• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : একটি রাত তোমার শহরে

  কাজী সাবরিনা তাবাস্‌সুম

০৩ অক্টোবর ২০১৯, ১২:৫০
গল্প
ছবি : প্রতীকী

পূজামণ্ডপের ডামাডোলে সরগরম চারদিক! দুর দূরান্ত থেকেও তরঙ্গায়িত ঢাকের শব্দ বাতাসে ভেসে এসে জানান দিচ্ছে নির্বাণের কানে। শুনতে ভালই লাগে, কিন্তু একটানা কানে বাজলে কেমন একটা মাথার ভিতরে ঝিম ঝিম করে। তবু জানলায় দাঁড়িয়ে পূজোর গন্ধ ভালভাবেই গায়ে মেখে নিচ্ছে সে। কি অদ্ভুত এক মায়া, ধূপের গন্ধে মোহিত না হয়ে উপায় নেই। আজ অষ্টমী, আজকেই ঢাকঢোলের শব্দ সবচেয়ে বেশি। কোন কোন পূজামণ্ডপে নাচ গানও হয়, প্রতিযোগিতা হয়, হৈ চৈ করার যেন এক হাজারটি উপায় খুঁজে বের করা আর কি!

মজা হয় ভীষণ, নির্বাণ ভালই উপভোগ করে পূজো পার্বণ। এখন তো সবে সন্ধ্যা, পূজো জমবে রাতের শেষ প্রহরে। নির্বাণ একটু পরেই বের হবে! না, পূজো মণ্ডপের উদ্দেশ্যে নয়, সে যাবে হাসপাতালে। আজ ডিউটি আছে তার। ডিউটির শিডিউল অবশ্য সে বদলে নিতে পারতো। কিন্তু দরকার মনে করেনি। নির্বাণ কখনোই কোন কিছু প্রকৃতির নিয়মের বাহিরে বদলানোর চেষ্টা করেনা। যা যেভাবে হবে হোক! তাতেই হয়ত মঙ্গল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক জানে, সে হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তার ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব এই দূর্গাপূজো। তাহলে এই সময়টা কি মাথায় রেখে শিডিউল দিতে পারতো না? যেহেতু দেয়নি, নির্বাণ ভেবে নিয়েছে এটাই যৌক্তিক। গতকাল সারা দিন ডিউটি ছিল তার। সারাদিন এমার্জেন্সির রোগীদের সামলে ওয়ার্ড কেবিন রাউন্ড দিয়ে সন্ধ্যাবেলা পুজোমন্ডপে হৈ হুল্লোড় করার মত শক্তি আর পায়নি সে। পাওয়ার কথাও না! বন্ধুরা কাজিনরা সবাই বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। নির্বাণ শেষমেশ ফোনের পাওয়ার বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন প্রিয় ঐ ঢাকের শব্দটাও সহ্য হচ্ছিল না। আজ বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমুলো। সারাটা দিন খুব আয়েশে কাটানোর পর এখন সন্ধ্যাবেলার ঢাকের সেই শব্দ টাই অসাধারণ মনে হচ্ছে। নির্বাণ অবাক হয়ে ভাবে প্রকৃতির লীলাখেলার কথা। কাল রাতে ক্লান্ত শরীরে ঢাক ঢোলকে কত কিই না বলেছে সে! নিজের মনেই হাসি পেল তার। তৈরি হয়ে স্টেথোস্কোপ, প্রেশার মাপার যন্ত্রটা গুছাতে গুছাতে একটা পরিকল্পনা এঁটে ফেললো।

আজ যেহেতু নাইট ডিউটি, সারা রাত হাসপাতালেই থাকতে হবে। অষ্টমী তো মিস হয়ে গেল; তাই বলে নবমী আর দশমী মিস করবেনা। আজই অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে বলে দিবে কাল পরশু দু’দিন ডে অফ নেওয়ার কথা। এই দু’দিন মৌমীকে সময় দিবে। মৌমী নির্বাণের মামাতো বোন এবং ভালবাসার মানুষ। পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়েটাও ঠিক হয়ে আছে। পূজোর পরেই আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের তারিখ পাকা হয়ে গিয়েছে। বিয়ের আগে এটাই নির্বাণ আর মৌমির শেষ পূজো। এই পূজোটা স্পেশাল। এই পূজোটা ব্যাচেলর জীবনের শেষ পূজো। আর এই সময়টায় নির্বাণ হাসপাতালে ডিউটি করছে। কেমন ছেলে সে? কেমন প্রেমিক সে? নিজের উপর ভীষণ রাগ হলো। অবশ্যই এই পূজোয় পাঁচদিনের ডে অফ নেয়া উচিত ছিল নির্বাণের। ভুল যখন হয়েই গিয়েছে, সে ভাবলো অন্তত কাল পরশু দুটো দিন ঢাকের শব্দে মৌমির হাত ধরে মাতোয়ারা হওয়া যাক! ভাবতেই সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরন জাগলো তার। ভারী মজা হবে নিশ্চয়ই।

কাল রাতে কারো সাথে কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়ায় মৌমি ভীষণ রেগে গিয়েছে। আজ আর ফোন ধরলো না। নির্বাণ ঠিক করলো মৌমিকে আরও একটু রাগিয়ে দিবে! না ধরুক ফোন ।কাল পরশু যখন সারাদিন হাসপাতালের রাস্তাটাও মাড়াবে না, তখন মৌমি কতটাই না খুশি হবে।

সুন্দর একটা অনুভূতিতে আটকে গেল নির্বাণের ভাবনা। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলো খুব ফুরফুরে মন নিয়ে। চারিদিক মন্ত্রমুগ্ধ শব্দের তাল যেন সমুদ্রের ঢেউ এর মত গর্জন দিয়ে উঠছে আর নামছে।

হাসপাতালে পৌঁছে নির্বাণের ফুরফুরে মনটি আর রইল না। একটি সুইসাইড কেস আসলো তার কাছে। মেয়েটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরের তিনটি ঘন্টা কি করে কাটলো জানেনা নির্বাণ। কি ভীষণ কষ্ট পেতে দেখলো রোগীকে, আপ্রাণ বাঁচার আকুতি। অবশেষে অত্যন্ত চেষ্টা আর সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় আরও দু’জন ডাক্তারের সাহায্যে মেয়েটার অবস্থা বিপদমুক্ত করতে পেরেছে। প্রচণ্ড ক্লান্তি বোধ করলো নির্বাণ; ক্লান্তি এবং বিষাদ! ফুরফুরে মনটা কেমন বিষিয়ে উঠলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল আনমনে। মেয়েটা ঘুমুচ্ছে না, কিন্তু চোখ বুজে আছে। নির্বাণ এর কারণ খুঁজে বের করলো। তার মনে হল মেয়েটা লজ্জিত। এই পৃথিবীর মানুষগুলোর চোখে চোখ রাখতে লজ্জিত। আবার মনে হলো, নাহ, এইজন্য না; মেয়েটা লজ্জিত কারণ সে একটা বিশাল চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে। নিজের কাছেই নিজে অপমানিত হয়েছে; এই গ্লানি মুছে ফেলতে খুব কষ্ট হবে তার!

নির্বাণ মেয়েটার ফর্ম নিয়ে বসলো। পূর্ণিমা দাস। ১৬ বছর বয়স। নির্বাণ আঁতকে উঠলো। মেয়েটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার বয়স ১৬। বেশ বড়সড় দেখায় তাকে। তার উপর সে হিন্দু ধর্মের। আজ তো তারও পুজো, তারও অষ্টমী। এই বয়সী একটা মেয়ের আজ সেজে গুঁজে মণ্ডপে মণ্ডপে নেচে গেয়ে বেড়ানোর কথা, তা না করে সে মরতে বসেছে? কেন? কি এমন দুঃখ পেতে পারে এইটুকু মেয়ে? কি এমন দুর্দশায় পূজোর এই আনন্দময় দিনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে?

নির্বাণ তাকালো মেয়েটির বাবা মায়ের দিকে। কেমন ছিন্ন ভিন্ন দৃষ্টি তাঁদের। পূর্ণিমার মায়ের পরনে নতুন শাড়ি, আঁচলের সাথে লাগালো দোকানের নেইমট্যাগটাও কাটার সময় পাননি মহিলা। হয়ত সাজতে বসেছিলেন নতুন শাড়িটা পরে। পূর্ণিমার বাবার দৃষ্টি অসহায়, অদ্ভুত। কিন্তু তিনিও ইস্ত্রি করা পাজামা পাঞ্জাবী পরে আছেন। হয়ত এই পরিবারটির সবার একসাথে পূজো দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। হয়ত তাদের মেয়ে পূর্ণিমা দরজা বন্ধ করে সাজতে বসেছিল। কোন কারণে সেই সাজ আর শেষ করতে পারেনি। কোন কারণে নিজের জীবনের প্রতি মায়া মমতা চলে গিয়েছিল। ষোল বছরের ষোড়শী তার স্বল্প জীবনের অসংখ্য দুঃখের হাত থেকে চিরতরে মুক্তি পাবার জন্য এই পৃথিবী থেকেই চিরতরে চলে যেতে চেয়েছিল। কি ভয়ংকর! মৃত্যু শব্দটাকে খুব ভয় পায় নির্বাণ। যদিও সে পেশায় একজন চিকিৎসক এবং মৃত্যু প্রতিটা মানুষের জন্য খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। তবু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনা নির্বাণ। অনেক ছোট বেলায় বাবা মাকে হারিয়ে যতটা বাস্তবতা বোঝার, বুঝেছে সে! এখন আর তাই অন্য কারও প্রিয়জন হারানোর ব্যথা সহ্য হয়না তার। নিজেই সে ব্যথা অনেক খানি অনুভব করে যেন! পেরিয়ে গেল আরো দুটো ঘণ্টা।

আরও কিছু রুটিন রোগী চেকআপ করে নির্বাণ ফিরে আসলো পূর্ণিমার কেবিনে। মেয়েটি সম্পূর্ণ সুস্থ এখন। নির্বাণ দেখলো মেয়েটি মানসিক ভাবে এখনও মারাত্মক বিপর্যস্ত। এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে ওয়ার্ম আপ করা লাগবে। মেয়েটির বাবা-মা কেউই সেই পরিস্থিতিতে নেই যে তাদের মেয়েকে ওয়ার্ম আপ করবে। তাদের চোখে মুখে সারা সন্ধ্যার ক্লান্তি, টেনশন, উদ্বেগ আর অনেক অনেক প্রশ্ন। হঠাৎ নির্বাণের মনে হল এই মেয়েকে এখন হাসপাতাল থেকে বিদায় দিলে বাড়ি ফিরেই তার বাবা-মা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলবেন। আগামীকাল নবমী। পূজোর আর দুটো মাত্র দিন। সেই বাকি দুটো দিনও মেয়েটির জীবনে পূজোর আনন্দ আসবে না। অথচ এত বুড়ো বয়সেও নির্বাণ পূজোর হৈ হুল্লোড় থেকে নিজের মনকে সরাতে পারছে না। তাহলে এই ছোট মেয়েটার পূজোর আনন্দ কত বেশি পাওয়া উচিত?

নির্বাণ একবার চোখ বুজে ভাবলো। আজ রাতে তার আর কোন কাজ নেই। চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। এখন অষ্টমীর শেষ প্রহর চলছে। এই শেষ প্রহরের পূজো উপভোগ করবে সে। এই পূজো দেখবে পূর্ণিমাকে সঙ্গে নিয়ে, পূর্ণিমার শহরে। এতে করে পূর্ণিমাকে যেমন একটু ওয়ার্ম আপ করা যাবে, সেই সাথে পূর্ণিমার বাবা-মাকে মানসিক সাপোর্টও দেওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ! কিন্তু একজন ডাক্তারের গাড়িতে চড়ে হাসপাতাল থেকে পূর্ণিমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে এবং স্বয়ং ডাক্তার সাহেব পূর্ণিমা আর তার বাবা মায়ের সাথে পূজো মণ্ডপে পূজো দেখবে, এই বিষয়টা হজম করা পূর্ণিমার বাবা মায়ের জন্য অস্বাভাবিক! একে তো সারা সন্ধ্যার অস্বাভাবিকতা ধকল, তার উপর ডাক্তার সাহেবকে বিরক্ত করা, তাদের তখন হাজারটা বাহানা যেন!

তবু নির্বাণ তাদের মানিয়ে নিলো। গাড়ি চালাতে চালাতে পূর্ণিমাকে পাশের সিটে বসিয়ে তার সাথে প্রচুর কথা বললো। তার মানসিক ট্রমা কাটিয়ে তুলার একশ একটা পন্থা অবলম্বন করলো। অতঃপর অল্প বয়সী পূর্ণিমা একটু সহজ হলে তাকে আর তার বাবা-মাকে নিয়ে চলে গেল পূজো মণ্ডপে। মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে ছুটে বেড়ালো তারা।

এখানে কে ডাক্তার আর কে রোগী সে প্রশ্নের অবকাশ ছিলনা। সবাই যেন দুর্গা মায়ের পূজারী। নির্বাণ তার সারা জীবনের পূজা মণ্ডপে ঘোরার অভিজ্ঞতায় এত আনন্দ পায়নি। তার হঠাৎ মনে হলো এই কারণেই সে ডাক্তার হয়েছে। এটাই তার পূজো, এটাই তার আনন্দ। মানুষের সেবা করা। শুধু হাসপাতালেই রোগীর সেবা হবে সেটা তো কোথাও ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। রোগীর সেবা হতে পারে ততক্ষণ যাবত, যতক্ষণ পর্যন্ত ডাক্তার রোগীর সেবা করে সন্তুষ্টি লাভ করতে পারেন।

নির্বাণের নিজেকে খুব তৃপ্ত মনে হলো। যতটা না শেষ রাত্রির পূজো দেখছে, তার চেয়েও বেশি দেখছে পূর্ণিমা আর তার মা বাবার ঝলমলে হাসিমুখ। অচেনা শহরে অচেনা এক পরিবারের মেয়ের নিষ্পাপ হাসিতে এত আনন্দ পাওয়া যেতে পারে তা কখনো ভাবেনি নির্বাণ। এই দিনের আনন্দটা পাবার জন্যই নিজের চিকিৎসা পেশাকে ধন্যবাদ জানায় বারবার।

অসাধারণ কিছু অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরবে আজ। সে নিশ্চিত, পূর্ণিমা নামের এই মেয়েটি আর কখনোই আত্মহত্যার মত পাপকাজ করার কথা ভাববে না। জীবনে যত কষ্ট আসুক, আজ রাতের আনন্দটা থেকে ছাপিয়ে যাবে না সে কষ্ট। আজ এতক্ষণে চিতার আগুনে ছাই হবার কথা ছিল তার। অথচ সে মনের আনন্দে বাবা মায়ের সাথে শেষ রাত্রির পূজো দেখছে। এই তীব্র আনন্দের মুহূর্তটা সারা জীবন আঁকড়ে রাখবে পূর্ণিমাকে। ঢাকের শব্দ ম্লান হচ্ছে। পূজো মণ্ডপে লোক কমে যাচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করছে। অষ্টমী শেষ। নির্বাণের ফোন বাজলো। স্ক্রিনে মৌমির নাম্বার। রাগ ভেঙেছে বোধহয় মেয়েটার। নির্বাণ পূর্ণিমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রিয় মানুষের ফোন রিসিভ করলো। কিন্তু তার আগে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। কাল পরশু তো নয়ই, আর কখনোই ইচ্ছাকৃত ডে অফ নেবেনা সে। ডাক্তার হয়ে ডাক্তারি করতে পারার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে পৃথিবীর অন্য কোন আনন্দে আকৃষ্ট হবার যে কোন উপায় নেই তার!

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড