• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘মায়াবতী’-এর ষষ্ঠ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : মায়াবতী

  রিফাত হোসেন

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৯:১১
গল্প
ছবি : প্রতীকী

আজ মায়ার বিয়ে। অপরিচিত একজনের সাথে। পরিবারের সবাইসহ মায়াও বেশ খুশি। সেদিন অরিনের বাবা নিশুর ঘরে এই জন্যই গিয়েছিলেন যে, তার পছন্দ করা ঢাকার একটা ছেলের সাথে মায়ার বিয়ে দিতে চায় তিনি। মায়া অরিনের বাবার মুখে এই কথাটা শুনে যেন থমকে গিয়েছিল। একদম স্তব্ধ হয়ে গেয়েছিলও। মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হয়নি ওর। অরিনের বাবা আবারও বলেছিল, ‘ছেলেটা খুব ভালো। শিক্ষিত ছেলে। ভালো চাকরি করে। এছাড়াও মায়াকে খুব পছন্দ হয়েছে ওর।’

মায়া তখন রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘আমি বিয়ে করব না। তাছাড়া তিনি আমাকে দেখেইনি কখনো। আমাকে তিনি পছন্দ করল কীভাবে? বা কোথায়?’

- রেগে যাচ্ছিস কেন মা? আমি তো তোর ভালোর জন্যই বলছিলাম। আসলে, আমিই তোর ছবি ওকে দেখিয়েছিলাম। ও সেখান থেকে তোকে পছন্দ করেছে। আমি না করে দিতে চেয়েছিলাম ওকে। কারণ, আমি জানি তুই এখন বিয়ে করবি না। কিন্তু নিশু যখন বলল, ও ঢাকায় চলে যাবে। তখন তোর কতটা কষ্ট হয়েছিল, তা আমি বুঝতে পেরেছি। সেজন্যই তো ওকে বলেছি আমরা সবাই রাজি। যাতে ওকে বিয়ে করে তুইও ঢাকায় যেতে পারিস। আর নিশুকে সাথে রাখতে পারিস। তখন তোরা দু’জনেই আবার হাসিখুশি থাকতে পারবি।

নিশুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি থাকলেও মায়ার বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওর মনে আছে অজানা এক ভয়। তাই সরাসরি অরিনের বাবাকে বলল, ‘তারা যদি নিশুকে সাথে নিতে রাজি না হয়।’

অরিনের বাবা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘একটু আগেই আমার সাথে কথা হয়েছে। তখন আমি নিশুর কথাটা বলেছি। ওদের কোনো সমস্যা নেই নিশুকে নিয়ে।’

মায়া নিশুর দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। নিশু-ও হেসে দিলো। দু'জনেই হাসছে। অরিনের বাবা তখন বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। এরপর কয়েকটা দিন কেটে যায়। ছেলেটাকে দেখেনি মায়া। তবুও ভালোবেসে ফেলেছে এটা ভেবে, যে ছেলে স্ত্রীর ভাইকে সাথে রাখতেও দ্বিমত পোষণ করে না। সেই ছেলের মন নিশ্চয় ভালো হবে। আর প্রকৃত সৌন্দর্য তো মানুষের মনেই আছে। তার চেহারায় নয়। চেহারা তো ক্ষণিকের সৌন্দর্য। যেটা যেকোনো সময় হারিয়ে যেতে পারে।

এরপর আরো কয়েকদিন কেটে যায়। ওর ভালোবাসার মানুষ (সায়েমের) কথা মনে পড়লেও নিশু আর নতুন জীবনের কথা ভেবে ভুলে যায় মায়া।

সেদিন অরিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা মায়া আপু, সেদিন যে ছেলেটা গ্রামে এসেছিল। তাকে তো তুমি ভালোবাসতে। তাহলে তাকে বিয়ে না করে অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করছ কেন তুমি?’

- আমি ওকে ভুলে গেছি অরিন। ও আমার অতীত । আমি নতুন করে বাঁচতে চাই। আর সাথে আমার ভাই-ও থাকবে। এর থেকে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না।

- তুমি নাহয় পরিবারের খুশি আর নিশুর কথা ভেবে বিয়ে করে নিচ্ছ। কিন্তু ওই ছেলেটা! ওর তো এইরকম কোনো পিছুটান নেই। সে তোমাকে কিছু বলছে না? ভালোবাসার দাবি নিয়ে তোমার সামনে আসছে না?

মায়া মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘সারাজীবন পাশে থাকবে বলে আশ্বস্ত করা মানুষটা-ও একদিন হারিয়ে যায়। কখনো সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে। আবার কখনো নদীর স্রোতের সাথে ৷ কখনো-বা লোভী মানুষদের ভিরে।’

অরিন অবাক হয়ে বলল, ‘বুঝতে পারছি না আপু।’

ঘরের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে নিশু বলল, ‘কিছু জিনিস বুঝার চেষ্টা করা-ও সাংঘাতিক অপরাধ।’

অরিন নিশুর দিকে তাকালো। অরিনের দৃষ্টিতে আছে তীক্ষ্ণতা আর রহস্যময় ভাব। নিশু ফিসফিস করে বলল, ‘ আকর্ষণটা এভাবে বাড়ে।’

মুচকি হাসি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অরিন। নিশু আর মায়া-ও হেসে দেয়।

আজ সকাল থেকেই বাড়িতে হুলুস্থুল আয়োজন। অসুস্থ শরীরে হলেও একমাত্র মেয়ের বিয়ে বেশ বড় করেই দিচ্ছেন মায়ার বাবা। গ্রামের কৃষক হলেও আয়োজনের কমতি তিনি রাখছেন না।

এদিকে নিশুর দুই চোখ শুধু অরিনকে আকর্ষণ করছে। নিশু আজ অদ্ভুতভাবে অরিনকে আবিষ্কার করছে। একদম ওর মনের মতো। অরিনের পরনের আকাশী-নীল রঙের জামা, খোলা চুল আর সারা বাড়িতে পায়ের আলতো স্পর্শ নিশুকে বারবার মুগ্ধ করছে। অরিন-ও যেন ইচ্ছে করেই নিশুর কাছাকাছি আসতে চাচ্ছে। শেষ দুপুরের দিকে বর চলে আসবে। তাই বাড়ির সবাই ব্যস্ত। অরিন কোনো একটা কাজে নিজের ঘরের দিকে গেল। কিন্তু ঘরের ভিতরে নিশুকে দেখে দরজার কাছেই থমকে যায় অরিন। হাত-পা কাঁপতে থাকে ওর। নিশু ওর হাত ধরে ভিতরে টেনে নিয়ে এলো। এরপর বিছানায় কাছে গিয়ে অরিনকে নিজের কোলে বসিয়ে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। অরিনের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল কয়েক মুহূর্তেই। ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে ও। নিশু অরিনেকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কৌতূহলী কণ্ঠে বল, ‘সেদিন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন কেন?’

অরিন না বুঝার ভান করে বলল, ‘কোনদিন?’

- যেদিন সকালে আপনি ডাকাডাকি করে আমাকে ঘুম ভাঙালেন। মায়া আপু যখন জানালা খুলে দিচ্ছিল, ঠিক তখকই আপনি আমার মাথায় স্পর্শ করেছিলেন। কিন্তু কেন?

অরিন মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘আমার ইচ্ছে করেছিল তাই।’

নিশু অরিনের ঘাড়ের পিছনে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, ‘আমারও তীব্রভাবে ইচ্ছে করছে।’

- কী?

- চুমু দিতে।

অরিন আবারও মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন।’

শব্দ করে হেসে উঠল নিশু। অরিন মুখ দিয়ে শব্দ করে নিশুকে চুপ করতে বলল। নিশু হাসি থামিয়ে বলল, ‘প্রেমে সফল হতে হলে পাগলামিটা খুব প্রয়োজন। তাহলে কী আমি সফল হয়ে গেছি?’

অরিন সন্দেহজনক হাসি দিয়ে বলল, ‘কীভাবে?’

- এই যে বললেন, আমি পাগল হয়ে গেছি। তাহলে নিশ্চয়ই আমার প্রেমে সফলতা এসেছে।

- কিন্তু, আমি তো প্রেমে বিশ্বাসী নই। আমি তো ভালোবাসায় বিশ্বাসী।

- একই তো হলো।

- উঁহু। আপনি আমার ঠোঁটের প্রেমে পড়তে পারবেন। আপনি আমার চোখের প্রেমে পড়তে পারবেন। আপনি আমার বুক, পেট কিংবা আমার কোমড়ের প্রেমে পড়তে পারবেন। কিন্তু আপনি কখনোই আমার আত্মার প্রেমে পড়তে পারবেন না। কারণ আত্মা অদৃশ্য। আর মানুষ কখনোই অদৃশ্য কিছুর প্রেমে পড়তে পারবে না। মানুষ একে অপরের আত্মাকে ভালোবাসতে পারবে। আমার বুক, পেট কিংবা কোমড়ের সৌন্দর্য একদিন হারিয়ে যাবে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের আকর্ষণ কমে যাবে কোনো একদিন। সেদিন এই প্রেম হারিয়ে যাবে। কিন্তু আত্মা! আত্মা অদৃশ্য। এর সৌন্দর্য আপনাকে আকর্ষণ করতে পারবে না। তাই আত্মার ভালোবাসা শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত থাকবে। এর যৌবনতা কখনোই হারাবে না। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত যেমন আত্মা আমার শরীরে থাকবে, তেমনি আপনার ভালোবাসা-ও আমার প্রতি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত থাকবে।

নিশু অরিনকে ছেড়ে দিলো। অরিন নিশুর কোল থেকে ওঠে দাঁড়াল। এরপর নিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চোখটা বন্ধ করুন একটু।’

নিশু দ্বিমত না করে চোখ দু'টো বন্ধ করে ফেলল। অরিন নিশুর কাছে গেল। নিশুর কপালে নিজের ঠোঁট দিয়ে শীতল স্পর্শ করে বলল, ‘আমি সেদিনের জন্য অপেক্ষা করব, যেদিন আপনি আমার আত্মাকে ভালোবাসতে পারবেন।’

নিশু কিছু না বলে চুপ করেই বসে রইল সেখানে। অরিন নিশুর থেকে কিছুটা দূরে এসে বলল, ‘আপনি এখন বাইরে যান। আমার কিছু কাজ আছে ঘরে।’

নিশু অরিনের দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ঘরে চলে এলো। ও এখন ঘোরের মধ্যে আছে।

বরের গাড়ি খুব কাছাকাছি চলে আসায় বাড়ির সবাই বিয়ের গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সবকিছুর ব্যবস্থা করা আছে। মায়ার বন্ধুরা সহ নিশু আর অরিন দাঁড়িয়ে আছে বরের কাছ থেকে টাকা আদায় করার ধান্দায়। দূর থেকে সবাই দেখছে বরের গাড়ি আসছে। সবার মধ্যেই উত্তেজনা কাজ করছে ঠিক এই মুহূর্তে। বরের গাড়ি সহ আরো কয়েকটা গাড়ি গেইটের কাছে সিরিয়াল করে থামল। ভিতর থেকে প্রথমেই বরের সাজে একজন বেরিয়ে এলো। মায়ার গ্রামের বন্ধুরা সবাই বরকে আটকে দিয়ে বলল, ‘আগে নিয়মকানুন সেড়ে নিন। এরপর আমাদের টাকা দিয়ে ভিতরে যাবেন।’

সবাই যখন এইসব বলছিল, তখন বরের সাজে থাকা লোকটা হুংকার দিয়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছু থমকে গেল। ঘাবড়ে গেল উপস্থিত সবাই। লোকটা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। এরপর হনহনিয়ে ভিতরে চলে গেল। সাথে বরযাত্রীরা। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল সবাই। অরিন আর নিশু, একে অপরের দিকে একবার তাকিয়েই বাড়ির ভিতরের দিকে দৌড় দিলো। লোকটা ভিতরে গিয়ে এদিক-ওদিক কী যেন খুঁজতে লাগল। ‘হা’ করে সবাই তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। লোকটা হঠাৎ মধ্যবয়সী একটা লোকের কলার চেপে ধরে বলল, ‘মায়া কোথায়?’

লোকটা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘ভিতরের ঘরে আছে।’

মধ্যবয়সী লোকটার কলার ছেড়ে দিয়ে এবার রেগেমেগে ভিতরের ঘরে গেল লোকটা। মায়া তখন ভিতরের ঘরে চুপচাপ বসে ছিল। চোখেমুখে ছিল দুশ্চিন্তার ছাপ। কারণ বাইরের কোলাহল ও স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। লোকটা কোনো কথা না বলে মায়ার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো। নিশু আর অরিন "হা" করে তাকিয়ে আছে। ওরা এখনো বুঝতে পারছে না কী হতে চলেছে? মায়াকে টেনে নিয়ে আসছে দেখে এগিয়ে এলো মায়ার বাবা এবং অরিনের বাবা। তারা দু'জন লোকটার দিকে এগিয়ে এসে হাত জোড় করে বলল, ‘কী হয়েছে বাবা? তুমি এইরকম করছ কেন? আর মায়াকে এভাবে টেনে নিয়ে এলে কেন?’

লোকটা মায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে হুংকার করে বলল, ‘ওকে সার্কাস দেখাতে নিয়ে এসেছি এখানে। কারণ এখন আমি সার্কাস দেখানো শুরু করব। আপনারা আমার সাথে ফাজলামি শুরু করেছেন।’

মায়ার বাবা বলল, ‘এইসব কী বলছ তুমি?’

- নেহাৎ আপনার অবস্থা খারাপ। নাহলে আপনার এই মিথ্যেবাদী মুখটা ঘুষি মেরে ভেঙে দিতাম আমি। যত্তসব ফালতু লোকজন। নিজের মেয়েকে একজনের সাথে নষ্টামি করতে দিয়ে, আরেকজনের সাথে বিয়ে দিতে লজ্জা করে না আপনার? আমার জীবনটা শেষ করে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?

- আমি তোমার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না বাবা। আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলবা কী হয়েছে?

- ভাগ্য ভালো ছিল। তাই বিয়ের আগেই আপনার মেয়ের কূ-কর্মের কথা জানতে পেরেছি আমি। নাহলে সারাজীবন আফসোস করতে হতো আমাকে। রাতেরবেলা মেয়েকে ফুরতি করতে পাঠাবেন। আর দিনেরবেলা বড়লোক এক ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবেন। ভেবেছিলেন সেইসব কেউ জানবেই না।

মায়া এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার মুখ খলল। লোকটার দিকে তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বলল - " আপনি আমাকে বিয়ে করুন বা না করুন। এতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু আমার অসুস্থ বাবাকে অপমান করলে আমি আপনাকে ছাড়ব না। আপনার এইসব কথা শুনে আমারা বাবার কিছু হয়ে গেলে আপনাকে জেলে দিবো আমি।"

মায়ার দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, ‘তোর মতো নষ্টা মেয়ের মুখে এইসব মানায় না। ঝড়-বৃষ্টির রাতে নির্জন স্থানে বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ফুরতি করতে যাস।’

- আপনি এইসব কোত্থেকে শুনেছেন আমি জানি না। হয়তো আমার গ্রামেরই কেউ বলেছে এইসব। তবে তার বলা সব কথা সত্যি নয়৷ আমি ওর সাথে শুধুমাত্র কথা বলতে গিয়েছিলাম। নষ্টামি করতে নয়। আর ঝড় তো পরে এসেছে।

লোকটা হো হো করে হেসে দিয়ে বলল, ‘সবাই তোদের নষ্টামি দেখেছে। গ্রামের লোকজন আসার সময় তোদের যেই অবস্থায় দেখেছে, না জানি তারা আসার আগে আরো কী কী করেছিস তোরা। ছি:! তোর এই সস্তায় বিলীয়ে দেওয়া শরীরটা নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে লজ্জা করবে না।’

নিশু লোকটার দিকে এগিয়ে এসে বল, ‘আমার আপুর সাথে ভদ্রভাবে কথা বলুন।’

- যেই মেয়ে দুই বছর বাড়ির বাইরে ছিল, সেই মেয়ের সাথে আর যাই হোক, ভদ্রভাবে কথা বলা যায় না।

মায়া বলল, ‘আমি আমার ভাইয়ের সাথে ছিলাম দুই বছর।’

লোকটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘রক্তের ভাই ব্যতীত অন্য সব ভাই'ই মাঝ রাতে বেড পার্টনার হয়ে যায়। এইসব অনেক দেখেছি আমি। দিনের বেলা সবার কাছে ভাই-বোন বলে পরিচয় দিয়ে রাতেরবেলা বিছানার ফুরতি করার ধান্দায় থাকে এরা।’

মায়া লোকটার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আল্লাহর কাছে অসংখ্য বার শুকরিয়া আদায় করছি এটা ভেবে যে, তিনি আপনার মতো নীচু মানসিকতার একজনের সাথে আমার বিয়ে হতে দিচ্ছেন না। সেই সাথে তাকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি, যে আমার সম্পর্কে আপনাকে এইসব কথা বলেছে। নাহলে আপনার এই নোংরা মানসিকতার রূপটা আমার সামনে আসতো না।’

লোকটা মায়াকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তবুও তোর মতো নিজের শরীর বিলিয়ে বেড়াই না আমি। আমার কিছু বন্ধু আছে। যারা ফ্রিতে নয়। মোটা অংকের টাকা দিয়ে তোর শরীর ভোগ করবে। তোর ঠিকানাটা দিয়ে দিবো আমি। যতক্ষণ ইচ্ছে ফুরতি করিস ওদের সাথে।’

মায়ার বাবা আর সহ্য করতে পারল না। বুক চেপে ধরে পড়ে গেলেন তিনি। নিশু হঠাৎ পাশে থাকা একটা ইট হাতে নিলো। কেউ কিছু বুঝার উঠার আগেই লোকটার মাথায় নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করল। লোকটা ভয়ঙ্কর এক আর্তচিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে স্তব্ধ হয়ে গেল। সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সবাই। কিছু মুহূর্তের জন্য আশেপাশের সবকিছু থমকে গেল। মায়া নিশুর কাছে গিয়ে নিশুকে আকড়ে ধরে বলল, ‘এটা কী করলি ভাই?’

নিশুর মাথায় রক্ত চলাচল করছে বিদ্যুতের গতিতে। ওর শরীর কাঁপছে। ও নিজেও বুঝতে পারছে না জ্ঞানহীন মানুষের মতো কী করে ফেলল। কান্নায় ভেঙে পড়ল বরযাত্রীর লোকজন। মায়া যতটা পারছে আঁকড়ে ধরে রেখেছে নিশুকে। ভয়ে ঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে নিশুর। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল। কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। গলগল করে রক্ত পড়ছে লোকটার মাথা থেকে।

- এরপর কী হয়েছিল?

জেলার সাহেবের দিকে তাকালো নিশু। সেদিনের মতো আজও কাঁপছে ওর পুরো শরীর। পাশে থাকা কয়েদি ওর দিকে পানি এগিয়ে দিলো। ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলল নিশু৷ কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, ‘খুব ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। মায়া আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। মায়া আপুও আমাকে ধরে রেখেছিল। তিনি বুঝতে পারছিল আমি খুব ভয় পাচ্ছি। সেখানেই গ্রামের একজন ডাক্তার উপস্থিত ছিল। সে লোকটাকে দেখে বলল, তিনি মারা গেছেন। সবার মাঝেই তখন একটা আতঙ্ক বিরাজ করছিল। মায়া আপু কাঁদছিল আমার ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা চিন্তা করে। আসলে ওই লোকটার মুখে মায়া আপুকে নিয়ে কুৎসিত কথাগুলো আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই কোনোকিছু না ভেবেই সামনে থাকা জিনিসটা দিয়ে লোকটার মুখটা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে চলে এলো। গাড়িতে উঠার সময় আমি দু'জনের চোখে জল দেখেছিলাম। এক হলো মায়া আপু, আরেক হলো অরিন। অরিন মায়া আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। প্রিয় মানুষ দু'জনের চোখের জল আমার হৃদপিণ্ডকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল তখন। ইচ্ছে করছিল দৌড়ে ওদের কাছে চলে যাই। এরপর নিজের হাতে ওদের চোখের জল মুছিয়ে দিই। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। আমাকে থানায় নিয়ে আসা হলো। এর ক’দিন পর কোর্টে নেওয়া হলো আমাকে। আমি নিজেই সব দোষ স্বীকার করলাম। আমার জেল হয়ে গেল চার বছর।’

- মায়া বা অরিন, কেউই কী কোর্টে আসেনি সেদিন?

- কাউকেই দেখিনি আমি। আমার দৃষ্টি ছিল তখন অস্পষ্ট। চোখ বেয়ে অজস্র জল বয়ে যাচ্ছিল। আশেপাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে পরিচিত কেউ কথা বলেনি আমার সাথে। এরপর আমাকে এখানে নিয়ে আসা হলো।

- এই চার বছরের মধ্যে কেউই তোর সাথে দেখা করতে আসেনি নিশু।

জেলার সাহেবের দিকে তাকালো নিশু। মৃদু হাসি দিয়ে শরীরটা শক্ত মেঝেতে এলিয়ে দিলো। জেলার সাহেব নিজের চোখ দু’টো মুছে চলে গেলেন সেখান থেকে। বাকি সময় কয়েদিরা আর চোখ বন্ধ করতে পারল না। সবাই স্তব্ধ। আজও সবকিছু কেমন যেন থমকে গিয়েছে। তবে সেদিনের মতো আজ কাঁদছে না নিশু। পাগলের মতো মৃদু হাসি দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। পাশের কয়েদি নিশুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হাসছ কেন এভাবে?’

নিশু আবারও মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘কিছু রহস্য থাকা ভালো। এতে আকর্ষণ বাড়ে।’

নিশুর কথাটা শুনে সবার বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু নিশু সেভাবেই হেসে যাচ্ছে। বুকের ভিতর চাপা কষ্ট নিয়ে রাতটা পাড় করল কয়েদিরাসহ জেলার সাহেব।

(চলবে...)

‘মায়াবতী’-এর ৫ম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মায়াবতী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড