শাহনেওয়াজ সুমী
সারারাত ধরে জেগে থেকে এখন চোখ জ্বলছে রোদেলার। রাতভর একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে গাড় কমলা আর নীল সুতা দিয়ে গলায়, হাতায় কাজ করেছে সে। ভোরে কী হলো কে জানে একটু তন্দ্রা লেগে গিয়েছিলো বোধহয় কোনোভাবে তাঁর । হঠাৎ সুঁই ফোটার তীব্র খোঁচায় ঝটকা দিয়ে উঠে বসতে গিয়ে সুঁইয়ের অনেকটাই ফুটে গেলো বৃদ্ধাঙ্গুলিতে । সুঁই টেনে বের করতে গিয়ে আঙ্গুল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাবীর বুকের কিছুটা অংশ লাল হয়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো রোদেলার। বেসিনের পানির কল ছেড়ে দিয়ে রক্ত ধুতে চেষ্টা করে দেখল আবছা একটা দাগ থেকেই যাচ্ছে, শুকালে হয়ত বুঝা যাবে না তবু তাঁর মনটা বড্ড খুঁতখুঁত করে উঠলো। সে পুরো পাঞ্জাবিটাই ধুয়ে দিলো।
ভেজা পাঞ্জাবি হাতে রোদেলা দরজা খুলে বারান্দায় এসে দেখল সূর্যমামা মাত্র উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আকাশে , কিন্তু এই নরম রোঁদে তো শুকাবে না ভেজা পাঞ্জাবি! তার ওপর একটু পরেই তার আর ফারহানের বন্ধু অভি আসবে, তার হাতে সে পাঞ্জাবিটা পাঠাবে ফারহানের জন্য। ভাবতে ভাবতে রোদেলা ঘরে এসে ভেজা পাঞ্জাবিটা ভালো করে ইস্ত্রি করে শুকিয়ে নিয়ে বাতাসে মেলে দিলো ।
আজ ফারহানের জন্মদিন। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এইদিনেই তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো রোদেলার। এরপর বারবার দেখা হওয়া, চেনাজানা হওয়া, রাতভর ফোনে কথা বলা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীরবে মানুষের সমুদ্রের মাঝে দিয়ে হেঁটে যাওয়া। ধীরে ধীরে কখন যে একে অপরের পরিপূরক হয়ে গিয়েছিল তারা সেটা নিজেরাও জানে না। অবাক করা ব্যাপার হলো তারা কখনও নিজেদের "ভালোবাসি" এই শব্দটা মুখে বলেনি। অথচ কী এক না বলা ভালোবাসার বাঁধন নিয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছে তারা। এই পাঁচ বছরে কতকিছু বদলে গেলো শুধু তাদের বোঝাপড়াটা সেই আগের মতই রয়ে গেছে।
কাল রাতে পাঞ্জাবিতে কাজ করার মাঝে দুইজন গল্প করে যাচ্ছিলো ফোনে। কী এক কথার মাঝে তাকে থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ ফারহান বলে উঠলো......
-রোদেলা চলো বিয়ে করে ফেলি। কোনো আয়োজন করে নয়, সোজা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। তাঁর কথার ভঙ্গিটা এমন ছিল যা শুনে রোদেলা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।
- কাজি অফিস কেনো? আমাদের দুজনের বাবা মায়েদের কারো তো অমত নেই আমাদের বিয়েতে!
- তাহলে বাবা মাকে ঢাকায় আসতে বলি?
রোদেলা আবার হেসে উঠে বলেছিল, 'আচ্ছা আসতে বলো।'
রাতের কথা মনে পরে তাঁর কেমন জানি লজ্জা লাগছে এখন। বিয়ের কথা শুনার পর থেকে কেমন একটা অজানা খুশি, ভয়, লজ্জা মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তাঁর ভেতরে। কলিং বেল এর শব্দে সে চমকে উঠলো। মাকে অভির সাথে কথা বলতে শুনলো। তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবিটা ভাজ করে একটা ব্যাগে ভরে বসার ঘরে এসে দেখলো অভি বসে আছে। তাকে দেখেই অভি হড়বড় করে বলল....
- দোস্ত কী দিবি দে তাড়াতাড়ি। আমার বাসায় আজ অনেক কাজ আছে। শুধু তোর জন্য বের হতে হলো।
বলতে বলতে রোদেলার হাত থেকে ছোঁ মেরে ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে গেলো অভি । অভির কাণ্ড দেখে রোদেলার খুব মেজাজ গরম হয়ে গেলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো সে…… না আজ সে মাথা গরম করবে না। আজ তাঁর জীবনের খুব বড় একটা দিন। সে ঠিক করেছে সন্ধ্যায় যখন ফারহানের সাথে তাঁর দেখা হবে 'ভালোবাসি' শব্দটা দিয়ে সে কথা শুরু করবে। তাদের মাঝে প্রথম ভালবাসি শব্দটা সে আগে বলতে চায়। সারাজীবন ফারহানকে এই নিয়ে খোঁচা মারা যাবে! মনে মনে রোদেলা হাসছে।
বিকাল বেলায় শাহাবাগের মোড়ে রিক্সা থেকে নেমে সাদা, লাল মিলিয়ে দশটা গ্লাডিওলাস কিনলো রোদেলা। কোন এক বিচিত্র কারণে এই বিদেশি ফুলের প্রতি ফারহানের বিশাল দুর্বলতা। ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর কেমন জানি লাগছে এর ওপর আজ সে শাড়ী পরে এসেছে। রোদেলা হাত উলটে ঘড়ি দেখলো, সময়ের চেয়ে বিশ মিনিট দেরি করে এসেছে সে তারপরেও ফারহান এখনো এসে পৌঁছেনি!
এমনতো কখনই হয় না ভাবতে ভাবতেই সে রাস্তার উল্টোদিকে ফারহানকে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বাস থেকে নামতে দেখেলো। সেদিকে তাকিয়ে রোদেলার বুকের মাঝে কেমন জানি করে উঠতে উঠতেই ফারহানকে পা ফচকে পরে যেতে দেখলো। ব্যস্ত বাস ততক্ষণে এগিয়ে গেছে সামনে আর পেছনের একটা প্রাইভেট কার সামনে চলে এসেছে। ফারহান গিয়ে তাতে প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলো। রোদেলা পাগলের মতো দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে এসে পড়ে থাকা ফারহানকে ধরে তুলতে চেষ্টা করলো। ফারহানের মাথার বাম পাশটা থেকে রক্ত গড়িয়ে পরে সাদা পাঞ্জাবি আর রোদেলার হাল্কা নীল সাদা শাড়ি ভিজে লাল হয়ে যাচ্ছিলো। তাঁর হাতের গ্লাডিওলাসগুলি ফারহানের বুকের উপর পড়ে রইলো । কারা কারা যেন তাকে আর ফারহানকে একটা প্রাইভেটকারে তুলে দিলো। রোদেলা ফারহানের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে। ফারহান কিছু বলতে চাইছে দেখে রোদেলা বললো-
- এইতো হাসপাতালে চলে আসছি। আর একটু, কিচ্ছু হবে না তোমার। একটু জেগে থাকো ফারহান আর একটু জেগে থাকো। কিন্তু রোদেলা দেখতে পাচ্ছে ফারহানের চোখ বুঝে বুঝে আসছে।
হাসপাতালের ইমার্জেন্সির সামনে একা দাঁড়িয়ে রোদেলা হাল্কা হাল্কা কাঁপছে। কয়েকজন বন্ধুদের সে খবর দিয়েছে তারা এখনো এসে পৌঁছেনি! অনেকটা সময় পর ডাক্তার বের হয়ে এলো। তার দিকে হেঁটে এসে তাকে বলল-
- আপনার সাথে আর কেউ আছে? আপনি কে হন রোগীর? আমি খুব দুঃখিত ম্যাডাম। উনি এখানে আসার আগেই চলে গেছেন। আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি।
শুকনো চোখে রোদেলা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাঁর কানে ডাক্তারের বলা আর কোন কথাই ঢুকছে না। একটা কথাই বিড়বিড় করে রোদেলা বারবার বলে যাচ্ছে-
'ভালোবাসি' তো বলা হলো না তোমাকে! 'ভালোবাসি' তো বলা হলো না তোমাকে! 'ভালোবাসি' বলা হলো না তোমাকে।
ওডি/এনএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড