মাহবুব নাহিদ
গ্রামের মানুষেরা ইর্ষা করে তাদের নিয়ে। এমন মধুর সম্পর্ক ভাই-বোনের এর আগে কেউ দেখেনি। কাকলীর চেয়ে প্রায় ১৫ বছরের ছোট তার ছোটভাই নাহিদ। বোনকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না নাহিদ। বোন যখন কলেজে যায় তখন খেয়াঘাটে বসে চাতকপাখির মতো তাকিয়ে থাকে নাহিদ। বোন কলেজ থেকে ফিরলে বাড়িতে যায় সে। বোনকে ছাড়া খাওয়া তো দূরে থাক গোসল পর্যন্ত করবে না নাহিদ।
বোন গায়ে সাবান মাখিয়ে পানি ঢেলে দিবে। এই ঘটনা প্রতিদিন ঘটতেই হবে। কাকলীর যদি কলেজ থেকে ফিরতে দেরী হয়ে যায় তবে ঝামেলায় পড়ে যান তাদের মা। শত বুঝিয়েও গোসল খাওয়া করাতে পারে না নাহিদকে। রাতের বেলা একা ঘুমাবে না নাহিদ। বোন এসে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবে তারপর ঘুমাবে সে। ঘুম পাড়িয়ে যে কাকলী চলে যাবে তারও উপায় নেই। ঘুমের ঘরে বোনেহাত ধরে বুকের মধ্যে চেপে রাখবে সে। বোন যদি উঠে যেতে চায় তাহলে ঘুম ভেঙে যায় নাহিদের।
একদিন দুই ভাইবোন এক জায়গায় ঘুরতে যাবে। খেয়াঘাটে গিয়ে দেখলো নৌকা নেই। তাদের বাড়ি থেকে কোথাও যেতে হলে নৌকা পাড়ি দিতে হয়। নৌকা ছাড়া বাজারেও যাওয়ার উপায় নেই। কাকলী নাহিদকে বললো, ‘নৌকা না থাকলে কোথাও যাওয়া যায় না বুঝলি ভাইটু’।
- হুম আপুনি
অনেকক্ষণ পরে নৌকা আসলো। তারা দুই ভাইবোন একসাথে নৌকায় চড়ে যাচ্ছে। নৌকা একটু দোল খেতেই ভয় পেয়ে গেলো নাহিদ। বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো সে। পুরো পথ বোনকে জড়িয়ে রেখেই গেলো নাহিদ।
কাকলী মাঝেমাঝে ভাইকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাইটু, তুই যে আমারে ছাড়া থাকতে পারোস না। আমি যদি কোনো জায়গায় চইলা যাই তহন কি করবি?’
- কই যাবা তুমি আমারে ছাড়া? যাইতে দিলে তো!
- তুই যহন থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করবি তহন?
- আমি স্কুলে যহন যামু তুমিও তো কলেজে যাবা।
আসলে কাকলী জানে কয়দিন পরেই তার বিয়ে। এই কথাটা সরাসরি তার ভাইকে বলতে পারছে না। সে জানে তার এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। ভাইকে তো আর সাথে নিয়ে যেতে পারবে না। কি হবে ভাইটার? কে করিয়ে দিবে গোসল? কে খাইয়ে দিবে? কে ঘুম পাড়াবে?
এসব চিন্তা যখন কাকলীকে আচ্ছন্ন করে তখন কোনো কিছুই আর ভাবতে পারে না সে। বিয়ের কথা ভাইকে এখনো জানানো হয়নি। অবশ্য কি জিনিস তা নাহিদ হয়তো জানেনা।
সেদিন ঘুমানোর সময় কাকলী নাহিদকে বিয়ের কথা বললো।
কাকলী বললো, ‘ভাইটু, আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে।’
- বিয়ে কি আপুনি?
- বিয়ে হলে অনেক আনন্দ হয়। তোমার একটা দুলাভাইয়া হবে। অনেক মজা হবে। অনেক খাওয়াদাওয়া হবে।
- ওহ কি মজা! কি মজা!
নাহিদ জেনে গেছে বিয়ের কথা। সে জানে বিয়ে হচ্ছে অনেক মজার বিষয়। সে সবার কাছে আনন্দ নিয়ে বিয়ের কথা বলতে থাকে। সারাগ্রামের মানুষ নাহিদের মুখ থেকেই শুনে গেলো তার বোনের বিয়ের কথা। সবাই বুঝতে পারছে যে পাগল ছেলেটা হয়তো জানেই না যে বিয়ে হলেই যে ওর প্রাণের বোন আর ওর কাছে থাকবে না। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো নাহিদ। অন্যদিকে একদম বিষন্ন হয়ে গেছে কাকলী। প্রকৃতির এই চিরাচরিত নিয়ম মেনে তো নিতেই হবে। মেয়েদের বিয়ে হলে স্বামীর বাড়ি চলে যেতে হবে। স্বামীর বাড়িই তাদের আসল ঠিকানা, সেই বাড়িই যে তাদের নিজের বাড়ি। মেনে নিতে কষ্ট হয় তবুও মেনে তো নিতে হবেই।
বিয়ের দিন যতোই সামনে আসছে কাকলীর আত্মা ততোই ছোট হয়ে আসছে। আর বাড়ির সাজ সাজ রব আর আত্মীয় স্বজনের আগমন দেখে আপ্লুত নাহিদ।
বিয়ের আগের রাতেও একইসাথে ঘুমালো দুই ভাইবোন। অবিবাহিত জীবনে এটাই কাকলীর তারভাইয়ের সাথে শেষ রাত্রিযাপন। ভাইকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চেয়েছেন যে তিনি কাল বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু সরাসরি কথাটা বলার সাহস পায়নি।
পরেরদিন সকাল থেকেই খুব ব্যস্ত কাকলী। নাহিদের সাথে দেখা নেই সারাদিন। নাহিদও সারাদিন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে বেড়ালো নাহিদ।
মেয়েদের বিয়ে হলে সাথে কেউ একজন যেতে হয়। অনেকেই কাকলীকে বলেছেন নাহিদকে নিয়ে যেতে। কিন্তু কাকলী রাজি হননি। তিনি জানেন তার ভাই সম্পর্কে। হয়তো ভাই বোনের এই রসায়ন শশুড়বাড়ীর লোকেরা অন্য ভাবেও নিতে পারে। তার ভাইকে যদি কেউ উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয় তাহলে সে অনেক কষ্ট পাবে। তবে তাকে ছেড়ে চলে গেলেও সে কষ্ট পাবে। কিন্তু এই বাস্তবতা তো মেনে নিতে হবে। কাকলী শুধু নিজেই জানেন যে কতটা কষ্ট তার হবে।
কাকলী অপরূপ সাজে সেজেছে। বোনের সাজ দেখে অবাক হয়ে গেছে নাহিদ। বোন যেই ঘরে বসা সেই ঘরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন নাহিদ। নাহিদের উপস্থিতি টের পায়নি সেই ঘরের কেউ। তখন কথা হচ্ছিলো সেই বিষয় নিয়েই।
কাকলী তখন বলে উঠলো, ‘আমি যে চলে যাবো, এই বাড়িতে আর আসবো না তা ও এখনো জানে না। আমি শুধু এটাই ভয় পাচ্ছি যে ও জানার পরে কি হবে।’
কথাটা শুনেই ওই জায়গা থেকে দৌঁড়ে চলে গেলো নাহিদ। খেয়াঘাটে গিয়ে দেখলো নৌকা আছে কিনা। নৌকা দেখতে পেয়ে সে ভয় পেয়ে গেলো। সে তো জানে নৌকা না থাকলে যাওয়া যাবে না। অনেক কষ্ট করে নৌকার দড়ি খুলে দিলো সে। নৌকা চলে গেলো নদীর মধ্যে। এবার সে খুশিতে আত্মহারা। তার বোন কোনোভাবেই যেতে পারবে না।
অবশেষে যাওয়ার সময় হয়ে গেলো কাকলীর। কাকলী নাহিদকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে নাহিদের কোনো কান্না নেই। কাকলী নিজেও অবাক হলো। তার ভাই কেনো কাঁদছে না! একটু কষ্টও অবশ্য লাগছে। সে চলে যাচ্ছে আর তাই প্রাণের ভাই কাঁদছে না। তারা খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নাহিদ গেলো অন্য রাস্তা দিয়ে। খেয়াঘাটে পৌঁছে নাহিদের কলিজা উড়ে গেলো। ঘাটে একটা লঞ্চ দাঁড়ানো। লঞ্চে করেই এসেছে তার দুলাভাইয়ারা। সেই লঞ্চেই তারা কাকলীকে নিয়ে উঠলো।
কাকলী লঞ্চে ওঠার সময় ভাইকে খুঁজে বেড়ালো। তার তো দেখা নেই। গেলো কোথায় ছেলেটা। দূর থেকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো নাহিদ। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কি হচ্ছে এসব। তার প্রাণের বড়বোন কেনো তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই দৃশ্য যে দেখতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি নাহিদ। লঞ্চ ছেড়ে দেয়ার পর তার সে কি কান্না। তার গগনবিদারী কান্নায় কেঁপে উঠলো পুরো পৃথিবী। কাকলীও লঞ্চের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো তার আদরের ছোটভাইয়ের দিকে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড