• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক গল্প : একজন সঙ্গে ছিলো (১ম পর্ব)

  সাবিকুন নাহার নিপা

০৬ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৮
গল্প
ছবি : প্রতীকী

রিকশায় বসে একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে রিশিতা। ওর বাসা থেকে হসপিটালের দূরত্ব গাড়িতে মাত্র ১৫ মিনিট। রিকশায় না হয় তার থেকে একটু বেশী সময় লাগবে! ১ঘন্টা যাবত ও বসে আছে রিকশায় কিন্তু এখনও হসপিটালের কাছাকাছিই যেতে পারেনি। শহরের এই বিরক্তিকর যানজট দিন দিন খুব অসহ্যকর মনে হচ্ছে রিশিতার কাছে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা হয় সবকিছু ছেড়ে গ্রামের দিকে গিয়ে থাকতে। আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে রিশিতা রিকশা থেকে নেমে গেলো। - মামা নিন আপনার ভাড়া। - মাঝপথে নাইম্মা গেলে একশ টাকা দেওন লাগবো। - মানে কি? আপনার যা ভাড়া তার থেকে তো বেশী দিলাম। - রাস্তার অবস্থা দেখছেন? এহন আফনে রিকশা ছাইড়া দিয়া গেলে আমার তো লাভের লাভ কিছুই হইব না। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ নিয়ে একশ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে হাটতে শুরু করলো রিশিতা। আজকের দিনটা শুরুই হয়েছে একটার পর একটা খারাপ সংবাদ দিয়ে। সকাল বেলা উঠেই জানতে পারলো কাজের মেয়েটা কয়েক হাজার টাকা আর ওর শাশুড়ির সৌদি থেকে আনা জায়নামাজ নিয়ে পালিয়ে গেছে। বাড়িতে দুটো গাড়ি দুটোই কয়েকদিন ধরে নষ্ট হয়ে পরে আছে অথচ সেকথা একবার কেউ ওকে জানায়ও নি।

রিশিতার স্বামী তাহমিদ বিজনেস ট্রিপে দেশের বাইরে গেছে। তাই একা হাতে বাচ্চা, সংসার, চাকরি সবকিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাও ভালো ওর শাশুড়ি অন্য শাশুড়িদের মতো নয়, কোনো কিছুতে তার কোনো অভিযোগ নেই। না হলে যে কি হতো! হসপিটালের সামনে এসে হঠাৎই মনে পরলো রিশিতার যে, আজ না খেয়েই বেরিয়েছে। ওষুধগুলো খাওয়ার জন্য হলেও কিছু খাওয়ার দরকার। রোজ রোজ ওষুধ খেতে একদম ভালো লাগেনা রিশিতার, তাই ও ভেবে রেখেছে এবার তাহমিদ আসলে বলবে যে, এই ওষুধগুলো আর খাবে না। পৃথিবীর কোনো ওষুধই ওর অসুখটাকে ঠিক করতে পারবে না।

কেএফসিতে বার্গার আর কোল্ড কফি অর্ডার করে অপেক্ষা করছিলো তখনই শুনতে পেলো যে কেউ একজন ওর নাম ধরে ডাকছে। কণ্ঠস্বরটা বেশ পরিচিত মনে হলো ওর কাছে, পিছনে তাকিয়ে এক পলক দেখেই মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। শুধু কণ্ঠস্বর নয় মানুষটাও যে ওর পরিচিত! পরিচিতর থেকেও বেশী কিছু ছিলো একসময়। রিশিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, প্রণব! প্রণব হাসতে হাসতে এসে রিশিতার সামনে এসে বসল। - ও মাই গড রিশিতা তুমি! আমি ভাবিইনি যে তোমার সাথে দেখা হবে। ভালো আছো তো? রিশিতা মাথা নাড়লো। কিছুসময় দু’জনেই চুপচাপ বসে থাকলো। রিশিতা কোনো কথা বলছে না দেখে প্রণব আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?’ রিশিতা কঠিন গলায় উত্তর দিলো, ‘না।’ প্রণবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ এতগুলো বছর পর দু’জনের দেখা হলো অথচ রিশিতা একটু সৌজন্যতা দেখানোর প্রয়োজন করলো না!

রিশিতার খাবার এসে যাওয়ায় ও খেতে শুরু করলো এর মধ্যে একবারের জন্যেও প্রণবের দিকে তাকালোও না। প্রণব আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন কি করছো?’ রিশিতা ভ্রু কুচকে প্রণবের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘কি করছে দেখছো না? খাচ্ছি তো!’ প্রণব থতমত খেয়ে বলল, ‘না মানে আমি জিজ্ঞেস করছি যে, চাকরি করছো না সংসার করছো?’ রিশিতা খাওয়া বন্ধ করে প্রণবের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘কোন সংবিধানে আছে যে চাকরি আর সংসার একসাথে করা যাবেনা?’ প্রণব ওর থেকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘এত বছর দেখাটা তো হুট করে হয়ে গেলো, একটু কি নরমাল আচরণ আমি আশা করতে পারিনা?’ রিশিতা কিছু না বলে কফি খাওয়ায় মন দিলো। প্রণবের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘দেশে থাকা হয়না?’ প্রণব মুখে হাসির রেখা টেনে বলল, না। আমি এখন ইটালি থাকছি, সেখানেই বিজনেস আছে। টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রিশিতা জিজ্ঞেস করলো, ‘মিম কেমন আছে?’ প্রণব অপরাধী ভঙ্গিতে বলল, ‘মিমের সাথে আমার বিয়েটা হয়নি রিশিতা।’ - ওহ! আমি তো শুনেছিলাম মিম স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিল। আর বাবার তো টাকাও ছিলো। - তুমি নিজের কথা বলো রিশিতা। তুমি কিন্তু অনেক বদলে গেছ, অবশ্য বদলানোর কথাই কারণ সময় তো আর থেমে নেই। আগের মতোই সুন্দর আছো তবে অনেক রোগা হয়ে গেছো। রিশিতা হেসে বলল, ‘শত্তুর ভাগ বিবাহিত পুরুষদের অন্যের বউকে ভীষণ সুন্দর লাগে।’ প্রণব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। রিশিতা যখন বিল পে করতে যাবে তখন প্রণব বলল, ‘আমি দিয়ে দিচ্ছি।’ রিশিতা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘তুমি কেন দেবে? আমাকে কি তোমার ভিখারি মনে হচ্ছে?’

পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে দেখে প্রণব বাইরে এসে দাঁড়ালো। রিশিতা বের হতেই প্রণব বলল, ‘এরকম অশোভন আচরণ কি না করলেই হতো না? হ্যাঁ মানছি আমরা একসময় রিলেশনশিপে ছিলাম। কিন্তু তার আগে তো আমরা বন্ধু ছিলাম।’ - তুমি কখনও আমার বন্ধু ছিলে না। আর এখন আমাকে দেখে তোমার হরমোনে যে সুড়সুড়ি হচ্ছে সেটা কি আমি বুঝতে পারছি না ভেবেছ? কথাগুলো বলে আর একমুহুর্ত দাঁড়ালো না রিশিতা। রিশিতার যাওয়ার দিকে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রণব। এই কি সেই মেয়ে, যাকে কলেজে প্রথমদিন দেখে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। এত বদলে গেছে! সময় মানুষকে এত বদলে দেয়?

- আর ইউ ওকে রিশিতা? - হ্যাঁ, স্যার আমি একদম ঠিক আছি। - তাহলে ছুটি কেনো নিয়েছো? - আসলে আমার বাবুটা অসুস্থ তো এই জন্য। - কি হয়েছিল? -একটু ঠাণ্ডা জ্বর। ড. কামাল হোসেন চোখের চশমা খুলে রিশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কথায় কোনো স্ট্রং লজিক খুঁজে পাচ্ছি না। আমি যে রিশিতাকে চিনি সে ছিলো বাংলাদেশের সব মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্টদের অনুপ্রেরণা। যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে হয়েও সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিল ব্যাচে প্রথম হয়ে। যে সম্পর্কে হেরে গিয়েও দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে প্রমাণ করেছিল দেশের প্রতিষ্ঠিত মহিলা ডাক্তার হিসেবে। যে দেশের কয়েকটি জেলায় একা একা থেকে চাকরি করেছে। সেই রিশিতা কিনা ছেলে অসুস্থতার জন্যে দুইমাস ছুটি নিয়েছে! এই রিশিতাকে আমার বড্ড অচেনা লাগছে। শোনো রিশিতা জীবন কিন্তু খুব বড় নয়, আবার খুব ছোটও নয়। তাই জীবনটাকে হেলাফেলা না করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাও। আমি চাই তুমি আবার সেই আগের রিশিতা হয়ে যাও। যে রিশিতাকে দেখলে মেয়েরা স্বপ্ন পূরনের শক্তি পায় ‘ রিশিতা বিরবির করে বলল, ‘তখন তো একজন সঙ্গে ছিলো।’ - রিশিতা তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো? - জ্বী। - তোমার হাজবেন্ড ফিরলে আমার সাথে দেখা করতে বলবে। - আচ্ছা। - আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার রোগটা শরীরের নয়, তোমার রোগটা মনের। - পৃথিবীর কোনো ডাক্তার বা ওষুধ আমার রোগ ভালো করতে পারবে না। - তুমি নিজে কি চাও তোমার অসুখ সেরে যাক? রিশিতা সেকথার জবাব দিলো না।

বাইরে বেরিয়ে আবারও প্রণবকে দেখতে পেলো রিশিতা। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো ওর। সকালে এতগুলো কথা শুনিয়ে আসলো তারপরও পিছু ছাড়ছে না! পার্সোনালিটি বলতে কি কিছু নেই! রিশিতাকে দেখেই প্রণব জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে কেনো এসেছিলে রিশিতা?’ - এখানে মানুষ কেনো আসে? - এখানে একদল মানুষ আসে পেশেন্ট হয়ে, আর একদল আসে পেশেন্টের সাথে। - আরও একদল মানুষ আছে যারা চিকিৎসা করতে আসে, আমি সেই দলের।

রিশিতা হাঁটা শুরু করলে প্রণব এসে অবাক গলায় বলল, ‘তুমি সেকেন্ড টাইম মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিলে? আমাকে কেনো জানাও নি?’ - তুমি কে? হু আর ইউ? কেনো জানাবো? আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি শুনলে তোমার বাবা-মা বরণ করে আমায় ঘরে ওঠাবে আর আমি নাচতে নাচতে চলে যাব সেটা ভেবেছিলে? প্রণব কিছু বলল না। - ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করার খুব শখ না! নিজের কি যোগ্যতা যে ডাক্তার বিয়ে করতে চাও? - সেজন্য বলিনি আমি। শুধু এটা বলতে চেয়েছি আমাকে মানুষ হিসেবে জানাতে! রিশিতা বিড়বিড় করে বলল, ‘মানুষের মতো দেখতে হলেই কি আর মানুষ হওয়া যায়!’ - শোনো প্রণব, আমি আর তোমার মুখ দেখতে চাই না। চাইনা মানে চাই না। আর কখনও আমার পিছু করবে না। আর যদি করো তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। আমার স্বামীকে তো তুমি চেননা! রিশিতা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।

রিশিতা যাওয়ার পর প্রণবের মনে হলো যা জানার জন্যে ও সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিল সেটা তো জানতে পারেনি। শুভ্র কোথায়? রিশিতার স্বামী কি শুভ্রই!

(চলবে....)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড