• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : বিশ্বনাথ হেয়ার ড্রেসার সেলুন

  খান রকিব

২২ মার্চ ২০২০, ১২:২২
ছবি
সমুদ্রের মধ্যিখানে আবার জেগে উঠবে কন্ঠস্বর (ছবি : প্রতীকী)

একদিন সন্ধ্যা উপরে আকাশ। নিচে নাগরিক বিলবোর্ড। তার নিচে যখন পুনর্নবার আপনাদের সাথে দেখা হলো, তখন আপনার উচ্ছ্বসিত দৃষ্টি নিয়ে বসে ছিলেন আরও একটি গল্প পাওয়ার আশায়। এবং আমি বলতে শুরু করলাম, আপনারা জেনে খুব অবাক হবেন; কিংবা অবাক হবেন না কিছুতেই। বলবেন, ধুর! এসব বাজে কথা। এমনটা হতেই পারে না। তুমি মদ্যপ, তুমি সাইকো। আমি যখন বর্ণনা করে যাব সবিস্তারে, সবিনয়ে, সবিস্ময়ে, আমি যখন শেষ রাতের স্বপ্নের মত বিস্মৃত ভাষায় অবিরাম বলে যাব; আপনারা শুনবেন। প্রবল আগ্রহ আপনাদের ঘিরে রাখবে সারাক্ষণ। এবং আমি এইখান থেকে শুরু করবো; বিশ্বনাথের সেলুনে লোকটি এসেছিল সেদিন। ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকার শুষে নিয়েছিলো নীলাভ ল্যাম্পপোস্ট। নিচে একটি কাঠের হাতল ওয়ালা চেয়ার, সেলুনে ব্যবহৃত সরঞ্জাম সম্বলিত কাঠের বাক্স আর তলা ছিদ্র হয়ে যাওয়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বনাথ। যার সেলুনের ছাদ ছিল সুবিশাল নীল-সাদা সম্বলিত আকাশ।আর রাতে ফুটে থাকা অবারিত নক্ষত্রের ফুল। হ্যাঁ, বিশ্বনাথ ব্রাহ্মপল্লি রোডে রোড লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে লোকজনের চুল দাঁড়ি ছাটে। রাস্তার পাশে থাকা ইলেক্ট্রিসিটির পিলারে টানানো সাইনবোর্ড ‘বিশ্বনাথ হেয়ার ড্রেসার সেলুন’।

লোকটা এসেছিলো বিশ্বনাথের কাছে। ভুড়িওয়ালা, পেটমোটা লোকটা, যার নাম সিরাজুল ইসলাম, কিংবা তার নামের পরে ইসলাম ছিলো না। ছিলো সর্দার। সিরাজুল ইসলাম বা সর্দার নামে লোকটি যখন চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে, ‘দাঁড়িগুলা জংলা হয়া গেছে, সেভ কইরা দে’ সন্ধ্যার আকাশ তখন আন্ধার হয়ে আসছিলো। বিশ্বনাথের মুখটাও তেমন। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কী দেখে আকাশে? কোন দৃশ্যপট কি ভেসে উঠর তার দৃষ্টির সীমানায়? কোন করুণ মূহুর্ত কি তার মনে পড়ে যায়? সিরাজুল ইসলাম বা সরদার ফের ধমকে উঠে বলেন, ‘কি কইলাম, কানে যায় না! সেভ কইরা দে’ বিশ্বনাথ সম্ভিৎ ফিরে পায়। লোকটির দিকে তাকায়, চোখ ফিরিয়ে নেয় নিকটের ড্রেনে। এবং খ্যাক খ্যাক করে এক ধলা থু থু নিক্ষেপ করে সে। তার মুখ গুলিয়ে বমি আসতে চায়। কিন্তু এই বমিতে বিশেষ কাজ হবে বলে মনে হয় না তার। মাথার উপরে নীলাভ স্টিক লাইটটি কত ওয়াট ক্ষমতা নিয়ে জ্বলছিল বলতে পারবো না। কিন্তু আমি বা আমরা, যারা সেদিন ভ্রাহ্মপল্লী রোডে বেকার বসে থেকে আসন্ন দৃশ্যায়নের সাক্ষ্যি হতে যাচ্ছিলাম, তারা অসংকোচে বলতে পারি, সেই আলোতে সেদিন বিশ্বনাথকে কী যে ক্ষুব্ধ, বিমর্ষ আর তেজী জেব্রার মত লাগছিলো! পরে আমরা বুঝেছি, এটি ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলো।

এই মুহূর্তে আপনাদের দিক থেকে উৎকন্ঠিত কোন ছেলে মানুষের প্রশ্ন ধেয়ে আসতে পারে, বিশ্বনাথ কি বালক, নাকি প্রৌঢ়বয়সী কোন অবাঞ্ছিত নাগরিক? আমি থেমে যেতে পারি আচমকা; প্রশ্ন শুনে। কিন্তু প্রশ্নটি তো অবাঞ্ছিত নয়! কারণ তখন হয়তো আমার খেয়াল হবে, এবং আমি বুঝতে পারবো বিশ্বনাথের প্রতি আপনাদের আগ্রহের সীমানা অকূল সমুদ্রের মধ্যিখানে গিয়ে পৌঁছেছে। এখন আমি চাইলেই পারতাম এই সমুদ্রের মধ্যিখানে আপনাদের দাঁড় করিয়ে রেখে খুব সচেতনভাবে পালিয়ে যেতে। কিন্তু গল্প কথক কি আর গল্প থেকে পালাতে পারে? এটা প্রবঞ্চকের কাজ। ফলে সমুদ্রের মধ্যিখানে আবার জেগে উঠবে কন্ঠস্বর।

আপনারা স্থির হয়ে বসুন। এবং তারপর পূর্বের বাক্য আর উদিত প্রশ্নের সামঞ্জস্যতায় বলে উঠবো, বিশ্বনাথ না বালক, না পৌঢ়া।বিশ্বনাথ একজন কিশোর। যার পড়ার কথা ছিলো কোন এক নাইট শিফট স্কুলে। কিন্তু সে কাজ করে সেলুনে। আর সে এতকাল ধরে সেলুনকেই বিদ্যালয় বলে জেনে এসেছে। এবং আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই তার মুচি পিতার কথা। যে পিতা জুতো সেলাইয়ের নামে একদিন খুব সকালে বের হয়েছিল রাস্তায়। তারপর আর ফিরে আসেনি। তখন হয়তো আপনাদের মনে হবে, এটি কোন সময়ের কথা,যে সময়ে মানুষ ঘরের বাহির হলে আর ফিরে আসে না? তখন আমি সচেতনভাবে সময়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো। কিংবা আপনারা হয়তো সেই সময়টাকে কল্পনা করা শুরু করবেন বলে আমার বলা না বলায় তফাৎ থাকবে না। এবং আবার আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব সেই ব্রাহ্মপল্লি রোডে।

বিশ্বনাথ হেয়ার ড্রেসার সেলুন। ফুটপাত। আগন্তুক বা কাস্টমার। সিরাজুল ইসলাম বা সর্দার। উপরে আন্ধ্যার আকাশ। তার নিচে ল্যাম্পপোস্ট। এবং তার নিচে যখন কিশোর বিশ্বনাথের বমি-টমি করার ইচ্ছে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে তখন সে পুনরায় লোকটির মুখের দিকে তাকাবে। আর তখন তার মনে হবে,কত কুৎসিত,কত জঘন্য গালে ছোট ছোট, খোচাখোচা দাড়ি ফোটে আছে আমনের বীজতলার মত সৌন্দর্য নিয়ে। সেই সৌন্দর্যে জর্জরিত খোচাখোচা কাঁচা-পাকা দাড়ি আচমকাই বিশ্বনাথের সমস্ত শরীর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দেবে। আর সে ছটফট করে উঠবে। রক্তাক্ত দেহ বা মন নিয়েই বিশ্বনাথ ছোট প্লাস্টিকের বাটিতে পানি নিয়ে গাল ভেজাতে থাকবে সিরাজুল ইসলাম বা সর্দারের। তারপর ক্রিম মাখাবে। যত্ন করে। তখন হয়তো আমার মনে হবে, গালে ক্রিম মাখানোতে কোন যত্ন ছিল না। কারণ আমি দেখেছিলাম, সেদিন সন্ধ্যায় ল্যাম্পপোস্টের আলোতে, বিশ্বনাথের চোখ হতে বারুদের গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। তখন আমার মনে হয়েছিলো, তার চোখে কেউ কমলা রঙের আগুনের প্রলেপ দিয়ে রেখেছিলো। কিসের আগুন? প্রতিশোধের? কিন্তু তখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠতে দেখিনি। কারণ তখনও বিশ্বনাথ ক্রিম ঢলে যাচ্ছিলো সন্তর্পণে। আর যখন সিরাজুল ইসলাম বা সর্দার আরামে চোখ বুঁজে থেকে বলে উঠেন, ‘আর কত ঢলাঢলি করস,এইবার খুর চালা’ বিশ্বনাথও হয়তো তখন বুঝতে পেরেছিলো এই মূহুর্তে তার খুর চালানো দরকার। আমি বা আমরা, যারা ব্রাহ্মপল্লী রোডে বিশ্বনাথ হেয়ার ড্রেসার সেলুনের সামনে উপবিষ্ট ছিলাম তারা দেখেছিলাম, বিশ্বনাথের ভেতরে এক অদৃশ্য অশরীরী শক্তি যেন ক্রমশ জেগে উঠছিলো। এবং তার হাত থরথর করে কাঁপছিলো। এবং তার ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা অশরীরী শক্তিটা হয়তো তাকে তাড়া দিতে থাকে। বিশ্বনাথ, খুর চালা, চালা খুর, চালা, চালা......... আর তখন আচমকা ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্ করে একটি শব্দ তরঙ্গ সঞ্চারিত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। আমরা দেখছিলাম সন্ধ্যার আকাশ। একটি নিভে যাওয়া নক্ষত্র পুনরায় প্রবল শক্তি নিয়ে ঝলমল করে জ্বলছিলো।

সিরাজুল ইসলাম বা সর্দার নামের মধ্য বয়সী লোকটি চিৎকার করে উঠার মতো এক সেকেন্ড সময়ও পায়নি। কারণ এক সেকেন্ড তখন অনেক সময়। বিশ্বনাথ পেশাদার খুর চালক তবে ঘাতক নয়। কিন্তু আমাদের তখন মনে হয়েছিলো, প্রথম দফায়ই কী করে গলার নিচে দুই ইঞ্চি খুর ডাবিয়ে দিতে পারে! অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়, অতুলনীয়। বিশ্বনাথ হয়তো এমন একটি মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলো। আচমকা খুরটা গলার নিচে চালিয়ে দিতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। নিঃশব্দে কেবল সিরাজুল ইসলাম বা সর্দারের মস্তক কেঁপে কেঁপে উঠে ঝিমিয়ে পড়ে। আর ঠিক ঐ মুহূর্তেই কেন যে এটা হয়েছিলো জানি না, ধপ করে ব্রাহ্মপল্লী রোডে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। যেন একটি দৃশ্যায়নের পর্দা নামলো।

সন্ধ্যা তখন ক্রমশ রাতের কোলে ঢলে পড়ছিলো। ইলেক্ট্রিসিটিহীন অন্ধকারে বিশ্বনাথের চোখের যে বিদ্যুতায়ন তা স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম। এবং শতাধিক গজ দূরত্বে দাঁড়িয়েও দরদরিয়ে ঘেমে জবজব হয়ে উঠছিলো আমাদের শরীর।

আরও পড়ুন : ধারাবাহিক গল্প : বসন্তের শেষে (শেষ পর্ব)

ব্রাহ্মপল্লী রোড, ফুটপাত, সেলুন, আগন্তুক এবং একটি আকস্মিক ঘটনার ভয়াবহতা যখন সেখানে উপবিষ্ট জনতা টের পেল তখন হা রে রে করে অনেককে তেড়ে যেতে দেখেছি। তখন কেউ কেউ অস্ফুটস্বরে বিশ্বনাথকে বলেছিলো, ‘এটা তুই কি করলি বিশ্বনাথ, দাড়ি ফেলতে গিয়া মানুষটারেই ফালায়া দিলি?’অন্ধকারের ভেতরই বিশ্বনাথকে ফোঁসে উঠতে দেখা যায়। এবং সে বলে, ‘বদমাইশটা কাইল মায়ের ঘরে ঢুকছিলো।আমি মা'রে কানতে দেখছি’তখন বিশ্বনাথের চোখে জল জমে উঠেছিলো। আর সে হাতের উল্টো পিঠে তা মুছে নেয়। আবার বলে, ‘আমি তখন বাইরে খাড়ায়া ছিলাম, ভিত্রে মা'য় চিক্কুর দিয়া উঠতেছিলো, আমার মন চাইছিলো তহনই কুত্তার বাচ্চারে সাইজ কইরা ফালাই’ তারপর অবিরত আরও কিছু বিস্ফোরক শব্দ, বাক্য বিশ্বনাথের কণ্ঠস্বরকে রুক্ষ মরুভূমি বানিয়ে দেয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড