• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : পালিয়ে বিয়ে

  মাহবুব নাহিদ

৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:২১
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন। পঞ্চগড় থেকে আসা একতা এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটী যাওয়ার নীলসাগর এক্সপ্রেসও এসে দাঁড়িয়েছে। একতা এক্সপ্রেসে রয়েছে রাত্রি, নীলসাগর এক্সপ্রেসে রাফসান। দুইজনই প্লাটফর্মের বাহিরের পাশের জানালায় বসা, ট্রেন দুটো যেভাবে দাঁড়িয়েছে তাতে দুইজন একদম সামনাসামনি। বাহিরের দিকে তাকালেই একে অপরকে দেখতে পাবে এমন অবস্থা। তবুও কেউ তাকাচ্ছে না। চোখ তাদের বাহিরের দিকেই কিন্তু দেখছে না এই জগতের কিছুই। দুইজনেরই গন্তব্য এক কিন্তু যাচ্ছে দুইজন দুইদিকে। তাদের গন্তব্য চিরচেনা, চিরনতুন একে অপরের কাঁধ। রাত্রির রাফসান আর রাফসানের রাত্রি, এটাই তাদের মনের আশ্রয়স্থল, আমৃত্যু আবাসভূমি। রাত্রির বাসায় তাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার কথা কাল। আজ যে কোনমতে পালিয়ে চলে এসেছে। তার মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার কাছে কোনো মোবাইল নাই। কাল রাফসান শুধু জানতে পেরেছে রাত্রিকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। রাফসানের মতো বেকার ছেলের সাথে রাত্রির পরিবার তাকে বিয়ে দিচ্ছে না। এই মুহূর্তে রাত্রির প্রথম কাজ হচ্ছে কমলাপুর স্টেশনে নেমেই রাফসানকে কল করা। পালিয়ে যেহেতু চলেই এসেছে সেহেতু একটা দফারফা হয়েই যাবে। স্টেশনে পৌঁছানোর আগে ট্রেন খিলগাঁওতে ক্রসিং এ পড়লো। অস্থির লাগছিলো রাত্রির। এই দেরী যে তার সইছে না।

বলে নেওয়া ভাল রাফসানের বাসা ঢাকা আরামবাগ আর রাত্রির বাসা বগুড়া সান্তাহার। পড়তেন একই সাথে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দ্বৈত কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে প্রায় হাজারবার অনুশীলন করতে হয়। সেই অনুশীলনের ফাঁকেফাঁকে কখন যে কে কাকে মন দিয়ে ফেলেছে তা তারা নিজেরাও জানে না।

কমলাপুর স্টেশনে নামলো রাত্রি। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি, তবুও তাকে যেতে হবে। স্টেশন থেকে কেউ বের হচ্ছে না কিন্তু রাত্রিকে তো বের হতেই হবে। বৃষ্টিতে ভিজেই রওয়ানা হবার টার্গেট নিলো সে। বের হয়েই একটা মোবাইল রিচার্জের দোকানে গেলো, ইদানিং আর রিচার্জের দোকান থেকে কথা বলা যায় না। তবুও অনেক জোর করে দোকানদারের মোবাইল নিয়ে কল দিলো রাফসানের নম্বরে। কিন্তু নম্বর যে বন্ধ! কি বিপদের কথা! ওদিকে বৃষ্টিতে ভিজে ট্রেনে উঠতে গিয়ে পানিতে ভিজে গেছে রাফসানের মোবাইল, সেই কারনেই তার মোবাইল রিচ করতে পারেনি। সে এবার সিদ্ধান্ত নিলো, রাফসানের বাসায় চলে যাবে সরাসরি। বাসার একটা ঠিকানা আবছা জানা ছিলো তার, বাকিটা খুঁজে বের করা যাবে। সে রওয়ানা হলো রাফসানের বাসার দিকে, তার প্রেম খুঁজতে। প্রেমে পরলে আসলে সবকিছুই পারতে হয়। পাহাড়ে উঠতে হয়, সাগর পাড়ি দিতে হয়, আগুনে ঝাপ দিতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয়, সাহস রাখতে হয় বুকে। এসবের কিছুই এখন রাত্রির করতে হবে না, রাত্রির এখন রাফসানের বাসা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। জানিনা কোনো এক অজানা শক্তি হয়তো প্রেমিকাদের থাকে, খুঁজে পাওয়া গেলো রাফসানের বাসা। কলিং বেল চাপা হলো। একজন মহিলা দরজা খুললো, দরজা খুলে সে দেখতে পেলো একটা অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে অর্ধভেজা অবস্থায় তার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা! মহিলার বড্ড মায়া হলো, মায়ের মন তো! আবার মায়েরা যেমন আবেগী হতে পারে নিজের সন্তানের বিষয়ে তারা ততোটাই কঠিন হতে জানে। সে বলে উঠলো, ‘কি চাই এখানে?’। রাত্রি বললো, ‘আন্টি, রাফসান’ এইটুকুই বলার সুযোগ দেয়া হলো রাত্রিকে। তারপর ভদ্রমহিলা কড়া কণ্ঠে লম্বা একটা বক্তৃতা দিলেন যার সারমর্ম এমন, ‘রাফসানকে নিয়ে অনেক বাজে মন্তব্য করেছে তোমার বাবা, আমরা গরীব হতে পারি তবে ছোটলোক নয়। আমরা আমার ছেলেকে বুঝিয়ে নিয়েছি, তাকে এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়েছি। তার মোবাইল বন্ধ আছে, তার যোগাযোগ করার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সে তোমাকে ভুলতে সক্ষম হয়েছে তাই তুমি তোমার বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নাও। তুমি সর্বোচ্চ আমার বাসায় এসে একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে পারো। এইটুকু সাহায্য তোমায় করতে পারি’ কথাগুলো বলতে মহিলার চোখেও পানি এসে গেলো কিন্তু সে বুঝতে দিলো না। তবে আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, মহিলা কথা বলার সময় হাতে একটা মোবাইল রয়েছে আর তাতে কারো সাথে কল চলছিলো। রাত্রি এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘রাফসান আমাকে ভুলে গেছে তার প্রমাণ কি?’ তখন রাফসানের মা একটা চিঠি বের করলো রাফসানেরই লেখা। হাতের লেখা তো রাত্রির সুপরিচিত। চিঠিতে লেখা, ‘রাত্রি আমি তোমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবো, তুমিও আমাকে ভুলে যাও। এটাই বাস্তবতা, এটা মেনে নিতেই হবে।’ রাত্রি এবার একটু শঙ্কিত হলো। সে আর কিছুই বললো না, চুপচাপ চলে গেলো। কথা তো অনেক বলার ছিলো। হাজারো কথা, হাজারো প্রশ্ন যার কোনোই উত্তর নেই। কত কথাই না দেয়া ছিলো একে অপরকে। কথা ছিলো একসাথে সারাজীবন পার করার, কিন্তু এই সামান্য ঝড়েই ভেঙে পড়লো রাফসান। মিছেমিছি এতো স্বপ্ন তাহলে কেনো দেখালো? রাফসান কেনো এমন করছে? সে এমন করতে পারে না! কি অপরাধ আমার? সে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে লাগলো। কেনো যেনো নিজের অজান্তেই বগুড়া যাবার একটা বাসের সামনে চলে আসলো। বাসের সুপারভাইজার জিজ্ঞেস করলো বগুড়া যাবেন কিনা। সে মাথা নাড়া দিলো, বাসটা তখনই ছেড়ে দিচ্ছিলো। সে বাসে উঠে বসলো, বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে! তাহলে কি সে বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে? কি জানি কি আছে কপালে লেখা!

ওদিকে রাফসান গিয়ে হাজির রাত্রিদের বাসায়। সেখানে তাকে মারাত্মকভাবে অপমান করলো রাত্রির বাবা। দু একটা চরথাপ্পর মারলো রাত্রির ভাই। সে রাত্রি রাত্রি বলে বহু চিৎকার করলো কিন্তু রাত্রির কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাত্রির পরিবারের লোকজন বুঝানোর চেষ্টা করলো যে তার ডাকে আর রাত্রি আসবে না। এক পর্যায়ে রাফসান জোর করে রাত্রির রুমের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয়া হলো। রাফসান নির্বিকার হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলো।

রাত্রির পৌঁছাতে রাত্রি হয়ে গেলো। বাহিরে কোনো মানুষজন নেই। রাস্তায় অল্প দুই একটা রিকসা আছে তখন। যত রাতই হোক চলাচলের জন্য নিরাপদ। রাত্রি ভেবেছিলো বাহিরে হয়তো তাকে খোঁজাখুঁজি চলছে কিন্তু সম্মানরক্ষার্থে তার পরিবার এই সিদ্ধান্তে যাননি। বাসার ড্রইং রুমে বসে আছেন সবাই। ফোনে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা চলছে। আর এখন জানা গেছে যে, রাফসানের মা রাত্রির সাথে যখন কথা বলে তখন রাত্রির বাবা ফোনের লাইনে ছিলো। রাফসানের মা’কে তার ছেলেকে কোনো ক্ষতি করা হবে এই ভয় দেখিয়ে এই কাজ করানো হয়! রাফসানের মায়ের সাথে ইতিমধ্যেই কয়েকবার কথা বলেছেন রাত্রির বাবা। আবারো তিনি হুমকি দিচ্ছেন কারন তার মেয়ে এখনো ফেরেনি, যদি না ফেরে তবে রাফসানকে জীবিত আর দেখতে হবে হবেনা। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো, কারোই বুঝতে সমস্যা হলো না যে কে আসতে পারে। দরজা খুলে দেখা গেলো রাত্রি! কিন্তু এ কোন রাত্রি? সারা শরীরে রক্তের দাগ। ভয়ে চমকে উঠলো সবাই। দরজা খোলার সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠলো রাত্রি ‘বেইমানটাকে মেরে ফেলেছি’ ভয় আর রাগের মিলিত কন্ঠে রাত্রির বাবা জিজ্ঞেস করলেন ‘কাকে মেরেছিস?’ রাত্রি বললো, ‘যে আমার প্রেম নামক অভিনয় করেছে, আমার অনুভুতির সাথে বেইমানি করেছে, আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছে, নিষ্প্রাণ এক ধুধু বালুচরে আমাকে মিছেমিছি ঘুরিয়েছে, সেই বেইমান, রাফসানকে বাবা বললো, ‘কীভাবে মেরেছিস? লাশ কোথায়? কখন করেছিস এই কুকাজ?’ রাত্রি বললো, ‘মাত্রই করেছি। আমাদের গলির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো ,পাশেই একটা ভাঙা কাচের টুকরা ছিলো তাই দিয়ে গলায় মেরে দিয়েছি’। বাবা বললো, ‘তাহলে এখনো পুলিশের কানে খবর যায়নি, তবে যেতে বেশি সময় লাগবে না। পুলিশ তোকে ধরে নিয়ে যাবে, পালা।’

রাত্রি বললো, ‘একা পালাবো?’

- একাই পালা, কোথায় যাবি পরে মোবাইলে বলে দিবো, আগে পিছনের দরজা দিয়ে বের হ হতভাগী, যাকে কিনা এত ভালবাসিস তাকে এইভাবে মেরে ফেলতে পারলি?

- মোবাইল কই পাবো? তার বাবা তখন তাকে তার মোবাইল ফিরিয়ে দিলো।

- আমি কীভাবে পালাবো? আমার কাছে কোনো টাকা নেই

বাবা তখন দ্রুত দুটি টাকার বান্ডিল এনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওরে পাগলী পালা তুই, আমরা দেখি লাশ কোনো জায়গায় সরিয়ে ফেলা যায় কিনা।’

রাত্রি পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। রাত্রির বাবা আর ভাই দুজনে দুটি টর্চলাইট নিয়ে বের হয়ে পড়লো। গলির মোড়ে তারা লাশ খুঁজতে লাগলো। লাশ তো পেলোই না বরং যা পেলো তাতে তারা বোকা বনে গেলো। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে মোবাইল, টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে রাত্রি। কারণ তারা লাশ না পেয়ে পেলো পানিতে লাল রং মিশ্রিত একটা হাড়ি। ততক্ষণে রাত্রি অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে, চলে গেছে বহুদুরে।

পরেরদিন রাত্রি রাফসানের সাথে ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড করলো যাতে লেখা, ‘পালিয়ে বিয়ে করে ফেললাম।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড