠিক মনে করতে পারছি না। - আমি শরৎ। একসাথে পাঠশালায় যেতাম। - ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিন্তু চাল চলনে তো বুঝাই যাচ্ছে না। - একটু পরিবর্তন এসেছে আর কি। - একটু না, অনেক পরিবর্তন। যে ছেলেটা সারাদিন ব্যাট হাতে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করত আর বলত বড় হয়ে দাদা হবে সে আজ সাদা পাঞ্জাবি পরে কাঁধে পাটের ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরছে। আমি কিন্তু অবাক হয়েছি।

শরৎ আমার ছোটবেলার পাঠশালার সহপাঠী। আজ অনেকদিন পর আমাদের দেখা। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠা শরৎ আজ কবি কবি ভাব নিয়ে আছে। জানতে পারলাম ছেলেবেলার সেই পাঠশালার বাংলার শিক্ষক শরৎ। কবিতা লিখে অবসরে। বইমেলায় নাকি দুটো বই বের হয়েছে গতবার। দুজনে একসাথে গোধূলি লগ্ন পর্যন্ত গল্প করলাম মাঠের কোণায় বসে। পুরনো বন্ধুকে অনেকদিন পর সামনে পেয়ে ফ্রেমবন্ধি করে নিলাম। আমার হাতে ক্যামেরা কিন্তু আমার ছবি নেই গ্যালারিতে। তা দেখে পরদিন ছবি তোলে দেওয়ার প্রত্যাশায় গ্রামের পাশে কাশফুলে বিস্তৃত মাঠে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বাড়ি গেল শরৎ। আমিও সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে গেলাম। রাতে খাওয়ার সময় ঠাম্মি জিজ্ঞেস করল, কেমন কাটল বিকেল? বিকেলের পুরো বর্ণনা দিতে আমার খাওয়ার পর্ব শেষ। আমার ঘরে যাওয়ার আগে ঠাম্মিকে বলে রাখলাম কাল শরতের সাথে কাশবনে যাব। ঘরে গিয়ে আজকের সব ছবিগুলো দেখলাম। এরপর রবি ঠাকুরের রহস্যগল্প পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

দিনের আলো ফুটতেই বাড়ির পিসি এসে আমায় ডেকে তুলল। আজ পঞ্চমী। সন্ধ্যায় দেবীর বোধন। দিনের বেলায় বেশ কাজের চাপ দেখলাম। আমি সবার সাথে হাত লাগিয়ে কাজ করতে পারি নি। আমি কিছুক্ষণ বই পড়ে স্নান করে আসলাম। আমার ইচ্ছে আজ কাশবনে গিয়ে সময় কাটানোর। একটা নীল শাড়ি পরে বসে রইলাম ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে। সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্যামেরা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখি নীল পাঞ্জাবি পরিহিত কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি এগিয়ে যেতেই শরতের পিছু ডাক। তাকিয়ে দেখি নীল পাঞ্জাবিওয়ালাই শরৎ। - দু’জনের পোশাকের রং যে মিলে গেল! - দৈব ঘটনা। - হুম, তাই হবে। চল এগিয়ে যাই। - তোমার সাইকেল কোথায়? - নিয়ে আসি নি। এমন ছোট ছোট কথা বলতে বলতে গ্রামের শেষ মাথায় গিয়ে কাশবন দেখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। সব সাদা মেঘ যেন মিশে আছে কাশফুলে। শরতের হাতে ক্যামেরা দিয়ে মনখোলা হাসিতে কাশবনের বাতাস ভারি করে তুললাম। - দিনের বেলায় ভূত আসল নাকি? - মানে? - এত হাসি কোথা থেকে আসে? - মেঘ হাসে, হাহাহা। জীমুতেন্দ্রভীতু শরৎ কি মেঘের হাসিতে ভয় পেয়ে গেল? - ধুর! কথার ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছে মতো ছবি তুলে ক্যামেরা ভর্তি করে সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরেছি ঠাম্মির কথা মতো। এসে মন্দিরে সবার ভিড়ে আমিও যোগ দিয়ে প্রার্থনা করলাম। রাত নেমে আসল। গভীর হতে লাগল নীরবতা। চোখে ভাসছে শরতের হাসিমুখ আর কানে ভাসছে শরতের কণ্ঠে আবৃত্তি করা কবিতা। মুগ্ধ হয়ে ভাসছি কল্পলোকে। ভাবতে ভাবতে দু’চোখ বুজে এলো ঘুমের ছায়ায়।

শরত কি আমার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছে? আজ যদি বলি তবে কি শরত রাজি হবে আমাকে নিজের করে নিতে যেমন চেয়েছিল এক যুগ আগে। আমি তো তখন পাত্তা দেই নি। শরত কি আজ আমায় পাত্তা দিবে? নবমীর দিন সকালে এসব ভাবতে ভাবতে মনে হল আজ বাবা-মা বাড়ি আসবে রাতে জানিয়েছিল। তাড়াতাড়ি উঠে গুছিয়ে নিলো সব। মাকে বিষয়টা জানাব বলেই স্থির করলাম।

বাবা-মাকে স্টেশনে আনতে যাওয়ার কথা কাজের লোকটির। কোন এক কাজে আটকে স্টেশনে যেতে পারছে না সে। এইসময় শরত আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। আজ সারাদিন আমাদের সাথে থাকার জন্য ঠাম্মি আসতে বলছি। স্টেশনে যাওয়ার কেউ না থাকায় নিজেই যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। কেউ মানা করল না।

আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই রেললাইন। রেললাইন পেড়িয়ে মিনিট পাঁচেক গেলেই বাস স্টেশন। এগারোটায় বাস এসে থামল। স্টেশনে কাউকে না দেখে রিক্সা করে এগিয়ে আসতেই থাকে বাবা-মা। রেল লাইনের ধারে এসেই থমকে যায় তারা। রাস্তার মাঝে একটা সাইকেল পড়ে আছে। নিস্তব্ধ চারপাশ। আরেকটু দূরে মুখ বিকৃত নিথর দেহ পড়ে আছে। ট্রেনে কাটা নয়, তবে হয়ত জোড়ে আঘাত ছিটকে পড়ে আছে। প্রাণের স্পন্দন আছে কি না বুঝতে কাছে যায় বাবা। অনুধাবন করে ঝকঝক ছুটে চলে যাওয়া ট্রেনটি কেড়ে নিয়েছে অন্য কারও বেঁচে থাকার অবলম্বন।

রিকশাওয়ালা গ্রামের লোকদের ডেকে আনল। সেখানে আমিও ছিলাম। মুখ বিকৃত হলেও পাঞ্জাবি দেখে চিনে নিলাম। আমি ‘শরৎ’ বলে একটা চিৎকার দিয়েই সজ্ঞা হারিয়েছি। পরদিন যখন আমার জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম শরতের শবযাত্রা প্রস্তুত। ঠাম্মির অনুরোধে আমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিল। শরতের সৎকার শেষে সবাই প্রতিমা বিসর্জনে দিতে গেল। মা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রতিমা বিসর্জন দেখতে যাবি?’ - জীবনের সেরা বিসর্জন তো মা দিয়ে এলাম চিতায়। আর কি দেখব? মা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। আমার কপোল গড়িয়ে পড়া অশ্রুস্রোত চলছিল অবিরাম।

সপ্তাহ খানেক পর মা-বাবা ঢাকায় ফিরতে বললে আমি আর রাজি হতে পারি নি। আমার পরনের শুভ্র শাড়ি দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল বাবা-মা। ঠাম্মি সব বুঝিয়ে বলেছিল তাদের। তাই, আমাকে এ নিয়ে কিছুই বলে নি। শুধু বলেছিল মন ভালো হলে যেন ঢাকায় ফিরে যাই। কাজের ব্যস্ততায় সেদিনই ফিরে গিয়েছিল তারা।

সেদিন বিকেলে সাদা শাড়ি পরে শুভ্র কাশফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে আরও একবার হেসেছিলাম আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কেউ ভুতুড়ে হাসির প্রতিবাদ করে নি। আমি কাশফুলের ভিড়ে শরতকে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি বারবার।

বাড়ি ফিরলে থামি আমার হাতে একটা ডায়েরী তোলে দিল বলল- ডায়েরীটি শরতের। শরতের মা পাঠিয়েছে। আমি পরম যত্নে নিজের কাছে রাখলাম। রাতভর অশ্রুসিক্ত নয়নে পড়ে দেখলাম পুরোটা। অধিকাংশ কবিতা আমাকে উৎসর্গ করে লেখা। অপ্রেরিত কিছু চিঠি আমাকে বাকরুদ্ধ করেছে। অবাক হয়ে পড়েছি কিছু কাল্পনিক আলাপন।

শরৎ মেঘ যেন একে অপরের পরিপূরক। সব স্মৃতি নিয়ে আর ফিরে যাই নি ব্যস্ত রাজধানীতে। শরতের কর্মস্থল আমার স্মৃতিময় পাঠশালায় যোগ দিলাম। স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছি গ্রামে। মাঝে মাঝেই খুঁজে ফিরি শরতের ছায়া। কিছু অসমাপ্ত আলাপন ছিল। শরত মেঘের আলাপন রয়ে গেল অগোচরে। শরত হাসে অন্তরীক্ষের শুভ্র মেঘে কিংবা কাশফুলে। আমার ক্রন্দন হেরে যায় শরত মেঘের আলাপন পড়ে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড