• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : কবি হৃদয়

  অরিত্রী মিত্র অথৈ

০৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৪৬
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

একটু আগেই রিম-ঝিমানিরা দল বেঁধে ছুটে এসেছিল নীলাকাশ, মায়ের কোল ছেড়ে। রুদ্ররক্তিমা সূর্যবক্ষকে কটাক্ষ করে বসুন্ধরার চিড়ধরা মৃত্তিকাকে সুশীতল বর্ষণে সিক্ত করতে। নুটুদের ছাগলটা সেই বর্ষার জলছবির মাঝে হয়তো কোন আসন্ন বিপদের ছায়া দেখেছিল। আকাশের আঁকাবাঁকা পথে পাড়ি জমানো রক্তাক্ত মেঘমালাকে দেখেই হয়তো তারস্বরে ডাকাডাকি শুরু করেছে। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ যেন কোন আগন্তুকের মর্মভেদী বিলাপ।

যেন কোন বিরহী হৃদয় খুঁড়ে প্রেমের গভীরতা উথলে উঠছে প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথায়। অদূরের পচা ডোবায় ব্যাঙের গুরুগম্ভীর গর্জন শুনে মনে হচ্ছে যেন কোন এক নিশ্চুপ পাতালপুরীর ঘুমন্ত দৈত্যদল ধরণীতল বিদীর্ণ করে উঠে আসছে সগৌরবে। যেন তারা নিমেষে মেতে উঠবে প্রলয়ের উল্লাসে। দূরাকাশে কোন এক নাম না জানা পাখি জানান দিয়ে গেল নিজের অস্তিত্ব। যেন সে বলে গেল আমি নিজেকে হারাইনি সহস্র বজ্রনির্ঘোষে।

পূর্বের আকাশে তখনো জলনূপুর পরা অপ্সরীদের আনাগোনা। যেন দু’নয়নে টলমল করছে অশ্রুবিন্দু। একটু স্পর্শ করলেই ঝরে পড়বে। আমি তাকিয়ে আছি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। আমার প্রবাসী মনটা তখনো দূরদিগন্তের মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে ফিরছে এক অচেনা অজানা ছায়ার পিছু পিছু। গত শারদীয় পূর্ণিমার মধুনিশিতে যখন আমি আত্মমগ্ন শুধুই কাব্যগ্রন্থের পৃষ্ঠার, কিন্তু আমার হৃদয়ে রসধারার অমিয়প্রাবন বয়ে যায়নি, কোন অলৌকিক কাব্যসুন্দরী তিলোত্তমাকে চেয়ে চেয়ে পাগল হয়ে ফেরেনি।

হঠাৎ আমার মনুষ্য কর্ণ তাচ্ছিল্য করে হৃদিকর্ণে কোন কল্পনীয় কুমারীর জলনূপুরের ছলাৎছল শুনতে পেলাম সহসাই। সেই শব্দ যেন আমার বক্ষপিঞ্জরে নিরন্তর সংগ্রাম করে চলছে। আমায় টেনে নিয়ে চলেছে কোন এক অজানা সুরের অনুকরণে। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি তার প্রতিটি পদক্ষেপে। গৃহবন্ধন ছিন্ন করে যখন পা রাখলাম সেই অনির্বচনীয় মহিমাকে প্রত্যক্ষ করতে। কিন্তু হায়! কোথায় সেই অপ্রত্যক্ষীত মানস সুন্দরী? সে কি বিদুষী নাকি বাকপটীয়সী? সে কি চির স্পর্শরহিতা নাকি আমার হৃদিগঙ্গার নিত্যস্নাতা? তাকে কোন এক কোণায় সংরক্ষণ করেছি সংগোপনে? সেই গোপনীয়তা কার থেকে? আমি কী তবে নিজেই নিজেকে ফাঁকি দিয়ে এসেছি এতদিন? কোন সুদূর হারালো আমার কল্পনার তিলোত্তমা? আমি যে ভিক্ষুকের বেশে তাকে আজো খুঁজে ফিরি রহস্যপুরী দ্বারে দ্বারে। সে কোন এক রহস্যময়ী আবছায়া? যাকে নিত্যই খুঁজে বেড়াই শত শত প্রাপ্তিহীনতার মাঝেও। হায় আমার কল্পনীয় কুমারী!

তার খোঁজে বেরিয়েছি আজ আমি। কিন্তু অপার্থিব মহিমান্বিত সেই রজনীতে যার অনাস্বাদিত প্রণয়বারি অনুভব করেছি, তাকে পার্থিবের মাঝে কি করে খুঁজে পাব? তাই তো আমি একবারো খুঁজে নেইনি স্বীয় অস্তিত্ব বিলীনকারিণী সেই মায়াময়ীকে। আহা! আমার বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষী মনকে সান্ত্বনার সুতোর এমনি করে কে বাধল? সেই অনুপমা রূপসীকে দর্শনের আশায় আজও যে ব্যত্যয় ঘটে আমার হৃদকোণে। ওহে রহস্যময়ী আবছায়ীতা তিলোত্তমা নারী, তুমি কি তা জানো?

যখন অবিশ্রান্ত বারিধারার প্রকোপ খানিকটা সীমিত আকার ধারণ করে, আমার সাত বছরের ভ্রাতুষ্পুত্র আনন্দ এসে দাঁড়ায় পাশে। আমি তন্ময় হয়ে ডুবে ছিলাম সেই কল্পিত নারীর অপরূপ অদেখা রুপমহিমা বর্ণনে। আনন্দ কাছে এসে খাতার উপর ঝুঁকে দেখল কিছুক্ষণ। কিন্তু তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এই বিরাট ভাব বিহ্বলতার অন্তহীন সাগরের অথৈ জলে নাবিকবিহীন নৌকা ভাসাতে সমর্থ হয়নি তখনো। আস্তে-আস্তে বলল, ‘কি করছো গো কাকা?।’

নিতান্তই সহজ ভাষণ, কিন্তু তা আমার হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরতর ভালবাসা নামের তুষাগ্নি আরো প্রগাঢ় প্রেমে সিক্ত করল। চেয়ে দেখি, সেই শারদ প্রাতে শুরুতে সেই কিশোরকচি শিশুটির ভীত হরিণশাবকসম আঁখি দু’টিতে একই নিতান্তই সহজ অথচ কতই না জটিল প্রশ্ন, ‘কি করছো গো কাকা?।’ আহা! এই ক্ষুদ্র শিশুটিকে কি করে বোঝাই আমি কি করছি।

তাতো আমি নিজেই জানি না। আনন্দের মা বলছিলেন, আমি নাকি জ্যোৎস্না রাতে ভূত-টূত দেখে ভিরমি খেয়ে এখন পাগল হয়ে গেছি।সত্যিই তো, পাগল হয়েছি বৈকি আমি। কিন্তু কাকে দেখেছি আমি। আমার চর্মচক্ষুর গোচর তো হয়নি সে। এ যে কি যন্ত্রণা, তা আমি তাদের কি করে বোঝাই? সবাই আমাকে পাগল বলে। আমি যে প্রেমের পাগল, তা কি তারা জানে? ওহে অচেনা অতিথি, কোন এক বিরহী শিল্পীর মতো আমারো যে বলতে ইচ্ছে করে, ‘তুমি কোন আকাশে থাকো, জ্যোৎস্না কারে মাখো? কার উঠানে পড়ো ঝরিয়া?’

পরিশিষ্ট : কবিহৃদয় চিরকালই অসাধারণ। যখন সত্যিকারের জীবন ভরে ওঠে হাহাকারে, তখন কবি কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়, আর দশজন সাধারণ মানুষের কাছে যেটা পাগলামি। কিন্তু হাজার না পাওয়াকে পেয়েই বেঁচে থাকে কবি হৃদয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড