• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক গল্প : এক পলকের একটু দেখায় (৮ম পর্ব)

  সাবিকুন নাহার নিপা

২২ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:১৭
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

সৈকত হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। সিসিলিয়া আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা কাছে গিয়ে সিসিলিয়ার গায়ে আলতো হাত রেখে বলল, ‘তোমার কি হয়েছে লিয়া!’ সিসিলিয়া জবাব দিলো না। ওর চোখে পানি। অনন্যা অবাক হয়ে বলল, ‘এই সামান্য ব্যাপার টায় তুমি কাঁদছ?’ সিসিলিয়া করুন চোখে একবার অনন্যার দিকে তাকালো। অনন্যা বিষণ্ণ গলায় বলল, - তুমি ঠিক নেই লিয়া! তোমার কিছু একটা হয়েছে। সিসিলিয়া সেকথার উত্তর দেয় না। এলোমেলো পায়ে ভিতরের ঘরে চলে যায়।

আয়নার সামনে তাকিয়ে নিজেকে বারবার খুঁটিয়ে দেখে সিসিলিয়া। প্রথম যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল তখন সব ছেলেদের জাতীয় ক্রাশ ছিলো ও। ছোটবেলা থেকেই রূপবতী হিসেবে সব জায়গায় মানুষের মন হরণ করেছে অতি সহজে। চুলগুলো ব্রাউন কালার আর কোঁকড়ানো হওয়ায় সবাই ভাবতো বিদেশী। তবুও ২৩ টা বসন্ত একাই কেটেছে তার! সিসিলিয়া আয়নায় নিজেকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। অনন্যা দরজার সামনে এসে বলে, ‘লিয়া আমি ভাইয়া কে বলে দেব যেন তোমার সাথে আর মজা না করে।’ সিসিলিয়া সেকথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘জানো অনন্যা, আমাদের কলেজে একবার অনুষ্ঠানে এক পরিচালক আমায় সিনেমার অফার দিয়েছিল। তাতে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমি খুশি হতে পারিনি! বরং হাসিমুখেই বলেছিলাম যে আমি কোনোদিন হাই হিল পরে নাচতে পারবো না।’ অনন্যা আস্তে করে বলল, ‘এসব কেনো বলছো লিয়া!’ - আমি যত জায়গায় গিয়েছি সবাই আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে কিন্তু কেউ কখনো প্রপোজ করেনি। সব জায়গায় আমাকে একটা অবজ্ঞা সইতে হয়েছে। - চুপ করো প্লিজ! সিসিলিয়া অনন্যার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘এই যে তোমার এই কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে করেনা। এটা তোমার ভান অনন্যা। মনে মনে তুমিও আমাকে করুণা করো সেটা আমি জানি। অনন্যা বিস্মিত হয়ে বলল, লিয়া! - তুমি সেদিন বার বার বললে, লিয়া ইউনিভার্সিটি তে যাওয়ার সময় শাড়ি পরে যেও। আমি ভেবেছিলাম তুমি এমনি বলেছ, কিন্তু যখন শাড়ি পরে তোমার সামনে আসি তখন তুমি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলে! অনন্যা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। সিসিলিয়া বিষাদ মাখা গলায় বলে, ‘আমি সবাইকে চিনি অনন্যা। সবার মনের খবর ও রাখি।’ অনন্যা কিছু বলতে গেলে সিসিলিয়া বলে, ‘আমি একটু একা থাকতে চাই অনন্যা। প্লিজ!’ অনন্যা মন খারাপ করে চলে যায়।

সিসিলিয়া আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। বিকেলের ঘটনা মনে করে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। বিকেলে যখন দোকানে যায় তখন দুটো ছেলের একজন বলে, দেখ হুরপরী আসছে। অন্যজন তখন নাক সিটকে বলে, বারের হুরপরী। হাটার ধরন দেখে এখন ও বুঝিস না যে খোঁড়া। তবুও জবাব দেয়ার জন্য সিসিলিয়া এগিয়ে যায় তখনই সৈকত এসে যায়। ওর ধারণা সৈকত এটা ইচ্ছে করেই করেছে যেন ছেলেদুটির সাথে সৈকতের ঝামেলা না হয়।

জন্ম থেকেই সিসিলিয়ার বাম পায়ে সমস্যা। হাটার সময়ে ভালো করে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না। তবুও যারা বুঝতে পারে তারা একশব্দেই বলে ফেলে প্রতিবন্ধী! যদিও এটা বলা উচিত। তবুও সিসিলিয়ার গায়ে কাঁটার মতো বিধে যায়।

সিসিলিয়া চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, ‘হে আল্লাহ তুমি আমাকে আরও অনেক সহ্যক্ষমতা দাও!’

সন্ধেবেলা প্রমার ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। ফোন করেছে তার বাবা এনামুল চৌধুরী। প্রমা ফোন রিসিভ করে হাসিমুখে বলল, ‘কেমন আছ বাবা?’ - ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? সব ঠিক আছে তো? - হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। আর আমিও ভালো আছি। - একটা খবর আছে প্রমা। - হ্যাঁ, বলো। - তোমার মাকে দেশে আনার জন্য যে টাকাটা তুমি খরচ করেছ সেটা আজ দিয়ে গেছে। প্রমা বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। একরকম চিৎকার করেই বলল, - এত সাহস ওর! কেনো মা কি শুধু ওর একার ছিলো! - তুমি মাথা ঠান্ডা রাখো প্রমা। প্রমা নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করল, - টাকাটা কিভাবে পাঠিয়েছে? - নিজে এসে দিয়ে গেছে। - এখন কোথায় থাকছে সেটা কি জেনেছ? এনামুল চৌধুরী অতি সন্তর্পণে দীর্ঘনিঃশ্বাস লুকিয়ে বলল, ‘নাহ!’ প্রমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘ইউ আর এ বেস্ট ফাদার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। তোমার মেয়ে কোথায় আছে সেটা জানবার কোনো ইচ্ছেই তোমার নেই!’ এনামুল সাহেব শান্ত কণ্ঠে বলল, আমার কাছে তুমিও যেমন সেও তেমন। আমার খুব চিন্তা হয় তার জন্য। কিন্তু.... - কিন্তু কি বাবা? - এই পৃথিবীতে এখন ও পর্যন্ত আমি একজন কেই ভয় পাই মা। আর সে হলো সিসিলিয়া। আমার ছোট মেয়ে। যার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস আমার নেই। প্রমা চুপ করে থাকে। সিসিলিয়ার চোখের দিকে তাকানোর সাহস ওর ও নেই। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আর কখনো ওর সাথে দেখা হয়নি। ওর মা সবসময় বাইরে দেখা করতো কিন্তু সিসিলিয়াকে নিয়ে আসতো না। পিঠেপিঠি বোন হিসেবে দু’জনের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিলো না। আর তাছাড়া দুজন ছিলো দুই মেরুর। সিসিলিয়া ছিলো সর্বগুণসম্পন্না। কথা কম বলতো। পড়াশোনায় ছিলো তুখোড়। পড়াশোনায় প্রমাও ভালো ছিলো। তবুও দুবোনের মধ্যে কম্পিটিশন ছিলো বরাবরই। সিসিলিয়ার নরম স্বভাবের জন্য সবাই ওকে পছন্দ করতো। আর প্রমার অপছন্দের কারণ হিসেবে ছিলো সিসিলিয়ার সৌন্দর্য। দুজনেই সুন্দর, তবে কি যেন একটা ব্যাপার ছিলো সিসিলিয়ার যেটার জন্য তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো। তাই প্রমা ইচ্ছে করেই সিসিলিয়াকে সবসময় দুর্বলতা নিয়ে হেয় করতো। সে কারণেই ছোটবেলা থেকে দুজনের সম্পর্ক দুরের।

বহুবছর পর প্রমা সিসিলিয়াকে মায়ের মৃত্যুর সময় দেখলো। সেই আগের মতোই চেহারায় কি যেন একটা আছে। তবুও কেমন একটা দুঃখী চেহারা। ক্লান্ত চোখ, মুখ। যার জন্য সব খারাপ লাগা মায়ায় পরিণত হয়। প্রমা চেয়েছিল মায়ের অনুপস্থিতিতে বোনের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে দিতে। কিন্তু সিসিলিয়া সে সুযোগ দেয়নি। সেদিনের পর আর প্রমার সাথে যোগাযোগ করেনি।

এনামুল সাহেব কখন ফোন কেটে দিলো প্রমা টের পেলো না। প্রমা আবারও ফোন করল। - হ্যালো বাবা। - হ্যাঁ বলো। প্রমা একটু ইতস্তত করে বলল, ‘সিসিলিয়া কি ভালো আছে?’ এনামুল সাহেব চুপ করে থাকেন। কোনো কথা বলেন না। প্রমার অস্বস্তি হয়। ফোন কেটে দেয়। বাবার চুপ করে থাকা দেখে যা বোঝার বুঝে ফেলে। প্রমার খুব অস্বস্তি হয়। একই বাবা মায়ের মেয়ে হয়ে ও বড় হয়েছে আরাম আয়েশের মধ্যে। আর সিসিলিয়া!

সিসিলিয়ার ঘুম ভাঙল আজ খুব সকালে। কাল সৈকতের সাথে খারাপ ব্যবহার করায় খুব আফসোস করেছে। তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতেই অস্থির হয়ে উঠলো ভিতরে ভিতরে সৈকত কে স্যরি বলার জন্য

দোতালায় যেতেই সৈকতের সাথে দেখা হয়ে গেল। সিসিলিয়াকে দেখেই সৈকত বলল, ‘বাহ ভাবী আপনি তো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছেন দেখছি!’ সিসিলিয়া ইতস্তত করে বলল, ‘কালকের ঘটনার জন্য মাফ করবেন। আমার আসলে মাথার ঠিক ছিলো না। কি যে হয়ে গেল। সৈকত অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কালকের কোন ঘটনা? ওই কুত্তা বলার ঘটনা?’ লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে সিসিলিয়া বলল, ‘হ্যাঁ।’ সৈকত হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘আপনার বলতে ইচ্ছে হয়েছে বলেছেন। দরকার হলে কুত্তার সাথে সাথে বিড়াল, শেয়াল, গুইসাপ এগুলোও বলতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।’ সিসিলিয়া বিরক্ত হলো। মনে হলো এতো সকালে এখানে না আসলেই ভালো হতো। বিরক্তি লুকিয়ে বলল, ‘আমি সত্যিই মন থেকে স্যরি ফিল করছি।’ সৈকত সিরিয়াস গলায় বলল, ‘আচ্ছা। শুকনো স্যরি তে তো তেমন কাজ হয় না। আপনি বরং ভালো করে পিঁপড়ে দিয়ে এককাপ চা বানিয়ে দিন। আসলে সকালে এখনও টয়লেট হয়নি তো!’ শেষের কথাটা বলতে গিয়ে একটু লজ্জা পাওয়ার ভান করলো সৈকত। সিসিলিয়া রেগে বলল, ‘আপনাকে যে এইমাত্র স্যরি বলেছি সেটা ফিরিয়ে নিলাম। আর কালকে যা যা বলেছি সব সত্যি। আপনি ওইগুলোই।’ - ভাদ্রমাসের কুত্তা? সিসিলিয়া দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো। সৈকত মুচকি হেসে আকাশের দিকে তাকালো। আজকের সকাল টা এতো বেশী মিষ্টি কেন লাগছে ওর!

(চলবে...)

আরো পড়ুন ৭ম পর্ব- ধারাবাহিক গল্প : এক পলকের একটু দেখায়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড