• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ২১তম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি

  রিফাত হোসেন

২২ আগস্ট ২০১৯, ১২:৫৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ইরার পাশে বসল আদিত্য। ইরার দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল, ‘সরি ইরা। আমি না জেনে তোমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলে ফেলেছি। আসলে, তুমি তো সন্ধ্যার পর আর বাড়ি থেকে বের হতে না। তাই আজকে হঠাৎ করে এত রাতে তোমাকে বাইরে দেখে হা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আবার যখন দেখলাম, তোমার কাধে মাথা রেখে একজন বসে আছে। তখন আর নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। তাই ওইসব উল্টো পাল্টা কথা বলে ফেলেছিলাম আমি।’

ইরা কিছু বলল না। ও অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। আদিত্য আবার বলল, ‘একটা সত্যি কথা বলবে?’

ইরা আদিত্যর দিকে তাকালো। আদিত্য আবার বলল, ‘রাত ১ টার সময় তুমি বাড়ির বাইরে কী করছিলে?’

ইরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলতে শুরু করল, ‘বিকেলের দিকে আয়ান ফোন করে বলেছিল দেখা করতে। তো আমি দেখা করতে যাই। আয়ান বলল ,ওর মা নাকি আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি না করিনি। কিন্তু যখন ওর বাড়িতে গেলাম। তখন দেখি ওর বাড়িরে কেউ নেই। পুরো বাড়ি ফাঁকা। প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে যাই আমি। কিন্তু আয়ানের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তাই আমি স্বাভাবিক ভাবেই ছিলাম। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল, তবুও ওর মা আসছিল না। আয়ান বলেছিল ওর মা একটা কাজে বাইরে গেছে, কিছুক্ষণ পরই চলে গেছে। সেই কিছুক্ষণ করতে করতে রাত প্রায় ১০ টা বেজে যায়। আমি আয়ানকে অনুরোধ করি আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে। কিন্তু আয়ান আমাকে বাধা দেয়। ওর সাথে শারিরীক সম্পর্ক করার কথা বলে আমাকে।’

আদিত্য ইরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর তুমি তাতে রাজী হয়ে গেলে। এরপর দু'জনে মিলে এক অবৈধ মিলনে জড়িয়ে পড়লে। রাত ১ টা পর্যন্ত তোমাদের সেই অবৈধ মিলন চলছিল।’

- আবারও আমাকে ভুল বুঝছ তুমি।

- এভাবে বলছ কেন? সরাসরি বলে দাও তুমিও চাচ্ছিলে ওর সাথে শারিরীক সম্পর্ক করতে। সে-জন্যই তো বিকেল থেকে এত রাত পর্যন্ত ওর কাছে ছিলে।

- তোমার ধারণা ভুল আদিত্য।

- আমার ধারণায় কোনো ভুল নেই ইরা। তোমার ইচ্ছে না থাকলে কখনোই তুমি একা একটা ছেলের বাড়িতে থাকতে না।

- আমি তো ভেবেছিলাম ওর মা আসবে। তাছাড়া কীভাবে যে এত রাত হয়ে গেল, তা বুঝতে পারিনি আমি। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, তখন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। ও জোর করে আমার শরীরটা ভোগ করেছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওকে বাধা দেওয়ার। ও নেশা করেছিল। ওর শক্তির কাছে আমার শক্তি ছিল তুচ্ছতম। ও নিজের ইচ্ছেমতো আমার শরীরটা নিয়ে খেলা করেছে। এমনভাবে আমাকে ধরেছিল যে, আমি নরতে পারছিলাম না। খুবলে খেয়েছে আমার শরীরটাকে। তারপর ওর যৌন স্বাদ মেটানো শেষ হলে আমাকে ছেড়ে দেয়।

আদিত্য শব্দ করে হাসল। প্রায় মধ্যরাত। হাসপাতালে খুব কম সংখ্যক মানুষজন। অপারেশন থিয়েটারের সামনে ইরা আর আদিত্য ছাড়া কেউ নেই। ইরা আদিত্যর দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো। আদিত্য অনবরত হেসেই যাচ্ছে। ইরা আবার বলল, ‘এভাবে হাসছ কেন? নিশ্চয় বিশ্বাস হয়নি আমার কথা।’

হাসি থামিয়ে দিলো আদিত্য। তারপর বলল , ‘বিশ্বাস! বিশ্বাস কথাটির মানে বুঝ তুমি? অবশ্য আমিও আগে এর মানে বুঝতে পারতাম না। যখন তোমাকে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিলাম। তবে আজ আমি বিশ্বাস কথাটির মানে বুঝি। তুমি বলতে চাচ্ছ, তোমাকে জোর করে আয়ান নিজের যৌন স্বাদ মিটিয়েছে। কিন্তু কী জানো তো? আমার একটুও মনে হচ্ছে না এই কথাটি সঠিক। কারণ, তুমি একদম ঠিক আছো। জামা-কাপড় সহ সবকিছুই অক্ষত আছে তোমার। চুলগুলোও এলোমেলো নেই। মনে হচ্ছে রুমডেট শেষ হওয়ার পর ওর বাড়ি থেকে মেকআপ করে বের হয়েছ।’

ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার জামা-কাপড় ছিড়ে গিয়েছিল। ও নিজেই টেনেটুনে ছিড়েছিল সব। পরে আমি যখন বাড়িতে আসতে চাচ্ছিলাম, তখন ও আমাকে একটা জামা দিয়ে বলে এটা পরে যেতে। আর যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই বাড়িতে ফিরে যেতে। যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। আমি তখন না করিনি। কারণ ওই অবস্থায় কোনোভাবেই বাড়িতে যেতে পারতাম না আমি। নিজের শরীরের ভিতরের কলঙ্কের দাগ মুছতে পারব না হয়তো, কিন্তু মেয়ে হিসেবে বাবা-মায়ের সম্মান কে কীভাবে কলঙ্কিত করতাম আমি? তাই আমি ওর দেওয়া জামা পরে ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছি।’

- তোমাকে খুব ভালো করে চেনা হয়ে গেছে আমার। এইসব বানানো গল্প আমাকে শোনাতে আসবে না।

ইরা বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল। আদিত্যর শার্টের কলার ধরে বলল, ‘আমার দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিলে আঙুল তোলো একবার। আমি যাই করি না কেন, সেটা আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে করেছি। কিন্তু তুমি? যাকে ভালোবাসতে, তার বান্ধুবীর সাথে সম্পর্কে জড়ালে। যখন, যেখানে ইচ্ছে তাকে জড়িয়ে ধর, আবার চুমু দাও। না জানি আমার দৃষ্টির আড়ালে আরো কত কিছু হয়েছে তোমাদের মাঝে।’

আদিত্যর চোখের রঙ কালো থেকে ক্রমশ লাল টকটকে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। ইরা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ওর কলার ছেড়ে দিলো। আদিত্য রাগে কটমট করতে করতে বলল, ‘আমাদের মাঝে কোনো নষ্টামি নেই। তুমি যা দেখেছ, সেটা নিতান্তই মজার ছলে হয়েছে৷ সত্যি কথা বলতে কী, তোমাকে দেখানোর জন্যই আমরা ওইসব করেছিলাম। তবে কী জানো? জ্যোতিকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি ওকে। কারণ, তোমার মতো ও কারোর সাথে বেইমানি করে না।’

- তুমি করলেই ভালোবাসা, আর আমি করলেই তা নষ্টামি হয়ে যায়। আসলে কী জানো? সব ছেলেরাই এইরকম। সবাই শুধু নিজেদের দোষ আড়াল করার চেষ্টা করে। কিছুদিন আগেও বলতে তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না তুমি। কিন্তু আজ অন্য একটা মেয়ে তোমার জীবনে এসেছে, তাই আমাকে ভুলে গেছ। আমি খারাপ আমি জানি। কিন্তু তুমি তো ভালো ছেলে। তাহলে তুমি কেন করলে এটা? এবার তুমিই বলো আসল অপরাধী কে?

আদিত্য কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, যখন মানুষের খুব প্রিয় কেউ তাকে অপছন্দ, অবহেলা কিংবা ঘৃণা করে তখন প্রথম প্রথম মানুষ খুব কষ্ট পায় এবং চায় যে সব ঠিক হয়ে যাক । কিছুদিন পর সে সেই প্রিয় ব্যক্তিকে ছাড়া থাকতে শিখে যায়। আর অনেকদিন পরে সে আগের চেয়েও অনেকবেশী খুশি থাকে যখন সে বুঝতে পারে যে কারো ভালবাসায় জীবনে অনেক কিছুই আসে যায় কিন্তু কারো অবহেলায় সত্যিই কিছু আসে যায় না।’

উনার এই কথাটাকে আমি পুরোপুরি সমর্থন করি। আমি বুঝতে শিখেছি, জীবন কখনোই থেমে থাকে না। সময়ের মতোই জীবন তার নিজ গতিতে চলতে থাকে। আর হ্যাঁ, ছেলেরা, মেয়েরা বলে কথা না। তুমি আয়ানকে ভালোবাসো। এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে, আমিও জ্যোতিকে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি ভালোবাসাটাকে নষ্টামির পর্যায়ে নিয়ে গেছ। আমি সেটা করিনি। পার্থক্যটা এখানেই।

ইরা কিছু বলল না। বিশাল এক নীরবতা নেমে এলো দু’জনের মাঝে। বেশ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলে আদিত্য সামনে এগিয়ে যায়। ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল, ‘কাকা কেমন আছে এখন?’

- এখন ভালো আছেন উনি। আঘাতটা মাথায় লেগেছিল, তবে ব্রেইনে কোনো ক্ষতি হয়নি। ভাগ্য ভালো ছিল বলে বেঁচে গেছে। বলতে গেলে আরেকটুখানির জন্য সাংঘাতিক কিছু হয়ে যায়নি। ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণ পর উনার জ্ঞান ফিরলেই উনাকে বেডে দেওয়া হবে। আপনারা দেখা করতে পারবেন তখন।

ডাক্তার চলে গেল। আদিত্য আর ইরা চুপ করে বসে আছে। নীরবতা ভেঙে ইরা বলল, ‘আমি বাড়িতে যাবো। একটা সিএনজি ডেকে দিবে?’

আদিত্য ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘একা একা বাড়িতে যেতে হবে না তোমাকে। চুপ করে এখানে বসে থাকো।’

- আমার ভালো লাগছে না। আর এভাবে থাকতেও পারছি না। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে আমার। শরীর খুব দূর্বল। নাহলে আমি নিজেই সিএনজি ভাড়া করে বাড়িতে যেতে পারতাম।

আদিত্য ধমক দিয়ে বলল, ‘বললাম তো এখানে বসে থাকো চুপ করে। আর তোমার মাকে ফোন করে বলে দাও আমার কাকা হাসপাতালে আছেন, তাই তুমি আমার সাথেই হাসপাতালে আছ এখন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।’

ইরা কিছু বলল না। আদিত্য খাবার আনতে চলে গেল। ইরার মা আদিত্য আর ইরার সম্পর্কের কথা অনেক আগে থেকেই জানে। তবে ওদের সম্পর্ক যে ভেঙে গেছে, সেটা এখনো জানেন না তিনি।

হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে আসল আদিত্য। ভিতরে এসে ইরার হাতে খাবারগুলো দিয়ে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে এগুলো খেয়ে নাও। আমি জিজ্ঞেস করে আসি কাকাকে কেবিনে কখন দিবে।’

ইরা করুণ দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকালো। আদিত্য ওর দিকে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রিসিপশনের কাছে চলে গেল। রিসিপশনে গিয়ে জানতে পারল একটু পরই পেসেন্টকে বেডে দেওয়া হবে। আদিত্য রিসিপশন থেকে চলে এলো। কিছুক্ষণ পর ওর কাকাকে বেডে দেওয়া হলো। ডাক্তার জানালো পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আদিত্য ভিতরে গিয়ে ‘কাকা’ বলে ডাক দিলো। আদিত্যর কাকা, মিস্টার ইকবাল দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইরা কোথায়? ও কী চলে গেছে?’

- বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

- ওকে ভিতরে আসতে বল। ওর অছিলায় আমি এখনো বেঁচে আছি। ও আমাকে হাসপাতালে না আনলে এতক্ষণে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতাম আমি। এক্সিডেন্ট হওয়ার পর আশেপাশে সাহায্যের জন্য কাউকেই পাচ্ছিলাম না। অবশ্য এত রাতে মানুষজন না থাকাটাই স্বাভাবিক।

আদিত্য ইরাকে ডেকে দিলো। ইরা ভিতরে এসে মিস্টার ইকবাল এর পাশে চেয়ার টেনে বসল। মিস্টার ইকবাল ইরার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোট করব না মা। শুধু এইটুকুই বলব, তখন তুমি আমাকে হাসপাতালে না নিয়ে আসলে আমি হয়তো এতক্ষণে মারা যেতাম।’

ইরা কিছু বলল না। ওর কথা বলার শক্তি ক্রমশ কমে যাচ্ছে। আদিত্যর দেওয়া খাবারগুলোও সেভাবেই রেখে দিয়েছে ও। মিস্টার ইকবাল আবার বলল, ‘তুমি কী অসুস্থ ইরা?’

নিচু কণ্ঠে ইরা বলল, ‘না আঙ্কেল। একটু ক্লান্ত লাগছে, এই আরকি। আপনি এখন বিশ্রাম নিন।’

- অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো আজকে। আদিত্য যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো, তখন তো মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতে। আদিত্যর পড়াশোনাও শেষ। সেই সাথে তুমিও আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলে। যতদিন এই দেশে থেকেছি, মাঝে মাঝেই আদিত্যকে বলতাম তোমাকে যেন বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু ও সবসময় এড়িয়ে যেতো। বেশি জোর করলেই বলতো পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত তুমি। তাই আসতে পারছ না।

ইরা আড়চোখে আদিত্যর দিকে তাকালো। আদিত্য মনে মনে বলল, ‘তখন মিথ্যে বলেছিলাম কাকা। ও তো তখন আমাকেই সময় দিতো না খুব বেশি। বাড়িতে আসার কথা বললে তো রেগে যেতো। তারপর তো আমিই বাড়ি থেকে চলে এলাম। আর ওর সাথেও সম্পর্ক একেবারে ভেঙে গেল।’

কাকার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল আদিত্যর। মিস্টার ইকবাল বললেন, ‘আদিবাকে বলেছিস আমার এক্সিডেন্ট এর কথা?’

- আমার কাছে ফোন নেই। তাছাড়া মনেও ছিল না ওদের ফোন করে বলার কথা।

পাশ থেকে ইরা আদিত্যর দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার ফোন দিয়ে ফোন কর আদিবাকে।’

আদিত্য ফোনটা হাতে নিলো। আদিবার নম্বর ইরার ফোনে সেভ করাই আছে। তাই কন্টাক্টস নম্বরে গিয়ে আদিবার নম্বর বের করে ফোন দিলো।

আদিবা ঘুমোচ্ছিল তখন। হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠায় ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। পাশেই ওর মা, মিসেস রোকসানা শুয়ে ছিলেন। ফোন রিংটোন এর শব্দে তার ঘুমটাও ভেঙে গেল। তিনি আদিবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত রাতে কে ফোন করেছে?’

আদিবা ফোন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইরা আপু ফোন করেছে।’

- কোন ইরা?

- ভাইয়ার ফ্রেন্ড ইরা। যে আগে ভাইয়ার সাথে আমাদের আগের বাড়িতে আসতো। তুমি তো তাকে খুব পছন্দ করতে।

মিসেস রোকসানার মুখে হাসি ফুটে উঠল মুহূর্তের মধ্যেই। মায়ের মুখের হাসি চোখ এড়ায়নি আদিবার। এতদিন পর মায়ের মুখে হাসি দেখে ওর ভালো লাগছে। মিসেস রোকসানা বলল, ‘এতদিন পর ফোন করেছে মেয়েটা। অনেকদিন হলো ওর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।’

- ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে ইরা আপুর। ওদের দু'জনের মাঝে এখন আর সম্পর্ক নেই। তাই হয়তো সে-ও আর তোমার সাথে দেখা করতে আসে না।

- ফোনটা রিসিভ কর তাড়াতাড়ি। আমি ওকে কাল এই বাড়িতে আসতে বলব।

আদিবা ফোনটা রিসিভ করে মায়ের হাতে দিলো। ওপাশ থেকে কিছু বলার আগে মিসেস রোকসানা বলল, ‘এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল তোর। মায়ের কথা ভুলে গেছিস, তাই না?’

ফোনের ওপাশ থেকে আদিত্য স্তব্ধ হয়ে গেল। এতদিন পর মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে ওর চোখের কোণে জল চলে এলো। আদিত্য নিজের মনে মনে বলল, ‘মা কী আমাকে চিনতে পেরেছে? হয়তো পেরেছে। মা ছেলেকে চিনতে পারবে না? হাজার মাইল দূর থেকেও সন্তানের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় মায়েরা। সেখানে এই তো মাত্র ফোনের এপাশ আর ওপাশ।’

আদিত্য কিছু বলতে যাবে, তার আগেই মিসেস রোকসানা আবার বললেন, ‘চুপ করে আছিস কেন ইরা? কথা বল আমার সাথে।’

এই কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য আদিত্যর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল আদিত্যর। অনেক কষ্টে চেপে রেখেছে ও। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর অস্ফুটস্বরে আদিত্য বলল, ‘মা।’

মিসেস রোকসানার ভ্রু-কুঁচকে তাকালেন ফোন স্ক্রিনের দিকে। স্ক্রিনে ইংরেজি অক্ষরে স্পষ্ট লিখা আছে ‘ইরা আপু’। মিসেস রোকসানা আদিবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর সাহস হলো কীভাবে আমাকে মিথ্যে কথা বলার?’

আদিবা থতমত খেয়ে গেল মায়ের কথা শুনে। বড় করে ঢোক গিলল। তারপর নিচু স্বরে বলল, ‘আমি কখন মিথ্যে কথা বললাম মা?’

- ফোনের ওপাশ থেকে আদিত্য কথা বলছে। আর তুই আমাকে বললি ইরা ফোন দিয়েছে। তাছাড়া নম্বরটা ইরা লিখে সেভ করেছিস কেন?

- এটা ইরা আপুরই নম্বর মা। তুমি আবার কথা বলে দেখো।

মিসেস রোকসানা একটু চুপ থেকে ফোনটা আবার কানের কাছে নিলো। তারপর বলল, ‘কে বলছ?’

ওপাশ থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ এলো শুধু। মিসেস রোকসানা আদিবার দিকে একবার তাকালো। তারপর রাগী কণ্ঠে বলল, ‘ইরার ফোন দিয়ে আমাকে কল দিয়েছিস কেন? তাছাড়া এত রাতে ইরার সাথেই-বা কী করছিস তুই?’

আদিত্য কিছু না বলে ফোনটা ইরার হাতে দিয়ে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। ইরা ফোনটা কানে নিয়ে বলল, ‘আন্টি, আমি ইরা। আদিত্যর বড় কাকা এক্সিডেন্ট করেছে। তাকে নিয়েই হাসপাতালে এসেছি আমরা।’

- এইসব কী বলছিস মা? ওর কাকা তো দেশের বাইরে চলে গেছেন? তিনি এখানে কীভাবে আসবেন?

- আজকেই বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। রাস্তায় একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে গেছে। এখন অবশ্য সুস্থ আছেন।

- কোন হাসপাতালে আছে এখন? আমরা আসছি।

- এখন আসতে হবে না আন্টি। সকালে আসলেই হবে। এখন তো তিনি ঘুমাবেন। এসে কোনো লাভ হবে না। সেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

- ঠিক আছে। আমরা সকালে চলে আসবো।

- আচ্ছা।

ইরা কেটে দিলো ফোন। মিস্টার ইকবাল এর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি এখন বিশ্রাম নিন আঙ্কেল। আমি বাইরে গিয়ে দেখছি আদিত্য কোথায় গেল।’

- আচ্ছা।

ইরা বাইরে এসে দেখে আদিত্য মাথা নিচু করে বেঞ্চে বসে আছে। ইরা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আদিত্য মাথা তুলে ইরার দিকে একবার তাকালো। তারপর আবার মাথা নিচু করে ফেলল। দু'জনেই চুপ করে আছে। হঠাৎ করে আদিত্য বলল, ‘খাবারগুলো খেয়ে নাও।’

- এখন খাবো না আমি।

আদিত্য বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে ইরার গালে ঠাসস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। তারপর রাগী কণ্ঠে বলল, ‘থাপ্পড়টা আবারও খেতে না চাইলে চুপচাপ খাবারগুলো খেয়ে নাও।’

ইরা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিস্ময়, কৌতূহল আর একরাশ ভয় নিয়ে আদিত্যর দিকে তাকালো ও। আদিত্য আবার ধমকের স্বরে বলল, ‘যাও।’

আদিত্যর পাশেই খাবারগুলো রাখা ছিল। খাবারগুলো হাতে নিয়ে আদিত্যর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বসল ইরা। প্যাকেট খুলে দেখল রুটি আর ভাজি। দেরি না করে গবগব করে খেতে শুরু করল ও। এর আগেও দুইবার ইরাকে থাপ্পড় মেরেছিল আদিত্য। তবে তখনকার থাপ্পড়ে ছিল আদর, স্নেহ আর ভালোবাসা। আর এখনকার থাপ্পড়ে কী আছে, তা অজানা ইরার কাছে। অবশ্য জানার কোনো চেষ্টা-ও করছে না ও। খাওয়ার মাঝে ইরা মনে মনে বলল, ‘ওকে কী একবার জিজ্ঞেস করব, খাবে কিনা?’

কিছুক্ষণ ভাবল ইরা। তারপর আবার বলল, ‘জিজ্ঞেস করতে গেলে যদি আবার মারে! এর থেকে ভালো, আমিই খেয়ে নেই সবটা। কিছু পাগল আছে, যাদেরকে ভালো কথা বললেও তারা ক্ষেপে যায়। আদিত্য অনেকটা সেইরকম’ই। খাওয়ার কথা বলে ওকে রাগানোর কোনো মানেই হয় না। একটা অসহায় মেয়েকে থাপ্পড় মারতেও দু'বার ভাবে না ও। ফাজিল ছেলে একটা।’

ইরা নীরবে খাচ্ছে, আর মনে মনে এইসব ভেবে যাচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে প্যাকেটগুলো আদিত্যর হাতে দিয়ে বল, ‘এগুলো ফেলে দিয়ে আসো।’

- আমি কেন ফেলতে যাবো এগুলো? তুমি খেয়েছ, তুমিই ফেলে দিয়ে আসো।

ইরা কিছু না বলেই আদিত্যর সামনে থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বেঞ্চের শুয়ে পড়ল। আদিত্যও আর কিছু বলল না। প্যাকেটগুলো ডাস্টবিন এ ফেলে দিয়ে এলো।

(চলবে...) আরো পড়ুন ‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ২০তম পর্ব - ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড