• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : মানবনীতি

  তুহিন হোসাইন

০২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:৩৫
গল্প
ছবি : প্রতীকী

বিকেলের সূর্যটা হালকা হয়ে আসছে। পাখিদের কলকাকলিতে সলিমুল্লাহ হলের পূর্ব পাশের বাগানটি মুখরিত হয়ে আছে। যত নীড় হারা পাখিদের মিলনমেলা এখানে। সারাদিনের দুরন্ত স্বাধীন জীবনে রাত মানে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আসে। যখন তার থেকে মুক্তির আশায় তীব্র বিরোধ করছে সমবেত পক্ষীকুল, ঠিক তখন ওই হলের ৩০৫ নাম্বার রুমের সামনে হট্টগোল শুরু হলো।

অনিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তার বাবা ছাত্তার আলী গ্রামের একজন হতদরিদ্র দিনমজুর। অতি কষ্টে ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। অনিক নিজেও টিউশনি করিয়ে কিছুটা ব্যয় বহন করে। তার পরিমাণ অতি অল্প। মাস শেষে পাঁচশত টাকা হাতে ধরিয়ে দেয় শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তাতে কোন রকমে চালিয়ে নিতে হয় পুরোটা মাস।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টিউশন ফি অতি অল্প। এখানে পড়ানো গৃহশিক্ষকের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা নগণ্য। তাই এই সঙ্কটটি অনিকের মতো পরিবারের সন্তানদের অতি আপোষে মেনে নিতে হয়। গৃহের শিক্ষক হওয়ার দরুন তিন বেলা খাওয়ার প্রস্তাবে অনেকে পড়াতে রাজি হয়। কিছু ক্ষেত্রে আবার খাওয়ার খরচের সাথে মাসিক বেতনের যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ ঘটে। অনিকের তেমন বদভ্যাস নেই। কিছুদিন সিগারেট ধরেছিলো কিন্তু বর্তমানে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। তিনবেলা খবারের টাকা জোগাড় করতে পারেনা তার আবার তামাক পাতা! অগত্যা সিগারেট ছাড়তে হয়।

ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে ছাত্তার আলী। ছেলেকে নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ নেই। ফজলুর দোকান চায়ের আড্ডায় সুযোগ পেলে ছেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নানা দিক বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করে। তার স্বপ্নের কাহিনি সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। অনিক তার এলাকা থেকে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। ফজলুর দোকানে এমনিতে খুব ভিড় লেগে থাকে। সামনে নির্বাচন তাই লোক সমাগম অন্যদিনের তুলনায় বেশি। রাজনৈতিক আলাপের সাথে ছাত্তারের গল্প বেশ জমে উঠেছে।

সালাম মণ্ডল দোকানে এসে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলো। তিনি গ্রামের মাতব্বর, বয়স পঞ্চাশের উপরে। বয়সের তুলনায় দেহ বেশ সুঠাম। সাদা লুঙ্গির সাথে মিল রেখে সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। ছেলে তাঁর মালয়েশিয়া থাকে। সেখান থেকে দামী পারফিউম পাঠিয়েছে। জিনিসটার বেশ সৎব্যবহার করছে সালাম মণ্ডল।

ছাত্তার বলে চলেছে, আমার মনি ইবার ফাস্ট ক্লাস পাইছে। আমার দুঃখের দিন শ্যাষ। ভালো একখান সরকারী চাকরি পালিপারে আমি পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকবো। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটোন লাগবো না। সালাম মণ্ডল মুখ কুঁচকে বললো, ছোট লোকের আশার শেষ নেই। এদের প্যাট তিমি মাছের প্যাট। দুনিয়া শুদ্ধ খাইলেও আরো খাইতে চায়। ছাত্তার আলীর চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা বইতে লাগলো।

আজ বৃহস্পতিবার অনিকের ক্লাস নেই। রাত জেগে পড়ায় একটু বেশি বেলা করে ঘুমিয়েছে। এবার শীতের প্রকোপ খুব বেশি। একটা কাঁথায় শীত মানায় না, তাই তিন চারটা কাপড় পরে ঘুমোতে হয়। তবুও শীতে শরীর জড়সড় হয়ে আসে। আজ মাসের সাত তারিখ এখনো বেতন দেয়নি। এবার বেতনের টাকা দিয়ে মোটা দেখে একটা লেপ কিনতে হবে। এরই মধ্যে নির্বাচন শুরু হয়ে গেলো। বিকেলের পর অনিচ্ছা সত্যেও মিছিলে যোগ দিতে হয়। অনেক দিন পেছন পেছন ঘোরার পর খুব কষ্টে ৩০৫ নাম্বার কক্ষে সে জায়গা পেয়েছে।

অনিক হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসলো, আর ঠিক তখনই মনে পড়লো গত দুই মাসের খাবারের বিল বাকি আছে। পেটের মধ্যে মোচড় দিতে শুরু করেছে এরই মধ্যে, নাড়িভুঁড়ি গুলো হজম হতে আর খুব বেশি সময় লাগবেনা। রুমমেটদের মধ্যে সবাই নতুন। ওদের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলা অনুচিত। বন্ধু বান্ধবের কাছে ঋণের পরিমাণ আকাশচুম্বী। এভাবে পড়ালেখা করা যায়না। গরীবদের পড়ালেখা করতে নেই। তারা হবে দিনমজুর তাদের আবার কিসের পড়ালেখা? সারাদিন খাটবো তিন বেলা পেট ভরে খাবো। ওতেই জগতের সকল শান্তি। অনাহারে মরার থেকে খেটে খেলে অন্ততপক্ষে বেঁচে থাকা যাবে। এমন সব আকাশ কুসুম কল্পনা মনের অজান্তে তাঁর মস্তিষ্কে এসে খেলা করে। এর নিয়ন্ত্রক সে নয় কোন এক অদৃশ্য শক্তি প্রতিনিয়ত খেলছে। কাপড়ের বাক্সটা খুলে বহুক্ষণ খোঁজার পরও কোন পরিষ্কার কাপড় না পেয়ে, অবশেষে রং জ্বলে যাওয়া শার্টটি পরে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটা শুরু করলো।

সন্ধ্যায় হামিদ ভাই রুমে প্রবেশ করে অনিকের দিকে কিছুক্ষণ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে এর আগেও বেশ কয়েকবার এসে অনিককে না পেয়ে ফিরে গেছে। এবার সে একনাগাড়ে বলে চললো, এই যে জমিদারের বাচ্চা কি ব্যাপার তোর? আজকাল মিছেলে তোর তেমন জোরালো ভয়েস পায়না ক্যান? মিছিলে সবার শেষে থাকিস? শরীর তো মাশআল্লাহ খোদার খাসি, মুখ দিয়ে কথা বের হয়না ক্যান? প্রথম বর্ষে এখন নতুন ছেলের অভাব নেই। যদি জোরে চেঁচাতে না পারিস হল ছাড়। তোর মতো গণ্ডারকে আমি শুধু শুধু দলে রাখবো না।

অনিক মাথা নিচু করে ফেললো। হামিদ ভাই শুধু আজ নয় বেশ কিছুদিন হলো সকলের সামনে এভাবে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এতক্ষণ অনিকের অশ্রু সিক্ত দুটি সজল চোখ অসহায় ভাবে এদিক ওদিক ঘুরছিলো। হঠাৎ করে চোখের দৃষ্টি সাব্বিরের বেডের নিচে রাখা একগোছা দড়ির দিকে নিবদ্ধ হয়ে রইলো। পরক্ষণে কয়েক ফোঁটা জল চোখ নিংড়ে মেঝেতে পড়লো। হ্যালো মনি আর কতদিন লাগবো তোর পড়া শ্যাষ হতি? আমি এহন আর আগের মতো কাম করবার পারিনা। গায়ে বল পায়নে,একটু খাটলে হাফ ধরে যায়। তুই তাড়াতাড়ি একখান চাকরি পালি আমি বাঁচি।

অনিক বেশ কিছুক্ষণ নিরবে থাকলো। কী উত্তর দেবে সে? নিজেও সে বেশ হতাশ। সারাটা দিন রুমেই ছিলো। কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। বিকালবেলা যে দুজন রুমে ছিলো তারাও টিউশনিতে গেছে। শীত লাগছে তবুও উঠে কাঁথাটা গায়ে চাপাতে ইচ্ছে করছে না। বিকেলের হালকা রোদ এসে পড়েছে গতকাল সন্ধ্যায় দেখা সেই এক গোছা দড়ির উপর। চিন্তা গুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। শুধু একটা চিন্তায় মাথার মধ্যে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড