• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘নিস্তব্ধতা’-এর দ্বিতীয় পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : নিস্তব্ধতা

  রিফাত হোসেন

০১ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:৪৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

পায়ের শব্দটা এবার ঘরের সামনে এসে গেল। সেই সাথে আবছায়া আলোয় একটা ছায়া। ফারাবীর মনে হচ্ছে এর বুকের ভিতর কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। কিংবা কেউ কলিজাটা খুলবে নিচ্ছে। রাগের মাথায় আলমারির দরজায় জোরে একটা ঘুষি মারল ফারাবী। তখন ঘরের বাইরে থেকে একজনের গলার আওয়াজ পেলো ও। লোকটা বলল, ‘ভিতরে কেউ আছে নাকি কামাল?’

ফারাবী নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আলমারির দরজাটা টান দিয়ে। সাথে সাথে একটা শব্দ হয়ে লকটা ভেঙে গেল। কোনোদিকে না তাকিয়েই আলমারিটার ভিতর ঢুকে পড়ল ও। আলমারিটা বড় হওয়ায় তেমন সমস্যাই হলো না৷ অনায়াসেই ভিতরে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য জায়গা পেয়ে গেল। এরপর আস্তে আস্তে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। ঘরের বাইরে থেকে আবারও সেই লোকটা বলল, ‘পিস্তলটা বাইর কর কামাল। আর আস্তে আস্তে ঘরের লাইট জ্বালা। হালারে গুলি কইরা ফালাফালা কইরা ফালাবি।’

লোকটার কথা শুনে ফারাবীর আত্মা ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।ডিপডিপ শব্দ হচ্ছে ওর বুকের ভিতরে। যতটা সম্ভব চুপচাপ বসে আছে ও। হাত নিয়ে মুখটা চেপে ধরে রেখেছে, যাতে কোনো শব্দ না হয়। এমনকি নিশ্বাস নেওয়ার শব্দ-ও না। দরকার হলে নিশ্বাস আটকে রেখে মরে যাবে। তবুও সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিজের মৃত্যু কখনোই আশা করবে না ফারাবী।

হঠাৎ বাইরে থেকে অন্য আরেকজনের গলার আওয়াজ পেলো ফারাবী৷ লোকটা বলছে, ‘লাইট জ্বলানো যাবে না ভাই। কেউ টের পাইয়া যাইবো। ওদিকে চাইয়া দেখেন ঘরের জানালাটা খোলা। আমার মনে হয় ওই জানালা দিয়ে ঘরে বাতাস আইসা কিছু পইড়া গেছে। তাই ওইরকম শব্দ হইছে। এখন আমাগো হাতে সময় বেশি নাই। তাড়াতাড়ি লাশটা সরাইতে হইবো। নাইলে এই দূর্গন্ধে রাস্তার মানুষজন-ও টের পাইয়া যাইবো।’

- ঠিক বলেছিস কামাল। শব্দ কোত্থেকে আসল, তা খোঁজার সময় নেই এখন৷ আগে লাশটা সরাইয়া লই৷ তারপর এগুলো দেখা যাবে। তাড়াতাড়ি লাশটা বাইর কর খাটের নিচ থিকা।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ফারাবী। মনে হলো বুকের উপর থেকে লক্ষ্য লক্ষ্য পাউন্ড ওজনের একটা পাথর নেমে গেল। আনন্দে ফারাবীর চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমা হয়ে গেছে। সেই সাথে এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে যে, ওর মায়ের লাশটা গুম করে দেওয়া হচ্ছে। কষ্টটা নিজের মধ্যেই চেপে রেখে দিলো৷ হঠাৎ ফোনের রিংটোন এর শব্দে আতঙ্কে উঠল ফারাবী। নিজের পকেটে হাত দিয়ে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকার পর নিজের মনে মনে বলল, ‘যাক বাবা, বেঁচে গেছি! ভেবেছিলাম আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠেছে৷ কিন্তু না, রিংটোনটা ওদের মধ্যকার কারোর ফোনের হবে। কিন্তু কারা এরা দু'জন? একজনের নাম তো কামাল। আরেকজন কে? নিবিড়! উঁহু, ওর কণ্ঠস্বর এইরকম না। তাহলে কী মাফিয়া নিজেই? হতেও পারে। আবার নাও হতে পারে।’

ফারাবী নিজের ভাবনা বাদ দিয়ে লোকটা ফোনে কী বলে, সেটা শোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তবে ঘর থেকে কিছুক্ষণ কোনো শব্দ শোনা গেল না। হঠাৎ লোকটা বলল, ‘এখন আর কিছু করা যাইবো না কামাল। বাবা বাড়িতে এসে গেছে। তাড়াতাড়ি বাইরে চল।’

‘বাবা’ নিজের মনে মনে শব্দটা কয়েকবার বলল ফারাবী। পায়ের ঠকঠক শব্দ পেয়ে আমার থেমে গেল। লোক দু'টো চলে যাচ্ছে। এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা। ফারাবী আলমারির দরজা একটু খুলে আড়চোখে বাইরের দিকে তাকালো। এরপর বলল, ‘কেউ নেই মনে হচ্ছে। এটাই শেষ সুযোগ। ওরা আবার ফিরে আসার আগেই আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে।’

আস্তে আস্তে আলমারি থেকে বের হলো ফারাবী। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল ও। এদিকে ওদিক তাকানোর পর সিড়ি দিয়ে নামতে যাবে, তখনই কেউ একজন ওর মাথায় পিস্তল ঠেকালো। সাথে সাথে কেঁপে উঠল ফারবী। পুরো শরীরটাই যেন আতঙ্কে উঠল। বুকের ডিপডিপ শব্দটা মুহূর্তের মধ্যেই বেড়ে গেল। নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। হঠাৎ ওর মাথায় পিস্তল ঠেকানো লোকটা বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা সত্যি করে বল কে তুই?’

ফারাবী মুখে কিছু না বললেও নিজের মনে মনে বলল, ‘আমি একজন সরকারি আইনজীবী। আর আমার সাথে এইরকম ব্যবহার! আবার আমাকে গালি-ও দেওয়া হচ্ছে। অন্যসময় হলে এক ঘুষিতে তোর মুখ ভেঙে দিতাম হারামজাদা। কিন্তু এখন নিজেই ফেঁসে গেছি।’

হঠাৎ লোকটা আবার অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ভাই, লাইটটা জ্বালান। আগে হালার মুখটা দেইখা নেই, তারপর মারমু। হালার সাহস দেইখা আমার কলিজা কাঁপা শুরু করছিল। শহরের নামকরা একজন মাফিয়ার বাড়িতে ঢুইকা পড়ছে ও। বাঁইচা ফিরতে পারব না আজ।’

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই ফিসফিস করে একজন বলল, ‘আস্তে আস্তে কথা বল কামাল। আর লাইট জ্বালানো যাবে না। বাবা হয়তো গাড়ি গ্যারেজে রেখে ভিতরের দিকে আসছে। বাবা যদি জানতে পারে, এইরকম ঝামেলায় জড়াইছি আমরা। তাইলে আর রক্ষা নাই।’

- তাইলে এই হালারে নিয়া কী করবেন এহন?

- আজ আর লাশ সরানো যাবে না। কাল সন্ধ্যার পর লাশ এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আপাতত আমি ওই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে আসি। যাতে দুর্গন্ধ আর না ছড়িয়ে পড়ে। তুই পিস্তলটা ধরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাক। তারপর পিছনের দরজা দিয়ে ওকে বাইরে নিয়ে যাবো। এরপর ওকে মারার ব্যবস্থা করব।

- ঠিক আছে ভাই।

আবারও জুতোর ঠকঠক শব্দ করে কেউ একজন চলে গেল। আবছায়া আলোয় আড়চোখে ঘরটার দরজার দিকে তাকালো ফারাবী। কেউই নেই ওখানে। তারমানে লোকটা এখন ভিতরে আছে। হয়তো জানালা বন্ধ করায় ব্যস্ত সে। ফারাবী নিজের মনে মনে বলল, ‘এটাই শেষ সুযোগ। বাঁচতে চাইলে এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।’

কিছুক্ষণ নীরবতা সবার মাঝে। হঠাৎ ফারাবী ফিসফিস করে বলতে লাগল, ‘ওয়ান, টু, এণ্ড থ্রি’

নিজের শরীরের সমস্ত শক্ত দিয়ে কামাল নামের লোকটাকে ধাক্কা দিলো ফারাবী। আকস্মিক ধাক্কায় নিজের ভারসাম্য সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়ে গেল কামাল। ফারাবী মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘কে কার ব্যবস্থা করবে, সেটা তো পরে দেখা যাবে। আগে আমাকে খুঁজে বের কর হারামজাদা। কতবড় সাহস! একজন সরকারি অফিসারকে গালি দিস তুই।’

ফারাবী আর এক মুহূর্ত-ও দেরি করল না। কামাল ওঠে দাঁড়ানোর আগেই ওকে পালাতে হবে এখান থেকে। তাছাড়া ভিতরের ঘরে আরেকজন লোক-ও আছে, যে খুবই সাংঘাতিক। তাই তার সামনে পড়া যাবে না কিছুতেই। ফারাবী দৌড়ে নিচের তলায় চলে এলো। দু'তলায় অন্ধকার থাকলেও ড্রয়িংরুমটা পুরোপুরি আলোকিত হয়ে আছে। ফারাবী সামনের দিকে দৌড় দিতে যাবে, তখনই মেইন দরজার দিকে কাদের যেন কণ্ঠ শুনতে পেলো। স্তব্ধ হয়ে গেল ফারাবী। অসহায়ের দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হায় আল্লাহ! শেষ রক্ষা-ও হলো না। ওদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আরো ভয়ঙ্কর একজনের সামনে চলে এলাম। এক্ষুনি ওই লোকটার বাবা ভিতরে ঢুকবে। আর আমাকে দেখেইল যখন কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করবে, কে তুই? তখন কী বলব আমি? তাছাড়া উনি তো আমাকে সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলতে পারবে’

ফারাবী চোখ বন্ধ করে নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ কী মনে করে যেন পিছন ঘুরেই দৌড় দিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর-ই বিজয়ের হাসি দিয়ে বলল, ‘ইয়েস। থ্যাঙ্কিউ আল্লাহ! সঠিক সময়ে আমাকে বাঁচার রাস্তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। এবার পিছনের দরজা দিয়েই আমি বাইরে চলে যাবো।’

ফারাবী আর সময় নষ্ট না করে পিছনের দরজাটা দিয়ে বাড়িটি থেকে বেরিয়ে গেইটের দিকে যেতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর-ই দেখল নিবিড়ের গাড়িটা। দূর থেকেই সেই ঘরটার জানালার দিকে তাকালো ফারাবী। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। তাই আর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে নিবিড়ের গাড়ির সামনে গেল। নিবিড় গাড়ির ভিতরেই ছিল তখন। ফারাবী গাড়িতে ওঠে বসার পর নিবিড় বল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে ফ্রেন্ড?’

ফারাবী কপালের ঘাম মুছে আমতাআমতা করে বলল, ‘একটু পানি খেতে গিয়েছিলাম।’

- আমি অনেক্ষণ ধরেই তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। তুমি আসছিলে না বলে আমি ভিতরের দিকেই যাচ্ছিলাম, তখন দেখি আমাদের বস এসে গেছে। সেজন্য তার সাথে কথা বলে আবারও গাড়িতে এসে বসলাম।

ফারাবী তাগাদা দিয়ে বলল, ‘এবার তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দাও নিবিড়। আমাকে বাড়িতে যেতে হবে।’

- ওকে।

নিবিড় গাড়ি স্টার্ট দিলো। দারোয়ান গেইট খুলে দিলো। জানালা দিয়ে ঘরটার দিকে আবারও তাকালো ফারাবী। যেই ঘরে আছে একটা মাথাহীন লাশ। আর সেই মাথাহীন লাশটা ওর মায়ের। ফারাবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল, ‘বাবা যে মা’কে খুন করেনি, সেটা নিশ্চিত। ওই লোক দু'টো মায়ের লাশটা গুম করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর মানে ওরাই আমার মা’কে খুন করেছে। আমি ওদের ছাড়ব না’

ফারাবী অন্যমনষ্ক হয়ে আছে দেখে নিবিড় বলল, ‘তোমার বাড়িটা কোথায় ফ্রেন্ড? আগে তো অন্য শহরে ছিলে, এখন কোথায় থাকো আমাকে বলো। বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসছি তোমাকে।’

- প্রায় ১ বছর হলো এই শহরে এসেছি। তবে এখন আমাকে সামনের মোড়ে নামিয়ে দিলেই হবে। তুমি নিজের কাজে যাও।

- ঠিক আছে।

ফারাবীকে সামনের মোড়ে নামিয়ে নিবিড় তিথির বাড়িতে চলে গেল। ফারাবী পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা নম্বরে ফোন দিলো। ফোনে কথা বলতে বলতে বাড়িতে চলে গেল ও। বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই বাবার ঘরে গেল। মিস্টার আহসান তখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ফারাবীর উপস্থিতি টের পেয়ে ওঠে বসলেন। ফারাবী তার কাছে গিয়ে বলল, ‘কী করছ বাবা?’

মিস্টার আহসান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তেমন কিছু করছি না আপাতত। তবে ভাবছি তোমার মায়ের কাটা মাথাটা কোথায় লুকাবো।’

ফারাবী হেসে দিয়ে বলল, ‘সেটা করার কোনো প্রয়োজন নেই বাবা। কারণ মায়ের শরীরের বাকি অংশ আমি পেয়ে গেছি। আর মায়ের আসল খুনিদের-ও আমি পেয়ে গেছি।’

মিস্টার আহসান ভ্রু-কুঁচকে তাকালেন ফারাবীর দিকে৷ ফারাবী আবার বলল, ‘হ্যাঁ বাবা। তোমার আর কোনো ভয় নেই। তুমি যে মা'কে খুন করোনি, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।’

মিস্টার আহসান উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন, ‘এইসব কী বলছ তুমি? তুমি কীভাবে তোমার মায়ের শরীরের বাকি অংশ পেলে? আর কে খুন করেছে তোমার মা’কে?’

নিবিড়ের সাথে দেখা হওয়ার পরের সব ঘটনা বাবাকে বলল ফারাবী। মিস্টার আহসান সবটা শোনার পর বললেন, ‘তুমি এতবড় রিস্ক নিতে গেলে কেন? তাছাড়া তুমি কীভাবে শিউর হচ্ছ যে, ওই ঘরে বিছানার নিচে থাকা লাশটা তোমার মায়ের-ই। তুমি তো আর লাশটা নিজ চোখে দেখনি।’

- আমি দেখিনি ঠিকই, তবে আমি অনুভব করেছি। আর আমার অনুভব ভুল নয়। তাই আমি নিশ্চিত, ওটা আমার মায়েরই লাশ।

ফারাবীর কথা শুনে মিস্টার আহসান গর্জে ওঠে বললেন, ‘চুপ কর তুমি। তোমাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে হবে এবার। মায়ের প্রতি তোমার এই অন্ধ ভালোবাসা-ই তোমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছ সেটা কী বুঝতে পারছ না তুমি?’

- আমি শুধু মা'কে নয়। আমি তোমাকেও ভালোবাসি বাবা। আর একজন সরকারি অফিসারের সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না তুমি।

ফারাবীকে ধমক দিয়ে মিস্টার ইকবাল আবার বললেন, ‘আরে রাখ তোমার সরকারি আইনজীবী। ওইতো একটা উকিলের চাকরি। এই উকিলের চাকরি নিয়ে আবার আমাকে কথা শোনাচ্ছ। আর কোনো কথা বলবে না তুমি। কোনোকিছু না ভেবেই নিজের জীবনটাকে হুমকির মুখে নিয়ে যাচ্ছিলে তুমি। ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় বেঁছে গেছ। ওটা কখনোই তোমার মায়ের লাশ হতে পারে না ফারাবী।’

- কেন হতে পারে না? আমি তো নিশ্চিত ওটা আমার মায়ের লাশ।

- কক্ষনো না। মায়ের মৃত্যুতে সাধারণ জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছ তুমি। তোমার বুঝা উচিত ছিল, মৃত্যুর দুই এক ঘন্টা পেরিয়ে যেতেই কারোর শরীর থেকে পঁচে যাওয়ার গন্ধ বের হয় না। তুমি কী দেখনি, তোমার মায়ের কাটা মাথাটা থেকে অনেক রক্ত পড়ছিল। এর মানে হলো, তোমার মা'কে দুই একদিন আগে খুন করা হয়নি, বরং দুই এক ঘন্টা আগে, কিংবা আরো কম সময়ের মধ্যেই খুন করে হয়েছে৷ এরপর মাথাটা আমাদের বাড়িতে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ফারাবী অবাক কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে কী ওটা আমার মায়ের লাশ নয়?’

- না। ওটা অন্য কারোর লাশ। এত তাড়াতাড়ি তোমার মায়ের লাশ থেকে অত দুর্গন্ধ বের হবে না।

- তাহলে ওটা কার লাশ? আর মায়ের লাশ কোথায়?

- বোকার মতো প্রশ্ন করছ ফারাবী। আমি কীভাবে জানবো ওটা কার লাশ? ওরা সন্ত্রাসী। নিজের স্বার্থের জন্য অনেককেই খুন করে ওরা। আর তোমার মায়ের লাশ কোথায় সেটাই বা কীভাবে জানবো আমি? আমি তো আর তোমার মা’কে খুন করিনি।

- কিছুক্ষণ আগেও এটাই মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু এখন আমার ভাবনা পাল্টে গেছে৷ তোমার দিকে আমার সন্দেহের তীর কয়েকগুণ গতিতে ছুটে যাচ্ছে বাবা।

- তুমি একজন সাইকো উকিল ফারাবী। তোমার ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন।

- যে এত নিখুঁতভাবে একজন উকিলের ভুল ধরতে পারে। সে নিখুঁত পরিকল্পনা করে আমাকে মাকে-ও খুন করতে পারে।

মিস্টার আহসান বললেন, ‘বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না।’

কলিংবেলের শব্দ শুনে ফারাবী কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। মিস্টার আহসান অবাক কণ্ঠে বললেন, ‘এইসময় কে এলো?’

- পুলিশ।

মিস্টার আহসান হতভম্ব হয়ে গেল ফারাবীর কথা শুনে। ফারাবী বলল, ‘ভেবেছিলাম মায়ের লাশসহ মায়ের খুনিদের পেয়ে গেছি আমি। তাই পুলিশদের বাড়িতে আসতে বলেছি। আর এটাও বলেছি মায়ের কাটা মাথাটা তোমার কাছে আছে।’

- এটা কী করলে তুমি?

- মায়ের হত্যাকারীর শাস্তি চাই আমি।

- এখন তো আমি ফেঁসে যাবো।

- তুমি খুন না করলে তুমি ফাঁসবে না কখনোই। সবটা পরিষ্কার করে বলল । এরপর আমি ওই মাফিয়ার বাড়িতে নিয়ে যাবো ওদের। হতেও পারে, মাকে অনেক্ষণ আগে খুন করে বিকেলে মাথা কেটেছে ওরা। তাই মাথা দিয়ে ওভাবে রক্ত পড়ছিল। পুলিশকে সাথে নিয়ে ওই বাড়িতে যাবো আমি। হাতেনাতে মায়ের লাশসহ খুনিদের ধরব।

- পুলিশ যে তোমার ‘হতেও পারে’ কথাতে বিশ্বাস করবে না, এটা আমার থেকেও তুমি খুব ভালো করে জানো। ওই মাফিয়া সাধারণ কেউ না সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। নামি-দামি ব্যক্তিসগ প্রধানমন্ত্রীর সাথেও ওদের কানেকশন আছে। কোনো শক্ত প্রমাণ ছাড়া পুলিশ ওখানে যাবে না৷ এতে ওদের চাকরি চলে না গেলেও ওরা অনেক সমস্যায় পড়ে যাবে। আর ওরা তোমার মতো বোকামি করবে না কখনোই।

- তাহলে এখন কী হবে?

- কী আর হবে? এখন আমাকেই জেল খাটতে হবে, যতদিন না তোমার মায়ের খুনের রহস্য সমাধান হয়। তবে আমার এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে, তুমি আমাকে সন্দেহ করছ।

- মায়ের এইরকম মৃত্যুতে আমি খুবই আতঙ্কিত বাবা। তার উপর কিছুক্ষণ আগে আমি যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছিল তুমি না, ওই মাফিয়াই মা'কে খুন করেছে। কিন্তু এখন তোমার কথা শুনে আমার মনে হলো, তুমি মা'কে খুন করেছ। আসলে আমি বুঝতে পারছি না কিছুই। আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

ঘনঘন কলিংবেল বাজছে। তাই মিস্টার আহসান চলে গেল দরজা খুলে দিতে।

ফারাবী নিজের মনে মনে বলল, ‘এখন কী করব আমি? সবকিছু ভেবেচিন্তে সন্দেহের তীরটা বাবার দিকেই যাচ্ছে। একজন আইনজীবী হয়ে মায়ের হত্যাকারীর শাস্তির ব্যবস্থা করব, নাকি একজন সন্তান হয়ে বাবাকে রক্ষা করব।’

(চলবে....)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড