• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : প্রেমের শেষ ঠিকানা

  আবদুল হান্নান জুলফিকার

১৬ মার্চ ২০২০, ১১:১৯
গল্প
ছবি : প্রতীকী

সবুজ গালিচার ওপর শীতল শিশির কণা ভরা যৌবন নিয়ে যৌবনতা বিলাচ্ছে দুলে দুলে সড়কের দু’ধারের সবুজ দূর্বাগুলো। বাগানে ফুটছে পুষ্পকলি। দিঘির ধারে ঘন কুয়াশায় আবছা আবছা অন্ধকার। পাখিদের কিচিরমিচির গুঞ্জন আর সমুদ্রে আছে স্বর্ণালি ধন। শুধু তা-ই নয়, সহস্র কোটি নেয়ামতে গড়া স্রষ্টার সৃষ্টি কী অপরূপ লীলাভূমি। যেথায় উঁচু উঁচু পাহাড় যেন দাঁড়িয়ে আছে নির্ঘুম পাহারায়, আছে জানা অজানা আরও কত কী। যা অনুভবের বাহিরে। এত সব সুধু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাখলুম মানুষের জন্য। তার বিনিময়ে সৃষ্টিকুল ঐ স্রষ্টার উপাসনা করাই স্রষ্টার গরজ ও গায়ত। সেই ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে আমাদের মাঝে প্রেরণ করেন সব মানবের মহামানব মুহাম্মাদ সা. কে। তাই তো সেই স্রষ্টার প্রতি প্রেম-ভালোবাসা নিবেদন করা প্রতিটি জীবকুলের নৈতিক দায়িত্ব। প্রেমের মহা সমুদ্রে ভাসমান হয়ে অনড় থাকা ছাড়া বৈকি। তেমনি বাগদাদের এক যুবকের প্রেমের চরম আত্মত্যাগের কাহিনী ফুটে উঠবে গল্পের গভীরে।

সন্ধ্যার আকাশ ধীরে ধীরে ঢলে পড়ে আঁধারের আবরণে, ঢাকা পড়ে যায় সূর্যের আলো নিকশ কালোর গভীরে। চন্দ্রের সীমারেখা অপহরণ হয়ে পড়ে মেঘের অন্তরালে। যুবকটি হাঁটছে শহরের রাস্তা ধরে আর তার চুলগুলো কোঁকড়া কোঁকড়া হয়ে বাতাসের তালে দুলছে। এক হাতে শরাবের বোতল। রং-বেরঙের কাপড়ে সুঠাম দেহটি ঢাকা পড়ে থাকে সবসময়। সেই যে বেরোয় ফেরে নিশির অন্তিমে। সারাদিন মাতলামি আর চুরি করে। অন্নের কোনো তোয়াক্কা করে না, কিন্তু মদ! মদের নেশা ফুরিয়ে গেলে তখন অনুভব করে যে, সে এখন উদরপূর্তিহীন। কখনো বা ভাবুক হয়ে প্রাচীরের দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকে। লোকে পাগল ভেবে বাচ্চাদের লেলিয়ে দেয় তার পিছু পিছু। সেও মুক্ত হয়ে থাকে কিছুক্ষণ ওদের সন্নিকটে, কারণ হয়েই থাকে হর-হামেশা বাচ্চাদের এমন আচরণ তার সাথে।

সে দিন সন্ধ্যা নেমে আসে। চারদিক কালো ছায়া। আজ খুব টায়ার্ড, তাই ভাবছে শীঘ্রই ফিরে যাবে ঘরে। বাড়িতে কেউ নেই আপন বলতে, কিন্তু তবুও নিজের কুঁড়েঘরে প্রশান্তি পায়। তাই তো ঘরে ফেরার প্লান করে। যুবকটি হাঁটছে আর হাঁটছে ততই রাত গভীর হচ্ছে। কিছুদূর এগুনোর পর দেখতে পেল যে, রাস্তার ধারে একটি জীর্ণ কুটির। কুটিরের ভেতর থেকে আলোক রশ্মি বাহিরে আসতে দেখা যায়। যুবকটি ভাবল এত রাতে প্রদীপের আলো? অতঃপর সে ধীরে ধীরে কুটিরের সান্নিধ্যে এগোতে থাকে। যতই সামনে এগোতে থাকে ততই যেন কানে গুনগুন ঘন শব্দ ভেসে আসে। কৌতূহল জাগে তার, একি হচ্ছে এখানে? ‘দরজায় ঠক ঠক শব্দ করে যুবক’ ভেতর থেকে আওয়াজ এলো কে? আমি পথিক, বলল বাগদাদের যুবক। কী চাই এখানে? ভেতর থেকে। না মানে! তোমার সাহায্যের খুবই প্রয়োজন ছিল আমার, খিরকিটা খুলবে? বলল যুবক। দরজা খুলে দেওয়া হলো। ভেতরে প্রবেশ করে যুবক কক্ষের এদিক ওদিক তাকানোর পর, ফ্লোরে বসে ধর্মীয় পুস্তিকা সামনে নিয়ে একটি কিশোরকে বসা দেখতে পায়। পাশে দাঁড় করানো আধো আধো আলোয় ভুগছে একটি প্রদীপ। দরজা খোলার অল্পক্ষণ পরেই বায়ুর ধাক্কায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল প্রদীপটি।

রাত দুপুর ভীষণ অন্ধকার, তুমি কী করছ? বলল যুবক। পড়ছি! ভয়ে ভয়ে কাতর স্বরে বলল কিশোর। গরিব বাবার সন্তান আমি কেরোসিন তৈল নেই বলে অন্যের কাছ থেকে ধার করে ক্রসিং এনেছি। দিয়াশলাই নেই, যা ছিল তাও অন্যের। কিন্তু আপনি প্রবেশের কারণে তাও হারালাম। এখন আমি অন্ধকারে কী করে পড়ি? কাল যদি আমি সবক আদাই করতে না পারি মার খেতে হবে? পারবেন আমাকে মুক্তি দিতে? ইসলাম চর্চার সুযোগ করে দিতে? কিশোরের প্রতিটি শব্দ যুবকের বিবেকে কুঠারাঘাতের ন্যায় বিঁধতে শুরু করে, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় তখন। ঘর্ম বেরিয়ে আলো ললাটে আর চেহারায়। ভাবছে জীবনে সীমাহীন পাপ করেই চলেছি, এমনটি আর কোনোদিন হয়নি। এ কেমন পাপ? যে আমাকে অস্থির করে তুলছে? ধিক্কার দিচ্ছে নিজেকে যুবক। খানিক নীরবতার পর, চল আমার সাথে, বলল যুবক। কোথায়? নিম্ন স্বরে বলল কিশোর। দোকানে, তোমার যা প্রয়োজন সবকিছু মিটে নাও। উৎফুল্লচিত্তে কিশোর যুবকের প্রস্তাবে ফওরান রাজি হয়ে যায়। এবং প্রতিদিন মন ভরে ফুটন্ত প্রদীপের দীপ্তিময় আলোতে পড়ালেখা করছে, এভাবে প্রায়ই যুবক কিশোরের সকল প্রয়োজন মেটায় এবং খোঁজ-খবর রাখে। যুবক ভাবে যে, ভালো তো কোনোদিন করিনি, রেহাই কি পাব পরপারে? নিজেই নিজেকে দুষ্কর ভেবে খোদা প্রেমে আত্মনিয়োগ হয় যুবক। নিজে মদ্যপানে নিমগ্ন, অন্যায়ে বিচরণ করে তবে ধার্মীকদের খুব ভালোবাসে।

ঐ কিশোর ছিল একজন মাদরাসায় পড়ুয়া ছাত্র। অভাবে ভালোভাবে পড়ালেখা করতে সক্ষম হতো না কিন্তু যুবক তার সব অভাব দূর করে দেয়। আর তাই এ কিশোর যুবকের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতে মঙ্গল কাম্যে স্রষ্টার নিকট সবসময় কেঁদে কেঁদে দয়া করতে থাকে। কিছুদিন পর যুবক মদ্যপান করে মাতাল চিত্তে আবারও বাগদাদের কোনো শহুরে রাস্তা দিয়ে উন্মাদ হয়ে হেলে-দুলে হাঁটছে আর চলছে, রাত তখন গভীরতায় প্রায়, মাতাল যুবক যখন রাস্তার পাশে কোনো এক ঘরের ধারে পৌঁছে তখন চলার গতি থেমে যায় তার। ঠিক তখনি সুউচ্চ আওয়াজে বিনয়ী ভাষায় যুবকের কানে ভেসে এলো মধুর কণ্ঠ। যুবক তখন কিছুটা সুস্থতা অনুভব করছিল। স্বরের কথাগুলো স্পষ্ট বুঝার জন্য কণ্ঠের নিকটবর্তী হয়ে জানালার গ্রিল ধরে ফাঁক দিয়ে দেখল। অতঃপর যুবকের আর বুঝার বাকি নেই যে, সে এক নাস্তিক কবি। নাস্তিকতার কবলে মহানবীর নামে কটূক্তিমূলক ভাষ্যে কিছু পঙক্তি রচনা করেছে। সেই পঙক্তিগুলো সুরের মূর্ছনায় আবৃত্তি করছে রাত দুপুরে। যুবকের হৃদয়ে নবীপ্রেমের স্পৃহা আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। প্রেমের সমুদ্র সৈকতে হাবুডুবু খাচ্ছে যুবক। মনে মনে ভাবছে, আমি এক নালায়েক বান্দা। তবে আমি রসুল সা. এর এ অপমান বরদাস্ত করতে পারি না। চোখে আর মুখে দীপ্ত শিহরণ, গোধূলির রক্তি মাখার মতো চোখ দিয়ে অগ্নি ঝরছে। ক্ষোভে সারাদেহ শীর-শীর করছে। অসহনীয় তাণ্ডবে সহ্য করতে না পেরে হাওমাও করে চিৎকার করে কবির দরজায় তীব্র আঘাত হানে। যুবকের প্রতিঘাতে খিড়কি দ্বিখণ্ডিত হয়ে দরজা খুলে যায়।

নবীপ্রেমের স্পৃহা যেন তাকে আরও মত্ত করে তোলে। তড়িৎ গতিতে কক্ষে প্রবেশ করে কবির ঘাড় মটকে দিয়ে দু'হাত ধরে ওপরে তুলে আর জোরে তাকে দেওয়ালের দিকে নিক্ষেপ করে। দেওয়াল ঘেঁষে ছিটকে পড়ে থাকে কবির মস্তিষ্ক। স্থবির হয়ে পড়ে থাকে কবির কলেবর। যুবক সেখান থেকে বাড়ি ফিরে যায়। পুরো রাস্তায় নবীর সা. প্রতি অপমানিত পঙক্তির কথ্য মনে করে অঝোর ধারায় অশ্রুপ্রবাহিত হয় যুবকের নয়নে। অবশেষে ঘরে পৌঁছে যুবক। খাবার না খেয়ে এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন : ছোটগল্প : ভাঁটফুল

ঘরের দরজাও বন্ধ করেনি আর এবরো-থেবরোভাবে থেকে যায় সবকিছু। সে রাতেই মহানবী সা. যুবকের চক্ষু শীতল করে দেন স্বপ্নে তাঁর দিদার মুবারকে। যুবককে নবী সা. বলেন তুমি আমার প্রেমে এতটাই মত্ত হয়েছ যে, আমি রওজায় থাকতে পারিনি, নিজেই তোমাকে দেখতে ছুটে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে যুবকের ঘুম ভেঙে যায়। অমনি কাঁদতে কাঁদতে যুবক আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুমে যুবক চলে যান না ফেরার দেশে। নবীপ্রেমের শেষ ঠিকানাই হলো যুবকের জান্নাত।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড