• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : অয়েনজিতার সাথে দেখা করতে এসে

  সেখ হুমায়ুন কবির সূর্য্য

২২ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:৩৬
গল্প
ছবি : প্রতীকী

দোতলার বেলকনিতে বসে নীচে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে প্রীণন। চারদিকে বড় বড় ফ্লাট বাড়ীগুলোর পাশে ছাপড়া বাড়িটি বেমানান ঠেকছে। আড়াই কাঠা জমিটিতে একটি টিনের চালা, অপরটি ছন দিয়ে তৈরি। উঠোনে মধ্য বয়সী এক মহিলা বসে সবজি কাটছেন।

পাশে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে তাকে সাহায্য করছে এক নববধূ। বেলা দুটোর সময় সবুজ কলেজ ড্রেস পড়া একটি মেয়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করল। প্রীণন মেয়েটির নাম জানে। ওর নাম বর্ষা। মেয়েটির গানের গলা অসম্ভব সুন্দর। শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়। অন্য গান গাইতে চায়নি বলে অয়েনজিতা ওকে বাড়ি থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আগে বর্ষা পড়াশুনার পাশাপাশি অয়েনজিতাদের বাড়ীতে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করতো। এর জন্য ওর মা ওকে ৩ হাজার টাকা করে বেতন দিতো। পরে অয়েনজিতা অপমান করার পর সে তিনতলায় তালুকদার বাড়িতে কাজ নিয়েছে। এখন বর্ষাদের সাথে অয়েনজিতাদের কোন সম্পর্ক নেই। বর্ষার বাবা রিক্সা চালায়। বর্ষা ছাড়াও তার একটি ভাই রয়েছে তার নাম স্বাধীন।

সে একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করে। উঠোনে নববধূটি তার। প্রীণন সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এই পরিবার সম্পর্কে অয়েনজিতা তাকে সব জানিয়েছে। এতবার বলেছে যে, সবকিছু মনের চোখে যেভাবে সাজিয়ে নিয়েছিল; আজ সেটা মিলিয়ে দেখছিল। এই বাড়ীর প্রধান পুরুষ এখনো আসেনি। এই লোকটিকে দেখার জন্য সে ব্যালকনির ছাদে গত দেড় ঘণ্টা ধরে বসে আছে। বর্ষাকে বেশ কয়েকবার এদিকে ওদিকে আসা যাওয়া করতে দেখল। সাদামাটা চেহারার একটি মেয়ে। আকর্ষণ করার মতো কিছু নেই। কিন্তু অয়েনজিতা এমন সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছিল যে, তার সাথে মেয়েটির কোন মিল নেই। এনিয়ে প্রীণন কিছু ভাবছেও না। সে বর্ষার বাবাকে দেখতে চায়। এই লোকটিকে তার দেখার অনেক সাধ। তার জন্য অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। শুধু এক পলক দেখা আর কথা বলার জন্য সে আকুল হয়ে আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন টিকি পাওয়া যাচ্ছে না।

দুর থেকে অয়েনজিতার গলা শোনা গেল, ‘ভাইয়া! প্রীণন ভাইয়া?’ প্রীণন ব্যালকনি থেকে উঠে দাঁড়াল। অয়েনজিতা খেতে ডাকছে। সে ডাইনিং এর দিকে হাঁটতে লাগল। অয়েনজিতা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। ওর আপন খালাতো বোন। অয়েনজিতার বাবা একটি রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতা। প্রীণন গত পাঁচ বছর যাবত আমেরিকায় সেটেল্ট হয়েছে। ওর বাবা রংপুরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। তিন ভাই-বোনের সংসার। স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকার বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনার সুযোগ পায় সে। চার বছর পর কোর্স কমপ্লিট করে সেখানেই এক সিনিয়র প্রফেসরের সাথে থিসিস করছে।

বাবা-মায়ের ইচ্ছা বাংলাদেশী মেয়েকে বিয়ে করে সে আমেরিকায় যাক। অনেক আলোচনার পর খালাতো বোন অয়েনজিতার সাথে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়। দুজনের ইচ্ছে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া। আর এজন্যই সে ঈদে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। অয়েনজিতার সাথে কথাবার্তা ঠিক হলে পরে আরেকবার এসে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবে। এভাবেই অয়েনজিতার সাথে প্রীণনের সম্পর্কটা নতুন করে মোড় নেয়। অয়েনজিতা বেশ লম্বা মেয়ে। নিজে ফিগারের যত্ন নেয় সে। ফলে ওর দিকে তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। তাকালেই চোখটা জুড়ে যায়। প্রীণন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এখনো এ বিষয়ে দু’জনের কেউ খোলামেলা ভাবে আলাপ করেনি।

দুপুরের খাবার খেয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে যায় প্রীণন। বিকেলে অয়েনজিতা এসে ডাক দেয়। বলে, ‘বর্ষা এসেছে, দেখবেন।’ প্রীণন ততটা উৎসাহ বোধ করে না। সে বর্ষার বাবার সাথে কথা বলার জন্য আগ্রহ বোধ করছে। বাধ্য হয়ে পাশের রুমে যায় সে। সেখানে অয়েনজিতা, ওর ছোট বোন অপূর্ণতা ও ভাই অপূর্ব বসে আছে। প্রীণনের খালা মহিলা সমিতিতে মিটিং-এ গেছেন। বর্ষা মাথা নিচু করে বসে আছে। অয়েনজিতা বলছে, ‘তোমাকে প্রীণন ভাইয়ার গল্প বলছিলাম না। এই সেই প্রীণন ভাইয়া। আর প্রীণন ভাইয়া এ হচ্ছে বর্ষা।’ বর্ষা চোখ তুলে একবার শুধু তাকাল। প্রীণনের মনে হল দুটো কালো দীঘির জলে স্নান করল। এত কাল সুন্দর কারো চোখ হয়। এরপর সবাই বর্ষাকে গান গাইতে বলল। চোখ ছাড়া একটা সাদামাটা মেয়ে। অয়েনজিতার সামনে অতি সাধারণ মনে হচ্ছে। এরপর যা ঘটল তাতে প্রস্তুত ছিলনা প্রীণন। বর্ষা গাইছিল- ‘কেন চোখের জ্বলে ভিজিয়ে দিলেম না......’

অতটুকু মেয়ের গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর। পুরো ঘরটি যেন গমগম করে উঠছিল। অপার বিস্ময়ে সেই গান শুনছিল প্রীণন। পুরো ঘরটিতে যেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হেঁটে বেরুচ্ছিলেন। প্রীণন বিমূঢ় ও বাকরুদ্ধ হয়ে গান শুনছিল। এক সময় গান থেমে গেল। যেন অনন্ত সময় ধরে সবাই অপেক্ষা করছিল। বর্ষা আস্তে করে বলল, আপু আমাকে উপরতলায় কাজে যেতে হবে। আমি যাই। ছোটরা হাত তালি দিয়ে উঠল। প্রীণন কিছু না বলে ওর রুমে চলে গেল।

অয়েনজিতাকে তখন এড়িয়ে চলল প্রীণন। বাবার কাছে ও শুনেছিল। বর্ষার বাবা একাত্তর সালে রংপুরে ওদের বাড়ীতে এসেছিলেন। সেসময় উত্তরবঙ্গে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রীণনের বাবা বলেছিল, ‘অয়েনজিতার বাবার কাছে গল্প শুনে বর্ষার বাবা রংপুরে এসেছিলেন। এরপর প্রীণনের বাবার সাথে তাদের আলাপ হয়। দুজনে একসাথে ভারতের মানকার চরে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং করতে গিয়েছিলেন। বর্ষার বাবা ছিলেন অকুতোভয় যোদ্ধা। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টারে তাদের ছিল শেষ সাক্ষাৎ। তারপর আর দেখা হয়নি। এরপর অয়েনজিতার মাধ্যমে বর্ষার বাবার গল্প উঠে আসে। পরে বাবার সাথে কথা বলে বিষয়টি মিলিয়ে নেয় সে। এরপর থেকেই অদম্য আগ্রহ ওই লোকটিকে দেখার।

রাতে শুয়ে কাজ করছিল প্রীণন। হঠাৎ রাত চিড়ে শোনা গেল কবি গুরুর গান। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা....।’ প্রীণনের মন ছটফট করে উঠল। সে বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটি হাঁটি পা-পা করে বর্ষাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। ভাঙ্গা দরজা আলগাই ছিল। সে ভিতরে প্রবেশ করল। উঠনো গোল হয়ে বসে আছে পুরো পরিবার। আর এই বাড়ির কর্তা যিনি রিক্সা চালান তিনি শোনাচ্ছেন রবীন্দ্র সঙ্গীত। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। প্রীণনের মনে হল সে যেন বাড়িতে চলে এসেছে। ওর আগমনে গান থেমে গেল। একটা ভরাট গলায় প্রশ্ন এল, ‘কে বাবা তুমি।’ প্রীণন বলল, ‘আমি রংপুরের মুক্তিযোদ্ধা আকবর মাস্টারের ছেলে।’ - আকবরের পোলা। কও কি! তোমার বাবা কেমন আছে? - বাবা এখন রিটায়ার্ড করেছেন। রংপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছেন।’ - ভাল, ভাল।’ - আপনি কেমন আছেন?’ - আমরা ভালই আছি। তবে আমাদের চেয়ে রাজাকাররা মনে হয় আরো অনেক ভাল আছে। দেখছো না চারদিকে বড় বড় ফ্লাট আমাদের গিলে খাচ্ছে। আমরা পেটের জন্য রিক্সার প্যাডেল ঘুড়াচ্ছি। আর ওরা টাকা-পয়সার পাহাড় গড়ে আমাদের চিড়ে চ্যাপ্টা করার চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধারা অনাদর অবহেলায় না খেতে পেরে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। আর রাজাকাররা ইসলামের নামে ব্যাংক-বীমা গড়ে তুলে স্বাধীনতার পতাকা-শহীদ মিনার ভেঙে ফেলছে।’

তিনি আবার গান ধরলেন, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু....।’ প্রীণনের মনে অদ্ভুত একটা আবেশ কাজ করল। সে গর্ব অনুভব করল, একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ীতে বসে আসে সে। সেই মুক্তিযোদ্ধা রিক্সা চালালেও রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়। এই গান ওর অন্তর ছুঁয়ে মনের সমস্ত দ্বীধা-দ্বন্ধ, ক্লান্তি দুর করে দিচ্ছিল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড