রিফাত হোসেন
বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সুমাইয়া বলল, ‘আপনি হয়তো জানেন না আমি আর শুভ একি অফিসে জব করি। দু'জনের কাজও এক, সেই সাথে কাজও করি পাশাপাশি টেবিলে। পরশু দিনের পরেরদিন আমাদের অফিসের একটা প্রজেক্টের কাজ করার জন্য আমাদের চট্রগ্রাম যেতেই হবে। বসকে অনেক অনুরোধ করেও লাভ হয়নি, কারণ প্রজেক্টটার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার আর শুভর উপর আগে থেকেই দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এদিকে আমাদের দুই পরিবারের গুরুজনেরা তো নাছোড়বান্দা। তারাও নাকি আগে থেকে বিয়ের তারিখ ফিক্সড করে রেখেছে। তাই সেই তারিখ আর পরিবর্তন করা যাবে না। এখন আমারা পরে গেলাম মহা বিপদে। তারপরই আমরা দু'জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, বিয়ের দিন রাতেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবো৷ তারপর ওখান থেকে কাগজপত্র সহ, প্রস্তুতি নিয়ে চট্রগ্রামে চলে যাবো। তাই আর এখানে বাসর হচ্ছে না।’
সবাই মনোযোগ দিয়ে সুমাইয়ার কথা শুনছিল। আদিত্য বল, ‘আপনাদের কপালটাই খারাপ। বিয়ে করবেন, অথচ সঠিক সময়ে বাসর করতে পারবেন না।’
পাশ থেকে শুভ হাসি দিয়ে বলল, ‘কোনো চিন্তা নেই। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। একদিন অপেক্ষা করে যদি তারপর টানা এক সপ্তাহ হানিমুন করার সুযোগ পাই, তাহলে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই এই অপেক্ষায়।’
জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে আদিত্য বলল, ‘মানে?’
- আরে আগে অফিসের কাজে কোথায় গেলে তো আলাদা আলাদা রুমে থাকতে হতো। কিন্তু এখন তো আমরা স্বামী-স্ত্রী। সো আর কোনো বাধা নেই। পরশু বাসর না করতে পারলেও তারপরের দিন আমরা চট্রগ্রাম রিসোর্টে থাকবো। সো হানিমুনটা সেখানেই হয়ে যাবে। তাই বললাম, একদিন অপেক্ষা করে যদি পরেরদিন আরো ভালো কিছু পাই, তাহলে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।
সুমাইয়া লাজুক দৃষ্টিতে সবার দিকে আড়চোখে তাকাল একবার। শুভ সহ আদিত্য আর জ্যোতি অনবরত হেসেই যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে শুভ ইরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিরে ইরা, ভালো লাগছে না?’
ইরা মলিন হাসি দিয়ে বলল, ‘ঠিক তা না। আসলে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে।’
- অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমার মনে হয় তুই আমাদেরকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিস, কিন্তু পারছিস না। বা আমাদের কাউকে দেখে তুই বারবার বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছিস। এটাই তোর অস্বস্তির একমাত্র কারণ। এছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের সাথে একটু মিশতে চেষ্টা কর, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
- আমি পারছি না ভাইয়া।
শুভ মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘আমরা সবাই যখন পেরেছি, তুইও পারবি। আমি জানি না তোর কী হয়েছে? তবে আমার মনে হয় আদিত্য যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, তার কাছে আমাদের সবার সমস্যা খুবই তুচ্ছ। আদিত্যর জায়গায় অন্যকেউ হলে এতদিন হয়তো আত্মহত্যা করেই ফেলতো। আদিত্য অবশ্য চেষ্টা করেছিল।।কিন্তু সফল হতে পারেনি আমার জন্য। আর আমারও ভাগ্য ভালো ছিল, তাই ওকে বুঝাতে পেরেছিলাম। অন্যকেউ হলে বুঝার চেষ্টাই করতো না।’
শুভর কথা শুনে চমকে উঠল জ্যোতি, ইরা আর সুমাইয়া। ইরা নিজের মনে মনে বলল, ‘আদিত্য আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল! কিন্তু কেন? আমার আর ওর সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছে বলে? কিন্তু আদিত্য তো এত উদাসীন, এত বুদ্ধিহীন নয়, যে সামান্য একটা আঘাতে ওইরকম ভয়ঙ্কর একটা সিদ্ধান্ত নিবে।’
জ্যোতি আদিত্যকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন কেন?’
আদিত্য কিছু বলল না। পাশ থেকে শুভ বলল, ‘ও এখন বাড়ি ছাড়া। কোনো কারণে ওর মা ওকে ভুল বুঝে বাড়ি থেকে বের করে দিছে। আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা ও আমাকেও বলেনি এখন পর্যন্ত।’
আবারও চমকে উঠল ইরা। ওর চোখেমুখে হাজারো কৌতূহল। মনে মনে বলল, ‘সেদিন কী তাহলে এই কথাটাই বলতে চেয়েছিল আদিত্য? কিন্তু আমি তো ওর কোনো কথা শুনিনি সেদিন। রাগ করে চলে গিয়েছিলাম।’
জ্যোতি আদিত্যর পাশে গিয়ে বসল। তারপর করুণ কণ্ঠে বলল, ‘এবার অন্তত আমাদের সবটা খুলে বলুন। সেদিন ক্যাম্পাসে আপনি কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বলতে পারেননি। আমি সেদিনের পর থেকে মনে এক কৌতূহল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনাকে জানার কৌতূহল। প্লিজ এবার বলুন সবটা।’
পাশ থেকে শুভ বলল, ‘তুই কী আগে থেকেই ওকে চিনিস?’
- হ্যাঁ। তবে কীভাবে চিনি সেটা এখন বলতে পারছি না। আগে উনার কথাগুলো শুনে নেই।
আদিত্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সবটা খুলে বলল সবাইকে। ও জীবনে কী কী হারিয়েছে, সবকিছুই বলল আদিত্য। তবে ইরার কথা বলেনি। অবশ্য ইচ্ছে করেই বলেনি আদিত্য। কারণ ও চায়না ইরাকে কেউ ভুল বুঝুক। পুরোটা বলার পর আদিত্য চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল ফেলল। সবার দিকে তাকাল একবার। উপস্থিত সবার চোখে জল ছলছল করছে। যেকোনো সময় বাধ ভেঙে ঝর্ণার মতো করে জল গড়িয়ে পড়বে সবার চোখ দিয়ে।
সুমাইয়া চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘আপনি এত জঘন্যতম একটা ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছেন। তাও আবার নিজের আপনজনের কাছ থেকে। সত্যি বলতে কী, আমার জানামতে কোনো মানুষই এটা মন থেকে মেনে নিতে পারবে না। সেখানে আপনি সবটা নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। প্রকৃত মানুষ এরাই, যারা সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিশ্বাস করে, নিজের মনোভলের প্রতি আস্থাশীল থাকে। আপনাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমি। সেই সাথে শুধু অবাক এর পর অবাক হচ্ছি। একজন ব্যক্তি কতটা গভীর চিন্তাধারার মানুষ, আর কতটা শক্ত মানসিকতার মানুষ হলে এইরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে আমি এটা জানি আপনি পারফেক্ট একজন মানুষ। ভবিষ্যতে আপনার জীবন সঙ্গীনী যে হবে, তার ভাগ্যটা অনেক ভালো। স্রষ্টার কাছে তার অসংখ্যবার শুকরিয়া আদায় করা উচিত, যে তিনি আপনার মতো একজন মানুষকে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে ঠিক করে দিয়েছেন।’
আদিত্য কিছু বলল না। মুচকি হাসল। ইরা করুণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য আদিত্যর মনে হয়েছিল, এবার হয়তো ইরা নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে। ওকে আবার ভালোবেসে কাছে টেনে নিবে। ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে এটা বুঝতে পারছে আদিত্য। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে অপরাধবোধের ছাপ।
হঠাৎ ইরার ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই একরাশ হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটের কোণে। মুহূর্তের মধ্যেই চোখের কোণে জমে থাকা জল হারিয়ে গেল। ইরা বসা থেকে ওঠে নৌকার সামনের দিকে গেল। ইরার মুখে আয়ানের নামটা শুনে আদিত্যর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। শুভ ওর কাছে এসে বলল, ‘আমি তোকে সান্ত্বনা দিতে পারব না। তোকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো কোনো কথাও বলতে পারব না। শুধু একটা কথাই বলল, আমি তোর পাশে আছি। সান্ত্বনা দেওয়া আর অনুপ্রেরণা মূলক কথা বলার চেয়ে পাশে থাকার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। ব্যক্তিগত ভাবে অন্তত আমি এটাই মনে করি। ধর তুই আবেগ বা অভিমানের বশে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলি৷ সেখানেও আমাকে পাশে পাবি। বন্ধুবান্ধব জীবনে আমি অনেককে দেখেছি, যারা অল্পতেই আত্মহত্যা নামক অপরাধ বেছে নিতে চায়। আমি তাদেরকে সবসময় বলে এসেছি, আমি তোমার পাশে আছি। হয়তো তোমার সাথে সাথে আমি আত্মহত্যা করতে পারব না, কিন্তু তুমি শেষ-নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ-পর্যন্ত আমাকে পাশে পাবে। আমার একজন খুব কাছের বন্ধু ছিল। ও একজন ব্যর্থ মানুষ। ব্যর্থতা ওকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, শেষ পর্যন্ত ও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। তখন সে প্রথমেই বিষ খাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। গলায় দড়ি দেওয়াটা সবাই করতে চায় না৷ কারণ এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। তাই সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করাকেই বেছে নেয় ও। আমি তখনও ওর পাশে ছিলাম। ও আমাকে বলল, তুই তো বলেছিস, আমি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ-পর্যন্ত তুই আমার পাশে থাকবি। তাই বলছি কি, তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি বিষ কিনে আনছি।’ আমি কিছু না বলে সেদিন মুচকি হাসি দিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ও বিষ নিয়ে আসে। তারপর আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ভালো থাকিস বন্ধু। বিদায়। আমি তখন ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘বিষের ঔষধ কী দিয়ে কিনেছিস?’
- কেন? টাকা দিয়ে কিনেছি!
- কার টাকা?
- আমি তো আর রোজগার করি না। তাই বাবার কাছ থেকে যে টাকা নেই সেখান থেকেই কিছু টাকায় কিনেছি।
আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘বাবার টাকায় জীবন ত্যাগ করতে লজ্জা করবে না তোর?’
- মানে?
- তোর হাতের জিনিসটা তোর টাকায় নয়, তোর বাবার টাকায় কেনা। ত্যাগ করবি নিজের জীবন, সেখানে বাবার টাকা অপচয় করবি কেন? পারলে নিজের টাকায় এইসব কিনে জীবন ত্যাগ কর।
ও সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘আমি এভাবে তোকে পাশে চেয়েছিলাম বন্ধু।’
( এই ঘটনাটা কাল্পনিক। বেকারত্ব জীবনের ব্যর্থতাগুলোর জন্য এই যুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই বলছি, সবক্ষেত্রে এই যুক্তি মেলাতে যাবেন না)
আদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন ভাই?’
- অবশ্যই। প্রশ্নটা বল?
- চোখের জল কী কখনো মিথ্যে হয়? মানে মানুষ মিথ্যে অভিনয় করে নিজের চোখের জলকে কন্ট্রোল করতে পারে? ইচ্ছে করে চোখে জল আনতে হবে, আবার ইচ্ছে করেই চোখের জল থামিয়ে দিতে পারে?
হাসি দিয়ে শুভ বলল, ‘অবশ্যই পারে।’
- তাহলে আমি বুঝবো কীভাবে, কোনটা সত্যি কারের চোখের জল, আর কোনটা মিথ্যে চোখের জল?
- ভালোবাসা যেমন বুঝা যায় না, তেমনি এই চোখের জলের ভাষা-ও বুঝা যায় না। এই দু'টোই অনুভব করতে হয়। তুই নিজেই অনুভব করতে পারবি কোনটা আসল চোখের জল, আর কোনটা মিথ্যে। আমার খুব কাছের একজন মানুষ ছিল কোনো একসময়। তার সাথে যখন আমার শেষবারের মতো দেখা হয়, তখন আমি তার চোখে জল দেখেছিলাম। তখন তার অন্য এক বন্ধু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল কান্নাকাটি না করতে। আমি খেয়াল করেছি, ওই কথাটা বলার দুই মিনিটের মধ্যেই ওর চোখের জল উধাও। ওর চোখের জল ছিল মিথ্যে। শুধুমাত্র আমাকে দেখানোর জন্য ওটা। ওই চোখের জল যদি সত্যি হতো, তাহলে এত সহজে তা মুছে ফেলতে পারতো না ও। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। সেদিন আমি ওর চোখের জলের ভাষা অনুভব করেতে পেরেছিলাম।
শুভ থামতেই সুমাইয়া বলল, ‘এতকিছু কীভাবে জানো তুমি?’
- অভিজ্ঞতা মানুষকে অনেক শিক্ষা দেয় সুমাইয়া। এইসব অভিজ্ঞতা আমি আগেই অর্জন করে নিয়েছি৷ তাই এগুলো খুব সহজেই বুঝে ফেলি।
- বিয়ের পর আবার বলো না, এবার বউকে ডিভোর্স দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।
- অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ আসলে হাতছাড়া করার মতো বোকা আমি নই। তাছাড়া এই অভিজ্ঞতাটা অর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শুভর কথা শুনে জ্যোতি আর আদিত্য হো হো করে হাসতে লাগল।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ সবার মাঝে নীরবতা। ইরার ফোনে কথা বলা শেষ। ওর মুখে এক প্রসন্ন হাসির আবেশ। কিছুক্ষণ আগেও ওর মুখটা গম্ভীর ছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। ঢেউ এসে ঝাপটা মারছে নৌকাটাকে। হালকা হালকা করে দুলছে নৌকা৷ ইরা হাত দিয়ে নিজের চুলগুলোকে একসাথে করার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে৷ প্রচণ্ড বাসাতের কারণে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। মুগ্ধ হয়ে ইরাকে দেখছে আদিত্য। কী অপরূপা সুন্দরী লাগছে ইরাকে।
আদিত্য এক দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকিয়ে আছে, তা চোখ এড়ায়নি জ্যোতি। ও রীতিমতো রাগে কটমট করছে৷ মনে মনে ভাবছে, ছেলেটা সাংঘাতিক রকমের অসভ্য। আমার মনে প্রেমের ফুল ফুটিয়ে দিয়ে এখন এক্স গালফ্রেন্ড এর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিই।
এভাবেই চলছিল মুহূর্ত। ঘড়ির কাঁটায় সময় তার নিজ গতিতে চলছে। সন্ধ্যা হতে খুব বেশি দেরি নেই বলে নৌকা ঘাটে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা সবাই বলল মাঝিকে। টুকটাক কথায় মাঝেই সময় কেটে গেল। নৌকা ঘাটে এসে থামালো। সবাই নৌকা থেকে নেমে এসে আবার হাঁটতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ সুমাইয়া বলল, ‘এবার আমি বাড়িতে চলে যাই। এমনিতেই লুকিয়ে লুকিয়ে বের হয়েছি আজকে।’
শুভ বলল, ‘ঠিক আছে। সাবধানে যেও।’
সুমাইয়া চলে গেল। শুভ আর আদিত্য পাশাপাশি হাঁটছে। ইরা আর জ্যোতি পিছনে পিছনে হাঁটছিল। আরো কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর জ্যোতি ইরাকে ইশারায় থামতে বলল। ইরা জ্যোতির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোতি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইরার দিকে। ইরার প্রতি ক্ষোভ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে ওর। দৃঢ় কণ্ঠে জ্যোতি বলল, ‘তোকে নিজের বন্ধু ভাবতেও ঘৃণা করছে ইরা। তুই সেদিন আদিত্যকে বুঝতে পারিসনি। ওর কথাগুলো একবারও শুনিসনি সেদিন। তুই নিজেও জানিস না, নিজের অজান্তেই আদিত্যকে কতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছিস তুই। পরিবারের অবহেলা, আর ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা আদিত্যকে প্রতিনিয়ত আঘাত করেছে। মানসিকভাবে আদিত্য আজ মৃত বললেই চলে। হয়তো সবাইকে নিজের মনের কথা বলছে না। নিজের বুকের ভিতর চাপা কান্নার আওয়াজ কাউকে শোনাতে চাচ্ছে না। অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে আমাদেরকে মানিয়ে নিয়ে হাসিখুশি থাকার। একটা ছেলে তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর তুই ওর সাথেই বেইমানী করেছিস। সবাই তো আর জানে না আদিত্যর সেই ভালোবাসার মানুষটা তুই। শুভ ভাই এটা জানলে তোর প্রতি তার ভালোবাসা এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। বোন হিসেবে তোকে যতটা বিশ্বাস করত, সেটাও আর থাকবে না। পরিবারের মানুষজন যখন উনাকে অবহেলা করেছে, উনাকে ভুল বুঝে কষ্ট দিয়েছে, সেইসময় তোর উচিত ছিল উনার পাশে থাকার। উনাকে সাপোর্ট দেওয়ার। বাট তুই তা না করে, উনাকে আরো কষ্ট দিয়েছিস। আসলে তুই কারোর ভালোবাসার যোগ্যই না।’
ইরা কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। জ্যোতি আবার বলল, ‘এত লোভ কেন তোর? আজ আদিত্য বেকার বলে তুই ওকে ছেড়ে একটা বড়লোক নেশাখোরের সাথে সম্পর্কে জড়ালি।’
ইরা রাগী কণ্ঠে বলল, ‘আমার কোনোকিছুরই অভাব নেই। আমার বাবা ভালো চাকরি করে। এছাড়াও আরো কয়েক জায়গা থেকে আমাদের ইনকাম আছে। যেখানে আমার নিজেরই এত কিছু আছে, সেখানে অন্যের টাকার উপর আমার লোভ হওয়ার কোনো কারণই নেই। তাই আমি কোনো লোভী নই। আর শুনে রাখ, আয়ানের নামে আমি তোর কাছ থেকে কোনো খারাপ কথা শুনতে চাই না। আয়ান অত্যন্ত ভালো একটা ছেলে।’
জ্যোতি হাসতে হাসতে বলল, ‘ভাইয়া সবসময় বলে, কাউকে বিশ্বাস করা ভালো, কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস ভালো না। চোখ দু'টো খুলে আশেপাশে কী হচ্ছে তাকিয়ে দেখ, তাহলে বুঝতে পারবি কে কেমন ছেলে।’
- মানে?
- ক্যাম্পাসে গিয়ে ভালো করে আয়ানের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে দেখ। সিনিয়রদের সাথে কথা বললে ওর পুরো জীবন বৃত্তান্ত খোলাসা হয়ে যাবে তোর কাছে। আমি আগে থেকেই উনার সম্পর্কে সবটা জানতাম। ভেবেছিলাম তোকে সবটা বলব। কিন্তু তুই তো আমার কোনো কথাই শুনতে চাস না। তাই কিছু বলিনি আর। সারারাত নেশায় ডুবে থাকে ওই ছেলেটা। ওর নামে তো পুলিশ কেইস ও আছে। এক বড় আপুর কাছে শুনেছি আয়ানের নামে ধর্ষনের অভিযোগ ও আছে। কিন্তু বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে তো, তাই কেইসটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।
ইরা মনে মনে ভাবছে, ‘অসম্ভব। আয়ান ওইরকম ছেলে না৷ আমি অনেকদিন হলো ওর সাথে চলাফেরা করি। ও কখনো আমার দিকে খারাপ দৃষ্টিতেও তাকায়নি। তাছাড়া আদিত্য সেদিন বলল আয়ান আমাকে রুমডেটের অফার দিয়েছিল ফোনে। কিন্তু কই? আমি তো এরপরও বহুবার ওর সাথে দেখা করেছি, ফোনে কথা বলেছি। পাশাপাশি বসে, হাত ধরাধরি করে অনেক সময় পার করেছি। ও তো কখনো রুমডেট বিষয়ে আমার সাথে কথা বলেনি। ইনফ্যাক্ট আকারে-ইঙ্গিতেও বুঝায়নি। আদিত্য সেদিন ইচ্ছে করে ওর নামে বাজে কথা বলেছিল আমাকে, তেমনি আজ জ্যোতি ওর নামে মিথ্যে অভিযোগ করছে আমার কাছে। যাতে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যায়।’
ইরা বলল, ‘অন্যের দোষ না ধরে নিজের দোষের কথা ভাব। তুই যেটা করছিস, সেটা কি ঠিক?’
- কীসের কথা বলছিস?
- তোর আর আদিত্যর সম্পর্কের কথা বলছি। দেখ জ্যোতি, তুই আর আমি খুব ভালো বন্ধু৷ তবুও এই সাধারণ বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে ঝগড়া হচ্ছে। আমি চাই না তোর আর আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ভেঙে যাক। সবারই ব্যক্তিগত জীবন আছে। আমি যেমন তোর আর আদিত্যর ভালোবাসার সম্পর্কের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি না, তেমনি আমি চাই না তুই আমার আর আয়ানের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াস। আমরা, আমাদের মতো করে বন্ধুত্বটা টিকিয়ে রাখি। ওইসব ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে আনিস না।
জ্যোতি কিছু বলল না। হাঁটতে শুরু করলে ইরা ওর হাতটা ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুই কী আসলেই আদিত্যকে ভালোবাসিস?’
জ্যোতি দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু কারোর সম্পর্ক ভেঙে নয়। আমি অনেক আগে থেকেই উনাকে ভালোবাসি৷ কিন্তু তোর সাথে উনার সম্পর্ক আছে, এটা জেনে আমি আর কিছু বলিনি। উনার সাথে দেখা-ও করিনি কখনো। সেদিন তুই জোর করেছিলি বলে উনার সামনে গেছিলাম তোর সাথে।’
- এখন তো আমার সাথে আদিত্যর রিলেশন নেই। ওকে কি বলেছিস তোর ভালোবাসার কথাটা?
- না।
- না বললে ও বুঝবে কীভাবে? বোকা নাকি তুই?
জ্যোতি মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া তখন কী বলেছে শুনিস নি? ভাইয়া বলেছে, ভালোবাসা কখনোই বুঝা যায় না। এটা অনুভব করতে হয়। তাই আমি চাই না উনাকে এই নিয়ে সিরিয়াস ভাবে কিছু বলতে। সময় হলে উনি নিজেই অনুভব করতে পারবে আমার ভালোবাসা।’
ইরা কিছু বলল না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে লাগল।
আজ শুভ আর সুমাইয়ার বিয়ে। সবাই এখন রেডি হচ্ছে। আদিত্য শুভর দেওয়া জামা-কাপড় নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। হঠাৎ করে দরজায় কারোর টোকা দেওয়ার শব্দ হলো। আদিত্য বলল, ‘জ্বি আসেন।’
জ্যোতি ভিতরে ঢুকল। আদিত্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। একরাশ মুগ্ধতা ছুঁয়ে দিয়েছে জ্যোতিকে। আদিত্য অন্য কোনোদিকে তাকাতে পারছে না। ইচ্ছে করছে সারাক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে আদিত্যর মনের ভিতর। একটা আকাশী রঙের শাড়ি, তার সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ, কপালে একেবারেই ছোট্ট একটা টিপ, খোলা চুল, মুখে হালকা মেকআপ আর লিপস্টিকহীন দু’টো ঠোঁট। উফফ, একটা মানুষ এতটা আকর্ষনীয় হয় কীভাবে? আদিত্য একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। কিছুটা সামনে এগিয়ে জ্যোতির খুব কাছাকাছি চলে গেল। তারপর জ্যোতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওয়াও।’ জ্যোতি হেসে দিলো। আদিত্য কিছুটা চমকালো, তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আপনি এখানে?’
লাজুক স্বরে জ্যোতি বলল, ‘ভাইয়া ডাকছিল আপনাকে।’
- আপনি যান আমি আসছি।
জ্যোতি আদিত্যর হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, ‘এই পাঞ্জাবিটা নিন৷ ভাইয়া পড়তে বলেছে আপনাকে।’
- কালকেও তো পাঞ্জাবি পড়লাম। আজকে আর পাঞ্জাবি পড়তে ভালো লাগছে না।
- আমি এত কিছু জানি না। ভাইয়া বলল এটা পড়তে। এখন না পড়তে চাইলে আপনাকে কিছু বলার নেই আমার। শুধু ভাইয়াকে বলব আপনি পাঞ্জাবি পড়বেন না বলেছেন।
আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘কিছু বলতে হবে না আপনাকে৷ আপনি এখন যান, আমি পাঞ্জাবি পড়ে আসছি।’
জ্যোতি মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। আদিত্য প্যাকেটটা খুলে পাঞ্জাবি বের করল৷ বিস্ময়কর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পাঞ্জাবির দিকে।
(চলবে..) আরো পড়ুন ‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ১১ম পর্ব - ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড