মুয়াজ বিন আলী
অরণী, অরণী উঠো, আর কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবে! অনেক বেলা হয়ে গেছে। উঠোওও অরণী। অরণীকে ডাকতে ডাকতে তার রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় অরণ্য। সূর্যের আলো অরণীর চোখে-মুখে এসে পড়লেই ঘুম ভেঙে যায় তার। এভাবেই প্রতিদিন সকালে অরণীর ঘুম ভাঙায় অরণ্য। পৃথিবী থেকে ৭.৮ কোটি কিলোমিটার দূরে থাকা এই মঙ্গল গ্রহের সূর্য এর আলো মুখে পড়তেই শুরু হয় অরণীর সকাল।
অরণ্য হচ্ছে অরণীর পার্সোনাল রোবট। ছোটবেলা থেকেই অরণ্যের সাথেই হেসে খেলে বড় হয়েছে সে। এই মঙ্গলে অরণ্য ছাড়া তার আর কোন খেলার সাথী নেই। মহাকাশচারী ড. ইকবাল অরনীর জন্মের সাত দিন পরেই তার জন্য এই রোবট তৈরি করেন,অরণীকে দেখভাল করার উদ্দেশ্যে। অরণীর নাম এর সাথে মিল রেখে রোবটটির নামকরণ করেন অরণ্য। অরণীর চেয়ে ৭দিনের ছোট হলে কি বা হবে, অরণ্য তো একটা রোবট। তার কপোট্রনের সাদা ডিস্কে আগে থেকেই সব ইন্সটল করে দিয়েছেন ড.ইকবাল। পৃথিবী সম্পর্কে, মানুষের আচার আচরণ সম্পর্কে, মানব প্রকৃতি সম্পর্কেপ্রায় সব তথ্যই সেভ আছে সেই ডিস্কে। ড. ইকবাল এই তথ্যগুলো অরণ্যের ডিস্কে সেভ করেছিলেন যাতে সে অরনীকে ঠিকমত বুঝতে পারে, অরণীর জ্ঞান বুদ্ধির যেন সুষ্ঠু বিকাশ ঘটে। ছোটবেলা থেকেই অরণীর শিক্ষক, বন্ধু,বাবা-মা সবকিছুই এই রোবট।
অরণীর মা মিসেস তানিশা যখন দুই মাসের প্রেগনেন্ট,তখন নাসা স্পেস এজেন্সি থেকে তার কাছে মঙ্গল এ যাওয়ার অফার আসে। মিসেস তানিশার নেতৃত্বে ৭ জনের মহাকাশচারী টিমকে একটি মিশনে মঙ্গলে পাঠানো হয়। মিসেস তানিশা তার প্রেগমেন্সির বিষয় টা গোপন রেখেছিলেন ইচ্ছা করেই, কারণ উনার এটাই ইচ্ছা ছিল যে উনার সন্তান মঙ্গলের বুকেই ভূমিষ্ঠ হোক। নাসা যখন উনার প্রেগমেন্সির বিষয়টা জানতে পারে তখন উনাকে পৃথিবীতে এনেই নবজাতকটির নিরাপদ ডেলিভারি করাবে কিনা সেই নিয়ে দুই পক্ষে তর্কাতর্কি শুরু হয়। এক পক্ষের মতামত এরকম যে, ‘বাচ্চাটা মানবশিশু, গিনিপিগ না যে তাকে দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করাব।’ আরেক পক্ষের মতামত অনেকটা এমন যে, ‘মঙ্গলে ভবিষ্যতে মানুষ থাকতে পারবে কিনা,সেটা নিয়ে গবেষণা করার জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগ আর পাওয়া যাবে না,সেজন্য মিসেস তানিশার বেবি মঙ্গলেই ডেলিভারি হোক।’ অবশেষে উনার বেবি মঙ্গলেই ডেলিভারি করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হল। বাচ্চাটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় উপস্থিত হল। মহাকাশচারী প্রফেসর ডা.ক্লিওপেট্রোর নেতৃত্বে বেবি ডেলিভারির সিদ্ধান্ত গ্রহণ হল। মিসেস তানিশার মনোবাসনা পূরণ হল ঠিকই। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে একটু হাসলেন উনি। আনন্দে আত্মহারা উনি। কিন্তু উনার সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। হঠাৎ ই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় উনার। নিঃশ্বাস নিতেই পারছিলেন না। অক্সিজেন মাক্স পরিয়েও কোন লাভ হল না। মিসেস তানিশাকে আর বাঁচানো গেল না। বাচ্চাটি মঙ্গলের বুকে সেফ হাউজেই বড় হতে থাকল।
কেটে যায় তেরটি বছর। অরণী জানে যে তাকে জন্ম দিতে যেয়েই তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তার মায়ের সম্পর্কে সব তথ্যই সে পায় অরণ্যর কাছে থেকে। অরণ্যের মেমরিতে ড.ইকবাল এই তথ্যগুলো সেভ করে রেখেছিলেন। কিন্তু অরণী তার বাবা সম্পর্কে কোন তথ্যই জানে না, ওর বাবা সম্পর্কে কেউ ই কিছু বলতে পারে না। কিন্তু যে করেই হোক,অরণী তার বাবাকে খুঁজে বের করবেই বলে মনে মনে শপথ করল। অরণ্যের কাছ থেকে সে তার মায়ের ল্যাপটপ এর পাসওয়ার্ড নিল। ল্যাপটপ এ সেভ করে রাখা ‘ফটো’ ফোল্ডারে ঢুকে সে তার মায়ের ছবিগুলো ঘাটতে যেয়ে সে দেখল যে একজন যুবকের সাথে তার মায়ের অনেক ছবি। ধারণা করে নিল এই লোকটাই হয়ত ওর বাবা। তার মায়ের সাথে যুবকটির অনেকগুলো ছবি ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস’ এর সামনে তোলা। তাই সে ধারণা করে নিল যে এই ভার্সিটিতেই তার বাবা মা পড়েছে হয়ত। ভার্সিটির স্টুডেন্টস রেকর্ড ফাইল ঘাটলেই সে তার বাবার ঠিকানা পেতে পারে। মহাকাশচারী ড.ইকবাল কে সে জোর করল অনেক যাতে তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। অবশেষে তাকে পৃথিবীতে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীর প্রেসার গ্রেডিয়েন্ট আর প্যাথোলোজিকাল কন্ডিশনে সে সাথে সাথেও খাপ খাওয়াতে পারবে না বলে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে কয়েক মাস রেখে এরপর ট্রেইনিং এর মাধ্যমে পৃথিবীতে বসবাসের উপযোগী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
অরণী পৃথিবী তে আসল। ওর সাথে ড.ইকবালকেও পৃথিবীতে নিয়ে আসা হল। পূর্ব পরিকল্পনা মত তার জন্য সব ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু অরণীর আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না। বাবাকে খোঁজার জন্য সে অস্থির। সিকিউরিটি গার্ড এর চোখ ফাঁকি দিয়ে সে একাই রাস্তায় চলে আসল। পকেটে মায়ের সাথে এক ছবিতে থাকা সেই যুবকের ছবি। রাস্তায় অনেক লোককেই সে জিজ্ঞাসা করল, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস টা কোথায়? পকেটে থাকা ছবিটি বের করে বলে এই লোককে কি চিনেন? সে ঠিকমত রাস্তাটাও পার হতে শিখেনি এখনো। রাস্তার সিগনাল সম্পর্কেও কোন ধারণা তার নেই। এক পর্যায়ে দৌঁড়িয়ে রাস্তা পার হতে যেয়ে গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে সে। পথচারীরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নেয়।
ইতোমধ্যে সব রকম নিউস চ্যানেলে অরণীর নিখোঁজ এর ব্যাপারে হেডলাইন দেয়া শুরু করে দিয়েছে। অরণীর ছবি পরদিন পত্রিকাতেও প্রকাশ পেল। সেই সঙ্গে তার মঙগল গ্রহ থেকে আসার কাহিনীও। পত্রিকায় ছবি দেখেই ডিউটি ডক্টর ফেস সনাক্ত করল যে এই মেয়েটিই অরণী। পত্রিকার নিচে থাকা ড.ইকবাল এর ই-মেইল এ সে অরণীকে পাওয়া গিয়েছে বলে মেইল করে দিল।
অন্যদিকে অরণীর সেই সব নিউজ চা খেতে খেতে পড়ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী ড.অনুপম। পত্রিকায় তিনি জানলেন যে, অরণীর মা একজন মহাকাশচারী এবং উনার নাম তানিশা। খবরটি পড়ে অনুপম সাহেবের হাত কাঁপতে শুরু করল। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তিনি তো ভেবেছিলেন মিসেস তানিশা আর বেঁচে নেই। ১৩ বছর আগে মিসেস তানিশা যখন মঙ্গলে যাবার অফার পায়,তখন তিনি দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। আর উনি তার সন্তানকে মঙ্গল এই ভূমিষ্ঠ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সন্তানের বাবা হিসেবে অনুপম সাহেব এই প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এসব পাগলামির কোন মানে হয় না, তাদের সন্তান পৃথিবীতেই সুস্থভাবে ডেলিভারি হবে’। কিন্তু মিসেস তানিশা তো নাছোড়বান্দা। তিনি তার সিদ্ধান্তেই অটল। স্বামীর সাথে কথা কাটাকাটি করেই তিনি মঙ্গল গ্রহে মিশনে চলে গিয়েছিলেন। স্ত্রীর এমন আচরণ এ অনুপম সাহেব যথেষ্ট রাগান্বিত হয়েছিলেন। তাই তিনি উনার খবর রাখার আর কোন প্রয়োজন মনে করেননি এবং ধরেই নিয়েছিলেন যে, বাচ্চাটি বাঁচবেনা।
এত বছর পর যখন তিনি জানতে পারলেন,অরণী তার মেয়ে আর সে এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি,তিনি বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে মিসেস তানিশার কলিগ ড.ইকবাল কে ফোন করলেন এবং সব খুলে বললেন। অরণী যেই হাসপাতালে ভর্তি ড.ইকবাল উনাকে সেই হাসপাতালের ঠিকানা দিলেন। অনুপম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে সেই হাসপাতালে অরণীর কেবিনে চলে গেলেন। অরণীর তখনো জ্ঞান ফিরেনি। মেয়েকে দেখে অনুপম সাহেব চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। অরণীর চুলে হাত বুলিয়েই যাচ্ছেন আর কেঁদেই যাচ্ছেন। প্রায় ২ ঘণ্টা পর অরণীর জ্ঞান ফিরল। চোখ খুঁলে সে দেখতে পেল একজন মধ্যবয়স্ক লোক তার বেড এর সামনে চেয়ারে বসে কাঁদছে। ঠিক তখনই একজন নার্স আসলেন আর অরণীর প্যান্টের পকেটে থাকা সেই লোকের ছবিটি তাকে ফেরত দিলেন। অরণী একদম অবাক। নিজেকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এই ছবির লোকটির সাথে সামনে বসে থাকা মানুষটির পুরো মিল। নিজের অজান্তেই বাবার কোলে মাথা রেখে দুই হাত ধরে বাবাকে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করে সে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড