• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ১৮তম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি

  রিফাত হোসেন

১৯ আগস্ট ২০১৯, ১১:৪০
গল্প
ছবি : প্রতীকী

বেশ কিছুক্ষণ নীরবে থাকার পর আদিত্য জ্যোতির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘মনে হচ্ছে লোকগুলো জঙ্গল থেকে বের হয়ে গেছে। আমাদের এবার এগোনো উচিত।’

আদিত্যর বুক থেকে মাথা তুলল জ্যোতি। এদিক ওদিক তাকানোর পর আবার আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার খুব ভয় করছে।’

- সেদিন তো আমাকে হুমকি দিলেন। যে আমার ঠ্যাং ভেঙে দিবেন। আরো কত কী বললেন? তাছাড়া শুনেছি গ্রামে বেশ গুণ্ডিগীরিও করেছেন। এত সাহসী মেয়ে আপনি। তাহলে এখন এত ভয় পাচ্ছেন কেন?

- ওটা তো আমার গ্রাম ছিল। এটা তো অন্য জায়গা।

- নিজের গ্রামে গেলে পাওয়ার বেড়ে যায়। আর অন্য জায়গায় গেলে ভয়ে চুপসে যান। এটা মোটেও সাহসীকতার পরিচয় না।

জ্যোতি বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, ‘উফ, এখন আমার সাহসের বিচার না করে তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজুন। আমার ভালো লাগছে না এখানে।’

- ঠিক আছে। আপনি আমাকে ধরে ধরে হাঁটুন। আর ভুল করেও কোনো শব্দ করবেন না।

জ্যোতি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আড়াল থেকে বের হয়ে এলো আদিত্য। জ্যোতি ওর হাত ধরে রেখেছে। আস্তে আস্তে চারিদিকে নজর রেখে এগিয়ে যাচ্ছে দু'জন। হঠাৎ দেখলো কিছুটা দূরে আলো দেখা যাচ্ছে। আলোটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। যত এগিয়ে যাচ্ছে, আলোটা তত বড় আকার ধারণ করছে। আদিত্য জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মনে হচ্ছে কেউ আগুন জ্বালিয়ে বসে রেখেছে ওখানে।’

- হয়তো ওই লোকগুলো। যাদের কথাবার্তার আওয়াজ এতক্ষণ পাচ্ছিলাম আমরা।

- এত দূর থেকে কারোর কণ্ঠস্বর ওখানে দাঁড়িয়ে আমরা শুনতে পাবো না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, কথাগুলো এই আগুনের সামনে থেকে বলেনি, আমাদের ওখান থেকেই বলেছে।

- তাহলে আমরা কী করব এখন?

- আগে আগুনটার কাছে যাই। দূর থেকে দেখবো ওরা কী এখনো আছে? নাকি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গেছে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবো। ওরা নিশ্চয়ই উল্টো দিকের রাস্তা দিয়ে ভিতরে এসেছে। তাই আমরা সেই রাস্তা দিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করব।

- ঠিক আছে চলুন।

- হুম। তবে খুব সাবধানে যেতে হবে। হয়তো ওরা এখনো আগুনের কাছেই আছে।

জ্যোতি রেগে গিয়ে বলল, ‘আপনি শুধু শুধু আমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছেন। একেকবার একেক কথা বলছেন আপনি। যেটা বলবেন, স্ট্রেইট সেটাই করবেন।’

- ঠিক আছে।

আদিত্য আর জ্যোতি আগুনটার দিকে খুব সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগল। খুব কাছাকাছি চলে যাওয়ার পর আদিত্য খেয়াল করল ওখানে লোকজন আছে। ঝোপঝাড় এর আড়ালে লুকিয়ে দেখল অনেকগুলো লোক ওখানে। ছোট একটা তাবু কেউ কেউ বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর একজন যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছে শুকনো কাঠামো দিয়ে আগুনটা জ্বালিয়ে রাখার।

আবার কেউ কেউ গাছের সাথে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আগুনে কাঠ দেওয়া লোকটির দিকে ভালো করে তাকালো আদিত্য। হঠাৎ ওর বুকটা ধুক করে উঠল। জ্যোতিকে নিজের সাথে চেপে ধরল ও। জ্যোতি আদিত্যর দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো। আদিত্য জ্যোতির কানের কাছে মুখটা নিয়ে বলল, ‘এদেরকে আমি চিনি। এরা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। আপনাদের বলেছিলাম না, আমাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল একটা ছেলে। তারপর কাজের কথা বলে আমাকে নিজের কাকাকে খুন করার প্রস্তাব দিয়েছিল।’

জ্যোতি বলল, ‘হ্যাঁ। ওই যে, নৌকায় ঘুরতে যাওয়ার সময় বললেন। আপনাকে তো মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছিল ওরা।’

- হ্যাঁ। ওরা সবাই এখানে আছে। সামনে যারা শুয়ে আছে। সবাইকে আমি চিনি। যে ছেলেটা আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখছে, সেটা কে শুনবেন?

- কে?

- ওর নাম রোহান। ওর সাথেই প্রথম পরিচয় হয় আমার। আমাকে পুলিশের হাত থেকে এই রোহানই বাঁচিয়েছিল। তারপর আবার সন্ধ্যার সময় আমাকে মিথ্যা বলে কারখানায় নিয়ে গেছিল এই ছেলেটাই।

জ্যোতি উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমি ওকে দেখবো একটু।’

- বাইরে বের হওয়া যাবে না। আর আপনার যে সাইজ, তাতে এই ঝোপের আড়াল থেকে কিছুতেই দেখতে পারবেন না।

- কিন্তু আমার যে খুব ইচ্ছে করছে ওদের দেখতে।

আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। হঠাৎ হাত দু’টো দিয়ে জ্যোতির কোমড়ে চেপে ধরল। সাথে সাথে শিউরে উঠল জ্যোতি। বিদ্যুৎ চকমকানো মতো করে চমকে উঠল ও। চোখ দু’টো বন্ধ রেখে বড় করে নিশ্বাস ছাড়ল। আদিত্য ওর কোমড় শক্ত করে ধরে ওকে উপরে তুলে ফেলল। জ্যোতি কিছুটা ভয় পেলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। স্বাভাবিক ঘটনার মতো করে এড়িয়ে গেল। চোখ মেলে সামনের দিকে তাকিয়ে রোহানকে দেখল। ভ্রু-কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ইশারায় নিচে নামাতে বলল আদিত্যকে। আদিত্য ওকে নিচে নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখেছেন।’

জ্যোতি প্রতিউত্তর দিলো না। আদিত্য আবার বলল, ‘কী হলো?’

জ্যোতি আদিত্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি এই লোকটাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি।’

আদিত্য অবাক হলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি উনাকে আবার কোথায় দেখবেন?’

- লোকটার নাম কী যেন বললেন?

- রোহান।

- হ্যাঁ। আমি ওকে খবরের কাগজে দেখেছি।

- ঠিক বুঝলাম না। ওকে খবরের কাগজে কীভাবে দেখলেন আপনি?

- আপনি হয়তো খবরের কাগজ পড়েন না৷ অথবা নিয়মিত না৷ কিন্তু আমি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ি। আমার হোস্টেলে কাগজ দিয়ে যায় একটা লোক। কালকে যখন আপনাদের ওখান থেকে হোস্টেলে গেলাম। তখন দেখি আমার টেবিলে খবরের কাগজ রাখা আছে। তো আমি আর দেরি না করে পড়তে শুরু করলাম। প্রথম পাতাতেই দেখলাম এই ছেলেটা সহ আরো বেশ কয়েকজনের ছবি। একটা খুনের অভিযোগে এদের সবাইকে খুঁজছে পুলিশ। ওদের মধ্যে একজনকে ধরতে পেরেছে। ওর কাছে থেকেই বাকি সবার নাম, ছবি সহ আরো গোপনীয় সব তথ্য জোগাড় করেছে পুলিশ। পুরো দেশে এই নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।

আদিত্য নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। জ্যোতি আবার বলল, ‘এরা খুব ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। আমাদের উচিত এক্ষুনি পুলিশের কাছে খবরটা পৌঁছে দেওয়া, যে ওরা এই জঙ্গলে লুকিয়ে আছে।’

- কিন্তু কীভাবে? আমাদের কাছে তো কোনো ফোন নেই।

- আমিও সেটাই ভাবছি।

- আচ্ছা আপনি অপেক্ষা করুন এখানে। আমি একটু আসছি।

জ্যোতি আদিত্যর হাত চেপে ধরে বলল, ‘আমিও যাবো আপনার সাথে। এখানে একা থাকতে পারব না আমি। ভয়ে মরেই যাবো।’

- আমি দূরে কোথাও যাবো না। আড়াল থেকে ওদের সবার পজিশনটা একটু দেখে আসবো শুধু।

- ওদের পজিশন দেখে আপনি কী করবেন? এইসব তো পুলিশের কাজ। তাছাড়া আপনাকে যদি দেখে ফেলে ওরা কেউ?

- পুলিশকে জানানোর জন্য হলেও এই রিস্কটা আমাদের নিতে হবে। আপনি প্লিজ চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন শুধু।

- ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।

আদিত্য জ্যোতির থেকে কিছুটা পিছিয়ে এলো। ঝোপঝাড় এর আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে তাবুর কাছাকাছি যেতে লাগল। রোহান আগুন নিয়ে ব্যস্ত এখন। আদিত্য পা টিপে টিপে যাচ্ছে তাবুর কাছে। অনেকটা কাছে চলে যাওয়ার পর তাবুর ভিতরের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেলো ও। কিন্তু ভিতরে যা দেখলো, তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না আদিত্য। ওর হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে। আতঙ্কে চিৎকার দিতে গিয়েও নিজেই হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরল। আস্তে আস্তে আবার পিছনের দিকে যেতে লাগল আদিত্য। ঝোপের কাছে যেতেই দেখল, জ্যোতি উঁচু হয়ে ঝোপের উপর দিয়ে সামনের দিকে দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। আদিত্য জ্যোতির হাত ধরে টান দিলো।

আকস্মিক ঘটনায় আতঙ্কে উঠল জ্যোতি। চিৎকার দিতে যাবে, তখনই আদিত্য নিজের ঠোঁট দিয়ে জ্যোতির ঠোঁট দু'টো আটকে দিলো। জ্যোতির ঠোঁট দু'টো নিজের ঠোঁটের গভীরে রেখে জ্যোতিকে জড়িয়ে ধরল। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা দু'জনের মাঝে। জ্যোতি চোখ বন্ধ করে আদিত্যর স্পর্শ অনুভব করছে। জ্যোতি শান্ত হয়েছে এটা ভেবে আদিত্য ওর ঠোঁট ছেড়ে দিলো৷ তখনই জ্যোতি আদিত্যর ঠোঁট দু’টোয় একটা কামড় দিলো। আদিত্য উফ্ শব্দ করতে চাইলেও নিজেকে সামলে নিলো। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বলল, ‘কামড় দিলেন কেন?’

- আপনি নিজেই তো আগে আমার ঠোঁট দু'টো আটকে দিলেন। তাই একটু ভয় পেয়ে কামড় দিয়েছি।

- শুরুতে তো খুবই উপভোগ করছিলেন। যেই আমি ছেড়ে দিচ্ছিলাম, তখনই কামড়টা দিতে হলো। আচ্ছা বাদ দিন। আমি একটু বাসটার কাছে যাবো ভাবছি।

জ্যোতি কৌতূহলী কণ্ঠে বলল, ‘বাসটার কাছে যাবেন মানে?’

- এখন এত কিছু বলতে পারব না। আপনি আমার সাথে আসুন। এখানে একা রেখে যাওয়া যাবে না আপনাকে। ভয় পেয়ে কখন আবার চেঁচামেচি শুরু করে দেন। তখন আর বাঁচার কোনো পথ থাকবে না।

- আমিও সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম। এভাবে জঙ্গলের ভিতরে একা থাকতে পারব না আমি।

জ্যোতি আর আদিত্য কোনোরকম শব্দ না করে পিছনের রাস্তা দিয়ে যেতে লাগল। বাসটা তখনও এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। এভাবে জনশূন্য রাস্তায় যাত্রীদের ফেলে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই হয়তো ড্রাইভার সবাইকে নিয়েই সকাল হওয়ার অপেক্ষায় আছে। বাসের কাছে গিয়ে দরজায় টোকা দিতেই হেল্পার জিজ্ঞেস করল, কে?

আদিত্য বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে বাস থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিলাম আমরাও।’

লোকটা দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘আসুন।’

- আমরা ভিতরে যাবো না। আপনি একটু মোবাইলটা দিন। আর বাসের কাউকে জিজ্ঞেস করুন, আশেপাশে কোনো থানা আছে কিনা। থাকলে, নম্বরটা নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি।

লোকটা ভিতরে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার বাইরে এসে বলল, ‘এই নিন ফোন। নম্বরটা ডায়াল করা আছে। কিন্তু পুলিশকে ফোন দিয়ে কী করবেন এখন? সকালের আগে রাস্তা ক্লিয়ার হবে না।’

- অন্য একটা কারণে।

লোকটা আর কিছু বলল না। আদিত্য পুলিশকে ফোন দিয়ে পুরো ব্যপারটি জানিয়ে দিলো। তারপর লোকটার হাতে ফোন দিয়ে বলল, ‘আমরা আবার ওখানে যাচ্ছি।’

- কিন্তু ভাই, আপনি পুলিশদের কাছে যা, যা বললেন, তাতে মনে হচ্ছে লোকগুলো খুবই ভয়ঙ্কর। আপনারা আবার ওখানে যাবেন বলছেন। কোনোভাবে যদি দেখে ফেলে, তাহলে আপনাদের শেষ করে ফেলবে ওরা।

- ওখানে যাওয়াটা খুব প্রয়োজন আমাদের। ওরা যদি কিছু অনুমান করে পুলিশ আসার আগেই পালিয়ে যায়। তাহলে আমরা জানতেও পারব না ওরা কোনদিকে গেছে। যদিও আমি পুলিশদের বলেছি সাবধানে আসতে। কারণ ওখানে ওই ক্রিমিনাল'রা ছাড়া-ও অন্য মানুষ আছে। যাদের আটকে রেখেছে ওরা। আমি কোনোভাবেই চাই না তাদের কোনো ক্ষতি হোক।

- আমিও আসব আপনার সাথে। যদি কোনো প্রয়োজন হয়।

- লোক বেশি হলেই সমস্যা এখন। ওরা টের পেলেই পালিয়ে যাবে, নাহয় আমাদের ক্ষতি করবে।

- ঠিক আছে ভাই যান আপনি। তবে ম্যাডামকে এখানে রেখে গেলে ভালো হয়। ভয় পেয়ে যদি আবার উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে। তখন আপনারা বিপদে পড়ে যাবেন। আর সন্ত্রাসীরা-ও পালিয়ে যাবে।

পাশ থেকে জ্যোতি বলল, ‘আমি উনাকে ছাড়া থাকবো না। উনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাবো।’

আদিত্য নিজেও অনেকবার বুঝালো জ্যোতিকে। কিন্তু জ্যোতি রাজী হলো না কোনোভাবেই। তাই বাধ্য হয়ে, ওকে সাথে নিতে হলো।

এবার বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ওদের দিকে নজর রাখল আদিত্য আর জ্যোতি। বেশ কিছুক্ষণ পর আদিত্য খেয়াল করল অনেকগুলো লোক আসছে। আদিত্য আর জ্যোতি লুকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করল উনারা কারা। আরো কিছুটা এগিয়ে আসার পর আদিত্য বুঝতে পারল উনারা পুলিশের লোক। ঝোপ থেকে বেরিয়ে আগে থেকেই হাত দু’টো উঁচু করে রাখল ওরা। যাতে সন্ত্রাসীদের লোক ভেবে গুলি না ছুড়ে পুলিশ। লোকগুলো আদিত্য আর জ্যোতির কাছে এলো। তাদের মধ্যে থেকে একজন আদিত্যর সামনে এলো। সম্ভবত বড় কোনো অফিসার তিনি। ওই অফিসার আদিত্যর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল - আমি ওসি হামেদ আহমেদ।

- আমার নাম আদিত্য। আমিই ফোন করেছিলাম আপনাদের।

- ওরা কোথায় আছে?

- ওরা সামনেই আছে। আমি যতদূর দেখেছি, একজন বাদে বাকি সবাই ঘুমিয়ে আছে। আর স্যার প্লিজ, গুলি চালাবেন না। ভিতরে এই মেয়েটার ভাই আর ভাবী আছে।"

সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকালো। জ্যোতি তড়িঘড়ি করে বলল, ‘ভাইয়া আর ভাবী আছে মানে? কী বলছেন আপনি এইসব? ওরা এখানে কীভাবে থাকবে?’

- এখানে কীভাবে এসেছে, তা আমি জানি না। তবে আমি ওদের দেখেছি ওই তাবুর ভিতরে। আমি যখন আপনাকে ঝোপের আড়ালে রেখে ওদের তাবুর কাছে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম শুভ ভাই আর সুমাইয়া ভাবী হাত-পা আর মুখ বাধা অবস্থায় পড়ে আছে। তারা অবশ্য আমাকে দেখেনি, কারণ তাবুর পিছনের দিকটা অন্ধকার। তাদের চারিদিকে লোকজন। তবে সবাই ঘুমিয়ে আছে। জেগে আছে শুধু শুভ ভাই আর ভাবী। আর স্যার, বাইরে লোকটা আছে, ও কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। খুব চালাক-ও। তাই বলছি খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে।

জ্যোতি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমাকে আগে বলেননি কেন আপনি?’

- ঠিক এই কারণেই বলিনি তখন। আমি যদি তখন বললতাম যে ওরা এখানে আছে। তখন আপনি উত্তেজিত হয়ে যেতেন। কান্না করতেন। আরো ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করতেন। আমাদের একটা ভুল উনাদের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। এটা ভেবেই তখন চুপ ছিলাম আমি।

- আমি ওদের কাছে যাবো। প্লিজ স্যার, যেভাবেই হোক আপনারা আমার ভাইয়া আর ভাবীকে বাঁচান।

আদিত্য জ্যোতিকে নিজের কাছে আনল। জ্যোতির চোখ দু'টো মুছিয়ে দিলো। তারপর ওসি হামেদ আহমেদ কে বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের ধরুন স্যার।’

ওসি হামেদ আহমেদ ইশারায় সবাইকে নিজেদের পজিশন দেখিয়ে দিলো। সাথে সাথে তাবুটার চারিদিক ঘিরে ফেলল পুলিশ। ওসি হামেদ সহ আরো দু'জন এগিয়ে গেল রোহানের দিকে। রোহান তখনও আগুনের কাছে বসে ছিল। কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনের দিকে পিস্তল তাক করে। তখনই রোহানের পিছনের জঙ্গল থেকে দু'জন পুলিশ এসে রোহানের মাথায় বন্দুক তাক করে ধরে। ওসি হামেদ আহমেদ ইশারায় রোহানকে চুপ থাকতে বলল। অন্যথায় মাথায় গুলি করবে। রোহান ভয় পেয়ে চুপ হয়ে গেল। চারিদিক থেকে সবাই বেরিয়ে এসে ঘুমিয়ে থাকা সবার মাথায় বন্দুক তাক করে ধরে রাখল। ওসি হামেদ পরপর দু’টো গুলি উপরের দিকে ছুড়তেই তড়িঘড়ি করে সবাই ওঠে গেল। কিন্তু ওরা কিছুই করতে পারল না, কারণ সবার মাথায় একটা করে বন্দুক তাক করানো। তাবুর ভিতরের সবাইকে বাইরে নিয়ে এলো। জ্যোতি আর আদিত্য দৌড়ে তাবুর ভিতরে গেল। শুভ আর সুমাইয়াকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলো জ্যোতি। হাত-পা আর মুখের বাধন খুলে দিয়েই দু'জনকে জড়িয়ে ধরল ও। শুভ বড় বড় করে নিশ্বাস ছাড়ছে। সুমাইয়া ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিত্য আর জ্যোতির দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর সুমাইয়া বলল, ‘তোরা কীভাবে জানলি আমরা এখানে আছি?’

আদিত্য সবটা বলল ওদের। শুভ বলল, ‘কী বলব ঠিক ভেবে পাচ্ছি না। তোরা দু’জন না থাকলে আমরা হয়তো বেঁচে বাড়িতে ফিরতে পারতাম না। সকাল হলেই প্রমাণ লোপাট করার জন্য ওরা আমাদের মেরে নিজেরা পালিয়ে যেতো।’

আদিত্য বলল, ‘কিন্তু আপনারা এখানে কীভাবে এলেন? আর আপনাদের এক্সিডেন্ট কোথায়, কীভাবে হয়েছিল?’

ক্লান্তিকর কণ্ঠে সুমাইয়া বলল, ‘এখন শরীরে একদম শক্তি নেই ভাইয়া। সেই দুপুরে একটা ধাবাতে হালকা খাবার খেয়েছিলাম। এরপর থেকে না খাওয়া।’

- আপনাদের যে তেমন কিছু হয়নি সেটাই অনেক। আমরা তো ভেবেছিলাম এক্সিডেন্টে বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে আপনাদের। পরে যখন এখানে দেখলাম। তখন কিছুটা শান্তি পেয়েছি।

- সকাল হলে ওরাই আমাদের মেরে ফেলতো। তারপর পালিয়ে যেতো ওরা।

- ঠিক আছে আপনারা এখন উঠুন। আপনাদের চিকিৎসা প্রয়োজন।

শুভ আর সুমাইয়া ওঠে দাঁড়ালো। তাবুর বাইরে আসতেই ওসি হামেদ আহমেদ বলল, ‘মিস্টার আদিত্য, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি না থাকলে হয়তো এত সহজে এই মাফিয়া গ্যাংটাকে ধরতে পারতাম না।’

- আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনারা সময় মতো না আসলে এনাদের বাঁচাতে পারতাম না।

- ঠিক আছে৷ কালকে যেকোনো সময় এই দু'জনকে নিয়ে আমাদের থানায় চলে যাবেন আপনারা। আপনাদের লিখিত অভিযোগ খুব প্রয়োজন। এদের সবাইকে আমি সারাজীবনের জন্য জেলে ঢুকিয়ে দিবো। আর ওদের লিডারকে তো ফাঁসিতে ঝুলানোর ব্যবস্থা করব। পুরো দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছে এই গ্যাংটা৷ কোর্ট থেকে বলে দিয়েছে, এদের তাড়াতাড়ি ধরতে। এবং পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি করতে।

ওসি হামেদ আহমেদ হাঁটতে লাগল। পিছন পিছন শুভ, সুমাইয়া, আদিত্য আওর জ্যোতিও এলো। রাস্তায় এসে শুভকে উদ্দেশ্য করে আদিত্য বলল, ‘আচ্ছা আপনাদের এক্সিডেন্ট কোথায় হয়েছিল?’

- এখানেই হয়েছিল।

- তাহলে নিশ্চয় মিস্টার জন আশেপাশের কোনো হাসপাতালে আছে।

- সামনেই একটা হাসপাতাল আছে। হয়তো সেখানেই আছেন তিনি।

ওসি হামেদ আহমেদ এর গাড়ি করেই ওরা হাসপাতালে পৌঁছালো। ভাগ্যক্রমে মিস্টার জনকেও পেয়ে গেল ওই হাসপাতালে।

(চলবে...) আরো পড়ুন ‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ১৭তম পর্ব - ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড