• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : তৃতীয় লিঙ্গ

  প্রণব সরকার অপু

২৫ আগস্ট ২০১৯, ১৬:১৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

আমি একটা আশ্রমে বড় হওয়া ছেলে এবং আমার মা একজন হিজড়া যা নিয়ে আমি গর্বিত। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে হতো আদৌ কি আমার মা বাবা নেই? নাকি আমি বাস্টার্ড চাইল্ড?

এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একদিন আমার হিজড়া মাকে প্রশ্ন করেই ফেললাম, ‘আচ্ছা মা, মা-বাবা কি সন্তানকে ঘৃণা করতে পারে?’ আমার মা আমার প্রশ্নের মানে ঠিকি বুঝতে পেরেছিল। উনি আমাকে উনার জীবনের গল্প টা বলা শুরু করলেন-

মা বাবা কি সন্তানকে ঘৃণা করতে পারে কিনা? হুম, আমাকে ঘৃণা করত কারণ আমি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। আমি কি আসলেই রক্ত মাংসের মানুষ? মানুষ হলে তো মাত্র ৭বছর বয়সে একটা সন্তানকে এভাবে কেউ ফেলে রেখে যায় না। আমাকে অবশ্য ফেলে না, মেরে রেখে যেতে চেয়েছিল। আমাকে যখন হাত-পা বেঁধে রেলের উপর ফেলে রেখে যাচ্ছিল আমি না চিৎকার করিনি, আমি সেই অল্প বয়েসেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার মা-বাবা আমাকে চায় না। এমনকি এই পৃথিবীও। আমার দিদা আমাকে বলত মানুষ মারা গেলে নাকি যে তাকে বানিয়েছে তার কাছে চলে যায়। আমিও ভাবতে লাগলাম, যাক এখন উপরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাস করবো? আমার কি দোষ? কেন আমাকে এভাবে বানালো?

কিন্তু হঠাৎ একজন মানুষরূপী দেবতা এসে আমাকে উদ্ধার করে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি সেই দেবতার আসল রূপ দেখতে পেলাম। রাত হলেই কেমন যেন পশু হয়ে যেত। আমার ৭বছরের শরীরটাকে ব্যথায় জর্জরিত করে দিত। আমি সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গেলাম। রাস্তায় হাঁটছিলাম হঠাৎ আশেপাশের মানুষগুলো মুখে হিজড়া হিজড়া শুনতে পেলাম। দেখলাম মুখে অদ্ভুত মেকআপ দেওয়া কিছু মানুষ, তখন থেকেই আমি সেই দলের সাথে যুক্ত হলাম। ওরা আমাকে খুব আনন্দের সাথেই গ্রহণ করলো। আমাদের সর্দারনী আমাকে খুব আদর করত এবং পড়ালেখার প্রতি আমার আগ্রহ দেখে আমাকে একটা স্কুলেও উনি ভর্তি করে দিয়েছিল।

আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা শুরু করলাম এবং রাতে আমার দলের সাথে টাকা কালেকশানে বের হতাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিল জীবনটাকে আমি দেখিয়ে দিব লিঙ্গ কখনোই একজন মানুষের পরিচয় হতে পারে না। মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ আর কর্মে। সব কিছুই খুব ভালোভাবে চলছিলো। আমি খুব ভালোভাবেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলাম। ততদিনে আমি টাকা কালেকশন ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি এলাকায় গিয়ে টিউশনি করিয়ে আমার মোটামুটি খরচের ব্যবস্থাও করে ফেলি।

কিন্তু হুট করে আমার জীবনে একটা ঝড় এলো। আমি সব সময় নিজেকে বুঝাতাম অন্য সবার মত আমাদের ইমোশন থাকতে নেই। আমাদের ভালবাসার অধিকার নেই অথবা ভালবাসতে নেই। কিন্তু আমি হেরে গেলাম।

- বুঝলাম না, হেরে গেলে মানে? মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলো-

রুদ্র, হুম রুদ্র। আমাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলো। আমিও স্বার্থপরের মত নিজের স্বকীয়তা লুকিয়ে রুদ্রের হাতে হাত ধরে হাটতে লাগলাম। অন্য সবার মত আমিও ভালবাসার সেই অদ্ভুত ঝড়ে পরে গেলাম। আমার কি করার আছে? কখনো যে কেউ এই ভাবে আমাকে ভালবাসেনি। কিন্তু ভয় ছিল রুদ্র যেদিন জানতে পারবে? ও কি আমাকে মেনে নিবে? না..না আমি কিছুতেই বলতে পারবো না, অসম্ভব।

এসব ভাবতে ভাবতেই রুদ্র আমাকে দূরে কোথায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলল। আমিও কি সব জানি ভেবে রাজিও হয়ে গেলাম। কি সুনসান নীরব একটা জায়গা। রুদ্র আমাকে একটি রুমে নিয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম ও আমার কাছে কিছু একটা চাচ্ছে? আমি কিছুটা ইতস্তত হয়ে সাহস করে রুদ্রকে বললাম, রুদ্র তোমাকে আমার কিছু বলার ছিল?

রুদ্র হা হা হা করে হাসতে লাগলো। তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি বলবা? তুমি হিজরা। আরে সমস্যা নাই, আমার বন্ধুদের সব চলে। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে ঘরে ৪জন ছেলে আসলো। কি প্রচণ্ড হিংস্রতায় ওরা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।’

আমি শুধু রুদ্রের মুখের দিয়েই তাকিয়ে ছিলাম, আর ভাবছিলাম স্বাভাবিক লিঙ্গের মানুষগুলোর ভালবাসাগুলো এমন অস্বাভাবিক কেন?? আমি জ্ঞান হারানোর আগে হঠাৎ করেই আমার মা বাবার চেহারাটা দেখতে পেলাম।আসলে রুদ্রের কি দোষ যেখানে আমার জন্মদাতা পিতামাতাই আমাকে চায়নি.....

বুঝতে পারছিলাম না কি বলবো কিন্তু মা আবার বলা শুরু করলো-

নিজেকে এক ময়লা আবর্জনার স্তূপে আবিষ্কার করলাম। এবারো মরিনি, কিন্তু আমাকে মরতে হবে, এই পৃথিবী আমার জন্য নয়। চলে গেলাম ট্রেন স্টেশন। যখনই লাফ দিতে যাব পিছন থেকে একটি ছোট্ট হাত আমাকে আঁকড়ে ধরল আর বলতে লাগলো, খাব..ক্ষুধা।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। পিচ্চিটাকে দেখে নিজের কথা মনে পড়ে গেল। আমি ভিক্ষা করা শুরু করলাম এবং ওকে পেট ভরে খাওয়ালাম। বুজলাম আমার মত পিচ্চিটার ও কেউ নেই। ভাবতে লাগলাম, মরে গেলে হবে না,আমার বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে।

আমি দিনে স্টেশনে পানি বিক্রি শুরু করলাম আর রাতে পিচ্চিটাকে পড়াতাম। আস্তে আস্তে আমার কাছে আশেপাশের বস্তির অনেকেই তাদের বাচ্চাদের পড়াতে দিয়ে যেত।আমি কিছু কিছু টাকা জমানো শুরু করলাম।আর সারাদিন স্টেশনে কুলিগিরি থেকে শুরু করে মানুষের জুতা কালি করা,যা পাই সব করা শুরু করি।ততদিনে আমার একটা বিশাল বাহিনী হয়ে যায় যারা সবাই আমার স্টুডেন্ট। দীর্ঘ ৩ বছর আমি এভাবে টুকটাক টাকা জমিয়ে নিজের একটা থাকার মত জায়গা করে ফেলি...আর হঠাৎ করেই একটা বিদেশী এনজিও আমার সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং তাদের অর্থায়নে আমি একটা বড়সড় স্কুল খুলে ফেলি এবং দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য মোটামুটি ভালো থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলি। যেখানে আমরা লিঙ্গ দেখে কাউকে আনি নারে বাবা..মানুষ হিসেবেই মানুষকে নিয়ে এসে সাবল্মবী করে গড়ে তুলি।

আমার মা কাঁদছিল। সাথে আমিও। মা হঠাৎ বলা শুরু করলো-

যেই আবর্জনার স্তূপে আমি পড়েছিলাম ঠিক সেখানে থেকেই আমি একদিন অর্ধমৃত অবস্থায় রুদ্রকে আবিষ্কার করি এবং রুদ্রের পাশেই ছিল ফুটফুটে একটি শিশু। আমি জানিনা, রুদ্রের জীবনে কি হয়েছিলকে বা কারা রুদ্র, রুদ্রের স্ত্রী এবং সন্তানকে এভাবে মেরে ফেলতে চাচ্ছিল। রুদ্র যে ভয়ংকর পাপ করেছিল সেটা জানি। কিন্তু আমি রুদ্রকে ভালোবেসেছিলাম। সেটা আমি আজও আগলে রেখেছি পরম ভালোবাসায়, মমতায়।

মা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমার বুঝতে আর বাকী রইল না। আমি আর কেউ না সেই রুদ্রের সন্তান। আমি এক চিৎকার করে আমার হিজড়া মাকে জড়িয়ে ধরলাম। আর বলতে লাগলাম, মাগো, আমার মা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। আমার আর কাউকে চাই না। হাজার জনম আমি তোমাকেই মা হিসেবে চাই।

আমার মা আমার চোখের পানি মুছতে মুছতে আমাকে বলে, তাহলে চল তোর দিদা দিদির সাথেও পরিচয় করিয়ে দেই। আমি বুঝতে পারছিলাম না, মানে কি মা? মানে হল, আমাকে ফেলে দিলেও আমি তো উনাদের ফেলতে পারিনারে বাবা। উনাদের এই শেষ সময়ে আমিই উনাদের শেষ আশ্রয়রে বাবা। আশ্রয়হীনতার মত ভয়ংকর ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না এই পৃথিবীতে।

আমি বুঝতে পারছিলাম আমার পাশের এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষটি আসলে আমাদের জড়জাগতিক লিঙ্গভিত্তিক পৃথিবীর জন্য বড্ড বেমানান....।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড