• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘মায়াবতী’-এর পঞ্চম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : মায়াবতী

  রিফাত হোসেন

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:৫৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

পরেরদিন আবারও দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল নিশুর। বিছানা থেকে ওঠে দরজার কাছে গেল। আশ্চর্য! দরজাটা বাইরে থেকে লাগানো কেন?

ঘুমন্ত কণ্ঠে হাই তুলতে তুলতে কথাটা বলল নিশু। কিন্তু পরক্ষণেই কাল রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল। কাল রাতে মায়ার সাথে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। ও ঘুমিয়ে পড়ার পর নিশ্চয় মায়া দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আবারও বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল নিশু। আগে কখনোই গ্রামে আসেনি ও। তাই ও জানে না গ্রামের পরিবেশ, গ্রামের মানুষজন কেমন। এমনকি গ্রামের বিছানা সম্পর্কে-ও কোনো ধারণা ছিল না ওর। তবে এই বিছানায় শুয়ে ও এইটুকু বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে, গ্রাম হোক আর শহর হোক। আরাম করে ঘুমানোর জন্য এইরকম নরম বিছানাই প্রয়োজন। গ্রামের মানুষজন-ও নিশ্চয়ই আরাম করে ঘুমাতে চায়। সেজন্য এইরকম নরম বিছানা রেখে দিয়েছে।

আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চোখ দু'টো বন্ধ করল নিশু। দরজার বাইরে থেকে ঠক্ ঠক্ আওয়াজ এলো আবার। বিরক্তির স্বরে ‘উফ্’ শব্দটা উচ্চারণ করল নিশু। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বরং ঠক্ ঠক্ শব্দটা আরো বেড়ে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। দুই কান চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল, ‘নিশ্চয়ই ওই বজ্জাত মেয়েটা দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। নাহলে এই বাড়ির বিছানার সাথে সাথে এই বাড়ি মানুষজন-ও অনেক ভালো। তারা অন্তত এভাবে ঠক্ ঠক্ আওয়াজ করে কাউকে বিরক্ত করবে না। কিন্তু মেয়েটা-ও তো এই বাড়িরই একজন!’

অতঃপর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে নিশু চেঁচিয়ে বলল, ‘দরজা খোলা আছে। ভিতরে আসুন।’

আড়চোখে দরজার দিকে তাকালো নিশু। কিন্তু না! ওই মেয়েটা নয়। মায়া হেঁটে হেঁটে ভিতরে আসছে। জিহ্বায় কামড় দিয়ে নিশু মনে মনে বলল, ‘না দেখেই আপুকে বজ্জাত মেয়ে বলাটা ঠিক হয়নি।’

কথাটা মনে মনে বলেই চোখ দু'টো বন্ধ করে ফেলল নিশু। কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর হঠাৎ মাথায় কারোর হাতের স্পর্শ পেলো ও। কেউ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে চোখ দু'টো খুলে সামনে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। মুহূর্তের মধ্যেই চমকে গিয়ে ওঠে বসল নিশু। অরিন নিশুর সামনে থেকে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। নিশু লক্ষ্য করল অরিন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। পাশে তাকিয়ে দেখল মায়া জানালাটা খুলে দিচ্ছে। জানালা খুলে দিয়ে নিশুর দিকে তাকিয়ে মায়া বলল, ‘কী হলো?’

অরিনের দিকে তাকালো নিশু। মেয়েটার দৃষ্টিতে এখনো ভয়ার্ত একটা আভাস আছে। নিশু জানে না এত ভয়ের কারণ কী? জানার কোনো চেষ্টা-ও করল না অবশ্য৷ মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না মানে কিছু না।’

- অরিন সেই কখন থেকে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছিল। তোর কোনো সাড়া পায়নি বলে আমিই এলাম। এরপর তুই ভিতরে আসতে বললি।

অরিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে নিশু বলল, ‘ওহ্।’

- তাড়াতাড়ি ওঠে ফ্রেশ হয়ে নে। রাতের খাবারটা দেরি করে খেলেও সকালের খাবার খুব তাড়াতাড়িই খেয়ে কাজে বেরিয়ে পড়েন এই বাড়ির সবাই।

- তুমি যাও, আমি আসছি।

মায়া চলে গেল। অরিন ও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। নিশু বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

ফ্রেশ হয়ে খাবারের ঘরে গেল নিশু। সবাই বসে ছিল সেখানে। নিশু চেয়ারে বসা মাত্রই সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে লাগল মায়া। খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষণ পর নিশু লক্ষ্য করল মায়াকে সবাই ‘মায়া’ বলে ডাকছে। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার দেওয়া নামটা বলেই আপুকে ডাকছে সবাই! কাকতালীয় ভাবেই কী আমার দেওয়া নামটার সাথে আপুর পরিবারের দেওয়া নামটা মিলে গেছে? হয়তো আপু চেহারায় মায়াবতী একটা ভাব আছে। সেজন্য উনারা পরিবারের মানুষজন ‘মায়া’ নামটা রেখেছিল।’

মায়ার কথায় ভাবনা বাদ দিয়ে খাওয়াতে মনোযোগ দিতে যাচ্ছিল নিশু। তখন মায়া বলল, ‘আমি জানি কী ভাবছিস তুই?’

নিশু জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো মায়ার দিকে। মায়া বলল, ‘ভাবছিস সবাই আমাকে ‘মায়া’ বলে বলে ডাকছে কেন? আসলে বিষয়টি কাকতালীয় কিছুই না। আমিই সবাইকে বলেছি আমাকে যেন মায়া বলে ডাকে।’

একরাশ হাসি ফুটে উঠল নিশুর মুখে। ও এটটাও কল্পনা করেনি। ওর দেওয়া নামেই পরিবারের সবাই ডাকছে। ভাবতেই নিজেকেই বিশেষ কেউ মনে হচ্ছে। নিশু আড়চোখে অরিনের দিকে তাকালো। অরিনের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। নিশু আর কিছু বলল না। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে নিশু নিজের ঘরে চলে এলো। নিশুর মাথায় এখন একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হলো, অরিন তখন ওর মাথায় স্পর্শ করেছিল কেন? যেই মেয়ে ওকে সহ্য করতে পারছিল না। সেই মেয়ে ওতটা কাছাকাছি চলে এসেছিল। কিন্তু কেন? এই কেন এর উত্তর নিশুর অজানা। একটা সাংঘাতিক রহস্যের মতোই থেকে গেল এই প্রশ্নটা। অবশ্য এই রহস্য উদঘাটনের করার কোনো চেষ্টা-ও করবে না নিশু! কারণ ও জানে, দু’জনের মাঝে একটা অদ্ভুত রহস্য থাকা ভালো। এতে আকর্ষণ বাড়ে। হঠাৎ মুচকি হাসি দিলো নিশু। হাসিটা-ও কেমন যেন রহস্যজনক!

এভাবে আরো দু'দিন কেটে গেল। বেশ আনন্দেই কাটছে নিশুর দিনগুলো। তবে ও একটা বিষয় বেশ ভালো করেই লক্ষ্য করেছে। তা হলো, অরিন প্রথম দিনের মতো এখন আর ওকে দেখলেই রাগী দৃষ্টিতে তাকায় না। আর রেগে কোনো কথা-ও বলে না। ওর সাথে চোখাচোখি হলেই কেমন এক সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ‘উঁহু! ওটা সন্দেহজনক দৃষ্টি নয়। ওটা রহস্যজনক দৃষ্টি।’

নিজের ভুলটা নিজেই শুধারালো নিশু। কিন্তু এত আনন্দের মধ্যে-ও বুকের ভিতর চাপা কষ্ট অনুভব করে নিশু। এক অদ্ভুত শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরে। ও জানে না, এই চাপা কষ্টটা কীসের জন্য? বা এই শূন্যতা কার অনুপস্থিতির জন্য। তবে মাঝে মাঝেই ওর চোখের কোণে জল জমে যায়। আরো দু’দিন কেটে যাওয়ার পর নিশু সিদ্ধান্ত নেয়, ও ঢাকা চলে যাবে। তাই খাবার টেবিলে বসে নিশু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বল, ‘আমি এবার ঢাকায় ফিরে যেতে চাই। ওখানে আমার মায়ের কবর আছে। এছাড়াও আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। এটা আমার মায়ের এবং মায়া আপুর স্বপ্ন। তাদের দু'জনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য হলেও আমাকে খুব তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরে যেতে হবে।’

নিশুর কথা শুনে অরিনের বুকটা ধুক্ করে উঠল। নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল ছলছল করতে লাগল। নিশ্বাস আটকে আসছিল ওর। কিন্তু এইরকম কেন হচ্ছে, তা অরিন জানে না। ও শুধু এইটুকুই জানে, ওর জীবন থেকে কেউ একজন হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো চিরদিনের জন্য। অরিন নিজের মনে মনে বলল, ‘নিশু চলে যাবে বলে আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? কীসের টান এত? আত্মার টান! কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? মাত্র কিছুদিন হলো ওর সাথে আমার পরিচয়। তেমন ভালো করে কথা-ও হয়নি আমাদের। তবুও এত কষ্ট হচ্ছে কেন আমার? কেন বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে? এর রহস্য কী? নিশু বলেছিল, দু'জনের মাঝে রহস্য যত বেশি থাকবে, আকর্ষণ তত বেশি বাড়বে। কিন্তু আমি তো এইরকম আকর্ষণ চাই না। যে আকর্ষণ আমার প্রিয় মানুষটাকে কেড়ে নেয়। প্রিয়! হ্যাঁ, নিশু আমার প্রিয় একজন মানুষ।’

অরিন এইসব ভাবছিল, আর ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নিশুর দিকে। নিশু অন্যদের সাথে কথা বললেও দৃষ্টি এবং মনোযোগ ছিল অরিনের দিকে। অরিনের চোখের অশ্রুবর্ষণ ওকে ক্রমাগত আঘাত করছিল। অনেক কষ্টে খাওয়া দাওয়া শেষ করল নিশু। ওখানে আর থাকতে পারছিল না। চেয়ার থেকে উঠার সময় মায়ার দিকে একবার তাকালো। মায়া নিশ্চুপ। দৃষ্টি নিচের দিকে। কারোর দিকে এক মুহূর্তের জন্য-ও তাকাচ্ছে না ও। হয়তো খুব কষ্ট পাচ্ছে। নিশু খাবার ঘর থেকে চলে যাচ্ছিল, তখন মায়া এসে ওর সামনে দাঁড়াল। নিশুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। ক্ষণিকের জন্য হলেও ওর ভেবেছিল, হয়তো মায়া কাঁদতে কাঁদতে বলবে, ‘আমাকে রেখে যাস না ভাই। আমি খুব ভালো করেই জানি, তুই এবং আমি। আমরা কেউই একে অপরকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারব না। আমাদের যে আত্মার সম্পর্ক। আর আত্মা আলাদা হয়ে গেলে, মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারে না।’

আশ্চর্য! মায়া কিছুই বলল না। শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। নিশু আর কোনোদিকে তাকালো না। নিজের ঘরে চলে এলো।

ওদিকে অরিনের মনের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শুধু ঝড় নয়। কালবৈশাখী ঝড়! ও কিছুতেই শান্তি অনুভব করতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে, খুব প্রিয় একজন হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ও কীভাবে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে যাওয়া থেকে আটকাবে? কোন অধিকার এ?

একটু একটু করে অস্থির হয়ে পড়ছে অরিন। খাবার টেবিলে সবার সামনে বসে থাকার মতো ধৈর্য আর হলো না ওর। ছুটে চলে এলো নিজের ঘরে। দরজা আটকে দিয়ে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগল। মুখ দিয়ে আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসছে ওর। কিন্তু বাড়ির অন্যরা শুনতে পাবে বলে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে বালিশের সাথে মুখ চেপ ধরে রেখেছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না ও। মনে হচ্ছে নিশ্বাসের অভাবে এক্ষুনি মরে যাচ্ছে। হয়তো আর মাত্র পাঁচ সেকেন্ড নিশ্বাস ছাড়া বাঁচতে পারবে। উঁহু, আর মাত্র চার সেকেন্ড। বা তিন সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, অথাব আর মাত্র এক সেকেন্ড। বালিশ থেকে নিজের মুখটা সরিয়ে নিলো অরিন। সাথে সাথে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে এক আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো। বড় বড় করে নিশ্বাস নিতে লাগল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘নিশ্বাস না নিয়ে আর এক মুহূর্ত-ও বাঁচতে পারব না।’

হাত দিয়ে চোখ মুছে বিছানা থেকে নেমে এলো। এরপর দরজা খুলে বাইরে যেতে যাবে, তখনই দেখে ওর বাবা নিশুর ঘরের দিকে যাচ্ছে।

ওর বাবা কতক্ষণ ঘরের ভিতরে ছিল তা জানে না অরিন। তবে অরিনের কাছে মনে হয়েছিল, কয়েক হাজার মুহূর্ত ধরে ও বাবার জন্য অপেক্ষা করেছে। অরিনের বাবা একসময় ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

ওদিকে নিশু আর মায়ার মুখে অজস্র হাসি। দু'জনের মনেই এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে এখন।

কিন্তু ওদের দেখে প্রতিবারের মতো এবারও প্রকৃতি বলল, ‘ভয়ঙ্কর এক বিপদের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলে তোমরা।’

প্রকৃতির কথায় রহস্যময় ভাব।

(চলবে...)

‘মায়াবতী’-এর ৪র্থ পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মায়াবতী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড