রিফাত হোসেন
- নিবিড়।
মিস্টার মাসুদ আহমেদ জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘নিবিড় আবার কে?’
- জানি না। শুধু নামটাই শুনেছি আমি।
উপস্থিত সবাই যখন ভাবছে কে এই নিবিড়? ফারাবীর মানসিক অবস্থার উপর দিয়ে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বারবার একটা কথাই ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘তা হলো কে এই নিবিড়? আমার বন্ধু! কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? নিবিড় কীভাবে মা'কে বা বাবাকে চিনে? আমি তো কখনোই নিবিড়কে বাড়িতে আনিনি। আর আমার পরিবারের কারোর সাথে কখনো দেখা-ও করাইনি।’
- আপনি কী চিনেন নিবিড় নামের কাউকে? ফারাবীর ভাবনার মাঝে কথাটা বলল ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ। ফারাবী আমতাআমতা করে বন্ধুর ব্যপারটি অস্বীকার করে বলল, ‘না আমি চিনি না।’
- ঠিক আছে। আচ্ছা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে এবার কিছু কথা বলি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী গলা কেটেই আপনার স্ত্রীকে খুন করা হয়েছিল। তবে তার কিছুক্ষণ আগে উনাকে ধর্ষণ করা হয়।
ফারাবী ‘হা’ করে তাকালো ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ এর দিকে। মিস্টার আহসান কিছুটা রাগ দেখিয়েই বললেন, ‘আপনার ধারণা ভুল ইনস্পেক্টর। ও একজন বিবাহিতা নারী। এবং ওর স্বামী এখনো বেঁচে আছে। তাই কোনো প্রমাণ ছাড়া আপনি ওকে ধর্ষিতা বলতে পারেন না।’
- আমাকে ভুল বুঝবেন না দয়া করে। এটা শুধুমাত্র অনুমান নয়, এটা আমার ব্যক্তিগত নিশ্চিত ধারণা থেকেই বলছি। কারণ আপনার সাথে আপনার স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। অনেকটা নড়বড়ে টাইপের সম্পর্ক।
- মানসিক সম্পর্ক যতই নড়বড়ে হোক না কেন, ও আমার নিজের স্ত্রী। আর সেটা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি আপনি।
- আমি কিছুই ভুলিনি আহসান সাহেব। কিন্তু আপনি নিজেই বলেছিলেন, আপনার স্ত্রী খুন হওয়ার দিন সকাল থেকেই বাড়ি ছিলেন না। তিনি সকালে সুস্থ এবং স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। আর বিকেলে তার দেহহীন মাথা বাড়িতে এসেছিল। অথচ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ্য করা আছে, উনি মারা যাওয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে কারোর সাথে শারিরীক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। সুতরাং দু'টো ঘটনার থেকেই বুঝা যায়, মৃত্যুর আগে তিনি আপনার সাথে নয়, অন্য কারোর সাথে শারিরীক সম্পর্ক করেছিলেন। আপনার কথানুযায়ী খুনটা যদি নিবিড় নামের লোকটাই করে থাকে, তাহলে নিশ্চিত যে, আপনার স্ত্রী অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন।
ফারাবীর মুখ আর চোখের আকৃতি আরো বড় হয়ে গেল। গত কয়েক বছরে-ও এতটা অবাক হয়নি ও, যতটা আজ হচ্ছে। এমনকি সেদিনও এতটা অবাক হয়নি, যেদিন জানতে পেরেছিল ও একজন উকিল। সরকারি আইনজীবীর যোগ্যতা অর্জন করেছে ও।
- আমি আর কিছু বলতে পারব না ইনস্পেক্টর। আমি খুব অসুস্থবোধ করছি। বিশ্রাম নিতে চাই। বাবার মুখে এই কথাটা শুনে কিছুটা নড়েচড়ে বসল ফারাবী। ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ বলল, ‘অবশ্যই। আপাতত আপনাকে আর বিরক্ত করব না আমি। আপনি বিশ্রাম নিন। আমি এখন যাই।’
ফারাবী কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল ইনস্পেক্টর এর কথায়। ইনস্পেক্টর বলল, ‘আহসান সাহেব, আমি নিশ্চিত আপনি এমন কিছু জানেন, তার দ্বারা নিবিড় নামের লোকটার কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারব আমি। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনি ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। এরপর আমাকে সত্যিটা বলবেন৷ এখন তাহলে চলি আমি।’
ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ ওঠে দাঁড়ালেন। পূনরায় ইনস্পেক্টরকে ‘ধন্যবাদ’ দিলো মিস্টার আহসান এবং ফারাবী। একে একে পুরো ড্রয়িংরুম ফাঁকা হয়ে গেল। একটা সোফায় পাশাপাশি বসে আছে ফারাবী আর মিস্টার আহসান। ফারাবী বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মা অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল, এটা কি সত্যি বাবা?’
মিস্টার আহসান দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘না। এটা মিথ্যা কথা। এটা তোমাদের কল্পনামাত্র।’
- কিন্তু আমি যে নিশ্চিত এটা সত্যি।
- তোমার ধারণা ভুল ফারাবী।
- নিশ্চয়তার কাছে ধারণা শব্দটা বেমানান বাবা। আর আমি নিশ্চিত, মা নিবিড়ের সাথে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।
মিস্টার আহসান অবাক কণ্ঠে বললেন, ‘কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছ তুমি? এই নিশ্চয়তার কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?’
- সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো তুমি বাবা।
- মানে?
- মানেটা খুব সোজা। মায়ের এই পরকীয়া সম্পর্কের জন্যই তুমি মাকে সহ্য করতে পারতে না। অবশ্য কোনো স্বামীই এটা মেনে নিতে পারবে না যে, তার স্ত্রী পরকীয়া করে। অদ্ভুতভাবে সেই ছেলেটা যদি হয় নিজের ছেলের বন্ধু, তখন সেটা মেনে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব। তাই না বাবা?
মিস্টার আহসান কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘কীসব আবোলতাবোল বলছ ফারাবী?’
- আমি ঠিকই বলছি বাবা। তুমিও জানো আমি ঠিক বলছি। সেই সাথে এটাও জানো নিবিড় আমার বন্ধু। কথাগুলো ইনস্পেক্টর এর সামনেই বলতে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু তখনও শিউর ছিলাম না মা'কে খুন আর তোমাকে অপহরণ করার ব্যক্তিটাই আমার বন্ধু নিবিড়। কারণ নিবিড় নামে অসংখ্য মানুষ আছে এই পৃথিবীতে। কিন্তু এখন তোমার চোখেমুখের অবস্থা দেখে আমি নিশ্চিত হলাম, আমার ধারণাই ঠিক। আমার বন্ধু নিবিড়ই আমার মা'কে খুন করেছে।
মিস্টার আহসান মাথা নিচু করে ফেললেন। টপটপ করে তার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। ফারাবী বলল, ‘চুপ করে থেকো না বাবা। এবার অন্তত সত্যিটা বল আমাকে। আর ওই ভিডিওটার সম্পর্কে-ও নিশ্চয়ই জানো তুমি। যার জন্য তোমাকে অপহরণ করেছিল নিবিড়। তাই না বাবা?’
মিস্টার আহসান চোখ মুছে ফারাবী দিকে তাকালো। এরপর মৃদু স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ। ভিডিওটা সম্পর্কে সবই জানি আমি। কিন্তু ভিডিওটা এখন আমার কাছে নেই। তাই নিবিড়কেও দিতে পারিনি।’
- আমাদের সামনে তাহলে অস্বীকার করেছিলে কেন? তাছাড়া এতসব কিছু আমাদের কাছে গোপন করলে কেন?
- শান্ত হও ফারাবী। আমি বলছি তোমাকে।
ফারাবী নড়েচড়ে বসল। এরপর মিস্টার আহসান এর চোখের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। মিস্টার আহসান চোখের জল মুছে পরপর সব বলতে লাগলেন।
- ওই হারামির বাচ্চা নিবিড়কে খুন করব আমি। বাবার মুখে সবটা শোনার পর রাগে আর ক্ষোভে কথাটা বলল ফারাবী। মিস্টার আহসান ফারাবীর হাত ধরে বলল, ‘শান্ত হও ফারাবী। আমি জানতাম তুমি এভাবেই রিয়াক্ট করবে। সেজন্যই তোমার কাছ থেকে সত্যিটা লুকিয়েছিলাম আমি।’
- আমি শান্ত হতে পারছি না বাবা। মা তো মারা গেছে। এবার নিবিড়ের পালা। অপরাধ যখন দু'জনেই করেছে, শাস্তি-ও দু'জনের একই হওয়া উচিত।
- আইনজীবী হয়ে এ-কথা বলতে পারো না তুমি।
- প্রয়োজন হলে আইনি ভাবেই ওকে শাস্তি দিবো আমি। ওকে ফাঁসিতে ঝুলাবো।
- ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
- ভিডিওটার থেকে বড় প্রমাণ আর হয় না বাবা।
- বললাম না, ভিডিওটা আমার কাছে নেই এখন। আর তুমি কী ভাবছ, ভিডিওটা থাকলে এখনো এতকিছু সহ্য করে এভাবে চুপ করে থাকতাম আমি।
- এই কেইস আমি সামলাবো বাবা। তুমি সাক্ষী দিবে ওর বিরুদ্ধে।
- তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাচ্ছ নিবিড়ের পরিচয়টা। ও শুধুমাত্র একজন কার রেসিং চ্যাম্পিয়ন নয়। একজন নামকরা সন্ত্রাসী এবং রাজনীতিবিধ এর সহযোগী। শুধুমাত্র মুখের কথাতে ওকে ফাঁসিতে ঝুলানো যাবে না। বরং ক্ষমতা ব্যবহার করে খুব তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়ে যাবে ও। আর এরপর কী হবে বুঝতে পারছ তো? তোমার মায়েরই মতো অবস্থা হবে তোমার। আমারও হবে।
- ওর এত সাহস হবে না বাবা। ও আমাকে ভালো বন্ধু মনে করে।
- নিবিড় জানে না তুমি আমার ছেলে। তোমার মায়ের সুত্র ধরেই আমাকে চেনে ও। কিন্তু তোমাকে চেনে অন্যভাবে। সেজন্য সেদিন ভুল করে তোমাকে রেদোয়ান রোহান এর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তবে রেদোয়ান রোহান বা উনার ছেলে ওখানে থাকে না। মাঝে মাঝে আসে শুধু। তাছাড়া অতবড় বাড়িতে নিবিড় একাই থাকে।
- কিন্তু বাবা, ইনস্পেক্টরকে যদি আমরা সবটা বলি। তিনি অবশ্যই বিশ্বাস করবে। তিনি-ও সাক্ষী দিবে আদালতে।
- সবসময় সাক্ষীতে কাজ হয় না ফারাবী। রেদোয়ান রোহান এর ওঠাবসা প্রধানমন্ত্রী এর সাথে। বিষয়টিকে তুমি যতটা সহজ ভাবছ, ততটা সহজ হয়। তোমার বয়স কম ফারাবী। উকালতিতে-ও তোমার অভিজ্ঞতা খুবই সামান্য। এখনি এতকিছু বুঝবে না তুমি। তাছাড়া রেদোয়ান রোহান কে কতটা চেনো তুমি? একটুও না। উনি কতটা সাংঘাতিক তা আমি জানি। আর নিবিড়ের সম্পর্কেও তেমন কিছুই জানো না তুমি। কলেজ লাইফের ক্লাসমেট হিসেবে যতটা চেনো আরকি। গত কয়েক বছর ধরে ওকে চিনি আমি। ওর সম্পর্কে সব কিছুই জানি আমি। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে। যা-ও একটা ভিডিও ছিল। সেটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। এদিকে ভিডিওটা যে আমার কাছে নেই, সেটা কোনোভাবেই নিবিড়কে বিশ্বাস করাতে পারছি না। অবশ্য ওর দ্বারা বিশ্বাস না করাটাই স্বাভাবিক। কারণ তোমার মা খুন হওয়ার দিন সকালেও ওটা আমার কাছেই ছিল।
ফারাবী অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে এখন কী করব আমরা? নিবিড়ের কী শাস্তি হবে না?’
- হবে। একটা মাত্র উপায় আছে। তবে কাজটাতে রিস্ক আছে
- মায়ের খুনিকে শাস্তি পায়িয়ে দেওয়ার জন্য সবরকম রিস্ক নিতে আমি রাজি আছি বাবা।
- তোমার মা ও নিষ্পাপ ছিল না কিন্তু।
- মৃত মানুষকে তো আর আমি শাস্তি দিতে পারব না। মা'কে আল্লাহ নিজেই শাস্তি দিবেন।
মিস্টার আহসান কিছু বললেন না। ফারাবী আবার বলল, ‘এবার বলো কীভাবে নিবিড়কে কঠিন কোনো প্রমাণসহ ধরতে পারব? রিস্ক হলেও কাজটা করতে চাই আমি।’
মিস্টার আহসান মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি দিলেন। ফারাবী আবারও নড়েচড়ে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল বাবার উত্তরের জন্য।
(চলবে...)
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড