• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (২২তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

২১ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:৩৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ইতি রাফাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘রাফা, সবসময় পাকনামো ভালো লাগে না। তুই আমার ঘরে যা এখন। আমি তোর খাবার নিয়ে আসছি।’

রাফা কোনো কথা না বলে সায়েমের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সায়েম ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘরে এলো। কালো রঙের একটা শার্ট, আর একটা কালো প্যান্ট পরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কড়া করে পারফিউম লাগিয়ে হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে লাগল। তখনই হঠাৎ ফোন রিংটোন বেজে উঠল। বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল রাফার ফোনটা পরে বাজছে। দরজার দিকে তাকালো একবার। কাউকে দেখতে না পেয়ে কৌতূহল বশত আয়নার সামনে থেকে সরে এসে বিছানার কাছে এলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো স্ক্রিনের দিকে। হঠাৎ সায়েম উত্তেজিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে একবার তাকিয়েই ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘অদৃশ্য মানব।’

বিব্রত না হয়ে একপ্রকার উত্তেজনার মধ্যে দিয়েই ফোনটা রিসিভ করল সায়েম। একদম চুপ করে থেকে ওপাশের মানুষটার কথা শোনার অপেক্ষায় ফোনটা কানে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ওপাশের মানুষটা কথা বলল না, তখন সায়েম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল৷ আর তখনই ওপাশ থেকে পুরুষালী কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ফোন ধরছিলে না কেন? আমি তো ভেবেছিলাম কোনো সমস্যায় পরেছ। যাক অবশেষে যখন ফোনটা রিসিভ করলে, ‘তখন কাজের কথাই বলি। আমাদের পরবর্তী প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়ে গেছে। এবার প্ল্যানটা শুধু ঠিকভাবে এপ্লাই করার পালা।’

সায়েম ভ্রু-কুঁচকে আবারও নিঃশ্বাস নিলো। অদৃশ্য মানব আবার বলল, ‘চুপ করে আছ কেন বুঝতে পারছি না। অন্যসময় তো বকবক করেই যাও সারাক্ষণ। যাই হোক শোন, আমাদের মাঝে যে ডিল হয়েছিল, সেখানে দু’টো কাজ ছিল। তার মধ্যে একটা প্রায় কমপ্লিট হয়ে গেছে। সেটা হলো তোমারটা। এবার আমার অন্য প্ল্যানটা কাজে লাগিয়ে পরের মিশন সাকসেসফুলি পার করতে হবে। শনিবার থেকে শুরু হবে পরবর্তী প্ল্যানের কাজ। আপাতত তোমার কাজ শুধু একটাই, সায়েমের পদক্ষেপ সম্পর্কে আমাকে ডিটেইলস জানানো। সায়েম কখন কোথায় যায়, সব। তুমি নিজের সোর্সে যতটুকু জানতে পারো আরকি। তবে এমন কিছু করবে না, যাতে ও আমাকে সন্দেহ করে।’

সায়েম এবার আর নিঃশ্বাস নিতে পারল না। দম আটকিয়ে চুপ করে রইল। ওর চোখ দু’টো লাল হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ইচ্ছে করছে ফোনের ওপাশের লোকটাকে গালাগাল দিতে। আর রাফার হাত-পা বেধে আধমরা করে জিজ্ঞেস করতে, ‘বল তোদের পরবর্তী প্ল্যান কী? আর কে এই অদৃশ্য মানব? আমি নিশ্চিত এ আমার পরিচিত কেউ। কণ্ঠটাও কিছুটা পরিচিত। বাট কে?’ কিন্তু না, সায়েম এই কাজটা করবে না। এটা করা সাংঘাতিক বোকামি হয়ে যাবে। রাফার জেদ সম্পর্কে ও অবগত আছে। ও মরে গেলেও কিছুই বলবে না। ও মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত-ও নিজের জেদ বজায় রাখবে।

ফোনের ওপাশের লোকটার কথায় ভাবনা স্থগিত রাখল সায়েম। লোকটা বলছে, ‘তুমি কি মজা করছ আমার সাথে? নাকি চুপ করে থেকে আমার সাথে কোনো চালাকি করার চেষ্টা করছ? ভুলে যেও না আমি কিন্তু গভীর জলের মাছ। ভয়ঙ্কর কিছু নিয়ে খেলা করাই আমার নেশা। সুতরাং আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করে তুমি নিজের বিপদ ডেকে আনছ।’

সায়েম ফোনটা কেটে দিয়ে হাঁপাতে লাগল। চোখ বড় বড় করে, দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকালো ফোন স্ক্রিনে থাকা নম্বরটার দিকে। নম্বরটা পরিচিত না থাকলেও এই কণ্ঠটা পরিচিত। আর শেষের এই কথাটা তো এর আগেও শুনেছে ও। - ভুলে যেও না আমি কিন্তু গভীর জলের মাছ। ভয়ঙ্কর কিছু নিয়ে খেলা করাই আমার নেশা। সায়েম মাথা চাপড়াতে লাগল৷ কোনোভাবেই মনে করতে পারছে না এই কথাটা আগে কার মুখে শুনেছে। সায়েম জানে এখন মনের উপর যত জোরই দিক না কেন, কোনোভাবেই মনে পড়বে না কিছুই। প্রয়োজনের সময় আসল জিনিসটা ভুলে যাওয়া ওর অভ্যাস। পরে অবশ্য মনে পড়বে, কিন্তু ততক্ষণে হয়তো সেই জিনিসটার প্রয়োজনই ফুরিয়ে যাবে।

সায়েম সময় নষ্ট করল না। লোকটা অনুমান করতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে এখানে। আর সেজন্যই ফোনের এপাশ থেকে কেউ কথা বলেনি। লোকটা নিশ্চয়ই পরে আবার ফোন করে রাফাকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু এর আগেই লোকটার সন্দেহ দূর করতে হবে। সায়েম ফোনটার দিকে তাকিয়ে লোকটাকে ম্যাসেজ পাঠানোর চেষ্টা করেও পারল না। কারণ ফোনটা লক করা। সিকিউরিটি লকটা জানে না ওর। দু'মিনিট ভাবল সায়েম। এরপর মৃদু হাসি দিয়ে ফোন হাতে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে ইতির ঘরে গেল। রাফা তখন শুয়ে ছিল। সায়েমকে দেখেই ওঠে বসল। ওর হাতে ফোনটা দেখেই বলল, ‘একি, আমার ফোন তোমার হাতে কেন?’

সায়েম নিজের হাতেই ফোন রেখে বলল, ‘পাসওয়ার্ড টা একটু বল। আসলে আমার ফোনটা ওই বাড়িতে রেখে এসেছি। আমার কাজিনকে ফোন করে বলব ওটা এখানে নিয়ে আসতে।’

রাফা চুপ থেকে কি যেন ভাবল একবার। তারপর বলে দিলো। সায়েম মৃদু হাসি দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নিজের ঘরে এসে লকটা খুলে ওই ‘অদৃশ্য মানব’ নামে মানুষটার নম্বরে ম্যাসেজ পাঠালো। ম্যাসেজটা এইরকম, ‘সরি, পাশে সায়েম থাকায় কথা বলতে পারিনি। তবে সব কথা আমি শুনেছি। আর কথা অনুযায়ী সায়েমের প্রতিটি পদক্ষেপের ডিটেইলস আমি জানিয়ে দিবো।’

ম্যাসেজটা পাঠানোর একটু পরই ম্যাসেজটা ডিলিট করে দিলো সায়েম। সাথে নম্বরটাও ডিলিট করে দিলো। এরপরই ও নিজের কাজিনকে নয়, বরং এক বন্ধুকে ফোন করল। কিছুক্ষণ কথা বলে আবার ফোনটা রাফাকে ফিরিয়ে দিলো।

ইতির আজ অফিসের দ্বিতীয় দিন। মনের ভিতর যেমন উত্তেজনা কাজ করছে, তেমনি ভয়-ও কাজ করছে। রোদের হাবভাব ওর কাছে মোটেও ভালো লাগে না। ছেলেটা কি চায়, সেটা কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না ইতি। তার উপর গত কালকে আবার উনার সামনেই ফাহাদকে জড়িয়ে ধরেছিল ও। ফাহাদও রেগেমেগে দুই একটা কথা বলে দিয়েছিল। ইতি খুব ভালো করেই জানে আজ ওর কপালে দুঃখ আছে। রোদ যে খোঁচা মেরে যে হাজারটা কথা শুনিয়ে দেবে, সে ব্যাপারে ইতি নিশ্চিত। তাই সব কিছুর মিশ্রণে মনের ভিতর ভয়, আতঙ্ক, উৎকণ্ঠ, আর উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইতি বুকে হাত দিয়ে বলল, ‘উফ, বুকটা কেমন ডিপডিপ করছে। মনে হচ্ছে এখুনি মরে যাবো। হয়তো আর দুই এক মিনিট। কিংবা এর থেকেও কম সময়।’

তবে ইতি ঠিক করেই নিয়েছে। আজ রোদের কেবিনের দিকে না যাওয়ার চেষ্টা করবে। খুব বেশি প্রয়োজন হলেও নিজে যাবে না। অন্য লোক পাঠাবে। সিঁড়ি দিয়ে চার তলায় ওঠে ডানে ঘুরল ইতি। একটা কেবিনের পরেই রোদের কেবিন। তার ঠিক উল্টো পাশে, মানে রোদের কেবিনের মুখোমুখি ওর নিজের কেবিন। সুতরাং ওর কেবিনে যেতে হলেও রোদের কেবিন সামনে পড়বে। তবুও ইতি পায়ে কোনোরকম শব্দ না করে রোদের কেবিন ক্রস করে নিজের কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আড়চোখে একবার রোদের কেবিনের দিকে তাকালো। দরজাটা বন্ধ আছে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কেবিনে দরজার ধাক্কা দিলো। কিন্তু ভিতরে গিয়ে সামনের দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে বরফের মতো জমে গেল ইতি। বুকটা কেমন ধুক করে উঠল। পা আর এক ইঞ্চিও সামনে এগোলো না। যেখানে দাঁড়িয়ে রোদের মুখোমুখি হয়েছে, সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রোদ এতক্ষণ ফাইলে মুখ গুজে ছিল। ইতিকে দেখে ফাইলটা টেবিলে ছুড়ে মারল। ইতির ভয়টা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল। রোদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে, সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকালো। ইতি নিজের চোখ দু'টো নামিয়ে নিলো। রোদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ইতির হাতটা ধরে টান দিলো। আচমকা এইরকম হওয়াতে রোদের উপর এসে পড়ল ইতি। নিজেকে সামলে নিয়ে রোদের থেকে আবারও নিজের দূরত্ব তৈরি করে নিলো। রোদ রোবটের মতো দাঁড়িয়ে এক হাতে ইতির একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ইতি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারল না। চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর রোদের দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকালো। রোদ কড়া গলায় বলল, ‘কালকে তো রাস্তার মধ্যে একজনকে জড়িয়ে ধরেছিলে। তাহলে আজ এই রুমের ভিতরে আমাকে জড়িয়ে ধরতে এত দ্বিধা করছ কেন?’

ইতি ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। ও জানতো রোদ এইসব নিয়েই কথা বলার জন্য ওর কেবিনে অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। ইতি আমতাআমতা করে বলল, ‘না মানে স্যার, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কাউকে জড়িয়ে ধরব না।’

- ধরবে না। কিন্তু কেন? আমাকে জড়িয়ে ধর। আমার বুক যে তোমার নরম বুকের স্পর্শ পাওয়ার জন্য ছটফট করছে।

ইতি ঘৃণার চোখে তাকালো রোদের দিকে। রোদ আবার বলল, ‘কি হলো? জড়িয়ে ধর আমাকে। কাল তো দেখলাম আশেপাশে মানুষজনকে তোয়াক্কা না করেই পরপুরুষের সাথে জড়াজড়ি করছিলে।’

ইতির কড়া গলায় বলল, ‘ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলুন স্যার। আমি উনাকে ভালোবাসি। তাই জড়িয়ে ধরেছিলাম উনাকে। প্রয়োজনে আবারও ধরব। আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে আপনি কথা বলবেন না।’

- ভালোবাসলেই কি জড়িয়ে ধরতে হবে? তাহলে আমিও তোমাকে জড়িয়ে ধরব। বিকজ আই লাভ ইউ।

ইতি দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল রোদের দিকে। রোদ আবারও বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই মিস ইতি। এই মিস শব্দটা বলতে কেমন যেন লাগছে আমার কাছে। কারণ সেদিনের ওই ঘটনাটা না ঘটলে আজ তুমি মিসেস থাকতে। এই যে আজ আমাকে জড়িয়ে ধরতে এত দ্বিধাবোধ করছ, সেদিন আমাদের বিয়ে হলে আজ এইরকম হতো না। আজ শুধু জড়িয়ে ধরা নয়, আমার বেডরুমে গিয়ে দু’জনে ইনজয় করতাম। তোমার এই পুরো শরীরটা শুধু আমার থাকতো। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য, এইসব কিছুই হলো না।’

ইতির চোখের কোণে ছলছল করছে জল। কিন্তু রোদ সেটা দেখে আরো মজা পাচ্ছে। ওর ঠোঁটের কোণে কুৎসিত একটা হাসি লেগেই আছে। ইতি বলল, ‘আল্লাহর কাছে আমি হাজারবার শুকরিয়া আদায় করি এই ভেবে যে, তিনি আপনার আর আমার বিয়েটা হতে দেয়নি। যেকারণেই হোক বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। নাহলে সারাজীবন আমার ভুগতে হতো। আমার এখন কী করা উচিত জানেন, পুরো অফিসের মানুষদের ডেকে এই সুষ্ঠু আর ভদ্র সমাজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আপনার মতো মানুষ রূপের একটা কুৎসিত পশুটার মুখোশ খুলে দেওয়া।’

রোদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘যাও বলো গিয়ে। কে বিশ্বাস করবে তোমার কথা? তুমি কী জানো এই অফিসে আমি কতদিন ধরে আছি? অফিসের মালিক থেকে শুরু করে সকল স্টাফরা আমাকে কতটা সম্মান করে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? অফিসের মালিক, মিস্টার এন্ড মিসেস চৌধুরী তো রোদ মানেই বিশ্বাসযোগ্য একজনকে বুঝে। কীভাবে ভাবলে তারা আমাকে অবিশ্বাস করে তোমার মতো দু'দিনের একটা কর্মচারীকে বিশ্বাস করবে? শেষে দেখা যাবে তোমার চাকরিটাই যাবে।’

- চাকরির ভয় আমি পাই না মিস্টার রোদ। এমনিতেই এই মাস শেষ হলে আমি চাকরিটা ছেড়ে দিবো। সুতরাং চাকরির ভয় আমাকে দেখাবেন না। আমি জানি যে কেউই আমাকে বিশ্বাস করবে না। আর সেজন্যই আপনার মতো এই নোংরা একজনকে আমি সহ্য করছি। আমার মেধার জন্য মিস্টার এন্ড মিসেস আমাকে স্নেহ করে অনেক। সকল জুনিয়ররা আমাকে সম্মান করে। যার প্রমাণ আমি কালকে প্রথমদিনেই পেয়েছি। অনেকেই আবার আমাকে আপু বলে সম্মোধন করেছে। এদের এই সম্মান আর ভালোবাসা আমি হারাতে চাই না বলেই এখনো চুপ করে আছি। আমার বাবার একটা সম্মান আছে। তিনিও সম্মানীয় ব্যাক্তি। অনেক বিজনেস ম্যানদের মুখে তার নাম-ডাক এখনো আছে। যদিও এখানে বাবার পরিচয় আমি দেইনি। কিন্তু আমি চাই না এইসব জেনে আমার বাবা-মায়ের সম্মানে কলঙ্কের দাগ লাগুক। তাই আমি চুপচাপ আছি। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি স্যার, যা হওয়ার হয়েছে। আমি জানি আমার উপর আপনার একটা ক্ষোভ আছে৷ আপনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এইসব করছেন। কিন্তু প্লিজ স্যার, আপনি সেসব ভুলে যান। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি সেদিনের জন্য। আপনি নতুন করে কাউকে নিয়ে সুখে থাকুন। আর আমাকেও থাকতে দিন।

রোদ আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ইতির দিকে এগিয়ে এলো। ইতির সামনে দাঁড়িয়ে, ইতির দুই কাধের উপর হাত দিয়ে ইতির ঠোঁটের কাছাকাছি নিজের ঠোঁট জোড়া নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘সেটাই তো চাচ্ছি আমি। তুমি বরং আমাকে বিয়ে করে নাও। এরপর আমরা দু'জনে সুখে শান্তিতে সংসার করব।’

কথা বলতে বলতে ইতির ঠোঁট স্পর্শ করতে যাচ্ছিল রোদ। কিন্তু ইতি হঠাৎ মুখটা সরিয়ে নিলো। নিজের সব শক্তি দিয়ে রোদের দুই পায়ের মাঝখান বরাবর সজোরে পা চালিয়ে দিলো। রোদ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে আর্তচিৎকার দিতে গিয়েও নিজের মুখটা চেপে ধরল। এক হাত দিয়ে নিজের নাক-মুখ চেপে ধরে বসে পড়ল। আরেক হাত দিয়ে নিজের মেশিনটা চেপে ধরল। ইতি কিছুটা এগিয়ে নিচু হয়ে রোদের মুখোমুখি হলো। রোদ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইতি হেসে দিয়ে বলল, ‘মিস্টার রোদ, এভাবে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ আগামী দুই থেকে চার মিনিট সময়টা আপনার খুব কষ্টে কাটবে। তবুও পুরোপুরি ঠিক হবেন না। বাকিটা ঘুমানোর সময় টের পাবেন। তা অস্রপাতি ঠিকঠাক আছে, না গেছে?’

রোদ রাগে ফুসতে লাগল ওর কথা শুনে। ইতি আবারও বলল, ‘লাথিটা একটু বেশিই জোরে লেগে গেছে, তাই না? আসলে নিয়মিত প্র‍্যাক্টিস করা হয় না তো, সেজন্য এমনটা হয়েছে। আসলে এই কিকটা ভাইয়ার থেকে শিখেছি আমি। ভাইয়ার মতে, সবারই এই কিকটা শিখে রাখা উচিত। কারণ এই কিকটা মারার দুই-চার মিনিটের মধ্যে কেউ আর ওঠে দাঁড়াতে পারে না। এই যেমন আপনি এখন দাঁড়াতে পারছেন না। আপনি ওঠে দাঁড়ানোর আগে আমি কেবিনের বাইরে চলে যাবো। তবে আমি আবার এখানে ফিরে আসার আগে আপনি এখান থেকে কেটে পড়ুন। কারণ তখন আমি একা আসবো না। সাথে কাউকে না কাউকে নিয়ে আসবো।আর আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না কোনো স্টাফ এসে আপনাকে এই অবস্থায় দেখুক।’

কথাটা বলে ইতি হাসতে হাসতে কেবিন থেকে বেরিয়ে মিস্টার চৌধুরীর কেবিনে এলো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার আসবো।’

ভিতর থেকে মিস্টার চৌধুরী বললেন, ‘হ্যাঁ আসুন।’

ইতি মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে ভিতরে ঢুকে সালাম দিলো। মিস্টার চৌধুরী ইতির দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিলো। এরপর বলল, ‘ইতি যে। তা কেমন আছ?’

- আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন?

- আছি ভালোই। তা এইসময় এখানে।

- আপনি ব্যস্ত মানুষ। অফিসে জয়েন করার পর থেকে আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ পাইনি আর। তাই এখন এলাম।

- তা যা বলেছ। আসলে নতুন একটা প্রজেক্টের কথাবার্তা চলছে। সেজন্যই একটু ব্যস্ত আরকি।

- আপনি তাহলে কাজ করেন। আমি এখন যাই।

- ঠিক আছে। কাজের কোনো সমস্যা হলে রোদকে বলো। তুমি ওর দায়িত্বেই আছ। ও তোমাকে সাহায্য করবে।

ইতি ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে এলো মিস্টার চৌধুরীর কেবিন থেকে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আপনার রোদ নিজেই তো নানন সমস্যার মধ্যে আছে। আমাকে আবার কী হেল্প করবে?’

রোদের কেবিনের সামনে এসে থেমে গেল ইতি। কেবিনের দরজাটা কিছুটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলো। কিন্তু না, রোদ নেই কেবিনে। ইতি ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই বাথরুমে আছে এখন। হয়তো অস্রপাতিতে হাওয়া দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে হারামজাদাকে আরো দু'টো মেরে আসি। অসভ্য লোক একটা। তবে আমি আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ এত সাহস কোত্থেকে এলো আমার। এইরকম কিছু করার কথা তো আমি কল্পনাও করতে পারি না। এত সাহস তো আমার মধ্যে নেই। তাহলে আজ হঠাৎ হলো টা কী?’

ইতি কিছুই বুঝতে না পেরে রোদের কেবিনের দরজাটা লাগিয়ে পিছনে ঘুরল। আর তখনই কারোর সাথে যেন ধাক্কা খেলো। আড়চোখে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করে ফেলল আবার। কারণ রোদ দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। রোদ ওর কথাগুলো শুনে ফেলেছে। এটা ভাবতেই লজ্জায় মরে যাচ্ছে ইতি। রোদকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে রোদ কড়া গলায় বলল, ‘অফিসের একটা প্রজেক্টের কাজে শনিবার চট্রগ্রাম যেতে হবে তোমাকে আর আমাকে।’

ইতি ভ্রু-কুঁচকে তাকালো রোদের দিকে। রোদ আবার বলল, ‘শুধু আমরা নয়, সাথে অফিসের আরো কয়েকজন যাবে। আর অফিসের গাড়ি দিয়েই।’

ইতি চিন্তিত কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু স্যার, আমি তো মাত্র দু'দিন হলো অফিসে জয়েন্ট করলাম। এখনি অফিসের কাজে আমাকে আরেক জায়গায় যেতে হবে মানে?’

- আমি ব্যতীত যারা যাচ্ছে, সবাই দু'দিন ধরেই অফিসে জয়েন্ট করেছে। এই নতুন প্রজেক্টের জন্য স্টাফ নেওয়া হয়েছে কয়েকজন। যাদের হেড হিসেবে তোমাকে রাখা হয়েছে। আর তোমাকে সাজেস্ট করার জন্য আমাকেও যেতে হবে চট্রগ্রাম। কারণ তোমরা সবাই নতুন। সেভাবে কিছু বুঝতে পারবে না। আর মিস্টার চৌধুরী তো যাবেই। বাকি কথা অফিস শেষে মিটিংয়ে সময় মিস্টার চৌধুরী নিজেই বলবেন।

মিস্টার চৌধুরী সাথে যাবে বলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো ইতি। তবে রোদ যাবে বলে আবার টেনশনও হচ্ছে। ইতি কিছু না বলে চলে গেল নিজের কেবিনে। রোদ পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল, ‘আজ যেটা করলে, সেটা একেবারেই ঠিক করোনি ইতি। এর পরিনতি খুবই ভয়ঙ্কর হবে। জাস্ট একটু অপেক্ষা কর।’

বিকেলে ৪.০০ বাজে। সায়েম ব্যাগ গুছিয়ে ডেস্ক থেকে ওঠে দেখল সারা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। হয়তো ওর জন্যই অপেক্ষা করছে। সায়েম ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে সারার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। বিকজ আজকে আমাকে ফেলে চলে যাননি।’

সারা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘আসার সময়ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু আপনার দেখা পাইনি। ভিতরে গিয়ে আর ডাক-ও দেইনি। তাই একাই চলে এসেছিলাম।’

- ডাক দিলেও হয়তো পেতেন না। কারণ আমি একটু আগেই বেরিয়ে এসেছি বাড়ি থেকে। একটা জরুরি কাজ সেড়ে, তবে অফিসে এসেছিলাম।

- ওকে তাহলে চলুন এবার।

- যাবো, তবে এখন কফি হাউজে যাবো। বাড়িতে আরো কিছুক্ষণ পর যাবো।

সারা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

- ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন।

সারা সম্মতি জানালো সায়েমের কথায়। ওরা দু'জন অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলো। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে৷ প্রতিদিন বিকেলে বৃষ্টি হওয়াটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। তাই এটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে ওরা সামনে এগোতে লাগল। সায়েম একটা টং দোকানে যেতে চাইলে সারা বলল, ‘এখানকার কফি তেমন ভালো না। আর এই টং দোকানটা কেমন খোলামেলা।’

সায়েম হেসে দিয়ে বল, ‘আমরা কী ফিজিক্যাল রিলেশন করতে এসেছি, যে চিপা চাপা কিংবা চার দেয়ালের মাঝের কোনো জায়গায় যাবো।’

সারা নাক-মুখ কুঁচকে বলল, ‘ছি:, আপনি দিনদিন অশ্লীল হয়ে যাচ্ছেন। আমি কী বলেছি, যে আমরা শারীরিক সম্পর্ক করতে এসেছি? আসলে বৃষ্টি হচ্ছে বলেই তো বললাম কোনো রেস্টুরেন্ট, বা কফি হাউজে চলুন৷ যাতে ভিজতে না হয়। আর বিলটা নাহয় আমিই দিবো।’

- আরে বাবা, বৃষ্টিতে ভিজে কফি খাওয়ার যে মজা, আপনি জাস্ট ভাবতে পারবেন না। চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন, আপনি আর আমি একটা টেবিলের দু'টো চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছি। মাথার উপর খোলা আকাশ ছাড়া কিছুই নেই। দু'জনের হাতেই কফির কাপ। কাপ থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে। আর খোলা আকাশ থেকে টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে কফির মগে। গরম আর ঠাণ্ডার মিশ্রনে দারুণ এক স্বাদ তৈরি হবে কফির। আমাদের এক হাতে থাকবে কফির কাপ, আর অন্যহাত দিয়ে একে অপরের হাত ধরে রাখবো শক্ত করে।

সারা হেসে দিয়ে বলল, ‘এতকিছু কীভাবে ভাবেব আপনি? কীভাবে পারেন সাধারণ জিনিসটাকে অসাধারণ করে তুলতে?’

- পাশে এইরকম একটা সুন্দরী গালফ্রেন্ড থাকলে বস্তিকেও রাজপ্রাসাদ মনে হয়। ওই যে আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিল যখন কোনো লোক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটায়, তখন মনে হয় যেন এক মিনিট গেল। কিন্তু সেই লোকটিকেই এক মিনিটের জন্যে গরম চুল্লির উপর বসিয়ে দিলে তার কাছে মনে হবে একঘণ্টারও বেশি সময় গেল। এটিই আপেক্ষিক তত্ত্ব।

সারা শব্দ করে হেসে দিয়ে হাঁটতে লাগল। টং দোকানে গিয়ে দোকানদারকে বলল দু'কাপ কফি দিতে। বৃষ্টি তখনও গুড়গুড়ি পড়ছিল। সায়েম আর সারা বসে পড়ল দু'টো চেয়ারে। মাথার উপর খোলা আকাশ। চারিদিকে আরো কয়েকটা টেবিল আছে, তবে ফাঁকা। সেটাই স্বাভাবিক অবশ্য। সবাই তো আর সায়েমের মতো না। কিছুক্ষণ পর দোকানদার কফি দিতে দিতে বলল, ‘ভিজে ভিজে কফি কীভাবে খাইবেন স্যার? সাথে কী ছাতা নাই?’

- না নেই। আর আমাদের ভিজে ভিজে খেতে কোনো সমস্যা হবে না।

দোকানদার চলে গেল। দুই মিনিট পর ছাতা হাতে আরেকটা লোক এলো। দোকানদারের কাছ থেকে লোকটা এক কাপ কফি নিয়ে সায়েমদের ঠিক পাশের টেবিলে বসল। ছাতা দিয়ে মুখটা আড়াল করে রেখেছে লোকটা। সায়েম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। কিন্তু দৃষ্টি পাশের টেবিলের লোকটার দিকেই আছে। সারা সব দেখছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। লোকটাই বা ওদের মতো পাগলামি করে বৃষ্টির মধ্যে এইরকম একটা জায়গায় কফি খেতে এলো কেন? সায়েম আবার মাঝে মাঝে মৃদু হাসি দিচ্ছে লোকটার দিকে তাকিয়ে। সারা কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিলে সায়েম হাত দিয়ের সারার মুখ আটকে ধরে বলল, ‘কফি খুব মনোযোগ দিয়ে খেতে হয়। কফির খাওয়ার সময় কথা বলে তো বোকারা। আপনি আর আমি নিশ্চয়ই বোকা নই।’

সায়েমের এই কথাটার কোনো অর্থ খুঁজে পেলো না সারা। মানুষ কিছুটা সময় কাটানোর জন্য এভাবে চা বা কফি হাউজে বসে। আর এই চা বা কফি খাওয়ার সময় তো কথা বলা বাধ্যতামূলক। অথচ ও উল্টো কথা বলছে। তবে কী এর পিছনে কোনো কারণ আছে?

(চলবে...)

আরো পড়ুন ২১তম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড