• বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘হতভাগ্য বাতিওয়ালা’-এর পঞ্চদশ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : হতভাগ্য বাতিওয়ালা

  মুহাম্মদ বরকত আলী

১৭ জুলাই ২০১৯, ১০:৩৮
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

স্যার টেবিলের নিকটে দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা কদমতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসেছি। আমি ওখানকার হেড মাস্টার আখতারুজ্জামান। আমাদের স্কুলের সভাপতি মিজানুর রহমান সাহেব আমাদের পাঠিয়েছেন। আমি দুর থেকে খেয়াল করতে পারিনি যে লোকটা এতক্ষণ মোষের মত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল। কি করে বুঝবো, লোকটার যে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস আছে তা কে জানতো? কিছু কিছু লোক আছে যারা ঘুমালে অর্ধেক চোখের পাতা বন্ধ থাকে আর অর্ধেক খোলা থাকে। এক প্রকার ট্যারা লোকের মত। কোন দিকে তাকায় তা বোঝা খুব কষ্ট কর। আমি যখন জেলা স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের একটা স্যার ছিলো ট্যারা। দেখা গেলো আমার দিকে তাকিয়ে অন্য কাউকে বলছে এই পড়া বল। আমার হাসি পেতো কিন্তু হাসার উপায় ছিলো না। পাছে বুঝে ফেলেন যে তার এই ট্যারামো দেখে হাসছি, তবে পিঠের উপরে কয়েকটা বেতের বাড়ি পড়ে যাবে অনায়াসে।

লোকটা আধো আধো ঘুম চোখে নিয়ে বললেন, কোন মিজানুর রহমান? এগুলো এক ধরনের প্যাঁচাল। স্কুলের নাম জানলেই তো হলো, আবার সভাপতির কী দরকার? স্যার বললেন, মিজানুর রহমান ওরফে ছাতু ভাই। কয়লা ধুইলে যেমন ময়লা যায় না ঠিক তেমন যতই নেতা আর টাকাওয়ালা হোক না কেন, নামের টাইটেল যতই বাড়ুক না কেন, পুরনো নাম থাকলে সেটা মুছে ফেলা যায় না। যতই মাজা ঘষা কর পুরনো নাম ফেলতে পারবে না। শুনেছি মানুষের টাকা পয়সা হলে নাম পরিবর্তনের জন্য গায়ের লোককে গরু জবাই করে গোস্ত ভাত খাইয়ে নাম পরিবর্তন করতে হয়। এটা করেও যে কাজ হয় না তার প্রমাণ পেলাম আজ। আমাদের ছাতু সাহেব টাকাওয়ালা হবার পর গ্রামের সমস্ত মানুষকে দাওয়াত করে খাইয়ে ছিলো একটা গরু কেটে। গ্রামের লোক হয়তো সামনে ছাতু না বললেও অগোচরে নিশ্চয় বলেন। আর এখন শহরে এসে সেই নাম মুছে যায়নি। শহরের মানুষকে গরু কেটে খাওয়ায়নি। গ্রামের মানুষ ভয়ে মিজানুর রহমান বললেও শহরের লোক এত সহজে বলবে না। এরা কেউ কাউকে তেমন মান্য করে না। লোকটা এবার সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, বলবেন না যে আপনারা ছাতু ভাইয়ের স্কুল থেকে এসেছেন? বাহ, এবার আবার ইশকুলটা হয়ে গেল ছাতু ভাইয়ের নামে। কি খেলারে ভাই, কি খেলা। লোকটা এবার আগ্রহের সাথে বললেন, আপনাদের জন্যই তো অপেক্ষা করছি। কাগজ রেডি আছে।

হেড স্যার দাঁত কেলিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। এই যা বিদ্যুৎ চলে গেলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লোকটা জবজবে ভিজে গেলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। নাকের ডগায়ও বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাক ঘামলে নাকি শশুর বাড়িতে ভালো আদর পাওয়া যায়। বৌয়ের আদরও কম হয় না। ছোট বেলায় আমার নাক ঘামলে মুছে ফেলতাম না। অতি যত্ন করে নাকটা সবার সামনে উপস্থাপন করতাম। মনে মনে খুব আনন্দ হতো এই ভেবে যে, আমি জামায় আদর পাবো অনেক। সবাই দেখো আমি কি ভাগ্যবান মানুষ আমার নাক ঘামছে। বড় বোনরা আদর বলতো, আমার ভাইয়ের শশুর বাড়িতে খুব আদর হবে। তখন আমি মুচকি হেসে অন্যত্র সরে যেতাম।

নাক ঘামলে যদি ভালো জামাই আদর পাওয়া যায় তবে কপাল ঘামলে কী হয়? এর উত্তর আমার জানা নেই। এরি মধ্যে লোকটা একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে সামনে ধরলেন।

নিন, মিষ্টি খান। আমার পাঁচটা মেয়ের পর এই একটা ছেলে হয়েছে। আজ অফিসে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছি। স্যার মিষ্টিতে হাত দিলেন না। স্যারের ডায়াবেটিস। আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। খাওয়ার বেলায় কোনো লজ্জা বা অনীহা দেখাতে নেই। আমি সানন্দে গ্রহণ করি। প্যাকেটে বেশ কয়েকটা মিষ্টি এখনো অবশিষ্ট আছে। দুটো চমচম খেয়ে বললাম, কিছু মনে করবেন না, স্যারের ভাগটাও খেলাম? খুব ভালো মিষ্টি। আচ্ছা আপনার কপাল ঘামছে কত দিন হলো? লোকটা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। তা কী করে বলবো? কেন বলুন তো? না এমনিতেই। আপনার পাঁচটা মেয়ের পর একটা পুত্র সন্তান হয়েছে তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।

এবার লোকটা একটু অন্যমনস্ক হয়ে চুপ থাকলেন। ভাবছেন হয় তো কবে থেকে তার কপাল ঘামছে। আমার মনে হয় কপাল ঘামলে পুত্র সন্তান হয়। আজ থেকে প্রবাদ তৈরি করে দিলাম যে, কপাল ঘামলে পুত্র সন্তান হয়। দুর সব বাজে কথা। কপাল ঘামলে কপাল পোড়াও হয়। শুধু এতটুকু জানা আছে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বলে, কপালে ছিলো রে তাই হয়েছে। আর একটা কথা প্রচলন আছে , কপালে আছে হাড় কি করবে চাচা খাজিনদার। লোকটা একটা রেজিস্টার খাতা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, এত দেরি হলো যে?

কী করবো, গ্রামের স্কুল একটু গুছিয়ে তারপর আসতে হয়। স্যারের সামনে খাতাটা আগলে ধরে বললেন, এই যে এখানে স্বাক্ষর করুন। স্যার কলমটা নিয়ে ঘচঘচ করে সাক্ষর করে দিলেন। কোনো কাগজে সাক্ষর করার আগে পড়ে দেখা উচিত কোথায় কী কারণে স্বাক্ষর করছি। অবশ্য এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা চলে আসে। দেখা গেলো বিশ্বাসের উপর স্বাক্ষর করে ধরা খেয়ে গেছে। আবার দেখা যায় অবিশ্বাস করে স্বাক্ষর করলাম না কিন্তু সেটা আমার মঙ্গল ছিলো। অথবা অবিশ্বাস করলাম। তাহলে আবার পাপ হবে। সুতরাং বিশ্বাস অবিশ্বাস ব্যাপারটা একটা কঠিন হিসাব। স্যার এখানে বেশ কয়েক বার এসেছে, তাই তার বিশ্বাসটা অনেক জোরালো। স্বাক্ষর শেষে একটা রসিদ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, কিছু দিবেন না? চা পান খাওয়ার জন্য আর কি। খুশি হয়ে। স্যার পকেট থেকে একশ টাকা বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিলেন। লোকটা কি মিষ্টি খাইয়ে টাকা নিচ্ছে? তাহলে কি পুত্র সন্তান হয়নি? আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে। প্রত্যেক প্রাণী যার নিকট থেকে খাবে তার প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। এটা সেই পদ্ধতি করেছে কিনা কে জানে। হেড স্যার টাকাটা আগেই সাইজ করে রেখে ছিলো মনে হয়। খুব যত্ন করে পকেট থেকে বের করে লোকটার সামনে মেলে ধরলেন। লোকটা ঈষৎ হেসে বললেন, এ কি দিচ্ছেন? এতে হয়? স্যারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা একটা কথা হলো? লাগবে না নিয়ে যান। স্যার আর একশ টাকা বের করে দিলেন। শুনেছি শিক্ষকেরা অতি মিতব্যয়ী হয় তাই বলে এরকম হয় জানা ছিলো না। লোকটা নিতে চাচ্ছিলো না। কিছুক্ষণ ধরে প্যাঁচাল চললো। শেষমেশ তিনশ টাকায় মামলা মিটলো। এবার ছুটলাম ফুড অফিসে। অফিস কক্ষে ঢুকে স্লিপটা নিয়ে একজন কর্মকর্তা একটা রেজিস্টার খাতা সামনে মেলে দিয়ে বললেন, এখানে স্বাক্ষর করেন।

স্বাক্ষর শেষ করতেই আরও একটা নতুন স্লিপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আজ আর দেওয়া হচ্ছে না। এই স্লিপটা হাতে দিয়ে যে কাউকে পাঠাতে পারেন। আমরা যার হাতে স্লিপ পাব তাকেই অনুদানের চাউল দিবো।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড