• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোট গল্প : পুনর্জাগরণ

  রকিব হোসাইন খান

২১ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৩৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

আমরা তখন ফিরতি বাস ধরার তাড়া অনুভব করছিলাম। আমার সাথে ছিল সানেম। ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে যাবে। তাকে এগিয়ে দিতে হবে। খালাম্মা বললেন, ‘আবার এসো বাবা।’

নিশ্চয় আসবো।আসা উচিত বলে বিনয়ের হাসি দিয়ে বিদায় নিলাম। তার আগে খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে। কুয়াশাচ্ছন্ন এক ঘোলাটে আবহাওয়া। শীত তার আগমন বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে। গায়ে একটা পাতলা জামা। দাঁত কিড়মিড় করছে ঠাণ্ডায়। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরছে শিশিরের ফুল। টিনের চালে কবুতর ছানারা কাঁপছে। বাড়ির সাথে লাগোয়া রাইস মিল। বর্গাকার প্লেয়িং ফ্লোর। নারী শ্রমিকেরা সেদ্ধ ধান ফ্লোরে বিছিয়ে দিচ্ছে। এইগুলি দেখতে ভালো। কিন্তু আমার আগ্রহের জায়গা অন্য কিছু। আমি হয়তো কাউকে খুঁজছিলাম। খোঁজার কারণ হয়তো বছর তিনেক আগের একটি রাতের স্মৃতি। সেদিন রুমেল ভাই রাতে হসপিটাল থেকে ফোন করে ধরা গলায় বলেছিলেন, ‘তোমার ভাবির অবস্থা খুব সিরিয়াস। ডাক্তার অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিয়েছেন। বোধহয় বাঁচানো গেল না’

‘আমাকে আসতে হবে?’ আমি বললাম। রুমেল ভাই আদ্র কণ্ঠে বললেন, ‘আসতে হবে কি, চলে এসো। এমন কেউ নেই এখানে যার উপর ভরসা করা যায়।’ নিজের কথাকেই নিজের কাছে রসিকতা বলে মনে হলো। ছি ছি মৃত্যুর সন্নিকটে থাকা পেশেন্টের স্বামীর কাছে ‘আসতে হবে’ জানতে চাওয়া অন্যায়। রাত তখন তিনটা বাজে। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে ফ্রেস হয়ে নিলাম। বাসা থেকে বের হবার পর আবার ফোন। ‘আসছি’ বলে রেখে দিলাম। গলির মোড়ে একটাও রিকশা নেই।কি একটা বাজে অবস্থা।হেটেই রওয়ানা দিলাম। ২৬ মিনিট পর হসপিটালে পৌঁছাতে পারি এবং দেখি বারান্দায় বিছানা পাতা। রুমেল ভাই ভাবির সিথানে বসে গম্ভীর হয়ে আছেন। খালা খালু খুবই অস্থির। আমাকে দেখে তারা ভরসা পেলেন। যদি কিছু একটা করতে পারি! কিন্তু তাদেরকে একথা বুঝানোর সাধ্যি আমার ছিল না। মানুষের মৃত্যুর অবধারিত সময়ে হয়তো আজরাইল নিজেও বলবে, ‘আই অ্যাম স্যরি’

ডক্টরস রুমে ছুটে গেলাম। সেখানে দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বসে আছেন। মেডিক্যাল হোস্টেলে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে তাদের সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল। তারা বললেন, ‘আমরা আমাদের সাধ্য মত চেষ্টা করেছি। আপনারা বড্ড দেড়ি করে ফেলেছেন।’

আমার চোখে ভেসে উঠছিলো রুমেল ভাইয়ের বিমর্ষ মুখ। খালা-খালুর অস্থিরতা। হ্যাঁ, দেরি হয়ে গেছে। ডাক্তারের কমন কথা শুনার মত দেরি।

গতকাল এখানে এসেই খালাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বাচ্চাদের কি খবর?’ খালা এক ফোটা হাসেন ।বড় দুঃখের সেই হাসি। জগতে মানুষের হাসিতেই কেবল তার অন্তরাত্মার গোপনীয় অনুভূতি নিখুঁতভাবে ফুটে উঠে। আমি খালার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। তিনি বললেন, ‘শাওন এখন স্কুলে যায়। আর সাদাফ চারে পা দিয়েছে’।

আমি অবাক হলাম কিছুটা। এই তো সেদিনের কথা! অথচ চার বছর হয়ে গেছে আমি টেরও পাইনি। সময় কেন যে প্রতারণা করে। কেন যে সে স্রোতের মত কলকল করে বয়ে যায় বুঝা মুশকিল। আমি বললাম, ‘ওরা তো আপনার হাতেই মানুষ হচ্ছে, না?’ - শাওনকে আমার কাছেই রাখি। আর সাদাফ থাকে ওর মায়ের সাথে।

মা! চমকে উঠলাম আমি। ওদের মা’কি ফিরে আসলো নাকি? আশ্চর্য, মৃত মানুষ ফিরে আসে কোথা থেকে! সকালে যখন শীতের আমেজ অনুভব করছিলাম তখন রুমেল ভাইকে দেখি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁত ঘষছিলেন। আর শাওন-সাদাফ রুমেল ভাইকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরছে। দুজনের মাথায় কান টুপি। শাওনের হাতে কাগজে মোড়ানো তৈলাক্ত পরোটা। সাদাফ তাড়া করছে তাকে। ধরতে পারছে না। যেন একটি কবুতরের জোড়া একে অন্যের সাথে খেলা করে যাচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্যে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, শাওনকে ধরতে না পেরে সাদাফ মাটিতে ঘরাঘরি খায়। শাওন তখন পরোটার একটি টুকরো সাদাফের মুখে ঠেলে দিলে ফিক করে হেসে দেয়। আবার উঠে বসে। দৌড়া খেলায় মাতায়। আমি ভাবি, কত ঝরঝরে হয়ে গেল ওরা।

সেদিন রাতের শেষের দিকে যখন হসপিটালের গেট থেকে সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে সানিমা ভাবির নিথর দেহ বহন করে বাড়ির পথে রওয়ানা হই শাওনের তখন দু’বছর বয়স। সাদাফের একচল্লিশ দিন। শোকাতুর পরিবার মৃত ব্যক্তির প্রতি মায়া বোধ করছিল ঠিকই। কিন্তু তারা আরও বেশি ব্যাকুল হয়ে ছিল দুটি ফুটফুটে শিশুর অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।

শবদেহ নিয়ে যাত্রা খুবই ভয়ঙ্কর এবং হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতায় ভরপুর যাত্রা। যারা অ্যাম্বুলেন্সে বসে ছিল তারা স্থির থাকতে পারছিলো না। তারা অবিরত বিলাপ করছিলো। মৃতরা তাদের মৃত্যুর পর ইহজাগতিক ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করকে পারে কিনা জানা নেই। যদি পায়, তবে সানিমা ভাবির এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারার কথা, তার শিয়রে বসে যারা কাঁদছে তারা তার জন্য কাঁদছে না। কাঁদছে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের দুর্গতির কথা চিন্তা করে।এটি যেন আশ্চর্য জগতের আরও আশ্চর্য এক সিনেমা। যেখানে কখনো কখনো কেন্দ্রীয় চরিত্রকেও কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ বলে মনে হয়।

সকালে যখন আমাদের টেবিলে খাবার নিয়ে আসেন রুমেল ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী তখন তার সাথে প্রথম দেখা হয়। সেলোয়ার-কামিজ পরনে। ওড়না প্যাঁচিয়ে মাথায় ঘুমটা দিয়ে ছিলেন বলে মুখাবয়ব পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিলো না। অনুমান করে নিলাম তিনি সুন্দরী ভদ্রমহিলাই হবেন। আমাদের যত্ন নিয়ে খাওয়ালেন। বেশ মিষ্টি কণ্ঠস্বর। পরিচয় দেওয়ার আগেই তিনি আমাকে চিনে ফেললেন। পরে খালাম্মার কাছে জানলাম, নতুন বউয়ের বয়স বছর খানেক। গত শীতে রুমেল ভাই দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। এবছর শীত অতি সন্নিকটে। খালাম্মা বললেন, সানিমা ভাবির মৃত্যুর পর প্রথম দুই বছর রুমেল ভাইকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েও লাভ হয়নি। তিনি বিয়ে করবেন না বলে স্থির করেছেন। তার পরের বছর একটু নমনীয় হয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন মা ছাড়া এই অবুঝ শিশু দুটিকে বড় হতে দেওয়া যাবে না। তাদের সুরক্ষার জন্য একজন মায়ের প্রয়োজন। সৎ মা হলেও।

আমরা যখন চলে আসবো তখন খেয়াল হলো, শেষবার চার বছর আগে এসেছিলাম। চার বছরে কতকিছু পরিবর্তন হয়েছে। সানিমা ভাবির শোক ভুলা গেছে, রুমেল ভাই পুনরায় সংসারী হয়েছেন। শাওন-সাদাফ ঝরঝরে হয়েছে। খালাম্মার কাঁধ হতে বোঝা কমেছে। খালু নিশ্চিন্ত, নির্ভার হয়েছেন। আর সবকিছু একত্রে কেমন স্বচ্ছ, সতেজ, প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড