রিফাত হোসেন
পরেরদিন সকালে ফোন রিংটোন এর শব্দ শুনে বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়াল ফারাবী। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইনস্পেক্টরের নম্বর। ফোনটা রিসিভ করল ফারাবী। ফোনের ওপাশ থেকে মাসুদ আহমেদ বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
- ওয়ালাইকুমুস সালাম। এত সকালে ফোন দিলেন, পোস্টমর্টেম কী হয়ে গেছে?
- না। তবে এর থেকে-ও বড় একটা সংবাদ দেওয়ার জন্য ফোন দিলান এত সকালে।
- বড় সংবাদ মানে? কী সেটা?
- নদী ঘাটের নৌকায় মাথাহীন একটা লাশ পাওয়া গেছে। যদিও শিউর নই, তবে আমাদের ধারণা ওটা আপনার মায়েরই লাশ।
ফারাবীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরবতা দু'জনের মাঝে। হঠাৎ দরজার টোকা পড়ল। ফারাবী দরজার কাছে যেতে যেতে ইনস্পেকটর কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘লাশটা কোথায় আছে এখন?’
- পোস্টমর্টেম এ পাঠানো হয়েছে। আজ রাতে আমি আপনাদের বাড়িতে যাবো একবার, তখনই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করব।
- ঠিক আছে।
- কার সাথে কথা বলছ এত সকালে। দরজা খুলে দেওয়ার পরই মিস্টার আহসান রুমের ভিতরে আসতে আসতে কথাটা বললেন। ফারাবী কিংবা ইনস্পেক্টর, কেউই ফোনের লাইনটা তখনও কাটেনি। ফারাবী কান থেকে ফোনটা নামিয়ে মিস্টার আহসান কে বললেন, ‘ইনস্পেক্টর ফোন করে বলল, নদীর ঘাটে থাকা নৌকায় মাথাহীন একটা লাশ পাওয়া গেছে। তাদের ধারণা ওটাই মায়ের লাশ।’
- ওহ্।
মিস্টার আহসান এর প্রতিক্রিয়া দেখে ভ্রু-কুঁচকালো ফারাবী। এইরকম দুঃখজনক একটা সংবাদ পাওয়ার পর-ও একজন মানুষ কীভাবে অন্যসময়ের মতোই স্বাভাবিক থাকতে পারে, তা ভেবে পাচ্ছে না ফারাবী। যেখানে মহলিটি সম্পর্কে উনার স্ত্রী হয়। ফারাবীর সন্দেহজনক আর ভ্রু-কুঁচকানো দৃষ্টি দেখে মিস্টার আহসান বললেন, ‘এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আজকে শনিবার। আজকে-ও তো তোমার আদালত বন্ধ। তাই এইসব ভাবা বাদ দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও। আমি গিয়ে সকালের খাবারের ব্যবস্থা করি।’
ফারাবী করুণ কণ্ঠে বলল, ‘তোমার মানসিক অবস্থা দেখে আমি অবাক হচ্ছি বাবা।’
মিস্টার আহসান মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘এত অবাক হওয়ার কিছু হয়নি। এমনটা নয় যে, তোমাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য আমি আগে নিজেকে সবসময় স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। তোমার মায়ের মৃত্যু আমাকে একটুও শোকাহত করতে পারেনি। প্রথমে হয়তো কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম আমি। কারণটা অবশ্য তুমি!’
- মানে?
- আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কেউ আমাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। তোমার মায়ের পর হয়তো আমাদের কারোর সাথে এইরকম কিছু হবে। তাই আকস্মিকভাবে একটা ভীমড়ি খেয়েছিলাম। বাট নাউ আই এম ওকে। কারণ আমি জানি, তোমার মা নিজের দোষে খুন হয়েছে। তাই এখানে তোমার কোনো বিপদ নেই। আমি চাই না এই বিষয়ে তুমি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কর। পুলিশ নিজের মতো করে খুনিকে খুঁজে বের করুক। তুমি এর ভিতরে যাবে না এটা আমার অনুরোধ। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো তুমি। অহেতুক একটা বিষয়ে সময় নষ্ট করো না।
ফারাবী দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি কী মায়ের খুনটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছ?’
- না। আমি শুধু এটাই বলছি, তুমি এই খুনের ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না। আসামীকে এরেস্ট করাটা পুলিশের কাজ। তোমার কাজটা শুধুমাত্র আদালতে। বরং সেটাই মন দিয়ে কর তুমি।
- আসল অপরাধীকে শাস্তি পাইয়ে দেওয়াটা-ও আমার কাজ বাবা। তাছাড়া আমি জানতে চাই, মা কী এমন করেছিল, যার জন্য তাকে খুন হতে হলো?
- তোমার মায়ের সম্পর্কে যত জানবে, ততই তোমার মনে ঘৃণা সৃষ্টি হবে তাকে নিয়ে। আর তুমি সেটা মেনে নিতে পারবে না কখনোই। ও তোমার নিজের মা নয়। সুতরাং ওকে নিয়ে আর মাথা ঘামি-ও না।
- বাট আমি উনাকেই ‘মা’ বলে।ডেকেছি।
মিস্টার আহসান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আচ্ছা ফারাবী, তোমার মনে কী প্রশ্ন জাগেনি কখনো, আমার মতো বয়স্ক একজনকে তোমার মায়ের মতো কমবয়সী এবং স্মার্ট মেয়ে কেন পছন্দ করল? কেন সে আমাকে ভালোবাসলো?’
- না। ভালোবাসা হয় একে অপরের আত্মার সাথে। আর আত্মার সৌন্দর্য কেউই দেখতে পারে না। তাই এখানে কে কতটা স্মার্ট আর কমবয়সী, তা ভাবি না আমি।
- আবেগ দিয়ে মানুষ চেনা যায় না ফারাবী। আসলে তুমি তোমার মা'কে নিয়ে একটু বেশিই পজিটিভ। তাই তার নেগেটিভ কাজগুলো তুমি দেখতে পাও না। তোমার মা এখন মৃত। আর আমি চাই না, একজন মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে তোমার মনে আর কোনো খারাপ ধারণা তৈরি হোক। তাই বলছি এইসব নিয়ে আর ভেবো না। খুনিকে শাস্তি দিলেও তোমার মা আর ফিরে আসবে না। বরং এতে তোমার জীবনটা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। বিশ্রাম নাও। অথবা সামনের সপ্তাহে সরকারি বন্ধের শুক্রবার আর শনিবার করে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসো। আমি আশা করি তোমার মাইন্ড ফ্রেশ হবে।
মিস্টার আহসান চলে গেলেন ফারাবীর ঘর থেকে। বাবার বলা কথগুলো শুনে ফারাবী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েই আছে। মুখটা মলিন হয়ে গেছে। চোখেমুখে অদ্ভুত এক কৌতূহল আর বিস্ময়। ওদিকে মাসুদ আহমেদ ফোনটা কানে ধরে রেখেছিল এখন। মিস্টার আহসান এর বলা প্রতি কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছেন তিনি। ফোনের দিকে যে ফারাবীর নজর নেই, তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ। তাই নিজেই ফোনটা কেটে দিলেন। এরপর মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ব্যক্তি ভাবেন, তাই না মিস্টার আহসান সাহেন। ভেবেছিলেন ছেলেকে কিছু আঘাতময় কথা বলে চুপ করিয়ে দিবেন। কিন্তু আপনি তো আর আমাকে চিনেন না, আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। এখন শুধুমাত্র পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষা। হয়তো এরপরই আপনার জীবনে ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয় নেমে আসবে। আপনার আলোকিত জীবনটা অন্ধকারে রূপ নিবে।’
সন্ধ্যা ৭:০১ বাজে। হোটেল থেকে খাবার কিনে বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছেন মিস্টার আহসান। নিঃশব্দে একাকী উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছেন তিনি। যেন কোনো পিছুটান নেই তার। বাজার পেরিয়ে কিছুদূর এসেছেন তিনি। আশেপাশে কোনো দোকানপাট না থাকলেও মানুষজনের চলাফেরা কিছুটা আছে। হঠাৎ দু'টো গাড়ি এসে থামলো মিস্টার আহসান এর সামনে। থমকে গেলেন মিস্টার আহসান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে মুখে রুমাল বাধা কয়েকটা ছেলে নেমে এসে মিস্টার আহসান কে মারতে শুরু করল। হঠাৎ আক্রমনে হতভম্ব হয়ে মার খাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না মধ্যবয়সী মানুষটা। আশেপাশের মানুষজন শুরুতে ওদের থামাতে চাইলেও রুমাল বাধা লোকগুলোর মার আর হুমকিতে স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। কেউ আর সামনে এগোতে পারল না। এদিকে মিস্টার আহসান চেঁচিয়ে লোকগুলোকে বলছেন, ‘কে আপনারা? আর আমাকে এভাবে মারছেন কেন?’
ওদের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘ভিডিওটা বের কর তাড়াতাড়ি। নাহলে জানে মেরে ফেলব।’
- কীসের ভিডিও?
লোকটা মিস্টার আহসান এর নাক বরাবর ঘুষি মেরে বলল, ‘চালাকি করারা কোনো চেষ্টা করবি না হারামজাদা। ভিডিওটা বের কর বলতাছি।’
মিস্টার আহসান এর নাক বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু লোকগুলোর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ওরা অনবরত মারছে, আর ভিডিও চাইছে। কিন্তু মিস্টার আহসান কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না, ওরা কীসের ভিডিও এর কথা বলছ।
লোকগুলো হঠাৎ মারধর বন্ধ করে দিলো। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘এভাবে হবে না। এমনতেই মানুষজনের ভীড় বেড়ে যাচ্ছে। হয়তো এতক্ষণে পুলিশের কাছে-ও খবর চলে গেছে। তাই একে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।’
লোকটার কথায় সম্মতি দিলো সবাই। লোকটা মিস্টার আহসান কে টানতে টানতে গাড়িতে তুলতে লাগলেন৷ কিন্তু মিস্টার আহসান গাড়িতে উঠতে চাইছেন না কোনোভাবেই। শরীরের যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল, সেটুকু-ও কাজে লাগালেন তিনি। কিন্তু এতগুলো ব্যায়ামপুষ্ট দেহের যুবকদের শক্তির কাছে উনার মতো মধ্যবয়সী এক লোকের শক্তি নিতান্তই তুচ্ছ। তাই মাথাতে পরপর দু'টো আঘাত লাগার পর-ই মিস্টার আহসান নিজের জ্ঞান হারালেন। দু'জন লোক মিলে উনাকে একটা গাড়িতে বসিয়ে দিলেন। দু'জনে মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘তোরা এবার নিজেদের জায়গায় চলে যা। এর ব্যবস্থা আমি করব।’
- আপনি কী একা সামলাতে পারবেন ভাই? তাছাড়া উনাকে এখন কোথায় নিয়ে যাবেন?
লোকটা হঠাৎ উগ্র কণ্ঠে বলল, ‘সেটা নিয়ে কি তোদের ভাবতে বলেছি আমি? এত কথা না বলে চুপচাপ নিজেদের জায়গায় যা। মজা, মাস্তি কর। আমি কাকে নিয়ে কী করব, সেটা জেনে তোদের লাভ কী? এটা আমার ব্যক্তিগত কাজ। তোরা আমাকে সাহায্য করেছিস, সেজন্য তোদের প্রাপ্যটুকু পেয়ে যাবি। আর ভালো করে শুনে রাখ, এই ঘটনাটা যেন কেউ কোনোদিন জানতে না পারে।’
- ওকে ভাই।
লোকটা আর এক মুহূর্ত-ও অপেক্ষা করল না। ড্রাইভিং সিটে বসেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। বাকি লোকগুলো-ও চারিদিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে ওঠে তড়িঘড়ি করে চলে গেল।
(চলবে...)
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড