• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : সৎকারবিহীন লাশ

  সঞ্জীব ধর

১৭ জুলাই ২০১৯, ১২:০৫
গল্প
ছবি : প্রতীকী

কিছুক্ষণ পর পর এক ফোঁটা এক ফোঁটা পানি যেন পাথর ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে নিচে পড়ছে। কিন্তু আওয়াজ হচ্ছে না। হবেই বা কী করে? দেহটার মধ্যে এমন কোনো রাসায়নিক শক্তি সঞ্চিত নাই যা শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। কিছু পানি সঞ্চিত ছিল, শুধু সেটা ঝরিয়ে চলেছে। গভীর কৃষ্ণপক্ষের রাত। ঘরের বাইরে ও ভেতরে উভয় জায়গায় ঘোর অন্ধকার। শুধু মাঝে মাঝে বিজলীর আলোর ছটা টর্চলাইটের মতো কাজ করছে। কিন্তু ওঠার ক্ষমতা নাই। যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে হাতের নাড়ীটা পরীক্ষা করে চলেছে বারবার। বাইরে গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন। তবে এখনো বৃষ্টি পড়া শুরু হয়নি। প্রচণ্ড বাতাসে বুঝি চালটা উড়িয়ে নেবে। সেটা হলে তো কথাই ছিল না। অন্তত সকালে কারও না কারও চোখে পড়ত। এখন তো তীব্র গন্ধ ছড়ানোর আগে সে সম্ভাবনা নেই। অথচ কী সৌভাগ্য ছিল! পাশেই কবরস্থান। মরার আগে একটা গড়ান দিলেই হতো। মানুষটিকে এভাবে মৃত্যুর পথে কেন যে ডেকে আনল তা ভেবে জল পড়ার গতিবেগ খানিকটা বাড়ে। কত লম্বা চওড়া এক জোয়ান পুরুষ ছিল সে। ছয় বছর আগে সেই প্রথম পরিচয় এমনই এক রাতে। অবশ্য শহরের নানারকম আলোকসজ্জায় বুঝায় যায় নি শুক্লপক্ষ নাকি কৃষ্ণপক্ষ। প্রতিদিনের মতোই শিকারে বের হয়েছিল।কিন্তু শিকারিও জানত না যে, শিকারের এমন করুণ পরিণতি হবে। যাই হোক সেই রাতের পর থেকে শিকারিকে আর শিকারের কাছে যেতে হয়নি। শিকারই ধরা দিয়েছে শিকারির কাছে। এই শিকারির টোপ যে অন্য শিকারির টোপের তুলনায় তেমন উন্নত তাও কিন্তু না। তবুও শিকারি এ টোপ-ই গিলত। কিন্তু কী অদ্ভুত! সে অস্পৃশ্য জগতেও রয়েছে ভালোবাসা। সে ধূসর জগতেও বিরাজ করে সোনালি স্বপ্ন। হৃদয়ের মাঝখানে জাগ্রত হয় বন্ধনের স্বপ্ন। সেদিনের সেই প্রস্তাব আজ কেমন কানের মাঝে বিশ্রী সুরে বাজে। অথচ সেদিন এই প্রস্তাব সে পিপাসার্ত বালির মতো শুষে নিয়েছিল।

‘তুই কি আমার সাথে এখান থেকে বেরিয়ে যাবি? সংসার পাতব দুজনে। সোনার সংসার। যাবি? ’ সিগারেটটা টানতে টানতে বলেছিল, ‘ভাবিস না, অত ভাবিস না। চল, চল।’ জন্মের পর থেকে প্রথমবারের মতো দু’চোখে স্বপ্ন বাসা বেঁধেছিল। একবার মনে হয়েছিল লোকটাকে বিশ্বাস করা যায় ? বিশ্বাস করা না করার তো কোনে প্রশ্ন-ই উঠে না। সে যেখানে আছে এর চেয়ে খারাপ জগত আর থাকে না।সেদিন-ই প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিল সে। সেদিন যে গাছের কোটরে আশ্রয় নিয়েছিল আজ তা সমূলে উৎপাঠিত। বাইরে বাতাস বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেছে। নাড়ীটা আবার পরীক্ষা করে। ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে অনেক আগে তবুও মন যেন মানতেই চাইছে না। দু’চোখের পর্দায় আবার ভেসে উঠে সেদিনগুলো। পরের দিনই এ বিহঙ্গ-বিহঙ্গমা উড়াল দিয়ে চলে এসেছিল সম্পূর্ণ এক অপরিচিত গ্রামে। গ্রামের এক পাশে কতগুলো উদ্বাস্তু আস্তানা গেড়েছিল।

তাদেরও আশ্রয় মিলেছিল সেখানে। একটি একটি খড় দিয়ে বেঁধেছিল ভালোবাসার নীড়। রাত গড়িয়ে যাচ্ছিল। দু'টি পাখি পড়ে আছে। একটি মৃত, অন্যটি মুমূর্ষু। এই মুমূর্ষু পাখিটির দু'টি কোটরে আজ বারবার ভেসে উঠছে সে পরিভ্রমণে কথা। যখন সে প্রথমবারের মতো নরককুণ্ড থেকে মুক্তি পেয়েছিল। প্রথমবারের মতো মনে হয়েছিল, ‘বাহ ! পৃথিবীটা তো অনেক সুন্দর। মাংসাশী জন্তু ছাড়াও অন্য প্রাণিও তো এখানে বাস করে দেখছি। তাহলে এ নিরীহ প্রাণিগুলোই কি রাতে মাংসাশী হয়ে উঠে?’ সেদিন এ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যগুলো করার আগে বিধাতা তার কণ্ঠস্বর রোধ করেন নি। কারণ বলার স্বাধীনতা হরণ করে একমাত্র মানুষ-ই। জীবনের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা সে সঞ্চয় করেছিল অল্প বয়সে, হয়তো সভ্য সমাজে ভদ্র মানুষগুলোর পক্ষে তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছিল সবকিছু। ভালোবাসতে শুরু করেছিল এ সুন্দর পৃথিবীটকে। মমতা জমেছিল প্রাণের ওপর, মানুষের ওপর। গড়ে তুলেছিল সুখের দাম্পত্য জীবন। অতীতকে এতই ভুলতে চেয়েছিল যে, কখনো স্বামীকেও জিজ্ঞাসাও করেনি তার অতীত কী? তার পরিচয় কী? তার মত হতভাগীর জন্য কেন-ই বা ঘর ছাড়ল? এসব প্রশ্ন মনে উঠার আগে-ই বড় ধরণে একটি তালা ঝুলিয়ে দিত মনের ঘরে। অতীতের মূলসহ উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল তারা। তাই যেদিন তৃতীয় প্রাণে সঞ্চার হয়েছিল, সেদিন এ ছোট্ট নীড়ে আনন্দের এক মহাপ্লাবন বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অতীতকে আমরা যতই মুছে ফেলতে চেষ্টা করি না কেন, তা শুধুমাত্র রিসাইকেল বিন-এ জমা হয়। ঝড় বন্ধ হয়ে গেছে। থেমে থেমে একটা শিয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে। হঠাৎ মনে মনে একটা প্রশ্ন করেই বসল সে, ‘আচ্ছা, বিধাতার কি মানুষের সুখ দেখে হিংসা হয়?’ একটু পাশ ফিরতে চেষ্টা করে কিন্তু সম্ভব হয় না। যেদিন ডাক্তার বলেছিল এ সন্তানকে পৃথিবীতে না আনাটা-ই ভালো হবে, সেদিন কিছুতে বিশ্বাস করতে চায়নি সে। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘আমি এসব বিশ্বাস করি না।’ শেষ পর্যন্ত দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে সন্তানকে ভূমিষ্ট করল। বছর খানিক চলল যম বনাম তাদের যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত যম-ই জয়ী। ছেলে তো গেল সেসাথে আর গোপন থাকল না রোগের কথা। পাড়ায় পাড়ায় রটে গেল। তৈরি হয়ে গেল কত কল্প কাহিনী। ময়-মুরুব্বিরা বলল, ‘গ্রামে বেশ্যা ঢুকেছে আর তোরা এখনো বসে আছিস?’ গ্রামবাসীরা আর দেরি করল না। সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে যখন তারা আশ্রয় খুঁজছিল, তখন তার স্বামী বলেছিল, ‘যখন এ পৃথিবীতে আর বেশি দিন থাকার সম্ভবনা নেই তখন আর মানুষকে বিরক্ত করে লাভ কী? আমাদের পাপের বোঝা আমরা-ই বইবো।’ যদি একটু পানি পাওয়া যেত? যেখানে নিজের স্বামীর মৃত্যুর সময় একটু পানি দিতে পারেনি সেখানে তার মৃত্যুর সময় সে পানি পাবে কেন?

এ স্থানটাও এক অদ্ভুত জায়গা। একেবারেই নির্জন। শুধু পাশের কবরস্থানে মৃত মানুষকে কবরে দিতে মানুষজন আসে নতুবা কেউ এখানে ভুলেও পা বাড়ায় না।একেবারে ভূতুড়ে পরিবেশ। এখানে আস্তানা গাড়ার পর ভিক্ষাবৃত্তি-ই হল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। প্রথম প্রথম কঙ্কালসার দেহখানা নিয়ে স্বামী যেত ভিক্ষা করতে। বিহঙ্গ শয্যাশায়ী হওয়ার পর বিহঙ্গমা চেষ্টা করত বিহঙ্গের মুখে গ্রাস তুলে দিতে। কিন্তু বিহঙ্গমাও শয্যাশায়ী হতে দেরি হলো না। তবে অদ্ভুত, যে প্রাণটি অন্য দু'টি প্রাণে বিষ ছড়ালো সে প্রাণটি এখনো টিকে রইল।

দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। নতুন দিনের আগমন ঘটবে। তার আশা শুধু একটা-ই, যত শীঘ্রই সম্ভব গ্রামে কারো মৃত্যু ঘটুক। তখন হয়তো সবাই কবরস্থানে আসলে, এ লাশটারও একটা ব্যবস্থা হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড