• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘হতভাগ্য বাতিওয়ালা’-এর অষ্টাদশ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : হতভাগ্য বাতিওয়ালা

  মুহাম্মদ বরকত আলী

১৮ আগস্ট ২০১৯, ১৩:৫৩
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

সব সময় চেষ্টা করি সময়ের কাজ যথা সময়ে করা। যাকে বলে একেবারে কাটায় কাটায়। কোনো কাজে গেলে আগেও যায় না সময় পার করেও যায় না। অপেক্ষা আমার নিকট সবচাইতে বিরক্তিকর ব্যাপার। আর তাই ইশকুলেও আসি ঠিক সাড়ে নয়টা। ছাত্রছাত্রীরা ইশকুল মাঠে খেলছে যে যার মত। এখনতো খেলার কথা না। একটা অজানা কৌতূহল নিয়ে অফিস কক্ষে ঢুকলাম। ব্যাপার বুঝলাম না আজ সবাই চুপচাপ অফিসে বসে কেন? এমন নীরব তো কখনো দেখিনি । সিরাজ স্যার হাতের ব্যান্ডেজ গলায় ঝুলিয়ে এক কোনায় চুপচাপ বসে আছেন। মনে হচ্ছে আজ কোনো শোক দিবস পালন করছেন। সিরাজ স্যার চুপচাপ থাকতেই পরে। একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়ে ভয়ে আতঙ্কে আছেন তিনি। কিন্তু বাকিরা আবার কী আতঙ্কে ভুগছেন? হেড স্যার চেয়ারের দুলুনি বন্ধ করে মনমরা হয়ে বসে আছেন।

ফরিদ ভাই হাতের কাজ বন্ধ করে হাত খুটরাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আঙ্গুলের মাঝে কি যেনো হারিয়েছে ফেলেছেন যা উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। কাজের লোক কিনা তাই প্রতিদিনের অভ্যাসে একটু ছেদ পড়লে এমনটি হয়। মৌসুমি হাসান ম্যাডামকে মনে হচ্ছে এই মাত্র কারো সাথে ঝগড়া করে এলো। চোখ দুটো লাল করে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছেন। পুরোপুরি থমথমা অবস্থা। কোথাও মার্ডার হওয়ার পরবর্তী পরিবেশ যেমনটি থাকে ঠিক তেমনটি দেখা যাচ্ছে। এমনও হতে পারে যে মৌসুমি আপা ভাই সাহেবের সাথে বিবাদ করে এসেছেন। তা বলে উনার জন্য সবাই শোকাহত নাকি? গাজী স্যার মাঝে মধ্যে আমার দিকে পিটপিট চোখে তাকাচ্ছে। আরে জনাব আমি আবার কী করলাম? এটা কী কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস, নাকি ঝড়ের পরবর্তিভাস? কিছু বুঝতে পারছি না। অনেকেই না খেয়ে উপবাস থাকে এরা দেখছি কথা না বলে কথা উপবাস করছে। সবাই যখন নীরব তখন আমি কেনো কথা বলবো? বেশ কয়েক মিনিট এমন দৃশ্য দেখলাম। কেউ কথা বলছে না। হেড স্যারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। কী ব্যাপার স্যার, কেউ কথা বলছে না যে? সকলেই এত নীরব কেন? হেড স্যার কোনো কথার জবাব দিলো না। ও বুঝেছি, আপনারা প্রতিযোগিতা করছেন। দেখছেন কে কতক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে এই তো? ছোট বেলায় স্কুলে আমিও এমন খেলা করেছি। খুব মজার খেলা। জেতার জন্য বন্ধুদের মুখের কাছে গিয়ে কত রকমের হাস্যকর অভিনয় করতাম। যেনো সে আগে কথা বলে। মুখে কথা বলতাম না শুধু উ আ উ আ করতাম। আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আমি খেলবো। আমি এখন থেকে শুরু করলাম। চুপচাপ আমিও বসে রইলাম।

কথা বলা যাবে না ঠিক আছে, তাই বলে কি আহা উহু করা যাবে না? ছোট বেলায় এটা নিষেধ ছিলো না। নিশ্চয় এখনো নিষেধ নেই। একটা গান ধরা যাক। গান ধরলে কেউ না কেউ কথা বলবে। তবে সংকেতের গান। কথা বলে আমি এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়তে চায় না। এই এখন থেকে আমার সময় শুরু হলো। উউউ উউউ আআআ আআআ ই ই ই। কিছুক্ষণ গাইতে থাকলাম আমার তৈরি সাংকেতিক গান। নাহ, এসব গান আর ভালো লাগছে না। আজ ক্লাস নিবো সাংকেতিক ভাষায়। কোনো কথা না বলে উঠে পড়লাম। কথা বলা বন্ধ করে চকের টুকরা হাতে নিয়ে বের হতেই মৌসুমি ম্যাডাম বলল, তপু আজ ক্লাস বন্ধ।

আপা সবার আগে কথা বলেছেন। আপনি এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়লেন। এই যা! আমিও যে কথা বলে ফেলাম। সব দোষ আপনার। আপনার জন্যই আমি হেরে গেলাম। স্কুল জীবনে এই খেলায় আমাকে কেউ হারাতে পারেনি। আজকেও আমিই ফাস্ট হতাম নিশ্চিত। কী আর করার, ক্লাসের সময় পার হয়ে গেছে। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সামনে পা বাড়াতেই আবার বললেন, বললাম তো আজ ক্লাস বন্ধ। এবার বুঝতে পেরেছি নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। কেন? কিছু হয়েছে? সরকারি কোনো ছুটি না কি? সফদার চাচা ছুটি ছাটা গুলো তো একটু দেখতে পারেন। আগে জানলে একটু দিবা নিদ্রা দিতাম। আমি এগুলো বলছি ঘটনা কী ঘটেছে তা যেনো মৌসুমি ম্যাডাম নিজের থেকে বলে। সিরাজ স্যার বললেন, ইশকুলের ক্লাস আজ বর্জন করেছে সবাই। সবাই বলছেন কেন? আমিতো করিনি। মৌসুমি ম্যাডাম এবার কথার ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তা করবে কেন? তোমার তো কোনো সমস্যা নেই। সংসার নেই, চাল নেই, চুলো নেই, বেতন হলেও কী না হলেও কী। এতক্ষণ তো এই আশায় ছিলাম যে মূল ঘটনা কী ঘটেছে শুনতে হবে। আনোয়ার স্যার বললেন, এভাবে আর কত দিন চলবে? আমাদের তো সংসার আছে। কী করতে যে এম এম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছেড়ে এখানে মরতে এসেছিলাম। বন্ধুর কথা মত ওর ইশকুলে যদি থাকতাম তাহলে কবেই বেতন হয়ে যেতো। ওরা এখন দিব্যি বেতন পাচ্ছে। সরকারি দলের লোকজন থাকতে হয়। এমনি এমনি হবে? কপালে আছে এই ঘানি টানা আমি কি আর তা খণ্ডাতে পারি? জ্বি স্যার, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। মেনে নিন না। মন থেকে মেনে নিলে আর কষ্ট মনে হবে না। মৌসুমি ম্যাডাম বলল, আমার ভাই বোন সবাই চাকুরী করছে। আমার বান্ধবীরাও কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও চাকুরী করছে। শুধু আমিই পড়ে আছি এখানে। এম এ পাশ করে কিনা একটা অবৈতনিক স্কুলে পড়ে আছি। বলতেও লজ্জা লাগে।

আমি সবার অনেক জুনিয়র। উনাদের উপদেশের কথা শোনানোর যোগ্যতা আমার নেই কিন্তু ভুল গুলো তো ধরিয়ে দিতে পারি।

আপা, আপনার তো কোনো সমস্যা থাকার কথা না। ভাই সাহেব তো ভালো একটা চাকুরী করছে। আপনার আবার কি প্রয়োজন? আর এখানে হেড স্যার, আনোয়ার স্যার, সিরাজ স্যার, এমন কি ফরিদ সাহেব, দুঃখিত ফরিদ ভাই সহ সবাই মোটামুটি চলছে। মানে যেভাবেই হোক চলে তো যাচ্ছে? শুধু মাত্র গাজী স্যারের একটু বেশিই সমস্যা। গাজী স্যার অনেক কষ্ট করে জীবন চালাচ্ছেন। কিন্তু দেখেছেন গাজী স্যার কখনো বিলাপ করেন না। কিন্তু কখনো গাজী স্যারকে বলতে শুনেছেন যে, এখানে এসে ভুল করেছি। অথবা একটু বিলাপ? স্যারের সমস্যা হলো কোনো বন্ধু মিথ্যে করে বললো যে ঐ স্কুল এমপিও হলো, এই এমপিও ছাড়লো এগুলোর খোঁজ খবর রাখা। এটা সে করতেই পারে।

আশায় বাঁধে বাসা। সফদার চাচাকে স্কুলের ফান্ড থেকে যা দেওয়া হয় তাতে উনার মোটামুটি নুন ভাত হয়ে যায়। আর অন্যান্য শিক্ষকেরা এসব ব্যাপারে কিছুই বলেন না। তার মানে নিশ্চয় তারা ভালো আছেন। সমাজ সেবা করতে এসেছেন সমাজ সেবা করেন। এবার সবাই নীরব। আমি এগুলো বলতে চায়নি তবুও কিছুটা ওনাদের দুঃখ সরিয়ে দেওয়ার জন্য বলি। কারো চাহিদার শেষ আছে? আমি জানি এখানে দুএক জন বাদে সব শিক্ষকের অবস্থা খুব একটা ভালো না। কোনো মতে চলে যায়। এতক্ষণ পর কলিমদ্দিন স্যার মুখ খুললেন, পাপ তো সেদিন থেকেই করেছি যে দিন এই ইশকুলে বিনা বেতনে নিয়োগ হয়েছি।

ক্লার্ক ফরিদ সাহেবও বাদ যায় কেন? আজ সেও সুযোগ পেয়েছে। উনি মুখ ভাংচিয়ে বললেন, এ্যা এ এ এ আমাদের টাকায় জমি কিনে আবার ওনারা থাকবেন দাতা নামে। আমরা ইশকুলের জমি কেনা টাকা দিলাম, রুম করার টাকা দিলাম, অথচ মেম্বার, চেয়ার ম্যান, সভাপতিরা হলেন এই জমির দাতা। আচ্ছা বেতন না হয় হচ্ছে না মানছি কিন্তু তাই বলে ইশকুলের সাহায্য দেওয়া চাউল পর্যন্ত মেরে দেবে?

এতক্ষণ পর লাইনে এসেছে। তার মানে এতো সব কিছু ঐ অনুদানকে কেন্দ্র করে? আর এর জন্যই হেড স্যার প্রমাণ স্বরূপ আমাকে সাথে নিয়েছিল। নিশ্চয় সবাই জেনে গেছে যে টাকা গুলো সভাপতি নিয়েছে। আর স্যারকেও এর মধ্যে জড়াচ্ছে? আমি মজার ছলে বললাম, স্যার আপনাকেও কিছু দেয়নি?

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড