বেলাল হোসেন
স্বপ্নের মতো বিশাল বাড়ি আকার আকৃতি ও জৌলুসে সাত তারকা রিসোর্ট। বাইরের চাকচিক্য ও আভিজাত্য দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে একটি দু’পায়া প্রাণীর আভ্যন্তরীণ শূন্যতা এবং অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যতার মাঝে নিঃসঙ্গ নির্বাসিত যাপনের কথা। বেলালের এই কঠিন সময় ভবের দুনিয়াতে শেষ প্রহরের কথা মনে করিয়ে দেয়। বেলালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে। সাভারের ভুলে যাওয়া এক স্থানে। টেক্সাসে এসেছি বিশ্বকাপ ফুটবলে উত্তর ভারত বনাম বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ দেখতে। জানতাম যে বেলাল ডগলাসের ৩৪ নম্বর রোডে থাকে। খেলা দেখে ভাবলাম রাতটা ওখানে কাটায়। গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের দ্বারা নিঃসঙ্গ বিশাল বাড়িটি প্রাণবন্ত।
তখনি মনে হলো আগামীকাল তো বেলালের ৫৬তম জন্মদিন। ছেলেমেয়েরা খেলা উপলক্ষ্যে বাবার জন্মদিন পালন করতে এসেছে, আগামীকাল কেক কেটে আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হতে আপন আলয়ে ফিরবে। আমাকে দেখে সবাই একটু অবাক। ওরা ভাবতেই পারেনি এই শরীরে আমি নিউইয়র্ক থেকে এতদূরে আসবো খেলা দেখতে। সারাহ মিষ্টি হেসে বলল আপনার বন্ধু রুমের মধ্যে। আমাকে দেখে বেলালের কপালের ভাজ কুণ্ঠিত, খুশীর ভঙ্গিমায় ভাবুক চেহরা। হঠাৎ করে বৃদ্ধ বন্ধু অনেকগুলো প্রিয়মুখ কাছে পেয়ে কিছুটা সামাজিক হতে চেষ্টা করছে। রাতে খাবার টেবিলে আলোচনার মুখ্য উপাদান হলো আজকের খেলা। কি করে ব্যাটাদের জালে তিন গোল ভরে দিলো ইমতিয়াজ, হাসান, তানভীরেরা। গ্যালারিতে মার খেয়ে ওদের (উঃ ভারতীয়) দাঁত ভেঙ্গেছে, পা খোঁড়াচ্ছে এটা সেটা। শুধু কথায় কথায় আমাদের রাজনৈতিক নির্বাসন ও মাতৃভূমির বর্তমান নিয়ে সবাই চুপ রইলো।
ঘুমানোর বন্দোবস্ত নিয়ে বাচ্চারা রীতিমতো কেওয়াজ করছে। অন্যদিকে নীরবে বেলালের রুমে জীবন সায়াহ্নের আড্ডায় ব্যস্ত আমি। অনেকদিন পেট হালকা করা হয়নি। তাকে পেয়ে গল্পের ক্ষুধাও মাথায় চড়ে উঠলো। আসলে গল্প নয় সবই আমার, আপনার, আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া স্বদেশের সত্য, সুন্দর, নির্মম বাস্তবতার কাহিনী। - আচ্ছা রাহবার তোর সাথে আমার প্রথম দেখা সাভারের এক ডর্মিটরিতে না। - হ্যাঁ। হঠাৎ করে তোর সে কথা মনে হলো? - কারণ, তোর সঙ্গে সেখানকার সাক্ষাতের সাথে আমার নির্বাসনের যোগসূত্র আছে। - তাই নাকি, ক্যামনে? - অবশ্যই। তা নয়তো কি। আমি যে একজন রাজনৈতিক প্রাণী ও রাজনীতির ছাত্র সেটা তো সেখানে সেসময় তোর থেকেই বুঝেছি ও নিজের মধ্যে ধারণ করেছি। নাহলে হয়তো আমার দ্বারা রাজনীতিও হতো না আর নির্বাসনের শাস্তিও পেতাম না। - আর তোর অবাঙ্গালীর সাথে সংসার করাটা নিশ্চয় কোন যোগসূত্র নহে। বেলাল এবার হোচট খেল। ধীরে ধীরে তাল লয় ঠিক করে নিঃসরণ করা শুরু করলো, ‘প্রথমত তুই নাটের গুরু আর এই সিরিয়ান আমায় খাদের কিনারায় নিয়ে এলো।’ - কিন্তু সারাহ’র সাথে সংসারে করার ফলেই আজ তুই পরিপূর্ণ। - হুম। - আচ্ছা বলতো সারাহ’র কেচ্ছাটা কি? এবার বেলালের কথার বাণ ছুটলো। তবে তা শুধু সারাহ নিয়ে নয় আরো অনেক কিছু। প্রথমবারেই যখন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলাম তখনই বিয়ের প্রচ্ছন্ন বার্তা পরিবার থেকে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ইচ্ছেও ছিলো কিন্তু ঠিক কি কারণে যে স্কলারশীপ নিয়ে প্যারিসে গিয়েছিলাম তা মনে নেই। এরপর সেখানে এক সর্বহারা অভিবাসী সিরিয়ান পরিবারের সাথে সখ্যতা। সিরিয়ার এই সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারটির বড় মেয়ে সারাহ’র সাথে হলো ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তিন বছরের স্কলারশীপ শেষে বুঝতে পারলাম পরিবারটি আমাকে যেভাবে চাচ্ছে তা ভাবতে আমারো ভালো লাগছে। অবশেষে পরিবারের সম্মতিতে হিল্লেটাও হয়েছিলো আড়ম্বরপূর্ণভাবে।
এইসময় দেশের এমন একটি পরিকল্পিত সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা আমার মননকে দারুণভাবে নাড়া দিলো। পরিবর্তনের ঊষালগ্নে নতুনভাবে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস এর ব্যবস্থা করা হলো একটি ভবিষ্যত উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে। প্রশাসনিক এই সংস্কারে যোগ্যতাই প্রধান মাপকাঠি হওয়াতে আজকের অবস্থানে আসা ত্বরান্বিত করলো। অবশেষে দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে মন্ত্রীপরিষদ সচিব হতে অবসর নিলাম।
তোর তত্ত্ব ‘আমি রাজনীতির ছাত্র’ এ কথার ভিত্তিতে জীবনের সর্বশেষ স্বপ্ন রাজনীতিতে নাম লিখালাম। ততদিনে আদর্শবাদী সরকারের একটি নতুন উদ্যোগ ‘মূল্যবোধ মন্ত্রণালয়’ দেশে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব’ এর আয়োজন করতে যাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশীদের মানসিকতা সত্যি সত্যি উন্নত জাতি গুলোর মতো পুনর্গঠিত হয়েছিলো। ফলস্বরুপ তখন থেকে জনগণের মাঝে রাষ্ট্রীয় সেবায় ফাকি দেওয়া ও দুর্নীতির প্রবণতা কমতে শুরু করেছিলো। সেইসাথে দেশের আদালত গুলোতে ফৌজদারি অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত সমাধান হতে থাকলো এবং রাজনৈতিক চিন্তা ও মূল্যবোধে বাংলাদেশীদের মস্তিষ্ক উৎকর্ষিত হলো। ফলে দেশকে আর ভূতের মতো পশ্চাৎপদ হতে হয়নি। কারণ এই মন্ত্রণালয় তার দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ সক্ষমতা প্রদর্শনে পিছপা হয়নি। দুই দশকের মধ্যে সামগ্রিক ভাবে জনগণের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আশ্চর্যজনক ভাবে মাত্র শতকরা দুই দশমিকে উপনীত হলো। এতে বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে একটি অদৃশ্যমান ‘বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব’ বিশ্বের অগোচরে ঘটে যায়। পরবর্তীতে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পরেই বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করলো। কষ্টসাধ্য এই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য প্রথম পদক্ষেপটাই ছিলো দেশের নাজুক শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। নতুন শিক্ষা কমিশন দেশের তত্ত্বীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে কারিগরি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান পদ্ধতির আধুনিকায়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমের মৌলিক পরিবর্তনসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় রাজনীতির লেজুরবৃত্তিক ধারায় ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের সুপারিশ করলো এবং তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছায়। এরপরে সরকারের ইচ্ছায় রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকাকে প্রধান্য দেওয়া আরম্ভ। দেশের স্পষ্ট পররাষ্ট্রনীতিতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, সরকারের এই বিশেষ চ্যালেঞ্জ সফলভাবে উৎরাতে সক্ষম হলো।
‘বুদ্ধি বিপ্লবে’র পর জনগণ একটি প্রত্যক্ষ বিপ্লবের কাছাকাছি চলে এসেছিলো। আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন মসিবত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোকাবেলা এবং দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার পরপরেই আদর্শবাদীদের সংগঠিত শক্তির কৌসুলি তৎপরতা জনগণকে পৌনঃপুনিক ভাবে একটি বিপ্লবের উপযোগী করে তুললো। পূর্বেকার সরকারের মানসিকভাবে উন্নত জাতি গঠনের যে প্রকল্প সফলতা পেয়েছিলো তা পূর্ণতা পেলো নতুন বিপ্লবে। কার্যত সংগঠিত, অসংগঠিত নানা ধরনের একতা ও শক্তির ঐকান্তিকতায় বিশ্ব একটি নতুন বিপ্লব দেখলো। যা শুধুমাত্র বাংলাতেই সীমাবদ্ধ রইলোনা। সীমান্তের কাঁটাতার পেঁড়িয়ে পুরো উপমহাদেশ ‘বাংলা বিপ্লব’ জ্বরে আক্রান্ত হলো। ঠিক একশত বছর পরে ভারতের বুকে একটি র্যাডক্লিফের আরো একটি কলম চলল নির্মম ও বিক্ষিপ্তভাবে। উপমহাদেশের বুকে জন্ম নিলো আরো কিছু ক্ষুদ্র জাতিরাষ্ট্র। বাংলা বিপ্লবের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, এশিয়াতে সদ্য নতুন এক রাজনৈতিক পরাশক্তিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্পে ধ্বংস হতে হলো। ধ্বংসমুখে নতুন শক্তি বাংলা’র আগমন আরেক পরাশক্তির জন্ম দিলো।
ইতোমধ্যে উন্নত মানসিকতার মূল্যবোধে বলীয়ান বাংলাদেশীরা বঙ্গোপসাগরকে নিজেদের ঘাটি বানিয়ে পুরো ভারত মহাসাগর চষে বেড়ানোর শক্তিসামর্থ্য প্রদর্শন করা শুরু করেছে। বর্তমানে শতাধিক এয়ারক্রাফট, সামুদ্রিক পরমাণু চুল্লি, পাঁচটি গভীর সমুদ্রবন্দর। সাথে সাথে গড়ে উঠলো বিশ্ব মানের সেরা প্রতিষ্ঠানসমূহ। গোয়েন্দা সংস্থা, মহাকাশ গবেষণা, নেভাল ডিটেকটিভ, উন্নত সিভিল সার্ভিস ইত্যাদি ।
সবকিছুর পরিবর্তনের মাঝেও ‘রাজনৈতিক পরিবর্তনে’র যে ধারা অব্যাহত ছিলো তার একটা উন্নত সংস্করণের অভাব বাংলাদেশের মানুষের কাছে তখনো স্পষ্ট। যার ফলশ্রুতিতে বিপ্লব-বঞ্চিতরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেনি। ভারত মহসাগরে একক আধিপত্য বিস্তার, সাগর থেকে মহাকাশ যান উৎক্ষেপণ, মহাসাগরে সফল নিওক্লিয়ার পাওয়ারপ্ল্যান্ট আর সীমান্ত প্রতিরক্ষায় ব্যালেস্টিক ক্ষেপানস্ত্র মোতায়েন অথবা বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ও দশম মাথাপিছু শীর্ষ আয়ের দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করার পরেও, জনগণ বিপ্লব এনে দেওয়া রাজনৈতিক আদর্শকে কয়েক বছরের মাথায় ছুড়ে দিলো। পরিবর্তনের এই ধারায় প্রতি-বিপ্লবীদের ক্ষোভ গিয়ে পড়লো বিশেষ কিছু ব্যক্তিত্বে। প্রতিবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই সঙ্গিনীর ‘জাতি পরিচয়’ আমার ওপর ক্ষমতাসীনদের ক্রোধ মাত্রাতিরিক্ত ধারণ করলো। পরিণতিতে বাধ্য হলাম স্বপ্নের মাতৃভূমি ছেড়ে সুদূর পরবাস যাপনে। এত কিছুর পরেও আফসোস জীবন গল্পের শেষটুকু দেশের মাটিতে রচনা করতে পারলাম না।
বেলাল এতক্ষণ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর ঢোক গিললো। দম ফেলে বলল তোর কি সেই দিনের কথা মনে পড়ে যখন ক্লাসে রামতনু লাহীড়ির জীবনী পড়া বাদ দিয়ে টঙের দোকানে চায়ের কাপে আমাদের ভবিষ্যত জীবন-কাহিনী রচনা করতাম। আর বিদেশিনীর প্রেমে বিভোর হয়ে আমার আপনার ভবিষ্যত ধ্বংস বৃত্তান্ত তৈরি করতাম। ক্লাসের এটেনড্যান্স দিয়ে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া সূর্যসন্তানদের অন্যায়, অবিচার, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদি আলোচনা করতে করতে মূল্যবোধের মলিন ঝিলিক মুখবয়াবে ভেসে উঠত। তখন মনে হতো এই ক্লাস ফাকি দেওয়ার সার্থকতা টুকু এখান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হলো। জানিনা সেই ফাজলামি ‘আপনার’ রাজনৈতিক চেতনায় কতটুকু প্রভাব ফেলেছিলো।
দুঃখ একটাই ৪৭ এর চেতনায় উপমহাদেশে যে যমজ রাষ্ট্র দুটি তৈরি হয় সেই চেতনাকে অবলম্বন করে বাংলার প্রতিবিপ্লবটি সফল। সেকারণেই আজ মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত ‘আমি ও আমার সত্তা’।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড