রোকেয়া আশা
আমার একেকটা বিকেলে খুব দেশের কথা মনে পড়ে। আমার মনে হয়, কয়েক সহস্র বছর পার হয়ে গেছে এই ঝলমলে শহরে পা রাখার। কয়েক কোটি বছর ধরে আমি ধূলোয় জমা একটি জনাকীর্ণ শহরের মায়াবী মেঘময় আকাশ দেখি না। যেই শহরের মানুষ শরত এলে শহরের প্রান্তে ছুটে যায় কাশফুল দেখতে। শিকাগোতে কাশফুল নেই। এখানে শরত আর হেমন্ত একই। ওরা যাকে বলে অটাম। আমার অফিসে খুব চাপ যাচ্ছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। আমি এখানে এসেছি চৌদ্দ বছর আগে।
এসেছিলাম মূলত পড়াশুনা করতে। যদিও, তখনই আমার উদ্দেশ্য ছিলো এখানে থেকে যাওয়ার। না, একটি উন্নত রাষ্ট্রের কসমোপলিটান চাকচিক্যের মোহে না। আমি এখানে থেকে যেতে চেয়েছিলাম কারণ - কারণ আমি দেশে ফিরতে চাইনি। সেই দেশে আমি ফিরতে চাইনি, যেখানে ফিরলে আমার একুশ বছর বয়সে পড়া প্রেমের স্মৃতিগুলো আমাকে পোড়াতে শুরু করবে। এই পালিয়ে থেকে পোড়ানো হয়তো বন্ধ হয়নি। কিন্তু, এখানে অন্তত কেউ আমাকে বিয়ে থা না করে বোহেমিয়ান জীবন কাটানো নিয়ে প্রশ্নও তোলে না।
মায়ের সাথে কথা হয় মাঝেমধ্যে ; আব্বুর সাথেও। ফোনে, ভিডিও কলে। একটা সময় পর্যন্ত অভিযোগই বেশি করতো। কেন দেশে ফিরছি না, এতগুলো বছরে একটাবারও কেন দেশে যাইনি। জানাতো, আত্মীয়তা ফিসফাস করছে। মেয়ে বিয়ে না করেই বিদেশে এতদিন ধরে একা আছে বলে। আজকাল আর অভিযোগও করে না। শুধু প্রতিবারই হাহাকার, সন্তানকে ঘরে ফেরানোর। একটাবার যেন বাড়িতে যাই, সেই অনুযোগ। আমি সেসব কথা বাড়তে দিতে চাই না। ফোনে খোঁজ নিই বাড়ির। স্মরণ, আমার ভাইটা এরমধ্যে বিয়ে করেছে। দুটো ফুটফুটে বাচ্চা আছে। দুটোই মেয়ে। ভিডিও কলে কি মিষ্টি করে ফুপি বলে ডাকে আমায়। এত মিষ্টি করে কোন শিশু আমাকে ‘মা’ ডাকে না। এক মানবের ওপর তীব্র অভিমান থেকে আমি স্বেচ্ছা নির্বাসনে বহুকাল ধরে। না, আমি আর ফিরবো না।
আমার কনসাল্টেন্সি ফার্মটা থেকে বের হয়ে অফিসের পার্কিং লটে চলে যাই সোজা। আমার ভক্সওয়াগনটায় চড়ে বসে ইগনিশন কিতে মোচড় দিই। অনেকটা পথ ড্রাইভ করতে হবে। আমার নিজস্ব বাড়িটা শহরের একদম শেষ মাথায়। তেরো বছরের অবর্ণনীয় কৃচ্ছ্রসাধনের পর দু’বছর আগে আমি শেষ পর্যন্ত নিজের একটা বাড়ি কিনতে পেরেছি। হোক ছোট, হোক তা শহরের শেষ প্রান্তে; তবুও তা একান্তই আমার। আমার নিজের একটা বাড়ি।
কাঠের ছাদওয়ালা দোতলা ছোট্ট এরকম একটা বাড়িতে আমার উজানের সাথে সংসার করার স্বপ্ন ছিলো। সেসব স্বপ্ন যদিও ষোল বছর আগেই পেছনে ফেলে এসেছি আমি। উজানের সাথে সম্পর্কের সময়টায় আমি একুশ বছরের তরুণী। অবশ্য আমার ছেলেমানুষী আচরণে ও প্রায়ই বলতো, ‘তুই মিথ্যেমিথ্যি বলিস তোর বয়স একুশ। আসলে তোর বয়স ষোল। তুই একটা বাচ্চা মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে, বাচ্চা মেয়ে।’
ওর কথা ভীষণ মনে পড়ে আমার। এখনো। আমার ঘ্রাণ পাওয়ার প্রথম মানুষ। উজানকে কখনোই আমার বলা হয়ে ওঠে নি, পৃথিবীতে ওই একমাত্র মানুষ; যার গায়ের গন্ধ আমি পাই। আর কারও গন্ধ আমি পাইনি কখনো। মায়েরও না। উজানকে প্রতিবার স্পর্শ করার পর আমার মনে হতো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ওর একান্ত শুকনো হলুদের মত ঘ্রাণটা আমায় ঘিরে আছে। আমার সেই তীব্র ষোড়শী প্রেম একদিন আমাকে ফেলে চলে গেলো।
কতবার ফেরানোর চেষ্টা করেছি, হিসেব নেই। এরপর একটা টেক্সটেই ও স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, ও আমার সাথে আর কথা বলতে চায় না। আমার লাগাতার ফোন কলে বিরক্ত হয়ে ব্লক করে দেয়া। আজও বুঝতে পেরে উঠিনি, সম্পর্কে ভাঙন কেন আসে। কিছু মতের অমিল হলেই সব ভেঙে দিতে হয়- তা মানতে পারি না।
আমি যখন বাড়িতে পৌঁছাই তখন সূর্যটা পশ্চিমে। সন্ধ্যা নামার আগের রোদ ছড়িয়ে পড়ছে। আমি গাড়িটা পার্ক করে অভ্যাস বশে লেটার বক্সটা চেক করি। যদিও চিঠি আসার কথা না এই মাসে। তবুও লেটার বক্সে হাত দিই। ভেতরে একটা খামের অস্তিত্ব টের পেতেই জমে যাই আমি। বক্সটার ভেতর থেকে সদ্য রোদে শুকোতে দেয়া হলুদের ঘ্রাণ পাচ্ছি আমি। এটার মানে জানি আমি। এই ঘ্রাণটার বাস্তবে অস্তিত্ব হয়তো নেই, কিন্তু এটুকুই জানান দিচ্ছে; আমি খামের ওপরের লেখা না পড়েও বলে দিতে পারি। ষোল বছর পর এই সুপ্রিয় ঘ্রাণটুকুর অর্থ হচ্ছে, উজানের স্পর্শ।
চিঠির খামটা হাতে নিতেই দেখি আমার ধারণা ঠিক। চিঠির প্রেরকের নামের জায়গায় ছোট ছোট ইংরেজি হরফে লেখা একটি নাম। রাহিল ইসলাম। উজানের পোশাকি নাম। উজান বলে খুব কম মানুষই ডাকতো তাকে। আমি খামটা খুলে ওখানে দাঁড়িয়েই চিঠিটা বের করি। হাত কাঁপছে ভীষণ। চিঠিটাও ঝাপসা লাগছে, চোখে কি পানি জমছে আমার? অথচ আমি ভেবেছিলাম আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। ওর হাতের লেখা দেখছি বহুবছর পরে।
ছোট্ট একটা চিঠি। ‘তুই নিজেও তারপর হুট করেই হারিয়ে গেলি। আমি তখনও তোকে খুঁজিনি। মনে হতো প্রেম আমার জন্য না। মনে হতো তোর প্রতি টানটা অন্যরকম হলেও প্রেম না। তোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার পরের দুটো বছর তারপরও বহুবার তোকে মনে পড়েছে।
শেষ পর্যন্ত যখন মনে হলো, বাচ্চা মেয়েটার সাথে দীঘির ধারে বসে গল্প করেও শুধু একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যেতো, তখন তুই হারিয়ে গেছিস। হোক। খোঁজ যখন পেয়েছি এতবছর পর তখন তোকে কনভিন্স করার দায়িত্ব আমার। তেইশ তারিখে শিকাগোতে আসছি। দেখা হবে। আবার পালানোর চেষ্টা করলে খুন করে রেখে দেবো। নীতু, নীতু, নীতু - তুই ভালো আছিস?’
আমি ফোন হাতে নিয়ে চেক করে দেখি। আজকেই তো তেইশ তারিখ। বাড়ি পর্যন্ত চিঠি এসেছে মানে ও বাড়ির ঠিকানা জানে। কিভাবে খোঁজ পেলো সেসব ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ও কি সত্যিই আসছে? এত বছর পরে? আমার মধ্যবয়স শুরুর আগবেলায় তাই বলে? উফফ্! এই বোকা চোখ দু’টোকে নিয়ে কি করবো আমি!
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড