• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : আড়ালের গল্প

  শফিক নহোর

২৫ আগস্ট ২০১৯, ১১:০৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

শীতের সকালে রোদ পোহানোর অছিলায় আমাদের বাহির বাড়ির নারকেল গাছ তলায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে যেতাম, স্কুলের পাঠ্যবই নিয়ে উচ্চস্বরে তা পড়তাম। বাবা দেখে যেন কিছু না বলে। তার জন্য হাতের কাছে রেখে দিতাম লম্বা পাটের খড়ি। পাশের জমিতে গম বপন করেছে; কাকতাড়ুয়া বানিয়ে জমিতে পুঁতে রাখা হয়েছে, তবুও জমিতে কাক এসে খেয়ে যাচ্ছে সদ্য বপন করা গমের বীজ। আমি মাঝে-মধ্যে তাড়িয়ে দেই।

শীতের সকালে রান্না শেষে মা, খেজুর গাছের পাতা দিয়ে অন্য রকম এক শীতলপাটি তৈরি করত, আশ-পাশের বাড়ি থেকে চাচি খালারা আসত। মা পান-সুপারি খেয়ে, ঠোঁট গারুয়া বাচা মাছের মত লাল-টকটকে করে রাখতো সবসময়। আমাদের সবার জন্য আলাদা আলাদা শীতলপাটি তৈরি করে রাখতো; মা ছিল নিপুণ কারুকাজে পারদর্শী একজন মানুষ। সবাই মায়ের কাছে আসত হাতের কাজ শিখতে। আনন্দে সবাই শিখতো সকাল কেটে যেত পরম আনন্দে।

আমাদের পুকুরপাড় জুড়ে খেজুর গাছ, লোকজন আমগাছের পরগাছা উদ্ভিদ ঢ্যারার আঠা দিয়ে পাখি শিকার করত। আমি ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে সেই বুলবুলি/কুলি-পাখি দিয়ে চড়ুইভাতি, করতাম সবাই মিলে। আনন্দোৎসব ছিল নিত্য দিনের কাজ, রান্না শেষে কলাপাতায় করে খাওয়া সবাই মিলে। ‘সে খাবারের স্বাদ ঠোঁটের কিনারে লেগে আছে আজ অবধি।’

মওলবীর উঠোন পাড়ি দেয়ার লুকোচুরি গল্প থেকে যায় আড়ালে। শীতের সকালে পিয়াজের ফুল দিয়ে ঝালমুড়ি আহ! কই, স্বাদ। স্কুলের সময় হবার আগেই স্কুলে যাবার জন্য রেডি হয়ে থাকতাম, চাতক-পাখির মত চেয়ে দেখতাম। বিশেষ সেই মানুষটি বের হচ্ছে কিনা। খেলার ছলে জীবনের রক্ষিত সম্পদ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আবেগে, বোকামি কর্মকাণ্ডে; অনুশোচনার অগ্নি দহনে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আমার সোনালি স্বপ্ন। নীল আকাশ আজ ঘোলাটে দেখায়, স্কুল জীবনের প্রতিটি স্মৃতি আমাকে খুব নাড়া দেয়। কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই, পৃথিবীর সমস্ত যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি।

এ ডিজিটাল যুগে নেই, কোন বান্ধবীর মোবাইল নম্বর, ই-মেইল অ্যাড্রেস। জীবন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে এই ব্যস্ত নগরে সবাই। এখানে কেউ কারো খবর রাখে না বিশেষ কোন প্রয়োজন ছাড়া।

সহজে মেলে না জীবনের সহজ সমীকরণ। আমার সহপাঠীরা বেঁচে আছে? নাকি মরে গেছে। আমি কেমন আছি, কেউ বলতে পারবে না। সময়ের প্রয়োজনে প্রিয়জনদের সঙ্গে শুধু দূরত্ব বাড়ছে দিনের পর দিন।

আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে আমি কিছুই জানি না, বড় আপা আমাকে বলছে। ছেলে পক্ষ নাকি স্কুল থেকে আমাকে দেখে গেছে! তাদের পছন্দ হয়েছে; আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। কথাটা শোনার পর আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কাউকে কিছুই খুলে বলতে পারিনি। বোকার মত কি সব করছি। সে কথা মনে হলে নিজের কাছেই লজ্জা করে। আমার পত্রবাহক ছিল টুটুল কাকা। সুখে-দুঃখে কাকার সঙ্গে সব কথা বলতাম। জাহিদের সঙ্গে দেখা করা খুব দরকার হয়ে পড়ল সেদিন। নজির ডাক্তারের বাড়ি পার হয়ে, টুটুল কাকার হাতে একটা চিঠি খুঁজে দিলাম। সঙ্গে মিলাদের একখান বাতাসা। টুটুল কাকা তা পেয়েই কি যে খুশি। ঐ বয়সে মানুষের অন্তরে লোভ থাকেনা, থাকে পবিত্র আত্মা।

চিঠি পাবার পরের দিন অপরাহ্ণে, কানু সাহার বাড়ির পিছনে আমাদের সাক্ষাত হয়। জাহিদকে বললাম, ‘চলো আমারা পালিয়ে বিয়ে করি, তা না হলে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে অন্য ছেলের সঙ্গে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।’ কথা বলার শক্তি পাচ্ছিনা, অজান্তে চোখর কিনার দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

জাহিদকে আমি সব কিছু দিয়ে দিয়েছি, নিজের বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, জাহিদ আমার সামনে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই বলছে না । আমি বুঝতে পারছি ভুল হয়ে গেছে। তখন একমাত্র সঙ্গী ছিল কান্না।

‘আচ্ছা জাহিদ তুমি কি কিছুই বলবে না। আমাকে ছাড়া তোমার কষ্ট হবে না।’ আমি ওড়নার আচল দিয়ে চোখ মুছে বার বার প্রশ্ন করতে থাকি। বেহিসাবি ভালবেসেছিলাম, বলেই হয়তো সব সহ্য করে নিতে হচ্ছে।

- তুমি আমাকে বুঝার চেষ্টা করো, খেলার ছলে, হয়তো অনেক কিছুই হয়েছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও? জীবন মরণ ক্ষতির কাছে সরি শব্দটা বড্ড বেমানান।

- তোমার বাবা তোমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। তুমি কিছু বলছো না কেন? তুমি বলতে পারবে না, তা আমি জানি। তোমার বাবা খুব রাগী স্বভাবের মানুষ তাই?' - তোমাকে ছাড়া আমিও তো ভাল থাকতে পারবো না। তাছাড়া এ বিষয়ে বাড়ির লোকজন জানলে, আমার তোমার জীবন শেষে করে ফেলবে। আমাকে ভুলে যাও প্লিজ মিনু।

সেদিন জাহিদকে খুন করতে ইচ্ছে করেছিল। আমার জন্য একবারও ভাবেনি। স্বার্থপরের মত শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছে। স্বার্থপর পুরুষ মানুষ। বাড়ির লোকজন, পাড়া-পড়শি সবাই খুব খুশি। বর পুলিশের চাকরি করবে। আমার মামা ছেলে পক্ষের সঙ্গে পাকাকথা দিয়েছে। আমার কাছে বাড়ির মানুষ একবারও জানতে চাইনি, আমার পছন্দের কেউ আছে কিনা।

আমার তো তখন বিয়ের বয়সই হয়েছিলো না। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। পুলিশের ট্রেনিং শেষে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান। চারদিকে পরিপাটি, বেশ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। আমার হৃদয় গহিনে দাবানল। ঠোঁটের কিনারে মানুষ দেখানো হাসি। বাসর ঘরে আমাকে সেই পুরাতন অধ্যায় যেতে হল পুনরায়।

পুরুষ মানুষ কী আর চায়? মন খুলার আগেই শাড়ির আচল খুলে নিচে ফেলে দিয়েছে আমার স্বামী। মানুষের সুখ-দুঃখের কথা থাকেনা। থাকেনা মন বুঝে নেওয়ার সময় পবিত্র বাসরঘরে। শুধু লেনদেনের পালা জীবনের প্রতি আমার কোন আক্ষেপ নেই, কিছু স্মৃতি ভুলে থাকতে চাই সবসময়।

- মিনু তোমাকে আমি চাঁদ বলে ডাকবো, তুমি আমার চাঁদ। আমি পুলকিত হই, স্বামীর ভালবাসা পেয়ে। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়, পছন্দের খাবার কিনে নিয়ে আসে। সংসারে সুখের অভাব নেই। কিছুদিন পর বাবা বেড়াতে এসে আমার সংসার দেখে কত খুশি হয়েছে। আমার জন্য বাবা গ্রাম থেকে কতকিছু নিয়ে এসেছে। বাবা ছাড়াকে পারে এমন করে ভালবাসতে, বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে। বাবা তুমি এত ভাল কেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে।

চার বছর পরে জাহিদ আমার মোবাইল নম্বর কি করে পেল বুঝতে পারছি না। সোনিয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও আমাকে বেকুবের মত উত্তর দিলো। আমি চাই না, এত বছর পর জাহিদ আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। একটা স্বার্থপর মানুষকে মনে রেখে লাভ কি! মধুর পরিবর্তন দেখে আমার প্রচণ্ড ভয় হতে লাগল। বিয়ের কয়েক বছর না হতেই মধু আমার বাবার কাছে দু’লক্ষ টাকা ধার চেয়ে বসলো। না দিতে পারলে আমাকে ছেড়ে দিবে, হুশিয়ারি দিয়েছে। বেশির ভাগ সময় সে নেশাগ্রস্থ থাকে। আমাকে বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন করে। যা বলা বা দেখানো সম্ভব ছিল না কখনো। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থা বাবার সংসারে।

ডিভোর্স লেটারের সঙ্গে একটি চিরকুট ছিলো। ও স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছে। পারিবারিক সমস্যা দেখিয়ে। আমি তখন আমাদের বাড়িতে, ডিভোর্স হবার উনিশ দিন পর বুঝতে পারলাম আমি মা হবো। ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মা’ গো গানটি মনে পড়ে গেল।

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, মা ইশারায় ইঙ্গিত দিয়েছে নবজাতকে হত্যা করি। মা তুমি তো আমাকে হত্যা করনি। আমার সন্তানকে আমি হত্যা করব কেন?

আমি বাড়ি থেকে সেই যে পালিয়েছি আর যাইনি। শুধু আমার সৌন্দর্যের ভাটা পড়েছে। শরীরে আগের মত শক্তি নাই, কাম শক্তি উধাও হয়ে যাচ্ছে। খাচ্ছর ব্যাটারা তাগরা মেয়ে মানুষ খুঁজে।

মধু ওর মাকে বলতো, ‘মারে তোরা আমার যতই যাদু মন্তর করিস ওষুধ খাওয়াস কোন লাভ হবে না। আমার মনে হলো দোষ।

মানুষের মনে রোগ হলে তা সারানো যায় না। জীবনের স্মৃতিচিহ্ন গুলো কখনো ভুলা যায়না। আমার শাশুড়ি মানুষ হিসাবে ভাল ছিলো। আমার জন্য অনেক করেছে। তবুও সংসার রক্ষা হয়নি আমার। আজ কত বছর শুধু পুরাণ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। এ বুকের উপর পা দিয়ে হেঁটে গেল নগরীর অগণিত পুরুষ।

আজ দু’জন মানুষ আমার ঘরে আসার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে দাম হাঁকাচ্ছে। অযাচিত প্রিয় মুখ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড